রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৯| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
610

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৯|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

নিশীথে ঘুম হলো না প্রলয়ের৷ শেষ প্রহরে একটু চোখটা লেগেছিল তবে রোদের তপ্ত ছটা ঘুম পালিয়েছে৷ বালিশে কনুইয়ের ভর দিয়ে বাঁ পাশে ফিরেছে প্রলয়। ঘুমের ঘোরে ভূমি তাকে জাপ্টে ধরেছে। ঘুমের ঘোরেও মেয়েটা কপালে সহসাই ভাজ পড়েছে৷ ভূমি কী খারাপ কোনো স্বপ্ন দেখেছে? ভেবে পায় না প্রলয়। চোখ মুখের উপর বেপরোয়া চুলগুলো বিরক্ত করতে হেলে পড়েছে৷ বড্ড বেহায়া চুলগুলো৷ ডান হাত দ্বারা চুলগুলোকে সরিয়ে একদৃষ্টে ভূমিকে দেখতে লাগল প্রলয়৷

ঘুম থেকে জেগে প্রলয়কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঘাবড়ে গেল ভূমি। তাড়াহুড়ো করে উঠে বসতে নিলে লম্বা চুলে টান পড়ল। মুখ থেকে “আহ্!” শব্দ উচ্চারিত হলো। প্রলয়ের সেদিকে খেয়াল নেই। এখনো সে একই ভঙ্গিতে ভূমির দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ মুখ কাঁদোকাঁদো করে ভূমি বলল‚

“একটু হাতটা সরাবেন? চুলে ব্যথা লাগছে৷”

ভূমির কথাগুলো কানে গেল না। প্রলয়ের বাহু ঝাকিয়ে ভূমি আবারও বলল‚ “শুনছেন?”

ভাবনার ঘোর কাটতেই আধ শোয়া হতে সোজা হয়ে বসল প্রলয়। ছাড়া পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে ভূমি। গায়ের ওড়না ঠিক করে‚ তড়িঘড়ি করতে করতে বিছানা ছাড়ল৷ এলোমেলো বিনুনি হাত খোপা করতে করতে বলল‚

“বেলা অনেক হয়েছে।”

কিছু বলল না প্রলয়। বিছানা ছেড়ে সেও এতক্ষণে নেমে পড়েছে৷ ভূমি ব্যস্ত হয়ে বিছানা গুছিয়ে নিল। এরপর ওয়াশরুমে গেল৷ প্রলয় ফ্যালফ্যাল করে সেদিকটাতেই চেয়ে রইল৷

সকালে খাবার টেবিলে প্রলয় কারো সঙ্গে কোনো কথা বলল না৷ এদিকে মাধুরী আর খারাপ ব্যবহার করলেন না ভূমির সঙ্গে৷ অল্পস্বল্প কথা হয়েছে ঠিকই তবে তিনি খুব শান্ত স্বরেই কথা বলেছেন আজ। উপস্থিত সকলেই অবাক মাধুরীকে দেখে। এমনিতে মাধুরী সচরাচর সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন না৷ এই জন্যই ভূমির সঙ্গে এমন ব্যবহার কেউ মেনে নিতে পারছিল না৷ ছেলের এই নিস্তব্ধতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না মাধুরী। সব তো ঠিক করে নেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। তাহলে ছেলেটা কেন এত রেগে আছে? নাস্তা খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে প্রলয় যখন সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হবে তখনই মাধুরী ছেলের পথরোধ করে দাঁড়ালেন। প্রলয় তাকাল না। মাধুরী বললেন‚

“কথা কেন বলছিস না মায়ের সঙ্গে।”

“আমার মা তো এখন সেলেব্রিটি হয়ে যাবে৷ ক্রমাগত সিরিয়ালের শাশুড়ীদের মতো আচরণ করছে।”

থতমত খেয়ে গেলেন মাধুরী৷ সিরিয়াস মুহূর্তে ঠাট্টা একমাত্র প্রলয়ই করতে পারে। সরে দাঁড়ালেন মাধুরী। প্রলয় সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় চলে গেল৷

তাড়াহুড়ো করে তৈরি হচ্ছে প্রলয়। গাড়ি নিয়ে সোজা কলেজে যাবে৷ সমাবেশ তো সেখানেই আয়োজিত হবে৷ অর্পণ খুব করে আজ প্রলয়ের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু তা আর হলো কই? প্রলয় কিছুতেই রাজি হলো না৷ অগত্যা না চাওয়া সত্ত্বেও হসপিটালে ছুট লাগিয়েছে অর্পণ। নিজের প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে ভূমিকে কাছে ডাকল প্রলয়। তার কথানুযায়ী ভূমিও বোকার মতো এগিয়ে গেল। প্রলয় বলল‚

“নিজের খেয়াল রেখ। মায়ের কোনো কথায় মন খারাপ করে থেক না৷ কারো কটু কথা হয়তো আটকাতে পারবে না৷ তবে এক কান দিয়ে ঢুকাবে আরেক কান দিয়ে বের করবে৷ মনে থাকবে?”

ভূমি মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে বলল‚ “হুম!”

দুজনের মাঝে দূরত্ব ঘুচাল। প্রেয়সীর ললাটে সিক্ত উষ্ণ অধর ছোঁয়াল প্রলয়৷ অর্ধাঙ্গের পক্ষ হতে প্রথম উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে শিরা উপশিরায় র’ক্ত ছলকে উঠছে। তন্মনে মৃদু ঝাঁকুনি দিল বোধহয়। দুহাতে ওড়না চেপে ধরল ভূমি। আঁখিদ্বয় আপনাআপনিই মুদে এলো৷ প্রলয় সরে দাঁড়াল৷ দুটি শরীরের দূরত্ব বাড়ল। পুরুষ মানুষ হয়েও লাজে বিমূঢ়দশা প্রলয়ের৷ ডান হাতটা তুলে নিজের বুকের বাঁ পাশটায় রাখল৷ কিছুটা ফিসফিসিয়ে বলল‚

“লাজে রাঙা হওয়া বারণ‚ কারণে অ-কারণ।”

রাতে…

আজকের দিনটা খুব তাড়াতাড়িই অতিবাহিত হলো যেন৷ চোখের পলকেই রাত নেমে এসেছে। অর্পণের মোবাইল ভূমির হাতে। এই তো সবে দিয়ে গিয়েছে অর্পণ। ইরার নাম্বার থেকে কল এসেছিল। মহুয়া কথা বলবেন মেয়ের সঙ্গে৷ বিছানায় দু পা ভাজ করে বসেছে ভূমি। ওপাশ থেকে আম্মার ত্রস্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো‚

“তোকে একটা খবর দেওয়ার আছে।”

মেয়ের প্রত্যুত্তরের প্রত্যাশায় না থেকে একটু সময় নিয়ে মহুয়া আবারও বললেন‚ “পশ্চিমের নদীর ধারে মকবুলের লা’শ পাওয়া গেছে৷”

ভূমি অবাক হয়ে বলল‚ “বলো কী আম্মা!”

“তা আর বলতে৷ গ্রামের মানুষ তো আতঙ্কে আছে। পুলিশ তদন্ত করছে। কিন্তু শাহাদাৎ ভাইয়ের থেকে শুনে যা বুঝলাম— ঘাতক কোনো প্রমাণ রাখেনি।”

“আমার খুব ভয় করছে আম্মা। তুমি‚ তোমরা সাবধানে থেক। তোমাকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হবে।”

“ধুর বোকা মেয়ে। হয়তো মকবুলের কোনো শত্রু ছিল। হয়তো ওই বাজে লোক কারো ক্ষতি করেছিল।”

ক্ষতির কথা শুনেই মনে পড়ল‚ মকবুল তো তার সঙ্গে খারাপ কিছু করতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস সেদিন প্রলয় সময়মতো চলে এসেছিলেন। একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ভূমির। কিন্তু আম্মার কাছেও কিছু বলতে পারছে না।

“আম্মা আমাকে চাচি মা ডাকছে। আমি এখন রাখছি।”

মহুয়া সায় জানিয়ে বললেন‚ “আচ্ছা যা৷ কাজ সাবধানে করবি। বটি‚ আগুন সাবধানে।”

“আচ্ছা আম্মা।” কথাটা বলেই ফোন কে’টে দিল ভূমি। অপেক্ষা করতে লাগল প্রলয় কখন বাড়ি ফিরবে।

রাত সাড়ে নয়টার দিকে প্রলয় বাড়ি ফিরেছে৷ বাকিরা আটটা বাজার আগেই ফিরে আসে৷ কখনো সখনো কাজের চাপ থাকলে দেরি হয়। সন্ধ্যের পর আর ঘর থেকে বের হয়নি ভূমি। সন্ধ্যেবেলা হালকা নাস্তা করে পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছিল। এশারের আযান পড়তেই নিজেদের ঘরে ফিরে এসেছে ভূমি। এরপর আর ঘর থেকে বের হয়নি। অর্পণের ফোন থেকে আম্মার সঙ্গে কথাও বলেছিল৷ তারপর বেশ কিছুক্ষণ সময় বারান্দায় একাকী সময় কাটিয়েছে সে৷ যখন দেখল প্রলয়ের গাড়ি মালঞ্চ নীড়ে প্রবেশ করছে তখনই তাড়াহুড়ো করে বারান্দার দরজা আটকে ঘরে প্রবেশ করল ভূমি৷

ক্লান্ত শরীর নিয়ে ধীর পায়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল প্রলয়। চোখমুখে ক্লান্তির আভাস৷ গায়ে জড়িয়ে রাখা পাঞ্জাবি খুলে বিছানার উপর রেখে দিল প্রলয়৷ হাতে ঘড়ি‚ মোবাইল আর ওয়ালেটও বিছানার উপর ছুড়ে ফেলেছে। কলেজে হওয়া সমাবেশ শেষে পার্টি অফিসে গিয়েছিল৷ বারান্দা থেকে ফেরার পথে তোয়ালে খানা হাতে করে নিয়ে এসেছিল ভূমি। প্রলয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বলল‚

“আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।”

“আমি ভীষণ ক্লান্ত। ফ্রেশ হয়ে এসে কথা বলছি।”

ভূমির হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল প্রলয়। ওয়ারড্রব থেকে টিশার্ট বের করে বিছানার উপর রাখল ভূমি। বিছানা গুছিয়ে ঘর থেকে বের হলো। উদ্দেশ্য প্রলয়ের জন্য কফি করে আনা। ফিরোজার কাছ থেকে শুনেছে‚ লোকটা কাজ থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরলে কড়া করে কফি খান৷

বেশ অনেকটা সময় পর কফি মগ নিয়ে ঘরে ফিরে এলো ভূমি৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে প্রলয়। পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভূমি। কফি মগ বিছানার পাশের টেবিলের উপর রেখে দাঁড়িয়েছে সে। কী করে কথাটা জিজ্ঞেস করবে বুঝে উঠতে পারছে না সে৷ তবে জিজ্ঞেস তো করতেই হবে। আয়নায় ভূমির প্রতিবিম্ব লক্ষ্য করে প্রলয় শুধাল‚

“ওহ কী যেন বলতে চাইছিলে— বল!”

প্রশ্রয় পেয়ে ভূমি জিজ্ঞেস করল‚ “ম..মকবুল কাকাকে কী আপনি মে’রে ফেলেছেন?”

“তোমার কী মনে হয়?”

“আপনি দয়া করে বলুন।”

ভূমির কণ্ঠস্বর বড্ড অগোছালো মনে হলো। প্রলয় চোখ বন্ধ করল। ভূমির র’ক্তাক্ত মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল৷ কাঁচ ফুটে পায়ের বেহাল দশা৷ অতিরিক্ত র’ক্ত ঝড়ার ফলে মেয়েটা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়লছিল। একটা সময় অচৈতন্য হয়ে ঢলে পড়েছিল ধুলোবালি জমা মেঝেতে৷ ভূমির এমন অবস্থা দেখে চোখ মুখ দিয়ে আগুন ঝড়ছিল প্রলয়ের। সেদিন নিজের চোখে প্রলয়ের ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছিল মকবুল৷ দেখতে পারছিল নিজের বিনাশ। বুকে হাত দিয়ে মেঝেতে পড়ে ছিল৷ বেচারা ব্যথা পেয়েছে নিশ্চয়ই৷ প্রলয়ের কাছে সেদিন হাত জোর করে ভীতু গলায় বলেছিল‚

“আ..আমারে ছাইড়া দেও৷ এই ভূল আমি আর করতাম না।”

“আমার বিচারালয়ের একটাই শাস্তি। আর তা হচ্ছে মৃত্যু। মনে রাখবি— পুরুষ তার শখের নারীর জন্য জান দিতেও পারে আবার জান নিতেও পারে।”

শেষোক্তটি চেঁচিয়েই বলল প্রলয়। এরপর সঙ্গে সঙ্গে তিনটে গুলি চালিয়ে ঝাঁঝরা করে দিল মকবুলের বুকটা। গলা কা’টা মুরগীর মতো তড়পাতে শুরু করল মকবুল। একটা সময় নিথর দেহ হতে প্রাণটা হয়ত বেরিয়েই পড়ল। এই সমস্তটা ভূমির অজানাই থেকে গেল। হয়তো কখনো জানা হবে না৷ মুহূর্তটা স্মৃতিচারণ হতেই প্রলয়ের অধর কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল ভূমির অগোচরে।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here