রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪৪| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
652

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪৪|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল স্যেট করছে আর গুনগুন করছে। ভূমি বুঝতে পারল না হঠাৎ লোকটার হলো কী? মনে এমন আনন্দের উৎস খুঁজে পেল না সে। বিছানায় চুপটি করে বসে রইল। প্রলয় সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসল। ভূমির কপালে সিক্ত উষ্ণ অধর ছোঁয়াল। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিল মেয়েটা৷ প্রলয় বাঁকা হাসল৷ ভুমির কপালের সঙ্গে কপাল মিলাল৷ প্রলয় বলল‚

“আজ আমার ফিরতে দেরি হবে। তুমি আমাকে মিস করবে তো বউ? তাহলে তোমার টানে আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব৷”

কিছুটা পিছিয়ে কম্পিত কণ্ঠে ভূমি বলল‚ “আপনি এসব…”

ভূমিকে আর কিছু বলতে দিল না। ডান হাতের তর্জনী মসৃণ ভাবে ভূমির ঠোঁটের উপর ছোঁয়াল। শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল। খেলে গেল শীতল স্রোত। ভূমির অতি সমীপে এগিয়ে এলো প্রলয়৷ দুজনের দূরত্ব ঘোচাল। আলতো হাতে ভূমি মাথায় চুলের পেছনে হাত রাখল প্রলয়। বুক ধুকপুক করছে ভূমির৷ অজানা শঙ্কায় গা শিউরে উঠল৷ অকস্মাৎ দুটো ব্যাকুল অধরোষ্ঠের আলিঙ্গন ঘটল৷ প্রলয় আরও ব্যাকুল হয়ে উঠল। একটু একটু করে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে৷ ভূমির এতটা সমীপে এসে নিজের আটকে রাখা দায় হয়ে পড়েছে৷ ছাড়া পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে ভূমি। নিশ্বাস আটকে আসছে তার৷ প্রলয়ের শার্ট খামচে ধরেছে। পুরুষালি অবাধ্য হাতের বিচরণ ঘটছে সর্বত্র জুড়ে৷ বেশ কিছু সময় পর ভূমিকে ছেড়ে দিল প্রলয়৷ ভূমির ওষ্ঠে মসৃণ ভাবে ছুঁয়ে বাঁকা হেসে বলল‚

“সামথিং ডিফারেন্ট।”

এই বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়া না প্রলয়। দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এদিকে বালিশে মুখ লুকাল ভূমি। ভীষণই লজ্জা লাগছে তার৷ এই মুখ কী করে দেখাবে সে। লোকটা দিনকে দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে৷

মাথায় শুধু মাধুরীর ব্যাপারটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। ভূমি আর ভাবতে পারছে না। মাথা ধরে এলো। মন এবং মস্তিষ্ক দুটোই চাইছে‚ তার একটিবার মাধুরীর সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। নিজের ভাবনাকেই অধিক প্রাধান্য দিল সে৷ ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা চাপিয়ে নিচে চলে গেল৷ উদ্দেশ্য মোর্শেদ শিকদারের ঘর৷ সে জানে মাধুরী এখন ঘরেই রয়েছেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ল ভূমি৷ ভেতর থেকে অনুমতি পেয়ে ভূমি দুয়ার ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। মাধুরী জিজ্ঞেস করলেন‚

“হঠাৎ আমার ঘরে— কী চাই?”

“মা আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

“আমার হাতে সময় নেই৷ যা বলার তাড়াতাড়ি বল।”

“আমি কী কোনো দোষ করেছি? না মানে আপনি কী কোনো কারণে আমার উপর রুষ্ট?”

“সেটা জানতে হলে আগে আমাকে এটা বল— তোমার বাবার নাম কী? কী করেন?”

“আমার বাবা কে‚ আমার জানা নেই! আম্মার কাছে অনেক জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু উনি আমাকে কিছুই বলেননি।”

কপাল চাপড়ে মাধুরী বললেন‚ “আমার হয়েছে ফাটা কপাল।”

মাধুরীর কথা ভূমি কিছুই বুঝল না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। মুখ ঝামটা দিলেন মাধুরী। তিনি এবার সাফ সাফ বললেন‚

“না আছে বাবার পরিচয়‚ না আছে বংশের পরিচয়। সব ঝামেলা আমার ঘাড়ে জোটে।”

এবার ভূমি বুঝতে পারল মাধুরীর এমন ব্যবহারের সূত্রপাত। ব্যাপারটাকে খুবই স্বাভাবিক ভাবে নিল ভূমি। ছোটবেলা থেকে কম কথা তো শুনতে হয়নি তাকে। বরঞ্চ সে এমন ব্যবহারেই অভ্যস্ত। মাধুরী পুনশ্চ বললেন‚

“এবার বুঝেছ আমার এমন ব্যবহার করার কারণ? তোমাকে আমি কোনদিনও মেনে নিতে পারব না। কোনো জার’জ সন্তানকে আমার ছেলের বউ হিসেবে তো কখনোই না৷”

মাথা নিচু করে ভূমি বলল‚ “আমি জা’রজ সন্তান নই৷ আমার বাবা আছেন।”

“তাহলে শুনি কে তোমার বাবা?”

ভূমি কী বলবে ভেবে পেল না! সে তো জানেই না তার বাবা কে? কোথায় থাকে? কী করে? কণ্ঠস্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে বলল‚ “আমার জানা নেই!”

“তুমি কী ভেবেছ— আমি কোনো খোঁজ খবর নিইনি? এমনিতেই যাকে তাকে আমার ছেলের বউ হিসেবে মেনে নেব?”

ভুমি কিছু বলতে নেবে তার আগেই মাধুরী বললেন‚ “অ্যাই তুমি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও তো৷ তোমাকে আমার একটুও সহ্য হচ্ছে না৷”

করুণ কোমল স্বরে ভূমি বলল‚ “এ বাড়িতে এসে আমি দ্বিতীয় মাকে পেয়েছি। আমাকে কী একটু ভালোবাসা যায় না মা?”

“তোমাকে আমি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছি!”

ভূমি আর একমুহূর্ত দাঁড়াল না৷ এখন সবটাই জলের মতো পরিষ্কার। খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে তার বাবা কে? কোথায় থাকে? কী করে? কেন তার মাকে এভাবে একা ফেলে গিয়েছিল? কেন তাদের জীবনটা অন্যদের মতো স্বাভাবিক হলো না? ক্ষিপ্রবেগে বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় চলে গেল৷ অঝোর ধারায় অশ্রুবর্ষণ হচ্ছে৷ কেন কেউ তাকে সহজ ভাবে মেনে নেয় না? যে করেই হোক আম্মার কাছ থেকে সব সত্যি জানতেই হবে। ঘরে এসেই মোবাইল থেকে নাজমার নাম্বারে কল লাগাল ভূমি৷ অপাশ থেকে কেউ কল রিসিভ করছে না৷ হতাশ হয় বিছানায় শুয়ে পড়ল ভূমি। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার৷ কেঁদেকেটে সব ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। চোখ বন্ধ করল ভূমি৷ কয়েক ফোঁটা উষ্ণ অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল নিমিষেই। ভাগ্যিস প্রলয় এখন বাড়িতে নেই৷ এই কান্না নিয়ে তাহলে আরেক কাহিনি ঘটে যেত৷ এরই মাঝে নাজমার নাম্বার থেকে কল আসতে শুরু করেছে। চট করে চোখ মেলে তাকাল ভূমি। রিসিভ করা নিয়ে সময় ব্যয় করল না সে। নাজমার সঙ্গে ভালোমন্দ কথা বলে‚ ফোনটা মহুয়ার কাছে দিতে বলল ভূমি। মহুয়াকে কোনো কিছুই বলতে না দিয়ে সে আগেই বলল‚

“আমার বাবা কে আম্মা?”

মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে ভীষণই অবাক হলেন মহুয়া। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন‚ “আজ হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

“তোমাকে বলতেই হবে আম্মা।”

মহুয়া সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন‚ “তোকে কী কেউ কিছু বলেছে?”

কথাটা পুরোপুরি ভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল ভূমি। তার আম্মাকে বলল‚ “হুট করেই জানতে ইচ্ছে হলো আম্মা। এবার অন্তত আমাকে সত্যিটা বল।”

“যেদিন সামনাসামনি দেখা হবে সেদিন সব সত্যি জানতে পারবি।”

গোধূলি লগ্নে…

বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষ জুড়ে সফেদ আব উড়ে বেড়াচ্ছে। যা একটু একটু করে রক্তিম বর্ণ ধারণ করছে। বাতাবরণও শীতল৷ আজ দুপুরে তপ্ততা ছিল প্রখর৷ মেঝে এখনো গরম হয়ে রয়েছে। ঘরে এসির হাওয়াও উষ্ণ মনে হয়েছে দুপুরে। ভূমি দু’হাত মেলে দোলনায় বসে রইল। খোলা চুলগুলো বাতাসে দোল খাওয়ার সঙ্গে মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। আজ এই অসময়ে চুল ছেড়ে রেখেছে৷ গোসল করে আধঘণ্টা হবে হয়তো। ভেজা মেলে রাখা চুলগুলো দেখে প্রশংসা পঞ্চমুখ সাবিনা৷ তার সঙ্গেই ছাদে উঠেছে ভূমি৷ ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না৷ মাধুরীর বলা প্রত্যেকটা কথা কানে বাজছে৷ কান্নারা এসে ভীড় জমাল নেত্র কোণে। গলা ভারী হয়ে আসছে। কান্নারা এসে দলা পাকাচ্ছে। বিষাদের তুমুল আন্দোলনে ভেতরটা র’ক্তাক্ত ক্ষ’তবিক্ষ’ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিষণ্ণচিত্তে চেয়ে রইল আকাশ পানে। নিজেকে ভীষণ ভার মনে হচ্ছে৷ হালকা হওয়ার তাড়না পিছু নিয়েছে৷ পাখি হয়ে উড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করছে বিশাল অম্বরে৷ এদিকে সাবিনা আচারের বোয়াম গুলো ঠিক করে রাখল৷ দুপুরে রোদে দিয়েছিল৷ সবগুলোই মাধুরীর বানানো। ভূমিকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে সাবিনা জিজ্ঞেস করল‚

“ভাবি আচার খাইবেন?”

“না আপু। তুমি এগুলো নিয়ে নিচে চলে যাও৷ আমি একটু একা থাকতে চাই।”

“ভাবি আপনের কী মন খারাপ?”

“না। আম্মার কথা একটু মনে পড়ছে।”

সাবিনা দাঁড়াল না। আচারের বোয়াম নিয়ে নিচে চলে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখল প্রলয় বাড়ি ফিরেছে। সাবিনা কিছুটা কাচুমাচু হয়ে রান্নাঘরের দিকে চলল। প্রলয়কে অতি ভয় পায় কিনা!

“তোর ভাবি কোথায় রে সাবিনা?”

মৃদুস্বরে সাবিনা বলল‚ “ভাবি তো ছাদে।”

“আচ্ছা তুই নিজের কাজে যা।”

কথাটা বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল প্রলয়। ছাদের কাছে এসে ধীর পায়ের ভূমির কাছে গেল৷ দোলনার কাছে দাঁড়িয়ে বলল‚

“আমাকে মিস করছিলে? দেখেছ তোমার টানে ঠিকই চলে এসেছি আমি।”

ভূমি কিছু বলল না৷ কিছু বলতে ইচ্ছেই হলো না তার৷ একই ভঙ্গিতে দোলনায় বসে রইল৷ প্রলয় দোলনায় দোল দিতে শুরু করল৷ চোখ বন্ধ করে রইল ভূমি। কিছুই ভালো লাগছে না তার৷ একটু একাকীত্ব প্রয়োজন। বিষণ্ণতা তার পিছু এ জীবনে ছাড়বে না৷ অনেকটা সময় ধরে ভূমিকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে কিছুটা খটকা লাগল প্রলয়ের। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল‚

“তোমার কী মন খারাপ ভূমি কন্যা? কেউ কী তোমাকে কিছু বলেছে?

“আম্মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে৷”

“খুব শীগ্রই তোমার আম্মার সঙ্গে দেখা হবে।”

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here