#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১২|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
[দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ]
“হতচ্ছাড়ি মাইয়া তোরে কতদিন কইছি আমগোর বাড়িত আইবি না!”
আঁখিদ্বয় সিক্ত হলো ভূমির। পা দুটো দোরগোড়াতেই থমকে গেল৷ বাড়িতে এক ফোঁটা পানি নেই৷ দুটো ভাত খেতে বসেছিল তখনই খেয়াল হলো ঘড়ায় পানি নেই। মনে কিছুটা সাহস সঞ্চার করে ছুটে এসেছিল জামাল কাকাদের বাড়ি৷ কাকি বেশ খিটখিটে মেজাজের। সহজ কথাও ক্রুদ্ধ স্বরে বলেন। মহিলা আবারও বললেন‚
“কোনো জারজ সন্তানের অপবিত্র ছায়া আমার বাড়ির আশেপাশে পড়ুক— এইডা আমি চাই না।”
“দয়া করে চুপ কর কাকি। আমি জা’রজ সন্তান নই।”
মহিলা মুখ ঝামটা দিয়ে টিপ্পনী কে’টে বললেন‚
“এই কাহিনি পুরো গ্রাম জানে। ওই কথা মুখে আনতেও ঘেন্না লাগে।”
দুহাতে কান চেপে ধরল। প্রতিনিয়ত এই কথাগুলো শুনতে তার একটুও ভালো লাগে না৷ মাকে নিয়ে খারাপ কথা শুনতে কারই বা ভালো লাগে? রমিজা আবারও বললেন‚
“তা আমার উঠোনে তোর ছায়া ক্যান?”
“বাড়িতে একফোঁটা পানি নেই আর আম্মাও বাড়ি ফেরেনি তাই আমিই তোমাদের কলপাড় থেকে পানি নিতে এসেছিলাম গো কাকি।”
“না থাকলে নাই। তোরে কে আইতে কইছে?”
মহিলার কথায় খুব খারাপ লাগল। এমনিতে অনেকের কাছেই এই শুনে অভ্যস্ত সে৷ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সমান তালে কেঁদে যাচ্ছে ভূমি৷ তার কান্নায় একটুও মায়া হলো না রমিজার৷ আবারও মুখ ঝামটা দিয়েই মৃদুস্বরে বলে উঠলেন‚ “ঢং!”
গৌর কপোল জুড়ে উষ্ণ অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে৷ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে ভূমি। মহিলা তাকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দিল না তো দিলই না। ক্ষিধেও পেয়েছে ভীষণ। নিরুপায় হয়েই ভূমি বলল‚
“কাকি আমাকে এই ছোটো কলসিটায় একটু পানি ভরে দেবে— ভাত খেতে বসেছিলাম।”
“এহন কি তোর কাম আমারে কইরা দিতে হইব?”
একটু থেকে রমিজা নিজ থেকেই বললেন‚ “কলসি দে পানি আইনা দিতাছি। কিন্তু তুই আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় ঢুকবি না।”
অল্পতেই খুশি হয়ে গেল ভূমি। ঘাড় কাত করে মহিলার কথায় সায় জানাল। কিছুক্ষণের মাঝেই মহিলা ভরা কলসি নিয়ে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালেন৷ ভূমির হাতে কলসিটা দিয়ে বললেন‚
“তোর আম্মারে কইবি এই মাসের পানির টেকাটা যেন তাড়াতাড়ি দিয়া দেয়।”
“আচ্ছা!”
❑
দূরাকাশে কৃষ্ণ মেঘের ঘনঘটা। ঘুরঘুর করে মেঘ ডেকে যাচ্ছে৷ দৈবাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় গাছগাছালি এপাশ ওপাশ হেলে পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন‚ বেশ আয়োজন করেই মেঘ বর্ষিত হবে। বাতাসের দাপটে মরিচাধরা আধ ভাঙা জানালার দুয়ার বারবার বাড়ি খাচ্ছে। আজই হয়তো ভেঙে পড়ে গেল! নিমেষহীন ভূমি আজ প্রকৃতিবিলাসে ব্যস্ত। কৃষ্ণ কেশ গুচ্ছ লতাপাতার ন্যায় জড়িয়ে আছে সমগ্র কোমড় জুড়ে। আসরের আযানের পর থেকে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। নামায আদায় করেই ভূমি এখানটায় এসে বসেছে। হঠাৎ খট করে শব্দ হওয়ায়‚ দৃষ্টি ঘরের দিকে আবদ্ধ করল সে। মায়াময়ী মানবীকে দেখে বিষণ্ণমনা রমণীর হৃদয় হুহু করে উঠল। সহস্র কান্না এসে ভীড় জমিয়েছে মৃগনয়নায়। এ যেন চোখে চোখে নালিশ জানাচ্ছে অনিমেষ৷ অধরোষ্ঠ কাঁপছে তরতর করে। মমতাময়ী মানবী কাছে এগিয়ে যেতেই ভূমি শুধাল‚
“আমার বাবা কে আম্মা?”
একই প্রশ্ন বারবার শুনতে শুনতে বিরক্ত হলেন মহুয়া। বাজখাঁই স্বরে বলে উঠলেন‚
“তোকে কতবার বলেছি‚ তোর বাবা নেই৷ আমিই তোর বাবা‚ আমিই তোর মা।”
“সবাই তাহলে কেন বলে‚ আমি জারজ সন্তান?”
কোনো উত্তর দিতে পারলেন না তিনি৷ মেয়ের কষ্টে যে উনারও মন কাঁদে৷ প্রতিনিয়ত নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি৷ শুরু থেকেই কম কথা শুনতে হয়নি উনাকে। তবুও প্রতিটা পরিস্থিতিতে নিজেকে নির্ভীক‚ নিগূঢ় রাখার চেষ্টা করেছেন। মেয়েকে ভালো রাখতে অহর্নিশ কষ্ট করে যাচ্ছেন তিনি। আদতে কী তা পেরে উঠছেন? নীরবতা ভেঙে ভূমি নিজে থেকেই বলল‚
“রমিজা কাকি তোমাকে টাকা দিতে বলেছেন৷”
“কীসের টাকা?”
“পানির টাকা।”
“উনি কী আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন?”
“না। আমি পানি আনতে গিয়েছেলাম।”
“উনি তোকে কটু কথা শোনায়নি তো?”
মায়ের কাছ থেকে সেই কথাগুলো লুকিয়ে গেল ভূমি। পাছেই না মা কষ্ট পায়৷ এমনিতেই মায়ের জীবনে খুব কষ্ট৷ অপূর্ণ স্বপ্ন আজও কষ্ট দেয় মাকে৷ মায়ের স্বপ্ন যে মেয়েকেই পূরণ করতে হবে৷ একদিন অনেক টাকা কামাবে। সেদিন আর মায়ের কোনো কষ্ট থাকবে না৷ ভাবতে বিষণ্ণতা এক ছুটে পালিয়ে গেল৷ মাকে আশ্বস্ত করে বলল‚
“আমাকে কেউ কিছু বলেনি আম্মা।”
মহুয়া অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পলিথিনে করে নিয়ে আসা তরকারি গুলো পাতিলে ঢেলে রাখলেন। ভূমিকে ডেকে বললেন‚
“বড়ো ভাবিজান আজকে দেখ কত তরকারি দিয়েছেন। তুই তো গোরুর গোশত পছন্দ করিস। আয় খেয়ে নে ক’টা।”
“রাতে জম্পেশ খাব আম্মা।”
মহুয়া অতি যত্নপূর্বক ছিকায় তুলে রাখলেন গোশতের পাতিল খানা। ভূমি চেয়ে দেখল একবার। বাতাবরণ ক্রমশ ব্যাকুল হচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কণা ইতিমধ্যেই ঝরতে শুরু করেছে। ভূমি একই ভঙ্গিতে জানালার দুয়ার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বৃষ্টি তার একদই অপছন্দের। তার একটা কারণ রয়েছে বইকি! ঝুরঝুরে টিন চুইয়ে পানি পড়ে ক্রমাগত। ভেজা মেঝেতে ঘুম হয়না। কাঁথাগুলো ভিজে চুঁইচুঁই করে। মায়ের কাছে এত টাকা নেই যে— টিনগুলো পাল্টাবে। কোনো কাজ ধরতে গেলেও তো টাকার প্রয়োজন। শীত এবং বর্ষা এই দুটো ঋতুতে খুব কষ্টের মাঝেই অতিবাহিত হয় ওদের। শীত আর বর্ষা কারো কারো জন্য রোমাঞ্চকর হলেও সবার জন্য হয় না। কথাটা সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে৷ সেজন্যই এই দুই ঋতু ভূমির ভীষণই অপছন্দের।
“আম্মা বৃষ্টি পড়ছে তো— এবার কী করব?”
“কিছু করতে হবে না। আসার সময় বড়ো পলিথিন কাগজ নিয়ে এসেছিলাম। ওটা লাগিয়ে দেব। আজ আর আমাদের ভেজা মেঝেতে শুতে হবে না।”
মায়ের কথায় হুট করেই খুশি হয়ে গেল ভূমি। মহুয়া প্রাণ ভরে মেয়ের চিত্তচাঞ্চল্য হাস্যজ্বল মুখটা দেখতে লাগলেন। অল্পের মাঝেও মেয়েটা কী অবলীলায় সবকিছু মানিয়ে নেওয়া চেষ্টা করে। মেয়ের মাঝেই নিজের ছায়া দেখতে পান তিনি৷
“কী ভাবছ আম্মা?”
“তোকে কয়েকটা কথা বলি শোন!”
ভূমি গিয়ে তার মায়ের কাছে বসল। ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করল‚ “কী কথা?”
“মানুষের জীবনটা শধুই একটা মরীচিকা— এছাড়া আর কিচ্ছু নয়৷ জীবনে চলার ক্ষেত্রে একটা কথা মেনে চলবি‚ চেনা মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়ার চাইতে অচেনা মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়া অনেক ভালো। এতে কষ্টটা কম হয়।”
হঠাৎ করে মায়ের মুখে এমন কথা শুনে ইতস্ততবোধ হলো ভূমির। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল মায়াময়ীর সুশ্রী পানে৷ মেয়ের ওমন চাহনির মানে বুঝতে পারলেন মহুয়া৷ গাল এলিয়ে হেসে উঠলেন তিনি৷ রুক্ষ হাত দ্বারা ভূমির গালে মমতামাখা স্পর্শ করলেন তিনি। নেত্র যুগল সিক্ত হলো কিছুটা। মহুয়া বললেন‚
“আমার পদ্মিনী যে বড্ড কোমল৷ যে কেউ তাকে খুব সহজেই কাঁদাতে পারে৷ খুব সহজেই তার ছোট্টো নিষ্পাপ হৃদয়ে আঘা’ত হানতে পারে।”
“আম্মা আমি তোমার সাহসী মেয়ে।”
মহুয়া পরম স্নেহে মেয়েকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন। বেঁচে থাকার এই একটা মাত্রই সম্বল উনার৷ মেয়ের মুখের হাসিটাই যে সব। মহুয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন‚
“মায়ের একটা কথা সবসময় মনে রাখবি— অন্যায়ে কখনো মুখ বুজে থাকবি না। মায়ের মতো ভুল তুই কখনো করবি না৷”
মহুয়ার কথায় অবাক হলো ভূমি৷ মায়ের মতো ভুল মানে? তার আম্মা তো কখনো ভুল করতেই পারেন না। ত্রস্ত কণ্ঠস্বরে শুধাল‚ “ভুল?”
“হ্যাঁ ভুল!”
শান্ত মোলায়েম স্বরে ভূমি বলল‚ “আমার আম্মা কখনো ভুল করতেই পারে না।”
“বোকা মেয়ে! ভুল প্রত্যেকটা মানুষেরই হয়৷ ভুল থেকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায়৷”
“তাহলে কী ভুল করা ভালো আম্মা?”
“ভুলের দুটো প্রকারভেদ আছে। কিছু ভুল আমাদেরকে জীবনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। লড়াই করে বাঁচতে শেখায়। আর কিছু ভুলের কারণে চলার পথে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে হয়।”
মহুয়ার আঁখিদ্বয় অশ্রুপ্লুত হলো। বহু পুরোনো কিছু স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে। মুখ তুলে তাকাতেই ভূমি দেখতে পেল তার আম্মা কাঁদছে। মায়ের ক্রন্দনরত মুখখানা দেখে বিচলিত হলো অষ্টাদশী কন্যা। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“কী হয়েছে তোমার আম্মা— কাঁদছ কেন?”
দ্রুত চোখ মুছে নিলেন মহুয়া। মেয়েকে আশ্বস্ত করে বললেন‚ “বাতাসের সঙ্গে কী যেন উড়ে এসে পড়ল! খোঁচা লাগছে চোখে।”
“বড়ো করে তাকাও‚ আমি ময়লাটা বের করে দিচ্ছি।
“তেমন কিছুই না। জানালাটা আটকে দে। আমি গোসলটা করে আসি৷ শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে।”
“আচ্ছা।”
রশিতে ঝুলিয়ে রাখা কাপড় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মহুয়া৷ মায়ের কথানুযায়ী ভূমি জানালা আটকে দিল৷ দৈবাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় শুকনো পাতা উড়ে এসেছে মাটির মেঝেতে৷ ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কণাও এতক্ষণ জানালার পাশের মেঝেতে লেপ্টে পড়েছে৷ ঝাঁটা দিয়ে ঝেড়ে সবগুলো পাতা ঘরের বাহিরে ফেলে এলো ভূমি। ভাতও রান্না করতে হবে৷ লাকড়িতে বোধহয় বাতাসের দাপটে আসা বৃষ্টির কণা ছিটে এসেছে৷ দ্রুত পায়ে চুলোর কাছে গেল ভূমি। কয়েক মুঠো লাকড়ি বোঝাই করে রাখা৷ না! লাকড়ি গুলো ভেজেনি। ভাগ্যিস বাতাসের দাপটে এপাশের জানালাটা আটকে গিয়েছিল। নয়তো আজ শুকনো মুড়ি খেয়ে কাটাতে হত৷ অবশ্য আম্মা সঙ্গে করে তরকারি এনেছিলেন৷ কিন্তু ভাতের স্বাদ কী আর মুড়ি দিয়ে মেটানো যায়?
তাড়াহুড়ো করে ভাত বসিয়ে দিল ভূমি। এতক্ষণে গোসল সেরেছেন মহুয়া৷ বারান্দায় জমিয়ে রাখা বালতি থেকে ওযু করার জন্য কিছুটা পানি নিয়ে টিন দিয়ে বেড়া দেওয়া গোসল ঘরে গেল সে৷ মাগরিবের আযান পড়েছে কিছুক্ষণ আগেই।
চলবে?…..
–
–
আসসালামু আলাইকুম। আজ থেকে অতীতের পাতায় পদার্পণ করেছি। শুধুমাত্র ভূমির টানাপোড়েন জীবনকে নিয়ে লেখা হবে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। যারা ডিএনএ রিপোর্টের রেজাল্ট জানতে চেয়েছিলেন তাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আশাকরি আপনারা ব্যাপারটা বুঝবেন।