#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩৯|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
শপিংমল থেকে বের হয়েছে প্রলয় আর ভূমি। ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ প্রলয়। এতক্ষণে এসির মাঝে ছিল বলে গরম অনুভূত হয়নি। রাস্তা অপাশের ফুটপাতে আইসক্রিমের দোকান বসেছে৷ প্রলয় একটিবার ভাবল ভূমিকে আইসক্রিম কিনে দেবে। ভূমিকে গাড়িতে বসিয়ে সেখানটায় গেল। যাওয়ার আগে ভূমিকে বারবার বলে গিয়েছে গাড়ি থেকে যেন না নামে। গাড়িতে বসে থাকতে একটুও ভালো লাগছে না ভূমির। ভাবল একটু গাড়ি থেকে নেমে পাশে দাঁড়াবে৷ গাড়ির জানালা খোলা ছিল। ভূমি দেখল‚ প্রলয় রাস্তা পারাপার হচ্ছে। চট করে বের হয়ে বাহিরে দাঁড়াল৷ এখন কিছুটা ভালো লাগছে। লোকসমাগমও খুব বেশি নেই। সবারই তো নিজস্ব কাজ থাকে৷ ভুমি দিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে। দুটো আইসক্রিম কিনে প্রলয় যখন পেছনে ঘুরল তখনই দেখতে পেল‚ পেছন থেকে একটা সাদা রঙা গাড়ি ছুটে আসছে৷ কয়েক সেকেন্ডের পথ। মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগছে৷ দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়ল প্রলয়। এদিকে রাস্তার কিনারায় দাঁড়িয়ে তার আসার অপেক্ষা করছে ভূমি। মেয়েটাকে বারবার বলা হয়েছিল‚ গাড়ি থেকে যেন না নামে৷ ভূমিকে একা ফেলে আসা তার সম্পূর্ণ ভুল ছিল। একদিকে রাগ অন্যদিকে ভূমিকে হারিয়ে ফেলার ভয় মাথায় জেঁকে বসেছে৷ হাত থেকে আইসক্রিম দুটো পড়ে গেল। প্রলয় সর্বস্ব দিন দৌঁড় লাগাল। মনে মনে একটাই দোয়া করছে‚ ভূমির যেন কোনো ক্ষতি না হয়। দরকার পড়লে সে যেন ক্ষ’তবিক্ষ’ত হয়।
ধুলোবালি জমা রাস্তায় ছিটকে পড়েছে ভূমি। আতঙ্কের মাঝে রয়েছে সে। চোখের পলক ফেলতে বেমালুম ভুলে গেল যেন৷ একটু হলেই সব শেষ হয়ে যেত৷ গাড়িটা তার উপর দিয়েই চলে যেত। ভাবতেই শরীরে কা’টা দিয়ে উঠছে৷ তার উপর গিয়ে পড়েছে প্রলয়৷ ভূমিকে বাঁচাতে গিয়ে হাতে ব্যথা পেয়েছে। সাদা রঙা গাড়িটা এখানে নেই। প্রলয় গাড়ির নাম্বারটা দেখে রেখেছে৷ একটুর জন্য ভূমি আজ বেঁচে গেল। ভাগ্যিস সময় মতো প্রলয় চলে এসেছিল। হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা থেকেই রাগটা তড়তড় করে মাথায় চড়ে বসল। সর্বস্ব শক্তি দিয়ে ভূমি গালে চড় মে’রে বসল প্রলয়। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি মেয়েটাকে মে’রে ফেলতে। একটুর জন্য প্রলয়ের প্রাণপাখি উড়াল দিচ্ছিল। চড় খেয়েও ভূমির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বাঁ গালটা ব্যথায় টনটন করছে৷ প্রলয়ের মতো কাটখোট্টা লোকের হাতে চড় খেয়েও থম মে’রে বসে রয়েছে ভূমি। কেমন স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছে! হয়তো আতঙ্কটা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারছে না৷ একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে‚ অশ্রুপ্লাবিত গভীর নেত্র যুগলে। লোকটা কী কাঁদছে? কিন্তু কাঁদার মতো তো কিছু ঘটেনি৷ চড়ের চেয়েও প্রলয়ের অশ্রুপ্লুত রক্তিম চোখ জোড়া তাকে বড্ড কষ্ট দিচ্ছে৷ রাস্তার কিনারায় গুটি কয়েক মানুষ জড়ো হয়েছে৷ লোকসমাগম ছিল না বিধায় ভীড় জমেনি। প্রলয় সকলের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল। প্রলয়ের দিক থেকে এমন রাগারাগি দেখে মানুষজন চলে যেতে শুরু করল। ভূমিকে কোলে তুলে গাড়িতে বসাল প্রলয়। একটা কথা পর্যন্ত বলল না লোকটা৷ নীরবে অশ্রুপাত করছে ভূমি। প্রলয় তার সঙ্গে কথা বলছে না ব্যাপারটা তাকে বড্ড পীড়া দিচ্ছে৷ কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। প্রলয়ের হাত থেকে র’ক্ত ঝড়ছে৷ কম্পিত হস্তে প্রলয়ের হাতখানা নিজের হাতে নিয়ে বলল‚
“আপনার হাত থেকে তো র’ক্ত ঝড়ছে।”
তাতেও কাজ হলো না। প্রলয় তো কথা বললই না উল্টো ঝামটা দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়েছে৷ রাগে কপালের রগ ফুটে উঠেছে৷ এসি চলছে তবুও তড়তড় করে ঘামছে লোকটা। ভয়ে ভয়েই ভূমি প্রলয়ের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। প্রলয়ের হাতটা আবারও ধরল৷ তখন লোকটার অশ্রুপ্লাবিত গভীর নেত্রে তাকিয়ে কষ্ট হচ্ছিল ভীষণ কিন্তু এখন এই লোকটাকে তার ভীষণ ভয় করছে। চোয়ালে শক্ত হয়ে রয়েছে প্রলয়ের৷ গাড়ির জানালা আটকে রাখা৷ ভূমি পুনরায় কিছু বলতে নেবে এরই মাঝে প্রলয় তার হাতটা নিজের বক্ষঃস্থলে চেপে রেখেছে৷ ভূমি উপলব্ধি করল‚ লোকটার হৃৎস্পন্দন প্রলয়ঙ্কারী ঝড় তুলছে। অল্প মুহূর্তেই কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে৷ এবার কিছুটা শান্ত কণ্ঠে প্রলয় বলল‚
“এতটা কেয়ারলেস কী করে হতে পারো তুমি? তোমাকে আমি বলেছিলাম না— গাড়ি থেকে নামবে না? কথা শুনলে না কেন?”
কণ্ঠস্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে ভূমি বলল‚ “দুঃখিত! আমি আসলে বুঝতে পারিনি।”
“একটু হলেই আজ আমার জীবনটা এখানেই থেমে যেত! ভাবতেই নিজেকে ছন্নছাড়া লাগছে।”
প্রলয়ের কণ্ঠস্বর ভারী শোনাল। ভূমি তাকাল প্রলয়ের চোখের দিকে। লাল হয়ে রয়েছে গম্ভীর চোখ জোড়া৷ ভূমির হাতে শব্দ করে অধর ছোঁয়াল প্রলয়। নিজেকে স্বাভাবিক করতে বলল‚
“হাত কে’টে গিয়েছে‚ একটু ফু দিয়ে দাও।”
অন্যদিকে…
উচ্ছ্বসিত অর্পণ পার্সেলটা খুলছে৷ র্যাপিং করা হয়েছে৷ র্যাপিং কাগজটায় গোলাপ ফুল আর লাভ আঁকিবুঁকি করা৷ খুবই নিভৃতে খুলল অর্পণ। ভিডিও কলে রয়েছে ইরা৷ বসে বসে একপলকে দেখছে অর্পণকে৷ লোকটা খুবই শিথিলভাবে র্যাপিং খুলতে দেখে হাসি পেল। শব্দ করে হেসেও উঠল মেয়েটা৷ হাসতে হাসতেই বলল‚
“এমন ভাবে পার্সেল খুলছেন যেন‚ একটু এদিকসেদিক হলেই সব শেষ।”
“অ্যাই তুমি এখানে বো’মা টোমা রাখনি তো?”
“হ্যাঁ বো’মাই রেখেছি৷ কিছুক্ষণ পরেই আপনি ফুসসস।”
অর্পণ আবারও পার্সেল খোলায় মনোযোগী হলো। বক্সের ভেতর একটা ঘড়ি‚ পারফিউম‚ ওয়ালেট আর একটা টেডি৷ এগুলো দেখে তার চোক্ষু চড়কগাছ। মেয়েটার বাচ্চামোতে হাসিও পেল ভীষণ। একটা গোলাপও রয়েছে সাথে৷ ছোটো একটা চিরকুট৷
“এইযে ম্যাম? এগুলো কী হ্যাঁ? আপনি কী এখনো টিনএজার রয়েছেন?”
“কেন আপনার পছন্দ হয়নি?” একটু থেমে বলল‚ “পছন্দ না হলেও এগুলো আপনাকে ব্যাবহার করতেই হবে৷”
“সে নাহয় করলাম৷ তবে আমাকেও তো রিটার্ন গিফট দিতে হবে। কী দেওয়া যায়?”
“আপনি আমাকে গিফট দেবেন?”
“হ্যাঁ! রিটার্ন গিফট।”
“তাহলে চুমু দিন। একটা গাঢ় চুমু।”
ইরার কথায় কাশতে শুরু করল অর্পণ। মেয়েটা মাত্রাতিরিক্ত চঞ্চল। অনেকটা দুষ্টু প্রকৃতির। টেবিলের উপর থাকা পানিটা ঢকঢক করে পান করল। তবুও কাশি থামছে না তার৷ ইরা আবারও বলল‚
“কী এমন ভুল বললাম— এভাবে কাশছেন কেন?”
“কল রাখছি। আমার কাজ আছে।”
সন্ধ্যে বেলা…
পনেরো তারিখ থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। দম ফেলারও সময় নেই পূর্ণতা পুষ্পিতার। মেয়ে দুটো কত ভেবেছিল‚ ভাইয়ের রিসেপশনে/জন্মদিনে কত মজা করবে। কিন্তু তা আর হবে কোথায়? খাতাটা বন্ধ করে পুষ্পিতা হাই তুলল৷ ভরসন্ধে বেলা ঘুম আসছে তার৷ বই হাতে নিলেই ঘুম পায় তার৷ পুষ্পিতাকে একটা গাট্টা মে’রে পূর্ণতা বলল‚
“ঘুমচ্ছিস কেন? পড়! এখনো অনেক পড়া বাকি।”
“কোথায় ভাবলাম— চৌদ্দ তারিখ খুব মজা করব! তা আর হলো কোথায়? সরকার আমার সুখে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।”
পুষ্পিতার কথার প্রত্যুত্তর করল না পূর্ণতা৷ পুষ্পিতা আবারও বলল‚ “তুই আর কী বলবি? তুই তো এমনিতেই পড়াপাগল!”
রাতে…
দুপুরের ঘটা ঘটনাটা কাউকে জানায়নি প্রলয়। ভূমিকেও বারণ করে দিয়েছিল জানাতে৷ শুধু শুধু সবাইকে টেনশনে ফেলার কোনো মানেই হয় না৷ ব্যাপারটা সে নিজেই সামলে নিতে পারবে। এখন সবটাই বুঝতে পারছে প্রলয়৷ ছেলের এভাবে হাত কেটে যাওয়া নিয়ে এক বেলা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছেন মাধুরী৷ ছেলের কিছু হলে সহ্য করতে পারেন না তিনি। ছোটো বেলায় একবার সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে চিবুকের অনেকটা অংশ কে’টে গিয়েছিল। তিনটে সেলাই লেগেছিল সেদিন। ছেলের এমন অবস্থায় কেঁদে কে’টে একশা করেছিলেন মাধুরী৷ মোর্শেদ শিকদার তো মাঝে মাঝেই উনাকে ক্ষ্যাপান। আজ ডান হাতে ব্যথা লাগায় প্রলয়কে মাধুরী খাইয়ে দিয়েছেন। খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই প্রলয় তার ঘরে চলে এলো৷ দুপুরের রাগটা এখনো কমেনি। কিন্তু রাগ ব্যক্ত করছে না কারো সামনে। এরই মাঝে হাত মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করল ভূমি। তাকে দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়াল প্রলয়। বড়ো বড়ো পা ফেলে ভূমির সমীপে এগিয়ে গেল।
প্রলয়কে এভাবে কাছে আসতে দেখে অবাক হয়েও হলো না। ভূমির সমীপে এলে সমস্ত রাগ মূর্ছা যায় প্রলয়ের৷ ভূমিকে নিজের কাছে টেনে এনে ঠাস করে দরজা আটকে দিল সে। স্বাভাবিক কণ্ঠেই ভূমিকে জিজ্ঞেস করল‚
“এতক্ষণ নিচে কী করছিলে?”
“এতক্ষণ কোথায়? একটু আগেই তো সবার খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হলো।”
“কিন্তু আমার যে মনে হলো— তুমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার থেকে পালাই পালাই কর।”
ভূমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। লোকটা কখন কী কথা কীভাবে বলে‚ মাঝে মাঝে তার বোধগম্য হয় না। ভূমির হাই তুলতে ইচ্ছে করছে৷ ঘুমও পাচ্ছে একটু আধটু৷ প্রলয় বুঝতে পেরে বলল‚
“তুমি শুয়ে পড়! আমার একজনকে কল করার আছে। আমি পাঁচ মিনিট পর আসছি।”
কথাটা বলেই বারান্দার দিকে চলে গেল প্রলয়। ভূমি বিছানা গুছিয়ে রাখল। এতকিছুর মাঝে চুল বাঁধেনি সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত খোপা করা চুলগুলো খুলে ফেলল ভূমি৷ ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে কাঁকই তুলে নিল।
অন্যদিকে…
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্রমাগত মোবাইলে টাইপিং করছে প্রলয়৷ মেসেজ টাইপ করার সময় চোখ মুখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছিল।
“কাজটা একদমই ঠিক করলেন না আপনি। আমার জানের দিকে হাত! এর শাস্তি তো এই সেহরিশ আরশান প্রলয় ঠিকই নেবে।”
একটু থেমে ঠোঁট উঁচিয়ে ‘চ’ শব্দ করল। এরপর আবারও লিখল‚ “সেহরিশ আরশান প্রলয় যে কারোর ঋণ রাখে না— মি. !”
মেসেজ পাঠিয়ে প্রলয় তার বিশ্বস্ত অনুচর রবিনকে কল করল। কল করার সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হলো। অপরপ্রান্ত থেকে কিছু শোনা গেল না। প্রলয় নিজে থেকেই বলল‚
“একটা গাড়ির নাম্বার দিচ্ছি‚ গাড়িটা কে চালাচ্ছিল সেই খবরটা আমাকে নিয়ে দিবি। পারলে লোকটার একটা ছবি আমাকে পাঠাবি৷ সে লোকটাকে আমার চাই৷ অ্যাট এনি কস্ট।”
চলবে?…..