#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩৮|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
বেশ অনেকগুলো গাড়ির লম্বা লাইন জমেছে। রাস্তার অপর প্রান্তের গাড়িগুলো সাঁই বেগে ছুটে যাচ্ছে। যেই জ্যামের ভয়ে তাড়াতাড়ি করে বাড়ি থেকে বের হলো। সেই জ্যামের মধ্যেই পড়তে হলো দুজনকে। প্রলয়ের রাগ লাগছে ভীষণ। তবে তা প্রকাশ করছে না পাছেই না মেয়েটা অভিমান করে বসে। এখনো চুপটি করে পাশের সিটে বসে রয়েছে। মাথা হেলান দিয়ে রেখেছে। ভূমির কী অস্বস্তি হচ্ছে? নেকাব পড়ে রয়েছে বিধায় বুঝতে পারছে না প্রলয়। তবুও ভাবনাটা মাথায় আসতেই জিজ্ঞেস করল‚
“গাড়িতে অস্বস্তি হচ্ছে তোমার? এসি চালিয়ে দেব?”
কোনো রকম ভণিতা না করেই ভূমিস বলে ফেলল‚ “জানালাটা খোলা যাবে?”
প্রলয় প্রত্যুত্তর করল না। গাড়ির জানালা খুলে দিল। সাঁই বেগে বাতাস গাড়িতে প্রবেশ করছে। এখন কিছুটা ভালো লাগতে শুরু করেছে। এতক্ষন গুমোট অনুভূত হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন দম আটকে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে হাত মোজা খুলে ফেলল। নেকাবও তুলে ফেলল। প্রলয় তা দেখে বলল‚
“জানালাটা বন্ধ করে‚ এসি চালিয়ে দিই?”
ভূমি মুখ তুলে তাকাল প্রলয়ের দিকে। ঘন আঁখিপল্লব জাপটে সায় জানাল। ভূমির চোখের ভাষা বুঝতে পেরে প্রলয় সেটাই করল। জ্যাম ছুটতে শুরু করেছে। প্রলয় গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিল। সফট মিউজিক বাজছে। মাঝে মাঝে গুনগুনও করছে প্রলয়। গাড়িতে চড়ার অভ্যেস নেই ভূমির। কেমন গান গুলাচ্ছে! সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।
বেশ অনেকটা সময় পর একটা শপিং মলের সামনে এসে গাড়ি থামল। চোখের চশমা ঠিক করে‚ সঙ্গে সঙ্গে মাস্ক পড়ে নিল। যাতে তাকে কেউ চিনতে না পারে। শপিং মলের বাহিরে লোকসমাগম ভীষণ। ভিড় অতিক্রম করে ভূমিকে নিয়ে শপিং মলের ভিতরে প্রবেশ করল প্রলয়। শাড়ি লেহেঙ্গার দোকান তৃতীয় তলায়।
এস্কেলেটরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল ভূমি। সে এসে দাঁড়িয়েছে একদম প্রলয়ের পেছনে। পাশেই ভূমিকে দেখতে না পেয়ে‚ পিছন ফিরে তাকাল প্রলয়। এভাবে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল‚
“দাঁড়িয়ে পড়লে যে‚ কোনো সমস্যা?”
“চলন্ত সিঁড়িতে আমি কখনো উঠেনি। অস্বস্তি হচ্ছে— ভয় করছে।”
ভূমির সহজ স্বীকারোক্তি। প্রলয় তার হাতখানা শক্ত করে ধরল। ভয়ে মেয়েটার হাত কাঁপছে। খুব করে অনুভব করল প্রলয়। দুজনে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে গেল। প্রলয়ের সংস্পর্শে এসে ভূমির সকল ভয় কে’টে গেল। শাড়ি‚ লেহেঙ্গার দোকানে ঢুকে মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেলল প্রলয়। তাকে দেখেই দোকানের লোকটা সালাম জানালো। তবে প্রলয়ের সঙ্গে বোরকা পরিহিত রমণীকে কেউই চিনতে পারল না। অবাক হয়েই তাকিয়ে রইল সবাই। সকলের এভাবে তাকিয়ে থাকায় খুবই অস্বস্তি হতে শুরু করল ভূমির। প্রলয় এখনো তার হাতটা ধরে রেখেছে। দোকানি নিজে থেকেই শুধালেন‚
“স্যার চা নাস্তা কিছু নেবেন? অ্যাই স্যারের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা কর।”
“আপনি ব্যস্ত হবেন না প্লিজ। ম্যাডামের জন্য লেহেঙ্গা‚ শাড়ি‚ আর টপস দেখান। একটু তাড়াতাড়ি করলেই ভালো হয়। আমার একটু তাড়া আছে।”
দোকানি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন‚ “আচ্ছা স্যার।”
দোকানি কর্মচারী আরেকজনকে নির্দেশ দিলেন প্রলয়ের কথা মতো সবকিছু সামনে নিয়ে আসতে। দেখে দেখে মেরুন রঙা লেহেঙ্গা খুবই পছন্দ হলো প্রলয়ের। নিশ্চয়ই তার প্রেয়সীকে এই লেহেঙ্গাতে ভারী সুশ্রী দেখাবে! লেহেঙ্গাটা সাইড করে রাখল। গুনে গুনে বেশ কয়েকটা শাড়ি নিল। প্রলয়ের পছন্দ আছে বলতে হবে। ভূমিরও খুব পছন্দ হয়েছে। বেশ কয়েকটা টপস আর থ্রিপিসও কিনে দিল। বিয়ের পর এই প্রথম প্রলয় ভূমির জন্য নিজে পছন্দ করে কিছু কিনছে। বেশ উচ্ছ্বসিত সে। মেয়েলি শপিং করার মাঝেও উত্তেজনা কাজ করছে তার। ভূমিকে জিজ্ঞেস করল‚
“তোমার পছন্দ হয়েছে তো? পছন্দ না হলে আমরা চেঞ্জ করে নিতে পারি।”
ভূমি দ্রুত ঘাড় দুপাশে ঝাকালো যার অর্থ তার এগুলোই পছন্দ হয়েছে। ভূমি চঞ্চল স্বীকারোক্তিতে ক্ষীণ হাসল প্রলয়। এরপর সবগুলো জিনিস দোকানদারকে প্যাক করে দিতে বলল। এরপর নিজের জন্য শার্ট‚ পাঞ্জাবি আর রিসেপশনের শেরওয়ানি কেনার জন্য অন্য দোকানে গেল। আগের ভঙ্গিতেই ভূমির হাত শক্ত করে ধরে রাখল। মেকআপের আড়ালেও মুচকি হাসছে ভূমি। জীবনকে নিয়ে ভীষণ তৃপ্তি হচ্ছে তার। আল্লাহ তাআলা তাকে একজন যোগ্য জীবনসঙ্গী বেছে দিয়েছেন। মনে মনে শুকরিয়া আদায় করল আল্লাহর নিকট।
বিছানায় ঘাপটি মে’রে বসে রয়েছেন মাধুরী। কিছুক্ষণ আগেই মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। মায়ের সঙ্গেই মূলত কথা বলে মুখটা গভীর করে রেখেছেন। রিসেপশনে উনার মা আসতে পারবেন না সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিয়েছেন। প্রলয়ের এমন হুট করে বিয়ে করাটাকে কিছুতেই সমর্থন করছেন না তিনি। বড়ো নাতির বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল উনার। ভেবেছিলেন কনিষ্ঠ নাতনি অর্থাৎ ভাসুরের ছেলের ঘরে নাতনি তৃপ্তির জন্য বিয়ের প্রস্তাব রাখবেন। কিন্তু তার আগেই যা হওয়ার হয়ে গেল।
চিন্তায় মগ্ন মাধুরী। তারউপর গহনা গুলো নাকি ঠিক করতে কিছুদিন সময় লাগতে পারে৷ চেনাজানা জুয়েলার্সের দোকানে দেওয়া সত্ত্বেও দেরি হচ্ছে৷ এখনো অনেককেই নিমন্ত্রণ করা বাকি। অনেক কেনাকাটা বাকি৷ এরমধ্যে মায়ের কাছ থেকে এমন একটা কথা শুনে শান্তি লাগছে না উনার৷ তিনিও তো প্রলয়ের বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিলেন তা কী আর পূরণ হলো? মানুষ সবসময় যা চাই তাই-ই কী পায়? এই চাওয়া পাওয়া নিয়েই তো জীবন! তারপরও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সবটা মেনে নিচ্ছেন তিনি৷
এরই মাঝে ফিরোজা এলেন৷ সাবিনাকে দিয়ে ডাক পাঠিয়েছিলেন মাধুরী। গোসল করছিলেন বিধায় তখন আসতে পারেননি ফিরোজা। ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে শুধালেন‚
“ভাবি আমাকে ডাকছিলে?”
“হ্যাঁ!” এরপর সবকিছু খুলে বললেন মাধুরী। ফিরোজা অত্যন্ত শান্ত স্বরে বললেন‚
“এত তাড়াহুড়োর কিছু হয়নি ভাবি। হাতে এখনো আট দিন রয়েছে। নিশ্চয়ই ততদিনে মাওই মাকে আমরা রাজি করাতে পারব।”
বিছানায় বসে থেকেই মাধুরী বললেন‚ “ভূমির মায়ের সঙ্গেও তো কথা বলতে হবে।”
“তা তো বলতেই হবে। আরশ এর পরিবারকেও তো নিমন্ত্রণ করতে হবে। শুনেছি আরশের ছোটো বোন ইরা নাকি ঢাকাতেই কোনো হোস্টেলে থাকছে। আমি ভাবছি মেয়েটা যদি আমাদের বাড়িতে আসত।”
“হঠাৎ আরশের বোন আমাদের বাড়িতে আসতে যাবে কেন?”
“ভাবি তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।”
“হ্যাঁ বল না— এত জিজ্ঞেস করার কী আছে! যখন যা মন চায় মুখ ফুটে বলে দিবি।”
“আরশের বোন ইরাকে আমাদের অর্পণ পছন্দ করে। অর্পণকে কাল বলেছিলাম মেয়েটাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে।”
“তাহলে কালই আসতে বল।”
“আচ্ছা ভাবি।”
❑
নিজের কেবিনে বসে রয়েছে অর্পণ। সবে লাঞ্চ করেছে৷ এখনো ব্রেক টাইম রয়েছেই। ফোনে একটা জামদানী শাড়ির দিকে চোখ আটকে গেল৷ শাড়িটা ভীষণই সুন্দর। লাল পাড়ের কালো শাড়ি। চট করে শাড়িটা অর্ডার দিয়ে দিল অর্পণ৷ এরই মাঝে ওয়ার্ডবয় এসে বলল‚
“স্যার আপনার নামে একটা পার্সেল এসেছে।”
“কোথায়? নিয়ে এসো।”
ওয়ার্ডবয় ছুটে গেল। কিছুক্ষণ পর আবারও পার্সেলটা সঙ্গে করে নিয়ে এসে অর্পণকে দিল৷ এরপর ওয়ার্ডবয় নিজের কাজে চলে গেল৷ পার্সেলটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল অর্পণ। ‘শুধুই আপনার জন্য সাহেব’ লেখাটা পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই ইরার কথা মনে পড়ল৷ মেয়েটা বড্ড চঞ্চল আর চতুর। ভেতরে কী রিয়েছে সেটা জানার আগ্রহ বাড়তে শুরু করল। ইরার নাম্বার বের কল কল দিল অর্পণ। সাথে সাথেই কল রিসিভ হলো। হয়তো অর্পণের ফোন আসারই অপেক্ষা করছিল ইরা৷ অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚
“হুট করে পার্সেল পাঠালে কেন?”
“আপনি আমাকে ভালোবেসে গিফট না-ই দিতে পারেন। আমি তো দিতেই পারি।”
“আমি কী বলেছি তোমাকে গিফট দিতে? আর কী আছে এতে?”
“নিজেই খুলে দেখে দিন।”
“পারব না।”
“আচ্ছা ত্যাড়া লোক তো আপনি।”
“ত্যাড়া লোকের সাথে কথা বলছ কেন?”
“তাহলে রেখে দিন। কথা বলতে কে বলল?”
“তুমিও কম ত্যাড়া না।”
“আপনার সাথে সারা জীবন ত্যাড়ামি করব।”
অর্পণের ক্ষীণ হাসি ইরা দেখতে পেল না৷ দেখলে হয়তো প্রেমে পড়ে যেত! নীরবতা সহ্য হলো না ইরার। তেজি স্বরে শুধাল‚
“লাইনে আছেন তো নাকি?”
“কী বলবে বল!”
“আমি তো ভাবলাম ফোন কানে দেখি হয়তো আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।”
“আমার মত কুম্ভকর্ণ নাকি আমি?”
“কী বললেন আপনি আমাকে? আমি কুম্ভকর্ণ? কুম্ভকর্ণ তো আপনি। সেদিন সকালে কল দিয়েছিলাম— পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল কে? আমি না আপনি?”
“রাতভর কথা কে বলছিল?”
“অবশ্যই আপনি!”
“অপর প্রান্তের মানুষটা কে ছিল তাহলে?”
“কী জানি!”
চলবে?…..