রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪২| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
628

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪২|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

অম্বরে আলোর দেখা নেই। বাহ্যজগতে ঝিম ধরা অমানিশা। বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভূমি। প্রলয় এখনো গোসল করে বের হয়নি৷ ভূমি অনেকক্ষণ ধরেই প্রলয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল৷ ইরাকে পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে বসিয়ে দিয়ে এসেছিল সে। রান্নাঘরেও কাজ রয়েছে কিন্তু ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে প্রলয় যদি তাকে দেখতে না পায় তাহলে চেঁচামেচি করতে পারে। তাইতো অপেক্ষা করছে এমপি মশাই কখন বের হবে! এরই মাঝে ওয়াশরুমের দরজা খোলার খটখট শব্দ কর্ণগোচর হলো। ভূমি বারান্দা থেকে প্রস্থান নিল। প্রলয় তার ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছে নিচ্ছে। ভূমি গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল। প্রলয় তার হাতে থাকা তোয়ালেটা হাতে দিয়ে দিল। বিছানায় বসে ভূমিকে বলল‚

“চুলগুলো মুছে দাও।”

প্রলয়ের হাত থেকে তোয়ালেটা নিল ভূমি। কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে প্রলয়ের চুল মুছতে মুছতে বলল‚

“আপনাকে কতবার বলেছি— অসময়ে গোসল করবেন না। ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।”

“তাতে কী? বসে বসে বউয়ের সেবা পাব।”

প্রলয়ের চুলগুলো মুছিয়ে দিল ভূমি। কিছু উষ্ণ নিশ্বাস তার সর্বাঙ্গে বিচরণ করছে। নিঃশ্বাস যেন আটকে আসছে। প্রলয়ের সমীপে থাকলেই এমনটা হয়। লোকটার শরীর থেকে কী সুন্দর ঘ্রাণ আসছে। খুবই ভালো লাগে ভূমির। চুল মুছিয়ে দিয়ে প্রলয়ের কাছে থেকে সরে দাঁড়িয়ে ভূমি বলল‚ “পানি নিয়ে আসছি।”

বিছানার পাশের টেবিলের কাছে চলে গেল ভূমি। জগ থেকে পানি গ্লাসে ভরল। এরপর প্রলয়ের সামনে এসে গ্লাসটা ধরল৷ ভূমির কাছ থেকে গ্লাসটা নিল না প্রলয়। অবাক হলো ভূমি। প্রলয় নিজে থেকে বলল‚ “নিজেই খাইয়ে দাও।”

লোকটার কখন কী ইচ্ছে হয় বুঝে উঠতে পারে না ভূমি! পানিও খাইয়ে দিতে হয়? প্রলয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সে। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শব্দ করে হেসে উঠল প্রলয়৷ শ্যামসুন্দর লোকটার হাসি সুন্দর। মা’রাত্মক রকমের সুন্দর। মাঝে মাঝে পলক ফেলতে ইচ্ছে করে না৷ পাছেই না লোকটার সৌন্দর্য ফিকা হয়ে যায়। নিজের এমন ব্যবহারে খুবই অবাক হলো ভূমি। কেন এমন অদ্ভুত কথাবার্তা মাথায় ঘুরপাক খায়?

ভূমির নাক টেনে প্রলয় বলল‚ “তুমি কী একটা জিনিস খেয়াল করেছ?”

চোখ ছোটো ছোটো করে ভূমি জিজ্ঞেস করল‚ “কী?”

প্রলয় ফিসফিসিয়ে বলল‚ “তুমি প্রেমে পড়েছ ভূমি কন্যা।”

কাঁপা কাঁপা গলায় বলল‚ “প্রেম?”

“হুম— হুম!”

প্রলয়ের অধর কোণে হাসি ঝলমল করছে। ভূমি কথা কাটানোর জন্য বলল‚

“রান্নাঘরে আমার কাজ আছে৷ যাই আমি।”

চলে যেতে নিল ভূমি। পেছন থেকে প্রলয়ের কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হলো। প্রলয় বলছে‚ “এখন পালিয়ে যাচ্ছ— ব্যাপার না৷ তবে অনুভূতির তীব্র জোয়ারে ভাসবে তুমিও৷”

বড়ো বড়ো পা ফেলে বেরিয়ে গেল ভূমি। পানির গ্লাসটা বিছানার পাশের টেবিলের উপর রেখে‚ সটান হয়ে শুয়ে পড়ল প্রলয়। চোখ বন্ধ করে কোলবালিশ আঁকড়ে ধরেছে। মনে হচ্ছে যেন বউকেই জড়িয়ে ধরেছে।

ফিরোজা আয়োজন করে রান্না করছেন। দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ খুশি উনি। এত আনন্দের উৎস খুঁজে পেল না ভূমি। মাধুরীও সেখানেই রয়েছেন৷ ভূমি সেখানেই গেল। তাকে দেখা মাত্রই মুখ ঝামটা দিলেন মাধুরী। ভূমি বুঝল না হঠাৎ করে এমন ব্যবহারের কারণ। সে ফিরোজাকে জিজ্ঞেস করল‚

“চাচি মা আমি কোনো সাহায্য করব?”

টিপ্পনী কে’টে মাধুরী বললেন‚ “তোমার সাহায্যের কোনো প্রয়োজন নেই৷ ঘরেই বসে থাক তুমি। সারাদিন তো শুধু শুয়ে বসেই কাটাও৷ কোন কাজটা নিজে থেকে করেছ?”

মাধুরীর কথার আগামাথা কিছুই বুঝল না ভুমি। হঠাৎ করে কীইবা বা হলো যে তার সঙ্গে এমন রুক্ষ ব্যবহার করেছেন তিনি? ফিরোজা বললেন‚

“ভাবি ও তো সব কাজ নিজে থেকেই করতে চায়৷ এমনকি করেও৷”

বাজখাঁই কণ্ঠে মাধুরী বললেন‚ “আমার চোখ আছে। আমি দেখতে পাই।”

অবুঝকে বোঝানো যায় তবে যে সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে তাকে কী করে বোঝাবে? ফিরোজা কথা কাটানোর জন্য বললেন‚ “প্লেট গুলোকে ডাইনিং টেবিলের উপর রেখে এসো ভূমি।”

“আচ্ছা চাচি মা।”

অন্যদিকে…

পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে অনেকক্ষণ যাবৎ বসে ছিল ইরা৷ মেয়ে দুটো আবারও পড়তে বসবে এখন। তাদেরকে বিরক্ত করা মোটেও ঠিক হবে না। তাই তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে ইরা। এর চেয়ে বরং নিচে বৈঠকখানায় বসে থাকা ভালো। অর্পণের ঘরের দরজা তখন খোলাই ছিল। ইরা সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। অর্পণকে দেখে সশব্দে হেসে উঠল সে। লুঙ্গি পরিহিত অর্পণ ফ্যালফ্যাল করে ইরার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সকালে হসপিটালে যাওয়ার সময় বাইকের সঙ্গে লেগে পায়ে কিছুটা ব্যথা পেয়েছিল। র’ক্তও বেরিয়েছিল খানিকটা। ট্রাউজার পড়লে ব্যথার জায়গায় আবারও ব্যথা লাগে। এদিকে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হওয়ার উপক্রম ইরার। অর্পণ ত্রস্থব্যস্ত ভঙ্গিতে ইরাকে বলল‚

“এ কী তুমি আমার ঘরে কী করছ?”

হাসি থামিয়ে ইরা বলল‚ “এখানে না এলে আপনার এমন রূপের দেখা কোথায় মিলত তাসরিফ ইফরাদ অর্পণ।”

দরজা দেখিয়ে অর্পণ বলল‚ “বের হও এক্ষুনি আমার ঘর থেকে।”

বিছানায় আয়েশ করে বসে ইরা বলল‚ “যদি না যাই? এই এক মিনিট‚ এক মিনিট! আপনি আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।”

“চেষ্টা নয়! ডিরেক্টলি তোমাকে আমার ঘর থেকে তাড়াতেই চাইছি।”

“একবার পার্মানেন্ট ভাবে এসে নিই। তখন আপনার মজা বোঝাব।”

“তুমি মেয়েটা বড্ড ত্যাড়া৷”

“এ আর নতুন কী? আপনি কী যেন করছিলেন সেটাই করুন।”

“এখন কী আমি তোমার সামনে জামা পাল্টাব?”

“ওয়াশরুম আছে তো!”

“আচ্ছা নির্লজ্জ মেয়ে তো তুমি।”

“ধ্যাৎ! টিকতে দিলেন না আমাকে।”

অর্পণ এগিয়ে এসে ইরার হাত ধরে বলল‚ “এভাবে আমার ঘরে বসে থাকলে‚ বিষয়টা সবাই অন্য চোখে দেখবে। কেন বুঝতে পারছ না তুমি?”

“আচ্ছা— আচ্ছা! যাচ্ছি!”

ইরা চলে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল অর্পণ। মাকে ইরার কথা জানিয়েছে ঠিকই কিন্তু এভাবে দুজনকে একই ঘরে বসে থাকাটা ভালো দেখায় না। ইরা হয়তো কিছুটা রেগে রয়েছে তার উপর৷ কিন্তু তারও কিছু করার নেই। পড়নের আধ ভেজা টিশার্ট পালটে আরেকটা টিশার্ট বের করে পড়ে ফেলল৷

খাবার টেবিলে…

সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে৷ ভূমি আজ সকলের প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছে৷ সকলের বললে ভুল হবে৷ মাধুরী নিজের খাবার নিজেই বেড়ে নিয়েছেন৷ তখন থেকে অন্যরকম ব্যবহার করছেন ভূমির সঙ্গে। মেয়েটা মনে মনে ভাবছে‚ তার দিক থেকে না জানি কোন অন্যায় হয়েছে! যে কারণে মাধুরী তার সঙ্গে এমন করছেন৷ ব্যাপারটা আর কারো দৃষ্টিগোচর না হলেও ফিরোজা ঠিকই দেখলেন। খাওয়ার একফাঁকে মোর্শেদ শিকদার বলে উঠলেন‚

“এই রাতের বেলায় তোমাকে আজ যেতে হবে না। আজ নাহয় আমাদের বাড়িতেই থেকে যাও।”

“তা হয় না আঙ্কেল। আমাকে একটু হোস্টেলে পৌঁছে দিলেই হবে।”

অর্পণ বলল‚ “ওদের হোস্টেলের নিয়ম বেশ কঠোর।”

মাধুরী বললেন‚ “তাহলে ওকে পৌঁছে দিয়ে আসিস। রাত হয়েছে তো।”

খাবার মুখে নিয়েই অর্পণ বলল‚ “হ্যাঁ জেঠিমা।”

ইরাকে উদ্দেশ্য করে ফিরোজা বললেন‚ “এখন তো বাড়ি চিনেছই৷ মাঝে মাঝেই আমাদের বাড়িতে চলে আসবে। কেমন?”

বিনিময়ে সৌজন্যমূলক হাসল ইরা। ভূমির তার পাতে আরও কিছুটা তরকারি দিল৷ কিছুটা তাড়াহুড়োর মাঝেই গোরুর গোশত রান্না করা হয়েছে৷ ফিরোজা নিজের হাতে রান্না করেছেন। ভূমি পূর্ণতাকে জিজ্ঞেস করল‚

“পূর্ণ আপু তোমাকে কী আরেকটু তরকারি দেব?”

“না ভাবিমণি। আমার পেট ভরে গিয়েছে৷”

ভূমি এবার পুষ্পিতাকেও একই কথা জিজ্ঞেস করল। পুষ্পিতার আরেকটু লাগবে। তাকে তরকারি দিল৷ প্রলয় তাকাল ভূমির দিকে৷ গম্ভীর স্বরে বলল‚

“তোমার কী খাওয়ার ইচ্ছে নেই?”

“আমি পরে…”

আর কিছু বলতে পারল না ভূমি। তার আগেই তাকে থামিয়ে প্রলয় বলল‚ “নো মোর ওয়ার্ডস৷ চুপচাপ খেতে বোসো।”

খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই যে যার ঘরে চলে গিয়েছে। অর্পণ ইরাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আসতে গিয়েছে। এঁটো বাসনগুলো রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে রাখছে ভূমি আর সাবিনা। তাকে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন ফিরোজা। সাবিনাকে প্লেটগুলো ধুয়ে রাখতে বলে তিনি বৈঠকখানায় গেলেন। মাধুরী সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷ এতক্ষণে হয়তো ঘরে চলে যেতেন কিন্তু ফিরোজা বললেন উনার কী যেন বলার আছে! তাই তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

ফিরোজাকে বৈঠকখানায় আসতে দেখে মাধুরী জিজ্ঞেস করলেন‚ “কী যেন বলতে চাইছিলিস?”

কোনো রকমের ভণিতা ছাড়াই ফিরোজা বললেন‚ “ভূমির সঙ্গে এমন করে কথা বলছ কেন ভাবি?”

“কেমন করে কথা বললাম?”

“তোমার এমন ব্যবহারে মেয়েটা কষ্ট পায়। হয়তো প্রকাশ করে না তবে কষ্ট পায় তো৷”

একটু থেকে পুনর্বার ফিরোজা বললেন‚ “তুমি তো ওকে মেনেই নিয়েছ তাহলে হঠাৎ কী হলো তোমার?”

তাচ্ছিল্য করে হেসে মাধুরী বললেন‚ “মেনে নিয়েছি?”

অবাক হলেন ফিরোজা৷ মুখে বললেন‚ “হ্যাঁ!”

“মেনে নিইনি— মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি৷ ওই মেয়ের ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে এখনো অনেক সত্যিই অজানা রয়ে গিয়েছে৷”

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here