রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪৫| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
630

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪৫|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

অতিবাহিত হলো আরও পাঁচটি দিবারাত্রি। সময় খুব তাড়াতাড়িই অতিবাহিত হয়ে যায়৷ চোখের পলকেই চলে যায় যেন৷ এ পাঁচদিনে মাধুরীর ব্যবহার আরও রুক্ষ হয়েছে। সকলের সামনে কথা না বললেও‚ আড়ালে কটু কথা শোনাতে ছাড়েন না তিনি। ভূমিও নীরবে তা সহ্য করে যায়৷ প্রলয়কে কিচ্ছুটি জানতে দেয়নি সে। আম্মার একটা কথা তার সদা মনে পড়ে। গ্রাম ছেড়ে আসার আগে আম্মা তাকে একটা কথা বারবার বলে দিয়েছিলেন‚ “পরিবারের সবাই সমান হবে এমনটাও না৷ ভালোমন্দ মিলিয়েই একটা পরিবার তৈরি হয়। কেউ তোমাকে পছন্দ করবে— আবার কেউ তোমাকে অপছন্দ করবে। তাই বলে তোমাকে হার মেনে নিলে হবে না৷ সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকতে হবে৷” আম্মার কথাগুলো মনে করে করেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভূমি৷ মায়ের প্রত্যেকটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে৷ এ পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে নিজের করে নিয়েছে ভূমি। এ পাঁচটি দিন বিষণ্ণতায় কাটলেও আজ ভূমি ভীষণ খুশি৷ তার একটা কারণ হচ্ছে‚ তার আম্মা আসছে৷ কতগুলো দিন পর আম্মাকে দেখবে সে৷ আনন্দ ধরে রাখতে পারছে না ভূমি।

গোধূলি বিকেল…

মালঞ্চ নীড়ে সবার আগমন ঘটেছে। ফিরোজার বাপের বাড়ি থেকে সকলেই এসেছেন। ফিরোজার বোন আর ভাইয়ের পরিবার এসেছেন। অর্পণ আর প্রলয় দুজনেই সবার কাছে বড্ড প্রিয়। মাধুরীর বাপের বাড়ি থেকে শুধু উনার ভাইয়ের পরিবার আসবেন। প্রলয়ের নানুমণি এ বিয়ে মানতে নারাজ তাই তিনি আসবেন না বলে দিয়েছেন। কেউ আর তাকে জোর করছেন না। বয়স্কা যেটা মনে করেন সেটাই করেন। উনার উপর দিয়ে কেউ যেতে পারে না। একমাত্র প্রলয় যদি আনতে পারে। কারণ প্রলয়কে বড্ড স্নেহ করেন তিনি। মাধুরীরা দু ভাই-বোন। তিনি ছোটো। যারা এসেছেন সকলেরই ভূমিকে পছন্দ হয়েছে। পছন্দ না হবার কোনো কারণই নেই। মালঞ্চ নীড়ে আজ লোকসমাগমে ভরপুর। মেহমানরা আসতে শুরু করেছেন। একে তো প্রলয়ের জন্মদিন তারউপর আবার রিসেপশন। ফিরোজার বড়ো বোন ফাহমিদা বললেন‚

“মাধুরী তোমার ছেলের বউ দেখছি আগুন সুন্দরী। এত সুন্দর মেয়ে কোথায় পেলে?”

থম মেরে বসে রইলেন মাধুরী। মহিলাদের আসর জমেছে উনার ঘরে। বৈঠকথানায় বাড়ির এবং নিমন্ত্রিত পুরুষদের আসর জমেছে। ভূমিকে এ ঘরে নিয়ে এসেছেন ফিরোজা। এ ঘরে মাধুরী‚ ফিরোজা‚ উনার বড়ো বোন ফাহমিদা‚ ভাইয়ের বউ রাবিয়া বসে বিভিন্ন আলাপ আলোচনা করছেন। অন্যের মুখে ভূমির প্রশংসা সহ্য হলো না মাধুরীর। ভূমি এখন উনার চোখের বালি। যাকে না পারছেন সইতে আর না পারছেন বের করে দিতে। থমথমে গলায় মাধুরী জবাব দিলেন‚

“এনেছি কোনো এক অজপাড়া গাঁ থেকে।”

মাধুরীর তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা স্পষ্ট বুঝতে পারল ভূমি। তবুও কিছু মনে করল না। মনে করেই বা কী লাভ? জোর করে কী আর কারো মনে জায়গা করা যায়? তবে সে জানে একদিন না একদিন হয়তো মাধুরীর মনে জায়গা করে নেবে। তবে সেই দিনটা কবে আসবে তার জানা নেই! চুপটি করে ফিরোজার পাশে বসে রইল সে। ফিরোজা সবই বুঝলেন কিন্তু কিছুই করার নেই উনার। সবাইকে আবারও চুপ করে থাকতে দেখে রাবিয়া বললেন‚

“মেয়েটা বেশ মিষ্টি দেখতে। তা কী কী দিলেন বউমাকে?”

এত কথা পছন্দ হচ্ছে না মাধুরীর৷ ভালো কথাও উনার সহ্য হচ্ছে না৷ ভূমির আজও মনে পড়ে‚ সেদিন কতটা ভালোবেসে কত কী কেনাকাটা করে দিয়েছিলেন মাধুরী৷ আসলেই মানুষ বদলায় কারণে অকারণে। ভেতরটা শূন্য শূন্য লাগছে। তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। মাধুরী বিরক্তি নিয়ে বললেন‚

“দেখতেই তো পাচ্ছেন৷ কোনো কিছুর কমতি রাখিনি৷ একমাত্র ছেলের বউ৷”

ফাহমিদা বললেন‚ “আচ্ছা মাধুরী— কোনো কারণে কী তুমি রেগে আছ অথবা মন খারাপ?”

মাধুরীকে কিছু বলতে না দিয়ে ফিরোজা কথা কাটানোর জন্য বললেন‚ “বাড়িতে অনুষ্ঠান। একটা চিন্তা তো আছেই। রাগ বা মন খারাপ কোনোটাই না৷ ভাবি আসলে একটু চিন্তিত৷ সব যেন ভালোই ভালোই মিটে যায় সেটাই কাম্য।”

অন্যদিকে…

ইরার হোস্টেলের সামনে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্পণ। বেশ কয়েকবার ইরার নাম্বারে কল দিয়েছে। কিন্তু রিসিভ হয়নি৷ উপায়ন্তর না পেয়ে অর্পণ দারোয়ানের কাছে গিয়ে ইরার কথা জিজ্ঞেস করল। দারোয়ান হোস্টেলের ভেতরে খবর পাঠাল৷ মিনিট দশেকের মাঝে ইরা গেইটের সামনে এসে দাঁড়াল। অর্পণকে দেখে হেসে দিল৷ তবে তার হাসিটা কেউই দেখল না৷ ঘর্মাক্ত শরীরের কালো শার্ট লেপ্টে রয়েছে৷ বাইকে হেলান দিয়ে ফোনে কিছু একটা করছে অর্পণ। তার কাছে এগিয়ে গেল ইরা৷ তাকে দেখে মাত্রই মোবাইলটা পকেটে রেখে কিছুটা রাগী গম্ভীর স্বরে অর্পণ বলল‚

“মোবাইল কোথায় আপনার?”

ইরা বোকা বোকা চাহনিতে ফোনটা দেখাল। মানে সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে৷ অর্পণ চুপ করে রইল। রাগ হচ্ছে ভীষণ। একে তো সারাদিনের ক্লান্তি। তারউপর এই মেয়ের হেঁয়ালি সহ্য হচ্ছে না। বেশিক্ষণ নীরব আর থাকতে পারল কই? ইরা আগ বাড়িয়ে বলল‚

“আপনি হঠাৎ হোস্টেলের সামনে কী করছেন?”

“ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে এসো৷”

অবাক হলো ইরা। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল‚ “কেন?”

“তোমার বাবা মা আসছেন সেটা তো তুমি জানোই৷ তাই আমার মা বলেছে তোমাকে এই দুদিন আমাদের বাড়িতে থাকতে৷”

“আমি এখান থেকেই নাহয় আপনাদের বাড়িতে যাব।”

“হঠাৎ এত লক্ষ্মীটি হলেন কী করে?”

মুখ ভেংচি কে’টে ইরা বলল‚ “আমি সবসময় এমনই।”

“আজ বেশি কথা বাড়াতে চাইছি না৷ আমি বড্ড ক্লান্ত। তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে এসো৷”

মিনমিনে সুরে ইরা ‘আসছি’ বলেই হোস্টেলের ভেতরে চলে গেল৷ এরপর ছোটো একটা ব্যাগ সঙ্গে করে নিয়ে এলো। তাকে দেখামাত্রই অর্পণ বাইকে চড়ে বসল৷ ইরার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে হেলমেট এগিয়ে দিল৷

বাড়িতে…

বৈঠকখানায় হুলুস্থুল কাণ্ড। মাধুরীর মা গুলবাহার এসেছেন। মাকে দেখতে পেয়ে খুবই খুশি তিনি। খিটখিটে মেজাজটাকেও বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। সকলেই বৈঠকখানায় উপস্থিত। প্রলয় নিজে গিয়ে তার নানুমণিকে নিয়ে এসেছে৷ সেই আসতেই হলো গুলবাহারকে৷ বড়ো নাতির আবদার কিছুতেই ফেলতে পারলেন না তিনি। প্রলয় যখন উনার বাড়িতে গিয়ে আহ্লাদিত হয়ে বায়না ধরল। তখনই বরফ গলে জল হয়ে গিয়েছে৷ সকাল থেকেই ভূমি মাথায় লম্বা করে ওড়না পেঁচিয়ে রেখেছে৷ মাগরিবের নামায আদায় করেই এখানে এসেছে৷ সে জানতই না প্রলয়ের নানুমণি এসেছে৷ নিচতলা থেকে কথাবার্তার আওয়াজ কর্ণগোচর হচ্ছে। তাই সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। গুলবাহার ভূমিকে দেখে ধীর পায়ে সামনে এসে বললেন‚

“এই বুঝি আমার নাতি বউ?”

প্রলয় গম্ভীর স্বরে বলল‚ “হ্যাঁ নানুমণি।”

ভূমির চিবুক ছুয়ে মুখ উঁচু করলেন গুলবাহার। বিজ্ঞ দৃষ্টিতে দেয়ে রইলেন বেশ অনেকটা সময়৷ এরপর মাধুরীর দিকে তাকালেন। কিছু একটা ইশারা করলেন মাধুরী৷ গুলবাহার এবার জিজ্ঞেস করলেন‚

“তা মেয়ে তোমার নাম কী?”

নিচু স্বরে ভূমি বলল‚ ওয়াজিহা মেহরাব ভূমি।”

“শুনলাম তোমার মা নাকি মানুষের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে। তোমার বাবা নাকি থাকতেও নেই। আরও অনেক কথাই শুনলাম।”

মহিলার কথায় কষ্ট পেল ভূমি। চকিত দৃষ্টিতে একটিবার তাকাল প্রলয়ের দিকে। এরপর আরেকটিবার তাকাল মাধুরীর দিকে৷ মাধুরী হাসছেন। তারমানে এসব কথা তিনিই উনার মাকে জানিয়েছেন৷ ভূমির খারাপ লাগল। ভীষণই খারাপ লাগল আজ৷ বৈঠকখানায় পিনপতন নীরবতা। নীরবতা ঘুচিয়ে প্রলয় তার নানুমণিকে বলল‚

“তুমি আমাকে এভাবে অপমান করতে পারো না নানুমণি।”

“আমি তোকে কখন অপমান করলাম?”

“আমার বউকে অপমান করা মানে আমাকেও অপমান করা৷”

আর কিছু বলতে পারলেন না গুলবাহার। এত যুক্তি দিয়ে কথা বলা উনার মোটেও পছন্দ নয়। তবুও প্রলয়ের কথার উপর কথা বলতে পারলেন না। কখনো বলেনও না। প্রলয় যে উনার বড্ড স্নেহের। মাধুরীর মুখটা আঁধারে ছেঁয়ে গেল৷ ভূমির চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে মজা লুটছিলেন তিনি। এরই মাঝে ইরাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে অর্পণ। নীরবতা মাঝে আবারও হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল৷ ইরাকে দেখেই ফিরোজা খুব বেশি খুশি হয়ে গেলেন। এত এত মানুষের মাঝেও নিজেকে একা মনে হলো ভূমির৷ প্রলয় ছাড়া আর কেউ নেই আজ তার পাশে৷ ছোটো বেলা থেকে বাবা নামক বটবৃক্ষের অভাব তাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে৷ বাবা না থাকার হাহাকার হৃদয়কে সহস্রাধিক ক্ষ’তবিক্ষ’ত করেছে৷ এদিকে ইরাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ফিরোজা৷ অর্পণের কাজিনদের সঙ্গে খুব হেসেখেলে ইরা৷ সবার মাঝে ভূমিকে তার খেয়ালই নেই। চুপিসারে ভূমি সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরে চলে গেল৷ কেউ তার দিকে খেয়ালই করল না৷

ঘরে এসেই কয়েক ফোঁটা অশ্রুবর্ষণ হলো মৃগনয়না অক্ষিকোটর হতে। কিন্তু মন খুলে কাঁদতে পারল না মেয়েটা৷ দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে‚ ঘরে ঢোকার জন্য অনুমতি চাইছে প্রলয়। ওড়না দ্বারা চোখমুখ মুছে একটিবার আয়নায় নিজেকে পর্যবেক্ষণ করল৷ অনুমতি পেয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল প্রলয়। সে জানে ভূমির এখন মন খারাপ। কেঁদেছেও হয়তো মেয়েটা৷ মুখটা কেমন লালাভ হয়ে রয়েছে৷ ঘন আঁখিপল্লবও কেমন সিক্ত। ভূমি বিছানার পাশের টেবিলটার সামনে দাঁড়াল৷ পানি পান করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। এই মুহূর্তে অন্যকোনো ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাইছে না প্রলয়। যে কথাগুলো শুনলে মেয়েটার মন বিষিয়ে যাবে৷ ভূমির মন ভালো করার জন্য প্রলয় গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল৷ বুকে হাত রেখে বলল‚

“দুদিন ধরে তুমি আমাকে একটুও সময় দিচ্ছ না বউ! আমার শরীরে ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।”

“আপনার কী শরীর খারাপ করছে? ভাইয়াকে ডাকব?”

মুহুর্তেই ব্যস্ত হয়ে উঠল ভূমি। তাড়াহুড়ো করে বিছানার থেকে নামার জন্য উদ্যত হলো৷ প্রলয় তার হাতটা ধরে ফেলল। গম্ভীর স্বরে বলল‚

“এত বোকা কেন তুমি? বেশ বুঝতে পারছি কয়েক বছরে আমার বাসর করা হবে না।”

লোকটার এহেন লাগামহীন কথাবার্তায় লজ্জায় অভিভূত অঙ্গনার পা দুটো থেমে গেল৷ ভূমিকে টেনে নিজের উপর ফেলে দিল৷ আটকে নিল শক্তপোক্ত বাহুবন্ধনে৷ প্রলয়ের সান্নিধ্যে এসে কষ্টগুলো মূর্ছা গিয়েছে৷ দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হলো। প্রলয় পুনশ্চ বলল‚

“কেন বোঝ না— তুমি আমার ভীষণ শখের! ভালোবাসি বউ। তোমার নারী মন কেন এই অনুভূতিটা বুঝতে পারে না?”

ভূমি বুঝল লোকটা তার মন ভালো করার চেষ্টা করছে। তা না হলে তার মতো উটকো ঝামেলাকে কেই-বা ভালোবাসবে? নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছে তার। প্রলয়ের উপর থেকে সরে গেল ভূমি৷ দুজনেই উঠে বসল৷ প্রলয় কিছু বলতে নেবে তার আগেই ভূমি বলে উঠল‚

“আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন। আমি নিচে যাচ্ছি।”

ভূমি যে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে তা বেশ বুঝল প্রলয়। কিছুক্ষণ আগেও তো মেয়েটা মুচকি হেসেছিল৷ তার কথাতে কী মন খারাপ হলো? কথাটা বলার সময় মেয়েটা তার দিকে তাকাল না পর্যন্ত।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here