#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৬৩|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষের দিবসপতি ম্লানোন্মুখ। পশ্চিমাকাশের দিকে ক্রমশ হেলে পড়ছে৷ নিজের উত্তপ্ততা কমিয়ে মলিন হয়েছে। মালঞ্চ নীড় ফেরার পর থেকে প্রলয় তার ঘর থেকে বের হয়নি। আর না দুপুরে কিছু খেয়েছে! ফিরোজা একবার খাওয়ার জন্য প্রলয়কে ডেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রলয় তার ঘর থেকে একবারও বের হয়নি। পূর্ণতা পুষ্পিতা দরজার কাছ থেকে ফিরে গিয়েছে কিন্তু ওদের দুজনকে ঘরে ঢুকতে পর্যন্ত দেয়নি প্রলয়। নিজেকে একা কিছুক্ষণ সময় দিতে চাইছে সে। বাড়ি ফেরার পর এখানকার থানার ওসির সঙ্গে কথা হয়েছিল। তারা বলেছে ভূমিকে খোঁজার যথাসম্ভব চেষ্টা করবেন। প্রত্যেকটা থানায় থানায় ভূমির ছবি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই ভূমিকে খোঁজার যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাধুরী এবার প্রলয়ের জন্য প্লেটে করে খাবার নিয়ে এসেছেন। দরজা খোলাই ছিল। তিনি ঘরে ঢুকে খাবারের প্লেটটা বিছানার পাশের টেবিলের উপর রাখলেন। কারণ প্রলয় বিছানার বাঁ পাশে শুয়ে রয়েছে। তিনি তাকে ডাকলেন। প্রথমবার প্রলয়ের কাছ থেকে সাড়া না পেলেও‚ পরেরবার এপাশ ফিরে তাকাল। চোখ মুখ ফুলে রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে কান্না করছিল। ভড়কে গেলেন মাধুরী। শশব্যস্তভাবে ছেলের মাথার কাছে গিয়ে বসলেন। প্রলয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন‚
“তোর কী হয়েছে বাবা? তুই কী কাঁদছিলি?”
গম্ভীর স্বরে প্রলয় জবাব দিল‚ “আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই। প্লিজ তুমি এখন যাও।”
শুনলেন না মাধুরী। একই ভঙ্গিতে বসে রইলেন। আবারও জিজ্ঞেস করলেন‚ “আগে তো তুই এমন ছিলি না! মায়ের সঙ্গে তো অনেক কথাই শেয়ার করতিস। তাহলে এখন তোর কী হয়েছে? বিয়ের পর অনেকটাই বদলে গেছিস তুই! মায়ের সঙ্গে কী মনের কষ্টগুলো শেয়ার করা যায় না?”
প্রলয় কিছুই বলল না৷ একই ভঙ্গিতে শুয়ে রইল৷ মাধুরী সমস্ত রাগ গিয়ে চড়াও হলো ভূমির উপর। তিনি ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন‚
“আমি আগেই জানতাম এই মেয়ের চরিত্র ভালো না। হতে পারে কোন ছেলের সাথে পালিয়েছে। মায়ের স্বভাব যেমন ছিল মেয়ের স্বভাবও তো তেমনই হবে তাইনা?”
মায়ের মুখে ভূমির সম্বন্ধে এমন কথা শুনে প্রলয়ের রাগ হলো। শোয়া থেকে উঠে বসে অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে চিৎকার করে উঠল‚ “তুমি চুপ করবে মা? বাড়িতে আসার পর থেকে দেখছি ভূমির নামে উল্টোপাল্টা কথা বলেই যাচ্ছ। কীসের ভিত্তিতে এসব কথা বলছো তুমি?”
“এখন তো আমার কথা তেঁতোই লাগবে। সত্যি কথা কারোরই ভালো লাগে না। তুই আমার একমাত্র ছেলে। তোকে নিয়ে আমার কত স্বপ্ন ছিল! কিন্তু ওই মেয়েকে বিয়ে করে তুই আমার সব স্বপ্ন শেষ করে দিলি। ভালোই হয়েছে ওই মেয়ে পালিয়েছে। আমি আমার ছেলেকে আবার বিয়ে দেব।”
“তুমি চুপ করবে মা? নাকি আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব? মনে শান্তি নেই তারউপর এখন বাড়িতেও শান্তি নেই। তোমাকে একটা কথা খুব ভালো ভাবে জানিয়ে দিচ্ছি‚ যেখান থেকেই হোক ভূমিকে আমি খুঁজে বের করবই। ওকে আমার চা-ই চাই।”
মুখ ঝামটা দিলেন মাধুরী। কিছুতেই প্রলয়ের মন থেকে ভূমিকে সরাতে পারছেন না তিনি। মেয়েটা কী জাদু করেছে জানা নেই উনার! শুরু থেকেই ভূমিকে তিনি সহ্য করতে পারেন না। ভূমির জন্য ছেলেটা উনার গুমরে গুমরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ছেলের প্রতি তীব্র অভিমান নিয়ে মাধুরী বললেন‚
“মায়ের প্রতি হয়তো তোর অনেক রাগ। কিন্তু মায়ের মন কখনোই তুই বুঝতে পারলি না। হ্যাঁ আমি ভূমিকে দেখতে পারি৷ তার কারণ তো তোর অজানা নয়! তুই আমার একমাত্র ছেলে৷ তোকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল৷ যেটা তুই একমুহূর্তের মধ্যে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিস। এতে আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি তা তুই একবারও জিজ্ঞেস করেছিস? আমার ছেলের কষ্ট আমি তো কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না৷ খাবার রেখে গিয়েছি— খেতে ইচ্ছে হলে খেয়ে নিস!”
এই বলে মাধুরী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন৷ প্রলয় তার মায়ের কথাগুলো ভাবতে শুরু করল৷ ঠিকই তো বলেছেন উনি। বিয়ের পর এই সাড়ে তিনমাস ধরে‚ মায়ের কাছে এসে মন খুলে কথা বলা হয়নি। মায়ের হালচাল জিজ্ঞেস করা হয়নি। কাজে এতটাই ডুবে ছিল যে‚ মায়ের খেয়াল নেওয়া হয়নি তার। মায়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে খারাপ লাগল প্রলয়ের৷ টেবিলের উপর থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে খেতে শুরু করল।
❑
সংকীর্ণ সেই কামরা হতে ডক্টর বেরিয়ে এলেন। ভূমিকে দেখানোর জন্যই পিংকি উনাকে ডেকেছিলেন। ঘরের ভেতরেই সবাই রয়েছে৷ তিথি বসে রয়েছে ভূমির মাথার কাছে৷ তার সেবায় কিছুটা সুস্থ ভূমি৷ দুপুরে জোর করে পেট ভরে খাইয়েছিল৷ না না করতে করতেও শুটকি ভর্তা দিয়ে অনেকগুলো ভাত খেয়েছে আজ৷ ডক্টরের পেছন পেছন যখন সবাই বেরিয়ে গেল তখন তিথিও আর বসে থাকেনি৷ তারও তো জানা উচিত ডক্টর কী এমন কথাবার্তা বলছেন পিংকির সঙ্গে! তিথি তখন দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল৷ ডক্টরের কথা আবছা হলেও বুঝেছে সে। ডক্টর বলছিল‚
“আই থিংক শি ইজ প্রেগন্যান্ট। তারপরও হসপিটাল থেকে চেকআপ করিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।”
এরপর ডক্টর চলে গেলেন। ডক্টরের কথায় খুবই রাগান্বিত হলেন পিংকি। সিদ্ধান্ত নিলেন দিন দুয়েকের মাঝেই ভূমিকে হসপিটাল থেকে চেকআপ করিয়ে আনবেন। যদি ভূমি অন্তঃসত্ত্বা হয় তাহলে সেখানেই অ্যাবর্শন করিয়ে নেবেন৷ এদিকে ডক্টরের কথায় খুবই খুশি হলো তিথি। শশব্যস্তভাবে ঘরের ভেতরে গিয়ে ভূমিকে জড়িয়ে ধরল৷ হুট করে জড়িয়ে ধরার মানে খুঁজে পেল না ভূমি। অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল‚
“কী হয়েছে আপু?”
“সে কী তুমি কিছু জানো না? মায়েরা নাকি সব জানে! তারা নাকি আগে থেকেই অনুভব করে৷ ভূমি তুমি আসলেই খুব বোকা।”
“কেন আপু কী হয়েছে?”
ভূমির পেটে আলতো করে হাত রেখে তিথি বলল‚ “এখানে ছোট্টো এক অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে৷”
তিথির কথা বোধগম্য হতেই আঁখিদ্বয় অশ্রুপ্লুত হলো ভূমির৷ ভাবতেই পারছে না‚ সে মা হতে চলেছে। খুশি খুশি লাগছে তার৷ অতি উল্লাসে সারা শরীর শিরশির করে উঠছে। মা হওয়ার সুন্দর এক অনুভূতি সে এখন থেকেই অনুভব করতে শুরু করছে৷ এই খবরটা আগে কেন জানতে পারল না সে? প্রলয় জানলে হয়তো খুবই খুশি হবে৷ ছুটে যদি প্রলয়ের কাছে চলে যাওয়া যেত? ভূমি ভেবে নিল‚ এখন থেকেই নিজের খুব যত্ন নেবে৷ বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার খাবে৷ যাতে করে তার বাচ্চা সুস্থ থাকে। পরক্ষণেই ভাবল এখান থেকে পালানোর কথা৷ এমন একটা পরিবেশে নিজের সন্তানের জন্ম দেবে না সে। কম্পিত হাতে নিজের পেটেই স্নেহমাখা হাত বুলাতে শুরু করল ভূমি। ভূমিকে নিয়ে এবার বেশ চিন্তায় পড়ে গেল তিথি৷ পিংকিকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে৷ জোড় করে অ্যাবর্শন করানো উনার কাছে বড়ো কিছু না৷ তিনি টাকার জন্য সবই করতে পারেন। এইতো মাস ছয়েক আগে রুমাকে জোর করে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে অ্যাবর্শন করিয়ে এনেছেন৷ থমথমে মুখ নিয়ে ভূমির কাছে বসে তিথি বলল‚
“তোমাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে৷ আমি জানি এই বাচ্চা নষ্ট করার জন্য ম্যাডাম এখন উতলা হয়ে উঠবেন।”
ভয় পেল ভূমি৷ কিছুতেই সে তার সন্তানকে মে’রে ফেলতে দেবে না৷ সে তিথিকে বলল‚ “আপু আমাকে এখান থেকে পালাতে সাহায্য করুন দয়া করে।”
“তুমি চিন্তা কোরো না বোনু৷ আমি তোমার পাশে আছি৷ দিন দুয়েকের মাঝে তোমাকে আমি এখান থেকে পালাতে সাহায্য করব।”
এদিকে…
নিজের ঘরে বসে রয়েছেন পিংকি৷ ক্রমাগত রাগে ফুঁসছেন তিনি৷ পান চিবোচ্ছেন। আজ চুনটা একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছেন মনে হচ্ছে৷ মুখ জ্বালা করছে৷ পান চিবোনোর দরুন মুখ ঠোঁট লাল হয়ে রয়েছে৷ পিংকি সবসময় সুগন্ধি মসলা দিয়েই পান খান। খেতে মিষ্টি মিষ্টি লাগে আর ঘ্রাণ বেশ সুন্দর। পানের বাটা থেকে আরেকটা পান বের করে মুখে পুরলেন তিনি৷ এদিকে ভূমির কথাটাও ভাবছেন। মেয়েটাকে এখানে রাখলে লাভবান উনিই হবেন৷ এখনকার গ্রাহকদের সুন্দরী মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ আর চাহিদা একটু বেশিই৷ সেক্ষেত্রে ভূমিকে দিয়ে কাজ করালে মোটা টাকা পাবেন তিনি৷ টাকার জন্য সবকিছুই করা যায়৷ বাচ্চা নষ্ট করা এ আর নতুন কী? এর আগেও তো এখানকার পাঁচটা মেয়ের বাচ্চা নষ্ট করিয়েছেন তিনি৷ ফোন বের করে মেহরাব শিকদারের নাম্বার কল লাগালেন তিনি৷ যেহেতু মেয়েটাকে মেহরাব শিকদার এখানে এনে দিয়েছেন তাই তাকেও তো কথাটা জানানো প্রয়োজন৷ পিংকি কল করার সঙ্গে সঙ্গেই রিসিভ হয়ে গেল৷ ওপাশ থেকে মেহরাব শিকদার বলে উঠলেন‚
“আবার কী হলো? তোমাকে কতবার বলেছি সময় অসময়ে আমাকে কল করবে না?”
বেশি কথা না বাড়িয়ে পিংকি বললেন‚ “যা সন্দেহ করেছিলাম সেটাই হয়েছে৷ মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা। এখন কী করা উচিত?”
“আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ? অন্য মেয়েদের সঙ্গে যা কর— এই মেয়ের সঙ্গেও সেটাই করবে।”
মেহরাব শিকদারকে সন্দেহ হলো পিংকির। তাই তিনি আজ সরাসরিই জিজ্ঞেস করলেন‚ “আপনি মিয়া বেশ ধূর্ত মাল৷ কোথা থেকে আনলেন এই মেয়েকে? আগে তো কখনো মেয়ে এনে দেননি। হঠাৎ এই মেয়েকে কোথায় পেলেন আর আমার এখানেই বা কেন পাঠালেন?”
“সেটা দিয়ে তোমার কোনো কাজ নেই৷ নিজের চরকায় তেল দাও।”
বিছানায় এবার আয়েশ করে বসে পিংকি বললেন‚ “সময় করে একবার দেখা করে যাবেন।”
“সেটা তোমাকে বলতে হবে না৷ আর একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ।”
“হুম বলুন! শুনিছি আমি।”
“সময়ে অসময়ে আমাকে কল করবে না৷ দরকার পড়লে আমি নিজেই কল করে সব খবরাখবর জেনে নেব।”
“বুঝেছি।”
কল রেখে দিলেন মেহরাব শিকদার। নিজের চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিলেন৷ এখন তিনি হসপিটালে আছেন৷ কিছুক্ষণ পরেই একটা ওটি আছে৷ এবার তিনি একেবারেই নিশ্চিন্ত। একসঙ্গে পথের কা’টা দুটোই উপড়ে ফেলতে পেরেছেন তিনি। যা উনাকে পৈশাচিক আনন্দ দিচ্ছে৷ এবারের পরিকল্পনাটা মারাত্মক ছিল। এই না হলে একজন যোগ্য ব্যবসায়ীর কাজ! মনে মনেই নিজের উপর গর্ব বোধ করলেন তিনি।
চলবে?…..