#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪৩|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
তিমিরের ঢল নেমেছে। অন্তরিক্ষের অমা আজ কাটবে না বোধহয়৷ সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরও ঘুটঘুটে রূপ ধারণ করেছে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে প্রলয়কে ঘরে দেখতে পেল না৷ দিব্যি ঘরের দুয়ার ভেতর থেকে আটকে রাখা। তার মানে প্রলয় বাহিরে কোথাও যায়নি৷ তাই সে বারান্দার দিকে অগ্রসর হলো। আরো উপস্থিতি অনুভূত হতেই সিগারেটের উষ্ণ ধোঁয়া বিলীন করে দিল প্রলয়। ভূমিকে দেখা মাত্রই হাত থেকে ফেলে দিল জ্বলন্ত সিগারেটটা। ভূমি এগিয়ে গিয়ে প্রলয়ের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“আপনি ধুমপান করেন?”
স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রলয় বলল‚ “হ্যাঁ! মাঝে মাঝে ওই আরকি।”
“ধুমপান না করলে হয় না? আসলে এসবের গন্ধ আর ধোঁয়াতে আমার নিশ্বাস নিতে একটু সমস্যা হয়।”
পা দ্বারা জ্বলন্ত সিগারেট নিভিয়ে প্রলয় বলল‚ “আজ থেকে আর না।”
অল্পতেই খুশি হয়ে গেল ভূমি। লোকটা তার কথা শুনেছে৷ ভাবতেও ভালো লাগছে৷ ভূমি এবার জিজ্ঞেস করল‚ “আপনি ঘুমাবেন না?”
“ঘুম আসছে না৷ তুমি গিয়ে শুয়ে পড়।”
ভূমি গেল না৷ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই৷ প্রলয় চেয়ার ছাড়ল৷ ভূমির হাত ধরে ঘরে চলে এলো৷ বিছানায় বসিয়ে ঘরের লাইট নিভিয়ে ঘুম বাতি জ্বালিয়ে দিল৷ বিছানার ডানপাশে শুয়ে ভূমিকেও পাশে শুয়ে পড়তে বলল প্রলয়৷ ভূমি শুয়ে পড়তেই তার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল‚
“চোখ বন্ধ কর। আমি তোমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুম চলে আসবে।”
প্রলয়ের কথামতো চোখ বন্ধ করল৷ ভূমির মাথাটা আলগোছে নিজের বক্ষঃস্থলে আগলে নিল প্রলয়৷ চোখ বন্ধ রেখেও ক্ষীণ হাসল ভূমি৷ আলতো হাতে চুলে বিলি কে’টে দিচ্ছে প্রলয়৷ ভালো লাগছে ভূমির। ঘুমও পাচ্ছে তার। এভাবেই সময় গড়াতে শুরু করল। একপর্যায়ে কখন যে‚ ভূমি ঘুমিয়ে পড়েছে সেটা ইয়ত্তার বাহিরে।
অন্যদিকে…
এখনো লুঙ্গি পড়ে রয়েছে অর্পণ। গরমকালে লুঙ্গি পড়ার উপকারিতা অনেক৷ তখন খাবার টেবিলেও সে লুঙ্গি পড়েই গিয়েছিল। তাকে এভাবে দেখে খুব হেসেছিল পূর্ণতা‚ পুষ্পিতা আর ইরা৷ দেখে মনে হচ্ছিল‚ জোকার কোনো মজার জোকস বলেছে৷ আর তারা ফ্রিতে মজা লুটছে৷ বাকি সদস্যরাও মিটিমিটি হাসছিল৷ অর্পন কখনো লুঙ্গি পড়েনি। তারউপর লুঙ্গিতে গিঁট না দিয়ে বেল্ট লাগিয়েছিল। তাইতো তাকে দেখে সকলে শব্দ করে হেসেছিল। একমাত্র ভূমিই কোনো রকমের প্রতিক্রিয়া করেনি। মেয়েটাকে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই শান্ত মনে হয়৷ আগ বাড়িয়ে সহজে কোনো কথা বলে না। কথা থাকলেও কিছু বাক্যের মাঝেই শেষ করার চেষ্টা করে৷ বিছানায় শুয়ে থেকেই ইরার নাম্বারে কল লাগাল অর্পণ। রিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কল রিসিভ হলো। ইরা বোধহয় তারই অপেক্ষা করছিল। অর্পণ ফোন কানে নিয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“কী মেডাম— ফোন হাতে নিয়ে বসে ছিলেন নাকি?”
“অপেক্ষা করছিলাম কখন আপনি বিরক্ত করবেন!”
“আমি বুঝি তোমাকে বিরক্ত করি?”
“এই যে এত রাতে একটা মেয়েকে কল দিয়েছেন‚ এটাকে বুঝি বিরক্ত করা বলে না? অবশ্য আমি বিরক্ত হচ্ছি না।”
“ওহ আচ্ছা! ওসব কথা বাদ। তা হবু শ্বশুর বাড়ি কেমন লেগেছে?“
“চলার মতো।”
“তাহলে বেটার শশুর বাড়ি খোঁজা উচিত— নয় কী?”
“আমার এটাই চলবে!”
আরও অনেকক্ষণ দুজনের প্রেমালাপন চলল। সময় গড়িয়ে যেতে লাগল। একপর্যায়ে কানে ফোন রেখে ইরা ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মেয়েটার ভারী নিশ্বাস কর্ণগোচর হলো অর্পণের। কল কেটে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। এবার অন্তত ঘুমানোর প্রয়োজন। সকালে ডিউটি আছে। তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।
সকালে…
সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রলয়ের আধোয়া কাপড়চোপড় গুলো ধুয়ে বারান্দায় মেলে দিল ভূমি। আজ তাড়াতাড়ি করেই সব কাজ সারছে৷ প্রলয় তখনো ঘুমিয়ে ছিল। তাকে আর জাগাল না। দরজা খুলে ঘর থেকে বের হলো। যাওয়ার আগে দুয়ার ভালো করে চাপিয়ে দিয়ে গেল। সাবিনা ছাড়া কেউই হয়তো ঘুম থেকে ওঠেনি। বড়ো বড়ো পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচ তলায় চলে এলো। এরপর ভূমি সোজা রান্নাঘরে চলল। আজ সকলের নাস্তা সে একাই বানাবে। সাবিনা তখন রান্নাঘরে ছিল না। হয়তো আজ তার উঠতে দেরি হবে। ভূমি চটজলদি ফ্রিজ থেকে বেশ কয়েকটা ডিম বের করল। ডিমগুলো সেদ্ধ বসিয়ে দিয়ে‚ সবজিগুলো কাটতে শুরু করল। আজ সবজি‚ কম তেলে ভাজা পরোটা আর সেদ্ধ ডিম সকালের নাস্তা হিসেবে থাকবে। এসব বাঙালি রান্না সে বেশ ভালোই পারে। কিন্তু ওসব বড়োলোকি খাবারের ধারে কাছেও সে নেই। কখনো রান্না করা হয়নি। দু বেলা দু মুঠো খেতে পারত সেটাই তার জন্য অনেক। আজ সে যা পারছে তাই রান্না করে রাখছে। হুট করে মাধুরীর বদলে যাওয়ার কারণটা ঠিক বুঝতে পারছে না ভূমি। শাশুড়ীর মন যুগিয়ে চলতে হলে‚ তার খেয়াল খুশি মতো কাজ করতে হবে৷ সে কোনো ভূল করেছে কিনা সেটাও বুঝতে পারছে না৷ কী এমন হলো উনার?
ঘণ্টা খানেক সময় ধরে ভূমি রান্নাঘরেই রয়েছে৷ এতক্ষণে সাবিনাও চলে এসেছে৷ ভূমিকে সাতসকালে রান্নাঘরে দেখে অবাকই হলো বটে৷ ত্রস্ত ভঙ্গিতে রান্নাঘরের ভেতরে প্রবেশ করল৷ ভূমি তখন মালটা কাটছিল। তার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে সাবিনা বলল‚
“আমি থাকতে আপনে এত কাম করতাছেন ক্যান ভাবি?”
“একটু আধটু কাজ করলে কিছু হবে না। আজ তুমি বিশ্রাম নাও। আর নয়তো এখানেই দাঁড়িয়ে থাক।”
“ভাবি আপনে কন আমারে কী করতে হইব! আমি কইরা দিতাছি৷”
“এখন আপাতত কিছু করতে হবে না।”
“ভাইজান জানলে আমার রক্ষা নাই ভাবি।”
“কিছু বলবেন না তোমার ভাইজান।” একটু থেমে ভূমি আবারও বলল‚ “তুমি আমাকে সাহায্য করতে চাও— তাই তো?”
মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে সাবিনা বলল‚ “হ ভাবি।”
“তাহলে প্লেট বাসন গুলো টেবিলের উপর গুছিয়ে রেখে এসো।”
“আইচ্ছা ভাবি।”
ভূমির কথানুযায়ী সাবিনা রান্নাঘর থেকে প্লেট‚ গ্লাস‚ বাটি আর পানির জগ নিয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে গেল। মালটা কা’টা হয়ে এলে‚ প্লেটটা ফ্রিজে রেখে দিল ভূমি। এরপর আবারও কাজে মনোনিবেশ করল। সবজি রান্না করা হয়ে গিয়েছে। পরোটা বেলে রেখেছে। খাওয়ার মিনিট দশেক আগে গরম গরম ভেজে নেবে। ডিমগুলোর থেকে খোসা ছাড়িয়ে নিল ভূমি৷ রান্নাঘরের কাজ প্রায় হয়েই গিয়েছে। ভূমি ঘরে চলে এলো। প্রলয় এখনো ঘুমচ্ছে৷ সে ডাকল না৷ ওয়াশরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে এলো। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা৷ পড়নের জামাকাপড় পালটে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ভূমি৷ মাধুরীর কিনে দেওয়া জামা থেকেই একটা নিয়েছে। সেটাই আজ পড়বে।
সকাল সাড়ে আটটা…
সবাই ইতিমধ্যেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। পূর্ণতা পুষ্পিতার পরীক্ষা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ওদের খাবার ঘরেই দিয়ে এসেছেন মাধুরী। সামনে পরীক্ষা‚ মানুষের দম ফেলবার সময় নেই। আর এদিকে ওদের দু বোনের সবকিছুতেই উদাসীনতা। পূর্ণতা যদিও একটু আধটু পড়াশোনায় মনোযোগী কিন্তু পুষ্পিতা একেবারেই ছাড়া হাত পা। মেয়েটার মাঝে গম্ভীরতা কবে আসবে? সেই নিয়ে চিন্তিত মাধুরী। এদিকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন প্রলয় কোলবালিশ ধরে শুয়ে রয়েছে। ভূমি এই নিয়ে দু দুবার ডেকে গিয়েছে। তবুও এমপি মশাইয়ের ঘুম ভাঙেনি। শেষ বার চেষ্টা করতে এলো ভূমি। ডাইনিং টেবিলে মোর্শেদ শিকদার‚ মাধুরী‚ ফিরোজা এবং অর্পণ উপস্থিত শুধু ওরা দুজনই এখনো ঘর থেকে বের হয়নি। একা যেতেও পারছে না ভূমি। প্রলয়ের মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ডাকতে আরম্ভ করল। কিছুটা নড়েচড়ে উঠল প্রলয়। তার মানে লোকটার ঘুম হালকা হয়ে এসেছে। যাক খুশি হলো সে। চোখ বন্ধ রেখেই ভূমি হাতখানা ধরে ফেলল প্রলয়। এবার চোখ পিটপিট করে তাকাল ভূমির মুখ পানে। ভূমি কিছুটা তাড়া দিয়ে বলল‚
“তাড়াতাড়ি উঠুন আপনার জন্য সবাই খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছেন। সে কখন থেকে আপনাকে ডাকছি!”
ঘুমুঘুমু ভারী কণ্ঠে প্রলয় বলে উঠল‚ “বরের ঘুম ভাঙাতে হলে আদর দিতে হয়। এ কথা কী তোমার জানা নেই?”
প্রলয়ের মুখে এহেন কথা শুনে লজ্জায় ভূমির কপোলদ্বয়ে রক্তিম আভার দেখা মিলেছে৷ মেয়েটাকে আর লজ্জা দিল না৷ আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে উঠে বসল৷ এরপর তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে এলো৷ এইফাঁকে ভূমি বিছানা গুছিয়ে নিয়েছে৷
খাবার টেবিলে…
সকলের প্লেটে পরোটা সবজি বেড়ে দিচ্ছে ভূমি। মাধুরী আজও নিজের খাবার নিজেই নিয়ে নিলেন। ভূমি দেখেও না দেখার ভান করে রইল৷ মাধুরীর কিনে দেওয়া জামা পড়েছে ভূমি। বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে চেয়ে ছিলেন মাধুরী৷ মেজেন্টা রংটা বেশ মানিয়েছে ভূমিকে৷ গৌর অঙ্গে ফুটে উঠেছে যেন। ইরার সঙ্গে তফাৎ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি৷ দেখতে শুনতে ইরার থেকেও সুন্দরী ভূমি। কিন্তু উনার মন তা মানতে নারাজ। ছেলের জন্য শিক্ষিত এবং ভালো পরিবারের মেয়ে চেয়েছিলেন তিনি৷ কিন্তু তা আর হলো কই? ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিচ্ছেন। না পারছেন সহ্য করতে আর না পারছে কিছু বলতে। তবুও সুপ্ত রাগের বহিঃপ্রকাশ হয়েই যাচ্ছে।
চলবে?…..