রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫৫| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
622

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫৫|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

ঝিরিঝির বৃষ্টি পড়ছে। মৃদুমন্দ বাতাসের দাপটে সেই বৃষ্টির কণা বারান্দা এবং জানালার রেলিং ভেদ করে লুটোপুটি খাচ্ছে ছোটো ছোটো ফুলের সফেদ মেঝেতে। আজ হসপিটালে যাননি মেহরাব শিকদার। হুট করেই শরীরটা সকাল থেকে খারাপ লাগছে। প্রেসার বেড়েছে অনেকটা। স্বামীর অসুস্থ শরীর নিয়ে চিন্তায় ভুগছেন ফিরোজা। সকাল থেকেই সেবা যত্নে লেগে পড়েছেন তিনি। মেহরাব শিকদারকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছেন কী নিয়ে এত চিন্তা করছেন তিনি! কিন্তু কিছুতেই জবাব মিলল না। অর্পণ নিজেই তার বাবার জন্য ঔষধ আর কিছু ফল কিনে দিয়ে গেছিল৷ হসপিটালে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল‚ “ডক্টর হয়ে কী করে নিজের শরীরে এতটা ক্ষতি করতে পারো? তুমি ঠিক কী নিয়ে এত টেনশন করছ আমি জানি না! তবে নিজের শরীরের খেয়াল রাখতে হবে। অন্তত আমার এবং মায়ের জন্য। এই ফলগুলো টাইম টু টাইম খাবে। আর মা যা রান্না করে দেবে চুপটি করে সেটাই খেয়ে নেবে৷” ছেলের কথা কিছুতেই ফেলতে পারলেন না তিনি। দুপুরে মেহরাব শিকদারের জন্য হালকা মসলা জাতীয় খাবার রান্না করেছিলেন ফিরোজা। ফুলকপি‚ টমেটো‚ মটরশুঁটি দিয়ে সবজি আর ছোটো মাছ দিয়ে পালংশাক রান্না করেছিলেন। গরম ভাতের সঙ্গে দুই টুকরো লেবু আর শসাও দেওয়া হয়েছিল৷ তারপর খাওয়া শেষে অর্পণের কিনে আনা কমলা‚ মাল্টা‚ আর নাশপতি খেতে দিয়েছিলেন ফিরোজা। কর্তব্যের খাতিরে একবার দেখা করে গিয়েছিল ভূমি। লোকটার মুখ অবধি দেখতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু অসুস্থ মানুষের উপর রাগ‚ হিংসা বা ঘৃণা দাবিয়ে রাখতে নেই। ঘরে শুয়ে বসে সময়ও কাটছিল না তার। এদিকে ঘুমও আসছিল না। পূর্ণতা পুষ্পিতা দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়েছে। তাই সে ভাবল একবার গুলবাহারের ঘরে যাওয়া যাক। ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এরপর সিঁড়ি ভেঙে নিচতলায় চলে গেল। গুলবাহারের ঘরের দরজার সামনে এসে ভূমি দাঁড়াল। দরজার টোকা দিয়ে বলল‚

“নানিমণি আসব?”

তসবি পড়ছিলেন গুলবাহার৷ সেটা থামিয়ে ভূমিকে ঘরে আসার জন্য ইশারা করলেন। অনুমতি পেয়ে ভূমি উনার ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। গুলবাহার কিছুটা নড়েচড়ে বসলেন। আজ হুট করেই পা আর হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে৷ ভূমি গিয়ে বিছানার সামনে দাঁড়াল। গুলবাহার বিছানায় বসতে বললেন। উনার কথানুযায়ী ভূমি বিছানায় বসল। তসবিখানা বালিশের পাশে রেখে হাঁটুতে হাত রাখলেন। এরপর ভূমিকে জিজ্ঞেস করলেন‚

“হঠাৎ আমার ঘরে? কী দরকার?”

“আসলে নানুমণি ঘরে শুয়ে বসে থাকতে আমার ভালো লাগছিল না৷”

চুপ করে রইলেন গুলবাহার৷ পরপরই ভূমি উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে আবারও বলল‚ “আমি কী আপনার পায়ে মালিশ করে দেব নানুমণি?”

চট করেই গুলবাহার তাকালেন ভূমির দিকে। না বলতেও মেয়েটা কী অবলীলায় বুঝতে পেরে গেল যে‚ উনার পায়ে ব্যথা করছে। মনে মনে খুশি হলেও প্রকাশ করলেন না তিনি। নিজেকে কঠোর ভাবেই উপস্থাপন করলেন। কড়া গলায় বললেন‚

“এত ভাব জমাতে হবে না। আমার মন জয় করা এত সোজা নয়!”

ক্ষীণ স্বরে ভূমি বলল‚ “তেমন কিছুই না নানুমণি। তখন খাবার টেবিলে বসার সময় দেখছিলাম আপনি বারবার হাঁটুতে ধরছিলেন। আর চোখমুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে ছিল৷ আমি ভাবলাম হয়তো আপনার হাঁটুতে ব্যথা।”

এবার কিছুটা নরম হলেন গুলবাহার৷ ব্যাপারটা সহজ করেই মেনে নিলেন। আপস করে নিলেন ভূমির সঙ্গে। মনে মনে ভীষণ খুশি হলো ভূমি। অন্তত গুলবাহার কিছুটা নরম হয়েছেন। একদিন মাধুরীও তাকে আপন করে নেবেন। সম্পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে তার। ভূমি সরিষার তেল হাতে নিয়ে গুলবাহারের পায়ে মালিশ করতে শুরু করল। ভদ্রমহিলা বেশ আরাম পাচ্ছেন। চোখ দুটো মুদে আসছে৷ ঘুম আসছে ভীষণ। এতক্ষণ কি-না ব্যথায় কাতড়াচ্ছিলেন!

গোধূলি বিকেল…

খুব একটা ছাদে ওঠা হয় না ভূমির। সারাক্ষণ ঘরে শুয়ে বসে আর সংসারের কাজেই সময় কাটায় সে৷ এভাবেই দিব্যি চলছে তার। আজ খুব ইচ্ছে হলো ছাদে ওঠার। তবে একা যাওয়ার অনুমতি নেই। প্রলয় তাকে বারণ করেছে একা বাড়ির বাহিরে অথবা ছাদে না উঠতে৷ এখন সময়টা গোধূলি বিকেল৷ পশ্চিমাকাশে প্রকাণ্ড সূর্যটা ক্রমশ নিভন্ত৷ আকাশ এখন একদমই পরিষ্কার। দেখে মনে হচ্ছে না দুপুরে বৃষ্টি হয়েছিল৷ বৃষ্টি থামার সঙ্গে সঙ্গেই রোদ উঁকি দিয়েছিল তখন। ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভূমি৷ ছাদ বাগানের গাছ গুলোর পাতায় পাতায় বৃষ্টির কণা। গাছে অনেক ফুল ফুটেছে৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা বাগান করতে ভালোবাসে। নানান জাতের ফুল গাছ লাগিয়ে রেখেছে৷ একটা বড়ো কাঠগোলাপ গাছ লাগিয়েছে৷ সাদা আর ম্যাজেন্টার সংমিশ্রণে ফুল গুলো খুবই পছন্দের৷ তীব্র সুবাস ছড়ায়৷ পাশেই আরেকটা মাঝারি কাঠগোলাপের গাছ৷ সাদা আর হলুদের সংমিশ্রণে ফুল ফুটেই থাকে সবসময়। এছাড়াও বেলী‚ গোলাপ‚ চন্দ্রমল্লিকা আর নয়নতারা তো রয়েছেই। সেদিন প্রলয়ের প্রতি অভিমান ছিল প্রচণ্ড তাই এসব খেয়ালই করেনি ভূমি৷ দোলনায় বসেই সময় কাটিয়েছিল৷ তবে আজ তার মন একদমই ফুরফুরে। এদিকে ফুলগুলোর ফটোগ্রাফি করছে পূর্ণতা পুষ্পিতা। কাল পরীক্ষা নেই৷ আবার দুদিন পর পরীক্ষা। তাই একটু সময় কাটাতে পারছে৷ পুষ্পিতা মুঠোয় করে অনেকগুলো কাঠগোলাপ ফুল তুলে ভূমির কাছে এলো৷ হলুদ ম্যাজেন্টা দুটোই রয়েছে৷ ফুলগুলো পেয়ে ভূমি খুশি হয়ে গেল৷ অধর কোণে হাসি ফুটে উঠল। এ সুযোগে ভূমির কয়েকটা ছবিও তুলে ফেলেছে পূর্ণতা৷ সে ভালো ছবি তুলতে পারে৷ পুষ্পিতা জিজ্ঞেস করল‚

“ভাবিমণি এই ফুলগুলো তোমার বিনুনিতে লাগিয়ে দিই?”

ভূমি আশেপাশের ছাদ আর জানালাগুলোর দিকে তাকাল। না! কেউই নেই আশেপাশে৷ মাথার উপর থেকে ওড়না সরিয়ে ফেলল ভূমি। পুষ্পিতা তার লম্বা বিনুনিতে ফুলগুলো লাগিয়ে দিল৷ সবটা ভিডিও করেছে পূর্ণতা৷ শেষে কানের পেছনটাতেও একটা ফুল গুঁজে দিল৷ ভূমিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে পূর্ণতা বলল‚

“ভাবিমণি তোমাকে পুরো ফুলপরী লাগছে৷”

প্রত্যুত্তরে ক্ষীণ হাসল ভূমি৷ পুষ্পিতার হাত থেকে দুটো ম্যাজেন্টা রঙের কাঠগোলাপ নিয়ে একটা পূর্ণতার কানের পেছনে তো আরেকটা পুষ্পিতার কানে পেছনে গুঁজে দিল। এরপর দুবোনের গাল টেনে বলল‚

“তোমাদেরও ফুলপরী লাগছে রায়বাঘিনী ননদিনীরা।”

পূর্ণতা এবার জিজ্ঞেস করল‚ “আচ্ছা ভাবিমণি! মা যে তোমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন‚ তোমার কী আমাদের মায়ের উপর রাগ হয় না?”

হাসি থেমে গেল ভূমির। সহসাই চিন্তার ভাজ পড়ল চোখমুখে৷ একটু অপেক্ষা করিয়ে মনে মনে উত্তর সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পূর্ণতা পুষ্পিতা প্রত্যুত্তরের আসায় একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে ভূমির দিকে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ক্ষীণ হেসে ভূমি বলল‚

“উনার মাঝে আমি এমন একজন মাকে দেখতে পাই। যিনি তার সন্তানের খুশির জন্য সবকিছু করতে পারেন। একদম আমার আম্মার মতো। আমি উনার অবস্থা বুঝতে পারি। আমি জানি একদিন উনি আমাকে আপন করে নেবেন৷ ক্ষণে ক্ষণে চোখে হারাবেন।”

যমজ বোন দুটোতে হা করে চেয়ে রয়েছে ভূমির দিকে। তাদের ভাবিমণি যতই শান্তশিষ্ট হোক না কেন! প্রচণ্ড ভালো। তাইতো এই অল্প সময়েই তারা মিশে যেতে পেরেছে। এমনিতে ওরা অচেনা মানুষদের সঙ্গে খুব সহজেই মিশে যেতে পারে না। ভূমির প্রতি তাদের শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। পূর্ণতা পুষ্পিতা এসে জাপ্টে ধরল ভূমিকে৷ দুজনের একসাথেই বলে উঠল‚

“তোমাকে আমাদের বড়ো ভাইয়ার বউ অর্থাৎ ভাবিমণি হিসেবে পেয়ে আমরা সত্যিই খুব খুশি। তুমি খুব ভালো ভাবিমণি।”

মেয়ে দুটোর বাচ্চামোতে হেসে উঠল ভূমি। মনটা খুবই ফুরফুরে লাগছে। ভাগ্যিস ওদের সঙ্গে আজ ছাদে এসেছিল৷ এমন করে মাঝে মাঝে ছাদে আসা প্রয়োজন। ওরা আরও কিছুক্ষণ ছাদেই সময় কাটাল। প্রায় আধ ঘণ্টা পর ছাদ থেকে নেমে গেল পূর্ণতা পুষ্পিতা আর ভূমি৷ মাথায় ওড়না পেঁচালে এত যত্নের ফুলগুলো পড়ে যেতে বা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই মাথায় আর ওড়না পেচাল না ভূমি। সেভাবেই পূর্ণতা পুষ্পিতার সঙ্গে নিচে নেমে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ভূমিকে আগে আগে যেতে দিয়েছিল ওরা দুবোন। পেছন থেকে যেন ভূমির চুলের ভিডিও করে বড়ো ভাইয়াকে পাঠাতে পারে সেই জন্য এমন বুদ্ধি।

ঘরে এসে ফোনের লক খুলে ভূমি দেখতে পেল প্রলয় তাকে অনেকবার কল করেছিল। তখন সে ছাদে ছিল। ফোন সঙ্গে করে নিয়ে যায়নি। হাতে করে ফোনটা বহন করতে ইচ্ছে করে না তার। ভারী ভারী লাগে। এবার ভূমি নিজে থেকে প্রলয়ের নাম্বারে ডায়াল করল। রিং হবার সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দেওয়া হলো। হয়তো প্রলয় ব্যস্ত আছে আর নয়তো কল ব্যাক করবে। হয়েছেও তাই। প্রলয় কল ব্যাক করেছে। সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করল ভূমি। সে কিছু বলবে তার আগেই অপাশ থেকে প্রলয় বলল‚

“কী ব্যাপার বরকে খুব বেশি মিস করছিলে বুঝি? এইতো আর ঘণ্টা খানেক পরেই চলে আসব সোনা।”

প্রলয়ের কথা শুনে মাথায় হাত ভূমির। কোথায় সে মনে করেছিল‚ হয়তো জরুরি কোনো কাজে লোকটা তাকে কল করেছিল৷ কিন্তু হলো তার উল্টো। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ভূমি বলল‚

“আপনি তো আগে এমন ছিলেন না! হঠাৎ করে পাল্টে গেলেন কী করে?”

“কোথায় পাল্টে গেলাম? তোমাকে তো প্রতিদিনই ভালোবাসি।”

“গম্ভীর এমপি মশাই হুট করেই কেমন হয়ে গেল! কেমন দুষ্টু দুষ্টু কথা বলে!”

ফোনের অপরপ্রান্তের ব্যক্তিটি বুকে হাত রাখল। আলহামদুলিল্লাহ! ভূমি কন্যা কথা বলতে শিখছে। সহজ হতে চেষ্টা করছে এটাই অনেক৷ ভূমিকে আরেকটু বাজাতে প্রলয় বলল‚ “তোমার কথা শুনে আমার ভীষণ প্রেম প্রেম পাচ্ছে। কী করা যায় বল তো?”

“দশ হাজার হাত দূরে থাকুন এমপি মশাই।”

“এখন তো দশ ইঞ্চি দূরত্ব সহ্য হচ্ছে না জান।”

“রাখছি। নানুমণি ডাকছেন।”

একপ্রকার মিথ্যে বলেই কল কে’টে দিল ভূমি৷ লোকটা দিনকে দিন লাগাম ছাড়া হয়ে যাচ্ছেন। কোনো কথাই আটকায় না৷ তিনি কী বুঝতে পারছেন না‚ উনার এহেন কথায় অষ্টাদশী কন্যার মনে প্রেমের মাদল বাজছে? উনি কী বুঝতে পারছেন না‚ অষ্টাদশী কন্যার মনে অনুভূতির তীব্র জোয়ার আছড়ে পড়ছে? থম মে’রে বিছানায় বসে পড়ল ভূমি। প্রলয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই লজ্জারা হানা দেয়!

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here