রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪৭| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
622

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪৭|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

একটা অতীত— একটা সত্যি ভূমির জীবনটাকেই পালটে দিয়েছে৷ বাবা থাকতেও ছোটো থেকে অনাথের মতো বড়ো হয়েছে। কতশত অপ্রতুলতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে! এমনও দিন গিয়েছে‚ ঘর খাবার ছিল না৷ শুকনো চিড়ামুড়ি খেয়ে রাত কাটিয়েছে মা মেয়েতে মিলে৷ পান করার মতো পানিটা পর্যন্ত কেউ দিতে চাইত না। সকলের লাঞ্ছনা নীরবে সহ্য করেছে৷ মণিকে ছাড়া তার আর কোনো বন্ধু ছিল না। স্কুলে কেউ তেমন মিশত না। সকলে জা’রজ জা’রজ বলে দূরে সরিয়ে দিত। তার আজও মনে পড়ে। গ্রামে আজিজ মাস্টারের মেয়ের বিয়ে ছিল। জামাল কাকাদের পাশের বাড়িটাই তাদের৷ ভূমি কখনো বিয়ে বাড়িতে যায়নি। বিয়ে বাড়ির পরিবেশ কেমন হয় জানা নেই তার! খুব ইচ্ছে হয়েছিল বিয়ে বাড়ি দেখার। কৌতূহল চাপিয়ে রাখতে না পেরে আম্মাকে না জানিয়েই চলে গিয়েছিল আজিজ মাস্টারের বাড়িতে। গ্রামবাসী অনেকই নিমন্ত্রিত ছিল সেখানেই। তাকে দেখা মাত্রই সেদিন তেড়ে এসেছিলেন রমিজা। প্রতিবেশী হবার দরুন তিনিও নিমন্ত্রিত ছিলেন৷ সেদিন কম অপমান করেননি তিনি। হাভাতে গোগ্রাসে গিলতে এসেছে এমন কথাও শুনতে হয়েছিল তাকে৷ বাকিরা মজা লুটছিল। মহুয়া এসব ব্যাপারে কিছুই জানতেন না৷ সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ছুটে এসেছিল ভূমি। আজও মনে পড়লে তার ভীষণ কান্না পায়। আঠারো বছর বয়সে কম কথা শুনতে হয়নি তাকে। আম্মাকেও কম কথা শুনতে হয়নি। আর এই সবকিছুর জন্য শুধুমাত্র একটা মানুষ দায়ী। এ জীবনে কখনো সেই মানুষটাকে সে ক্ষমা করবে না। বাবারা বুঝি এমনও হয়? নিজের সন্তানকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই মে’রে ফেলতে চায়? ঘৃণায় জর্জরিত হলো অঙ্গনার কোমল হৃদয়।

মহুয়ার কাছ থেকে সত্যিটা শোনার পর নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না ভূমি। আম্মার চোখমুখের দিকে তাকাতে পারছিল না সে৷ খুব করে উপলব্ধি করছিল মহুয়া কাঁদছেন। আম্মার ক্রন্দনরত মুখটা কী করে দেখবে সে? দৌঁড়ে সেখান থেকে প্রস্থান নিয়েছিল ভূমি। ঘরের দরজা চাপিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল৷ নিজেকে ঘৃণা হচ্ছিল খুব৷ শুধুমাত্র তার জন্য তার আম্মার জীবনটা এতটা কষ্টের। সে যদি এই নিকৃষ্ট পৃথিবীতে না আসত তাহলে তার আম্মাকে জীবন নামক লড়াইয়ে নামতে হত না৷ আর না মানুষের কটু কথা নীরবে হজম করতে হত। খুব কাঁদছে ভূমি। বারবার নিজেকে দেখছে আর ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নিচ্ছে৷ চোখমুখ ফুলে লাল হয়ে গিয়েছে। এরই মাঝে ঘরে এসে ভূমিকে এভাবে কাঁদতে দেখে ঘাবড়ে গেল প্রলয়৷ দ্রুত পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল। ভূমি নিজে থেকে জড়িয়ে ধরেছে প্রলয়কে। অর্ধাঙ্গিনীর এহেন কাণ্ডে অবাক হলো প্রলয়৷ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল‚

“এভাবে কাঁদছ কেন? কেউ তোমাকে কিছু বলেছে?”

কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গিয়েছে। চোখমুখ ফুলে লাল টমেটো হয়ে গিয়েছে৷ নিজের বক্ষঃস্থল থেকে ভূমির মুখখানা তুলল প্রলয়৷ মেয়েটার হঠাৎ কী হলো? কেন এত কাঁদছে? বুঝতে পারছে না প্রলয়৷ কিছুই বলছে না ভূমি৷ এমনকি চোখের দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। ভূমির মাথা ঘুরছে৷ দেহে বিন্দুপরিমাণ শক্তি অবশিষ্ট নেই। ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীরটা৷ প্রলয় আবার জিজ্ঞেস করল‚

“কেন কাঁদছ ভূমি কন্যা? কেউ তোমাকে কিছু বলেছে? আমাকে বল! তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে?”

ভূমি মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না৷ অথচ তার অনেক কিছু বলার ছিল। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে— ‘কেন তার আম্মার সাথে এত বড়ো অন্যায়টা হলো? কেন তাকে সমাজের কাছে জা’রজ সন্তান হিসেবে পরিচিত হতে হলো? কী অন্যায় ছিল তার আম্মার? কী অন্যায় ছিল সেই অনাগত বাচ্চাটার? জন্মের আগেই কেন পরিচয়হীন হতে হলো?’ আবারও কাঁদতে শুরু করল ভূমি। প্রলয় আরও ঘাবড়ে গেল। বেশি কাঁদলে তো মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যাবে৷ বাড়ি ভরতি মেহমান৷ ভূমিকে নিজের সঙ্গে জাপ্টে নিল৷ মেয়েটাকে এভাবে কাঁদতে দেখে প্রলয়ের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। যদি এমন হত‚ প্রেয়সীর হৃদয় হতে সকল বিষণ্ণতা গ্লানি নিংড়ে নিতে পারত। ভূমির মাথাটা বুকে আগলে নিল প্রলয়৷ মেয়েটার কান্নার বেগ কিছুটা কমেছে৷ কেমন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে হাতে বাঁধন। ভূমির মুখটা তুলতেই প্রলয় বুঝতে পারল মেয়েটা অচৈতন্য হয়ে পড়েছে৷ আলগোছে পাঁজোকোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল সে। ঘুমের ঘোরেও হেঁচকি তুলছে। হুট করে কী হলো ভূমির? কেন এভাবে কাঁদছিল? জ্ঞান ফিরুক তখনই জানতে চাইবে। ভূমির চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে প্রলয়৷

বিকেলে…

ছাদে নাচের রিহার্সাল হচ্ছে৷ পূর্ণতা পুষ্পিতার পরশু থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা। তারা আপাতত এসবে নেই। কেউ তাদের জোরও করেনি৷ বেচারিদের তো দম ফেলারও সময় নেই। অর্পণ আর ইরা একটা গানে নাচবে৷ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল। আরশ‚ রাফি‚ লাম আর লামিয়া গ্রুপ ডান্স করবে। দুটো দল ভাগ হয়ে গিয়েছে৷ কাপল ডান্স করবে অর্পণ ইরা৷ রোমান্টিক হিন্দি গানে নাচছে দুজনে৷ অর্পণের তালে তাল মেলাচ্ছে ইরা৷ কিন্তু হঠাৎ করেই একটা স্টেপ ভুল করে বসে সে৷ পড়ে যেতে নিলে অর্পণ তাকে ধরে ফেলল। ইরাকে রাগানোর জন্য টিপ্পনী কে’টে বলল‚

“নাচ না জানলে উঠোন বাঁকা।”

“আপনি চুপ থাকুন। আপনাদের ছাদ ভালো না৷ তাই আমি নাচতে পারছি না৷”

“এখন তো এই কথা বলবেই।”

ভেংচি কাটল ইরা। এবার আর মজা নয়। অর্পণ গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “এই গানে তুমি কমফোর্টেবল তো?”

হাই তুলে ইরা বলল‚ “হুম কমফোর্টেবল।”

টাইম ব্রেক চলছে৷ হাঁপিয়ে উঠেছে ওরা৷ কাল সন্ধেবেলায় রিসেপশন৷ হাতে এখনো অনেক সময় রয়েছে৷ মোট চারটা গানে নাচবে ওরা সকলে৷ বেশ মজা করছে ওরা৷ রাতে ছাদে ছোটো করে মেহেন্দির আয়োজন করবে ছোটোরা মিলে৷ বোতলে করে পানি খাচ্ছে ইরা৷ আরশ তার পাশেই বসে রয়েছে। রাফি অর্পণকে জিজ্ঞেস করল‚

“আচ্ছা আমরা সবাই এখানে রয়েছি কিন্তু বর বউ কোথায়? ওদের কোনো পারফরম্যান্স নেই?”

জবাবে অর্পণ বলল‚ “তোরা তো জানিসই‚ ভাই এসব পছন্দ করে না।”

বেজায় বিরক্ত হলো রাফি। প্রলয়কে তার পানসে মনে হয়৷ কোনো রসকষ নেই এর মাঝে। রাফি বলল‚ “ভাই প্রচন্ড নিরামিষ। নিজের বিয়েতে অন্তত একটা রোমান্টিক পারফরম্যান্স দেওয়া উচিত।”

“আরে ইয়ার‚ এসব কথা প্রলয় ভাইয়াকে বলা আর কলাগাছকে বলা একই কথা।”

আরশের কথায় সকলে হেসে উঠলে একত্রে৷ কিছুক্ষণ ব্রেক নিয়ে ওরা আবারও রিহার্সাল করায় মনোযোগী হলো। সন্ধ্যের পর আরও কাজ রয়েছে৷

চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘরে ক্রমাগত পায়চারি করছেন মহুয়া। মেয়ের জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছে উনার৷ তখন ওভাবে ছুটে গিয়েছিল এরপর আর দেখা হয়নি। এখন বিকেল হতে চলল। কই মায়ের কাছে তো একটিবারও এলো না৷ মহুয়া ভাবলেন একবার ভূমির ঘরে যাবেন। মেহরাব শিকদার এখনো ভূমির আসল পরিচয় জানেননি এ ব্যাপার অবগত মহুয়া৷ তবে কতক্ষণ সত্যিটা আড়াল থাকবে? মেহরাব শিকদার তো ঠিকই সত্যিটা জেনে যাবে? তখন কী হবে? ভূমির কোনো ক্ষতি করবে না তো লোকটা? এই নিয়েই চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন মহুয়া৷ লোকটার ভয়ঙ্কর কিছু সত্যি একমাত্র তিনিই জানেন। এ ব্যাপারে ভূমিকেও তিনি কিছু জানাননি৷ মেহরাব শিকদার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ আতঙ্কিত তা তিনি সেদিন রাতেই বুঝতে পেরেছিলেন। বাকি সত্যিগুলোও ভূমিকে জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। মহুয়ার পায়চারি করার মাঝেই নাজমা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন। মহুয়াকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলেন‚

“তুমি এভাবে পায়চারি করছ কেন মহুয়া?”

নাজমাকে পেয়ে মনে কিছুটা সাহস সঞ্চার হলো। পদচারণ থেমে গেল মহুয়ার৷ তিনি নাজমার কাছে এগিয়ে গেলেন৷ বাহিরে একটিবার ভালো করে দেখে নাজমাকে বিছানায় বসিয়ে বলল‚

“ভাবি আমার মেয়েটা যে সমস্ত সত্যি জেনে গিয়েছে। ও নিজেকে কী করে সামলাবে? যে বাবা তাকে গ্রহণ করেনি ভাগ্যের পরিহাসে তাদেরই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে সে৷ এসব কিছু কী করে সহ্য করবে?”

“সত্যি কখনো চাপা পড়ে থাকে না মহুয়া৷ একদিন না একদিন সবাই এই সত্যিটা জানবে। তাই অহেতুক চিন্তা কোরো না।”

“তবুও আমার খুব ভয় করে ভাবি। সত্যিটা যেদিন সবাই জানতে পারবে সেদিন কী আমার মেয়েটাকে সবাই মেনে নেবে? আজকাল আমার ভীষণ ভয় হয়। মেয়েটাকে সামলানোর জন্য কী আমি থাকব?”

“এসব কী ধরনের কথা? থাকবে না মানে কী?”

“আমার জীবনটা এখন অনিশ্চিত। তবে আমার মেয়েটাকে একজন দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন ছেলের হাতে তুলে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত।”

সন্ধ্যেবেলা…

তিমিরাচ্ছন্ন অন্তরিক্ষে ক্ষণে ক্ষণে মেঘ গর্জে উঠছে৷ ছাদে মেহেন্দির আয়োজন করা আপাতত স্থগিত। আবহাওয়ার অবস্থা ভালো না৷ যেকোনো সময় মেঘ আসতে পারে৷ তবে সবটাই অনিশ্চিত। উপরতলায় একটা ঘরে ভূমিকে মেহেন্দি লাগিয়ে দিচ্ছে ইরা আর লামিয়া৷ প্রলয়ও রয়েছে ওদের সকলের সঙ্গে। সেখানে গান-বাজনা খানাপিনারও আয়োজন হয়েছে৷ তখন জ্ঞান ফেরার পর প্রলয়কে কিছুই বলেনি ভূমি৷ এখনো মুখ ভার করে রয়েছে। কিছু একটা ব্যাপার তো ঘটেছেই যা মেয়েটাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। অল্প সময়ের জন্য পূর্ণতা পুষ্পিতাও সেখানে উপস্থিত হয়েছে৷ সারাদিন তো অনেক পড়াশোনা করেছে৷ এবার একটু সকলের সঙ্গে সময় কাটানো প্রয়োজন। এদিকে ভূমিকে একনজর দেখতে উপরে যাচ্ছিলেন মহুয়া৷ সেই দুপুরের পর থেকে আর বের হয়নি। দুপুরের খাবার নাকি ঘরেই খেয়েছিল। তারউপর উনার সঙ্গেও তো দেখা করেনি মেয়েটা৷ ভূমির ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন মহুয়া। তখনই দেখতে পেলেন অর্পণ এদিকেই আসছে৷ হয়তো নিচে যাবে। তিনি একদৃষ্টে অর্পণের দিকে তাকিয়ে রইলেন৷ এ বাড়ির ছেলেমেয়ে গুলো বড্ড ভালো৷ ভূমিকে অল্প সময়েই আপন করে নিয়েছে। আর অর্পণ তো ভূমিরই ভাই৷ হোক তারা দুই মায়ের৷ কিন্তু ভাইবোন তো! বাবা তো একজনই। ভাগ্যের কী পরিহাস? দুটো ভাইবোন ঠিকই মিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। মহুয়াকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚

“কিছু বলবেন আন্টি?”

অর্পণকে উনার খুবই পরিপক্ব এবং দায়িত্বশীল মনে হয়েছে এই অল্প সময়েই৷ নিজের উপর কিছুটা আস্থা রেখে তিনি বললেন‚ “আমাকে একটা কথা দিতে পারবে বাবা?”

অবাক হয়ে অর্পণ বলল‚ “কী কথা?”

কিছুটা সময় নিয়ে মহুয়া মনে মনে নিজের কথাটা সাজিয়ে নিলেন৷ একটিবার শুকনো ঢোক গিলে বললেন‚

“আমার মেয়েটাকে ছোটো বোনের মতো করে সবসময় আগলে রেখ। সংসার আর সমাজের মারপ্যাঁচ ও বোঝে না৷ কোনো ভুলচুক হলেও ওর পাশে থেক।”

অর্পণ বুঝতে পারল না হুট করে এমন কথা বলার মানে৷ উত্তরের আশায় চেয়ে রইলেন মহুয়া৷ অর্পণ উনাকে আশ্বাস দিয়ে বলল‚

“ভূমিকে আমি আমার বোনই মনে করি৷ ঠিক যেমনটা পূর্ণতা পুষ্পিতা। আমি সবসময় বড়ো ভাইয়ের মতো ওর পাশে থাকব প্রত্যেকটা মুহূর্তে। আমি চিন্তা করবেন না।”

মহুয়া বিরবির করে বললেন‚ “ও তো তোমার বোনই।”

বিরবির করতে থাকা কথাটা শুনতে পেল না অর্পণ। তবুও জিজ্ঞেস করল‚ “কিছু বললেন আন্টি?”

“কিছু না বাবা। তোমার কথা শুনে খুবই নিশ্চিন্ত আমি।”

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here