রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪৯| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
639

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪৯|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

ভূমিকে পার্লারের মেয়েরা সাজিয়ে দিয়েছে৷ ভ্রু প্লাক না করলে নাকি সাজ সুন্দর হবে না৷ পার্লারের মেয়েটা অনেকবার বলেছে ভ্রু প্লাক করার জন্য৷ কিন্তু ভূমি নিজের সিদ্ধান্তে অত্যন্ত কঠোর। সে ভ্রু প্লাক করবে না মানে করবে না৷ ইরা‚ লামিয়া অনেকবার রাজি করানোর চেষ্টা করেছিল৷ এরপর প্রলয়ও স্ট্রিক্টলি বারণ করে দিয়েছে৷ তারপর আর কেউই জোর করেনি৷ ভূমিকে সুন্দর করে সাজিয়ে হিজাব করিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ লেহেঙ্গার সঙ্গে ম্যাচিং করে হিজাব আনা হয়েছিল। হাতের চিকন চুড়ি আর মোটা কঙ্কণ পড়ানো হয়েছে৷ কঙ্কণ জোড়া এ বাড়িতে আসার পর থেকে হাতে পড়ে রয়েছে সে৷ কিছুক্ষণ আগেই মাধুরী কিছু গহনা দিয়ে গিয়েছেন। এগুলো প্রলয়ের বউয়ের জন্যই বানানো হয়েছিল৷ সবগুলো খুব যত্নসহকারে ভূমিকে পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ আজকের জন্য পূর্ণতা পুষ্পিতা পড়াশোনা থেকে ছুটি পেয়েছে। সকালে সব পড়ে রেখেছে যাতে করে কাল পরীক্ষায় কোন সমস্যা না হয়। কাজিনমহলে প্ল্যান ছিল মেয়েরা শাড়ি আর ছেলেরা পাঞ্জাবি করবে।

“তুমি এখানে বসে থাক! আমি ঝটপট তৈরি হয়ে আসি। নয়তো পরে আর সময় হবে না।”

ঘাড় কাত করে সায় জানাল ভূমি। ইরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ আয়নার সামনে বসে রয়েছে ভূমি। নিজেকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে৷ বেশি মেকআপ করানো হয়নি। হালকার মাঝেই অপরূপা লাগছে। হাতের মেহেন্দি বেশ গাঢ় রং হয়েছে৷ সবাই খুব বলছিল‚ ‘হাতের মেহেন্দির রং গাঢ় হলে না স্বামী আদর করে’ কথাটা যতবার শুনেছে ততবারই লজ্জায় লাল নীল হয়েছে সে। বাকিরা একটু বেশিই লজ্জা দিচ্ছে তাকে৷ সমস্ত মনখারাপ দূর করে ভূমি নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে৷ আম্মাকে দেওয়া কথা সে অবশ্যই রাখবে৷ এমন কোনো দিনও হয়নি যে‚ সে তার আম্মার কথা কোনো দিন অমান্য করেছে৷ তবে এই কথাটা কী করে অমান্য করবে? আম্মা যে নিজের কসম দিয়েছেন৷ যতই কষ্ট হোক অতীতকে সে কিছুতেই নিজের বর্তমানে আসতে দেবে না। এরই মাঝে শেরওয়ানির হাত গুটাতে ঘরে প্রবেশ করল প্রলয়৷ আয়নায় সামনে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত নারীকে দেখে হৃৎস্পন্দন যেন সেখানেই থেমে গেল। থেমে গেল কয়েক লহমা। অত্যন্ত ধীর পায়ে ভূমির সমীপে এগিয়ে গেল প্রলয়। চোখের সামনে যেন পুতুল বউ বসে রয়েছে। প্রলয়ের উপস্থিত বুঝতে পেরে সেই পুতুল বউয়ের চোখের ঘন পাপড়ি কেঁপে উঠল৷ বার কয়েক পলকও ফেলল। সময় অতিবাহিত হবার সঙ্গে প্রলয় এগিয়ে গেল তার অর্ধাঙ্গিনীর সমীপবর্তী। কারো হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ শুনতে পেল প্রলয়৷ মস্তিষ্ক ফাঁকা মনে হচ্ছে৷ সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে নিজের কাছে৷ শুকনো ঢোক গিয়ে গলা পরিষ্কার করে প্রলয় বলল‚

“আমাকে কী মে’রে ফেলার চিন্তা করছ?”

প্রলয়ের কথা কিছুই বুঝল না ভূমি৷ লোকটার মাথা কী খারাপ হয়েছে— কীসব উল্টো পাল্টা কথা বলছেন? ভূমি চোখে চোখ রেখে কিছুটা তেজি স্বরে বলল‚

“কীসব উল্টো পাল্টা কথা বলছেন আপনি?”

প্রলয় নিজের বুকে হাত রেখে চোখের চশমা ঠিক করে বলল‚ “ভূমি কন্যার এমন জ্বালাময়ী রূপ দেখে আমার ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে৷ নির্লজ্জ অনুভূতি গুলো বারবার উঁকি দিচ্ছে৷”

কণ্ঠস্বরে উন্মত্ততা। ভূমি চোখ ফিরিয়ে নিল৷ ওই দুচোখে তাকিয়ে থাকা বড়ো কঠিন৷ নে’শা ধরে যায়৷ আস’ক্তি কাজ করে৷ প্রলয় এগিয়ে এসে প্রেয়সীর ললাটে সিক্ত পরশ এঁকে দেয়৷

সবে ভূমির ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে ইরা৷ এতক্ষণ ভূমির সঙ্গে সঙ্গেই ছিল সে৷ সকালে মায়ের কাছ থেকে নীল কাতান শাড়ি নিয়ে এসেছিল পড়ার জন্য। বিছানার উপর শাড়ি‚ অর্নামেন্টস আর মেকআপ করার যাবতীয় সবকিছুই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ইরা দরজা আটকাবে তার আগেই অর্পণ এসে সামনে দাঁড়াল। হুট করে তাকে দেখে খুব অবাক হলো ইরা। অর্পণের হাতে একটা শপিং ব্যাগ। ভেতরে কী আছে জানা নেই ইরার! দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইরার দিকে এগিয়ে দিল অর্পণ। ইরা জিজ্ঞেস করল‚

“এটাতে কী আছে?”

“আমি বলব কেন? তুমি নিজেই খুলে দেখে নিয়ো।”

অর্পণের সামনেই পার্সেল খুলল ইরা৷ ভেতরে লাল পাড়ের কালো জামদানী শাড়ি রয়েছে৷ শাড়িটা চোখ ধাধানো সুন্দর। এক দেখেতেই পছন্দ হওয়ার মতো শাড়িটা৷ মনে মনে খুবই খুশি হলো ইরা৷ অর্পণের পক্ষ থেকে এটাই প্রথম গিফট৷ খুশিতে চোখমুখ চিকচিক করছে ইরার৷ পরক্ষণেই ভুরুদ্বয় কুঁচকে অর্পণকে জিজ্ঞেস করল‚

“হঠাৎ শাড়ি গিফট করছেন ব্যাপার কী?”

“কেন আমি কী কিছু গিফট করতে পারি না? এমনিতেই এই শাড়িটা পছন্দ হয়েছিল তাই অর্ডার করে দিয়েছিলাম। তোমার পছন্দ না হলে‚ দাও আমি ফেরত দিয়ে দেব।”

অর্পণ শাড়িটা নিতে নিলে ইরা চট করে হাত সরিয়ে ফেলল। পছন্দের শাড়িটা সে কিছুতেই হাতছাড়া করবে না৷ তাও আবার অর্পণের দেওয়া। ইরা ভেংচি কেটে অর্পণকে বলল‚

“আপনার সাহস তো কম না! আমার শাড়ি ফেরত দেবেন— আমার শাড়ি?”

“তাহলে আজ তুমি এই শাড়িটা পড়বে। কেমন?”

“হুম পড়ব! আপনি এখন আসতে পারেন।”

চোখ ছোটো ছোটো করে অর্পণ বলল‚ “কাজের বেলায় কাজি— কাজ ফুরোলেই পাজি!”

“কীসের মধ্যে কী বলছেন? নিজে তো সেজেগুজে তৈরি। আমি রেডি হব না? নাকি এই কদাকার অবস্থাতেই বাহিরে যাব?”

“সেটা আগে বলবে তো। আমি যাচ্ছি ম্যাডাম। তুমি তাড়াতাড়ি সাজুগুজু করে এসো।”

“আপনি বের হন আগে ডাক্তার সাহেব।”

অর্পণ বের হয়ে যেতেই ইরা দরজা আটকে দিল। বাকিরা সবাই সেজেগুজে তৈরি। শুধুমাত্র সে-ই লেট লতিফা। ইরা শাড়ি পড়তে পারে। তাই একা তৈরি হতে তার কোনো অসুবিধে হবে না। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে তৈরি হতে শুরু করল ইরা। যাওয়ার আগে অর্পণ তাকে দুটো লাল গোলাপ দিয়ে গিয়েছে। সেই ফুলগুলোই আজ খোপায় লাগাবে।

পুরো বাগান জুড়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। মালঞ্চ নীড় সেজে উঠেছে রঙিন বাহারী মরিচ বাতিতে। বাগানে স্টেজ সাজানো হয়েছে৷ গোলাপ‚ চন্দ্রমল্লিকা‚ রজনীগন্ধা দিয়ে ডেকোরেশন করা হয়েছে সবকিছু। বাগানের ছোটো ছোটো গাছগুলোর উপরও মরিচ বাতি দেওয়া হয়েছে।

কলেজ জীবনে প্রলয়ের মাত্র তিনজন বন্ধু ছিল৷ যারা তার খুব কাছের। অনার্স পড়াকালীন সময়ও ওরাই তার প্রিয় বন্ধুদের তালিকায় ছিল৷ ভাগ্য সহায় ছিল তার চারজন একই ভার্সিটির একই ডিপার্টমেন্টে চান্স পেয়েছিল৷ এখন জাহিদ‚ নাঈম আর মুশফিকা তিনজনই ঢাকার বাহিরে সেটেল্ড। তিনজনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তারা তাদের পরিবার নিয়েই এসেছে আজ৷ মুশফিকাকে সবসময় মুশফিক ভাই বলে ডাকত প্রলয়। এ নিয়ে জাহিদ আর নাঈম কম মজা উড়াত না। প্রলয়ের দেখাদেখি ক্লাসের বাকি সহপাঠীরাও মাঝে মাঝে মজা করে মুশফিক ভাই বলে ডাকত। রাগে গাল ফুলিয়ে রাখত মুশফিকা। সেই জন্য রাগাতেও বেশ ভালোই লাগত৷ মুশফিকা এখন চট্টগ্রাম থাকছে৷ স্বামী সন্তান নিয়ে বেশ আছে৷ জাহিদ আর নাঈমেরও বিয়ে হয়েছে৷ নিজেদের স্ত্রীকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তারা৷ বন্ধুদের মাঝে এতদিন শুধুমাত্র প্রলয়ই সিঙ্গেল ছিল৷ এখন তো সিঙ্গেল তকমাটাও মুছে গেল। বিয়ে করার কথা বলতেই যে ছেলেটা নাক সিটকাত সেই ছেলেটাই হুট করে একদম অচেনা একটা মেয়েটা বিয়ে করে আনল। ব্যাপাটা শুনে ওরাও বেশ অবাক হয়েছিল। তবে ‘জন্ম মৃ’ত্যু বিয়ে’ তিনটাই আল্লাহ নিজে ঠিক করে রাখেন। এতে তো আর মানুষের কোনো হাত নেই। মেহমানদের আপ্যায়নের জন্য সমস্ত আয়োজন আগে থেকেই করে রাখা হয়েছে। নতুন বর বউ একে অপরের হাত ধরে হেঁটে আসছে স্টেজের কাছে। প্রলয় তখনও তার বন্ধুদের দেখেনি। সে তো বিভোর হয়ে আছে তার ভূমি কন্যাতে৷ মেরুন রঙা লেহেঙ্গায় দারুণ মানিয়েছে তার অঙ্গনাকে। গৌর অঙ্গে ফুটে উঠেছে যেন। বুক ধুকপুক করছে৷ নিগড় ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে ক্রমশ। এ রূপে তো কখনো দেখেনি। সে মনে করে এরকম জ্বালাময়ী রূপ শুধুমাত্র তার অর্ধাঙ্গিনীরই রয়েছে৷ প্রেয়সীর রূপের আগুনে সে নিজেকে বারবার ঝলসাতেও রাজি। উপস্থিত সকলের দৃষ্টি কেড়েছে এই ❝প্রলমি❞ জুটি৷

প্রলয়ের বন্ধুরা এবং তাদের পার্টনাররা সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ তাদের হাতে কোল্ড ড্রিংকস। প্রলয় ভূমিকে ওদের কাছেই গেল। ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য৷ বন্ধুদের সঙ্গে অনেকদিন পরেই দেখা হচ্ছে তার। এমনিতে কথা হয়। প্রলয়কে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরল জাহিদ৷ তারপর পিঠে চাপড় মে’রে বলল‚

“কী রে মামা বিয়ে করে বন্ধুদের ভুলে গেলি?”

“তোদের ভূলে গেলাম কখন? কাল বিকেলেও না আমাদের কথা হলো?”

প্রলয়ের কথা দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠল জাহিদ৷

ভূমিকে বেশ বিজ্ঞ দৃষ্টিতে হা করে তাকিয়ে রয়েছে মুশফিকা সহ বাকি দুজন অর্থাৎ জাহিদ আর নাঈমের স্ত্রীগন৷ অনেকের নজরই এখন ভূমির দিকে। এদিকে মুশফিকাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রলয় বলল‚

“কম দেখ! নজর লাগিয়ে দিবি নাকি?”

“এত সুন্দরী বউ কোথায় পেলি কালাচাঁন?”

“বলব না। তার আগে তুই আমাকে কালাচাঁন বলা বন্ধ কর৷ সেই কলেজ লাইফ থেকে বলে আসছিস। হাঁপিয়ে যাস না?”

“না রে। তোকে কালাচাঁন বললে এনার্জি আরও বাড়ে৷”

“বউয়ের সামনে অন্তত অফ যা। প্রেস্টিজ আর রাখলি না আমার।”

এরই মাঝে রিফাত‚ জাহিদ আর নাঈমও এখানে চলে এসেছে৷ মুশফিকা আর প্রলয়ের কথা মাঝে নাঈম ফোড়ন কে’টে বলল‚

“বউয়ের সামনে আবার প্রেস্টিজ কীসের? যা হবে সব খুল্লাম খুল্লা হবে।”

ভূমি মাথা নিচু করে রেখেছে ভূমি। কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে৷ প্রলয় মৃদু ধমকে নাঈমকে বলল‚ “চুপ থাক বেশরম।”

“ওহ! এখন আমরা বেশরম হয়ে গিয়েছি? আপনি ধোয়া তুলসি পাতা!”

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here