#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩২|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
বৈঠকখানায় আলোচনা চলছে। মোর্শেদ শিকদার‚ মেহরাব শিকদার আর অর্পণ বসে রয়েছে৷ ডাইনিং টেবিলে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে৷ ভূমি প্রলয় কেউ-ই এখানে উপস্থিত নেই। পুষ্পিতা টিভি দেখছে৷ ওর টিভি দেখা নিয়ে রেগে আছেন মাধুরী। সামনে পরীক্ষা আর মেয়েটা মনের আনন্দে টিভি দেখছে। পূর্ণতা তার ঘর থেকে সবেই বের হয়েছে৷ মাধুরী ডাইনিং স্পেস থেকে চেঁচিয়ে বললেন‚
“বড়োটা পড়াশোনায় কত মনোযোগী আর ছোটোটাকে দেখ! পড়াচোর একটা। পূর্ণ যা তো মা— এই কুম্ভকর্ণের কান টেনে আমার কাছে নিয়ে আয়।”
ফিরোজা হেসে উঠলেন৷ পূর্ণতা বৈঠকখানার দিকে গেল৷ পুষ্পিতা তার বাবার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল‚
“দেখলে বাবা? মা আমাকে সহ্যই করতে পারে না। একটু টিভি দেখছি সেটাও দিচ্ছে না।”
মোর্শেদ শিকদার মেয়েকে প্রশ্রয় দিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশে বললেন‚ “কেন মেয়েটার সঙ্গে এমন করছ মাধুরী?”
“তোমার মেয়ে সবই করতে পারে‚ শুধু পড়াশোনা করতে গেলেই নাকি তার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়৷”
“কথাটা কী সত্যি পুষ্প?”
ধরা খেয়ে পুষ্পিতা বোকা হাসল৷ কথাবার্তার একপর্যায়ে মেহরাব শিকদারের দিকে তাকিয়ে মোর্শেদ শিকদার শুধালেন‚
“আজ সকালে তাড়াহুড়ো করে বের হলি। কোনো সমস্যা ছিল নাকি?”
“না ভাই কোনো সমস্যা না। হসপিটাল থেকে ক্যাম্প করা হবে।”
“সে তো বেশ ভালো খবর।”
“আমাদের হসপিটালের সিনিয়র ডক্টর যারা রয়েছেন সবাইকে একেক জায়গায় ক্যাম্পের জন্য যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শুধু আমাদের হসপিটাল না অন্য হসপিটাল থেকেও একই নির্দেশনা দিয়েছে মেডিকেল বোর্ড৷ সাতটা গ্রাম সিলেক্ট হয়েছে।”
অর্পণ তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল‚ “তোমাকেও যেতে হবে বাবা?”
“হ্যাঁ! আমাদের হসপিটাল থেকে চারজন যাবেন। অনিন্দ্যনগর যাচ্ছি আমরা৷ ওখানে নাকি নতুন হসপিটাল তৈরি হয়েছে৷ সামনের সপ্তাহ থেকে নাকি চালু হবে৷”
অবাক হয়ে অর্পণ বলল‚ “ভূমি তো অনিন্দ্যনগরেরই মেয়ে৷ তোমরা চাইলে আরশদের বাড়িতেই উঠতে পারো৷ এই ক্যাম্পের কথা ভাই মেডিকেল বোর্ডে জানিয়েছিল।”
একটু থেমে অর্পণ আবার বলল‚ “শাহাদাৎ আঙ্কেল বড্ড ভালো মানুষ৷ গ্রামের মানুষের কথা চিন্তা করে স্কুল আর একটা হসপিটাল করেছেন৷ গ্রামের মানুষ উনাকে খুব মানেন৷ উনিই ওখানকার গ্রামপ্রধান।”
ঘরে…
বিছানার উপর প্রলয়ের ঘামে ভেজা পাঞ্জাবি পড়ে রয়েছে৷ বিছানাটাও এলোমেলো৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল দেখছে ভূমি। প্রলয় বেলীফুলের গাজরা লাগিয়ে দিয়েছিল তখন। সুন্দর মিষ্টি সুরভি ছড়াচ্ছে। বাঁ হাতে জড়িয়ে দেওয়া মালা শুকল৷ রজনীগন্ধার তীব্র সুবাসে শরীর রিনরিন করে উঠল৷ আয়নায় নিজেকেও একবার পরখ করল৷ ফর্সা গালে রক্তিম আভা। এ কী— ভূমি লজ্জা পাচ্ছে!
অগোছালো বিছানা চট করে গুছিয়ে রাখল ভূমি। প্রলয় ওয়াশরুমে গিয়েছে৷ লোকটা ভীষণই অগোছালো। তা না হলে কেউ এভাবেই জামাকাপড় বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে? গুছিয়েও তো রাখা যায়! তা করবে কেন? ভূমি বিছানার উপর থেকে পাঞ্জাবি তুলে নিয়ে বিনে রাখল। কাল ধুয়ে দেবে৷ আধোয়া কাপড় এখানে জমা করে রাখে। প্রলয় আসার আগেই বিছানা ঝাঁট দিল৷ ড্রেসিং টেবিলের সামনের সবকিছুই অগোছালো। এরই মাঝে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো প্রলয়৷ ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দেখে পছন্দ হলো না যেন! এসেই ভেজা তোয়ালে সেই বিছানার উপরই ফেলে রাখল। এবার ভূমি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল‚
“আপনি ভীষণই অগোছালো!”
“গুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তোমার— ভূমি কন্যা।”
আর কিছু বলতে পারল না ভূমি। সময় মতো কীভাবে মুখ বন্ধ করিয়ে দিতে হয় তা লোকটা বেশ ভালোই জানে৷ বিছানার উপর থেকে ভেজা তোয়ালে খানা তুলে বলল‚
“অসময়ে গোসল করেন কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো!”
“সমস্যা নেই কিছুদিন পর তোমাকেও এই অভ্যেস ধরিয়ে দেব৷”
প্রলয়ের কথা বোধগম্য না হলেও ভূমি বুঝল এই লোকের সঙ্গে কথা বলে কোনো ফায়দা নেই। এর থেকে ভালো নিঃশব্দে সে নিজেই সব গুছিয়ে রাখুক৷ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রজনীগন্ধার মালাটা খুলতে শুরু করল ভূমি। প্রলয় দ্রুত পায়ে ভূমির হাতটা ধরে শুধাল‚
“ফুলের মালাটা খুলছ কেন?”
“চাচি মা ডাকছেন— খাবার খেতে যেতে হবে তো!”
“খাওয়ার সঙ্গে ফুলের সম্পর্ক কী?”
“উনারা কী মনে করবেন!”
“কিছুই মনে করবে না৷ তুমি চল তো আমার সঙ্গে।”
❑
রান্নাঘরের কাজ শেষ করে ঘরে যাবে তখনই পূর্ণতা এসে ডেকে নিয়ে গিয়েছে ভূমিকে৷ কী যেন কথা বলবে৷ সব পরিকল্পনা তো আর একা করা যায় না৷ এক্ষেত্রে ভূমিকেও জড়াবে৷ ভূমির সমীপে বসে বলল‚
“তোমাকে কানাকানি একটা কথা বলি?”
ভূমি বিছানার উপর ভালো করে বসল বলল‚ “কী কথা গো রায়বাঘিনী ননদিনী?”
পূর্ণতা ফিসফিসিয়ে বলল‚ “আগামী ১৪ই ফেব্রুয়ারি বড়ো ভাইয়ার জন্মদিন।”
প্রলয়ের জন্মদিনের কথা শুনেই ভূমি ভাবতে শুরু করল‚ ‘হাতে আর মাত্র আটদিন! লোকটা তার জন্য অনেক করেছে। তারও তো কিছু করা উচিত কিন্তু কী করবে?’ ভূমিলে চুপ থাকতে দেখে পূর্ণতা আবারও বলল‚
“আমাদের বড়ো ভাইয়া ভীষণই স্পেশাল৷ তাই তো ভালোবাসার দিনে তার জন্ম।”
“ভালোবাসার দিন?”
পুষ্পিতা বলল‚ “এ বাবা তুমি জানো না? ১৪ই ফেব্রুয়ারি তো ভালোবাসা দিবস। ভ্যালেন্টাইন্স ডে।”
“আমার জানা ছিল না।”
রাত সাড়ে এগারোটা…
নিস্তব্ধ ঘর৷ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসেছে প্রলয়৷ বসে বসে অপেক্ষা করছে কখন ভূমি ঘরে আসবে৷ মেয়েটা রান্নাঘরের কাজ গুলো করছে। সকলে হয়তো এতক্ষণে নিজেদের ঘরে চলে গিয়েছে৷ ঘরে আসার আগে প্রলয় দেখে এসেছিল— ভূমি এঁটো বাসনগুলো ধুয়ে রাখছে। এ কাজটা তো সাবিনাও করতে পারত৷ কেন যে আগ বাড়িয়ে নিজের ঘাড়ে কাজ তুলে নিচ্ছে কে জানে? খুব শীগ্রই আরেকটা পরিচারিকা নিতে হবে৷ তাহলে অন্তত বউকে কাছে পাওয়া যাবে।
“এই মেয়ের এদিক সেদিক ছোটাছুটি বন্ধ হবার নয়।”
বিছানা ছেড়ে ঘর থেকে বের হলো। পূর্ণতা পুষ্পিতা ঘর থেকে কথাবার্তা আওয়াজ ভেসে আসছে৷ নিশ্চয়ই ভূমি সেখানে রয়েছে।
“আমরা কিন্তু খুব আনন্দ করব সেদিন। এবারের জন্মদিন একটু বেশিই স্পেশাল বড়ো ভাইয়ার জন্য।”
পুষ্পিতার কথার মাঝেই দরজার কাছ থেকে প্রলয়ের গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে এলো‚ ‘ভূমি ঘরে এসো।’ রাশভারি সেই কণ্ঠস্বরে আচমকা পিলে চমকে উঠল ভূমির৷ তার পাশ থেকে সরে বসল পূর্ণতা পুষ্পিতা। মেকি হেসে পুষ্পিতা বলল‚
“বড়ো ভাইয়া ডাকছে‚ তুমি ঘরে যাও ভাবিমণি৷”
ভূমি কিছু বলল না৷ বিছানা থেকে নেমে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ সোজা চলে এলো নিজেদের ঘরে৷ ঘরে এসে প্রলয়কে কোথাও পেল না৷ এই তো লোকটা তাকে ডেকে এলো। এরই মাঝে আবার কোথায় চলে গেল? ওয়াশরুমের দরজাও তো বন্ধ।
বারান্দা ধোঁয়াময় হয়ে গিয়েছে৷ কারো পদচারণ অনুভূত হতেই জ্বলন্ত সিগারেট বাহিরে ছুড়ে ফেলল প্রলয়। হাত দ্বারা ধোঁয়া বিলীন করার চেষ্টা করল৷ ভূমি এসে পাশে দাঁড়িয়েছে ইতিমধ্যেই। সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে না পেরে কিছুটা কেশেও উঠল৷ বারান্দায় একমুহূর্তে দাঁড়াতে দিল না প্রলয়৷ ভূমির হাত ধরে ঘরে নিয়ে এলো৷ আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল ভূমিকে৷ গ্রীবাদেশে সিক্ত কোমল স্পর্শে শিরশির করে উঠল সর্বাঙ্গ। আবেশে দুচোখ মুদে এলো ভূমির৷ কানের কাছে ফিসফিসিয়ে প্রলয় বলল‚
“কোথায় রাত হয়েছে বরকে একটু সময় দেবে তা না— বসে বসে আড্ডা দিচ্ছ!”
“একটু বসে ছিলাম।”
“বসে তো তুমি আমার সামনেও থাকতে পারতে। যাই হোক— এর শাস্তি তো তোমাকে পেতে হবে।”
ভূমি চোখ মেলে তাকাল৷ মুখ তুলে প্রলয়কে দেখে বলল‚ “শা…শাস্তি?”
“হ্যাঁ শাস্তি৷ সারারাত আমার মাথা টিপে দেবে৷”
ভূমির আড়ালেই ঠোঁট চেপে হাসল প্রলয়৷ শাস্তি দেবার কথাটা নিছকই মজা করে বলেছে৷ তবে ভূমিকে দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা সত্যি সত্যিই ভেবে নিয়েছে৷ যাক ভালোই হয়েছে। মেয়েটাকে আরেকটু জ্বালাতন করার সুযোগ পেল। সরে দাঁড়িয়ে‚ ভূমি নিয়ে গিয়ে বসাল বিছানায়। দরজা আটকে‚ ঘুম বাতি জ্বালিয়ে দিল প্রলয়। এরপর নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ল৷ ভূমি আধশোয়া হয়ে বসেছে৷ কোমল হাত জোড়া নিজের চুলের উপর রেখে প্রলয় চোখ বন্ধ করে ভূমিকে বলল‚
“মাথাটা টিপে দাও৷”
প্রলয়ের কথানুযায়ী মাথা টিপে দিতে শুরু করল। কিন্তু কাজটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না৷ ভূমিকে টেনে নিজের পাশে শুইয়ে দিল প্রলয়৷ আচমকা এমন হওয়ায় কিছুটা ভয় পেয়ে গেল ভূমি৷ পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল। বক্ষঃস্থল চেপে রেখেছে ভূমিকে।
চলবে?…..