#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫৪|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
বিছানায় শুয়ে এপাশ অপাশ করছে প্রলয়। অপেক্ষার প্রহর গুনছে কখন ভূমি ঘরে আসবে। খাওয়া শেষ হতেই সে তো ঘরে চলে এলো কিন্তু বিবিসাহেবার আসার নামগন্ধও নেই৷ নিচে কী করছে এখনো? এদিকে তার বরমশাই যে অপেক্ষা করতে করতে অক্কা পাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই মোটেও! কাজ তো সাবিনার দায়িত্বেও দিয়ে আসতে পারে৷ তা না করে নিজেই কাজের দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছে৷ যখন তখন বউকে কাছে পাওয়া যাচ্ছে না৷ প্রলয় একবার বিছানার ডানপাশে যাচ্ছে তো আরেকবার বিছানার বাঁ পাশে যাচ্ছে৷ সময় যেন কাটছেই না৷ কিছুক্ষণ এভাবেই গড়াগড়ি খেয়ে বারান্দায় চলে গেল প্রলয়৷ দুদিন ধরে সিগারেট ছুঁয়েও দেখেনি। শশীশূণ্য অম্বরে ঘোর আঁধারিয়া। মৃদুমন্দ সমীরণে অপরাজিতা গাছের লতাপাতা গুলো দুলছে৷ বারান্দায় হরিদ্রাভ আলো জ্বলছে৷ রেলিঙে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রলয়৷ দৃষ্টি স্থির রেখেছে বিস্তীর্ণ অন্ধিকা অম্বরে। সময় থমকে গেছে তার৷ আজ দুপুরে একটা প্রেস কনফারেন্স ছিল৷ আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে বহু প্রশ্নের সম্মুখীনও হতে হয়েছে৷ প্রত্যেকটা নিউজ চ্যানেলেই প্রলয়ের কথাগুলো লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে। মোবাইলে সেগুলোই একটিবার দেখল সে৷ মাথা ধরে গিয়েছিল তার৷ একটা সিগারেট ধরাল প্রলয়৷ পরপরই উষ্ণ ধোঁয়া বাতাসে বিলীন করে দিল৷ আজকাল সিগারেটের ধোঁয়াতেই স্বস্তি মেলে না৷
রান্নাঘরের কাজ শেষ করে সবেই ঘরে এলো ভূমি। দরজা আটকে ঘরের ভেতরে এলো। প্রলয়কে না পেয়ে একবার ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকাল৷ না! দরজা তো বাহির থেকে বন্ধ। এরপর দেখল বারান্দার দরজা হুট করে খোলা৷ সে ভেবেই নিল প্রলয় এখন বারান্দায় রয়েছে৷ তাই সে বিছানা গুছিয়ে‚ ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল বাঁধতে আরম্ভ করল। বিকেলে ফিরোজা চুলে তেল লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ঘন দীঘল কেশে একা তেল দিতে পারে না ভূমি৷ বিয়ের আগে সবসময় আম্মা তাকে তেল লাগিয়ে দিতেন। কুপির সেই টিমটিমে আলোয় মাদুর পেতে বসে তেল লাগানোতেও এক অন্যরকম উচ্ছ্বাস কাজ করত। এখানে তো মুখ ফুটে বলতেও দ্বিধাবোধ হয় যে‚ “আমাকে চুলে তেল লাগিয়ে দিন।” ছোটো বেলা থেকেই আম্মা তার চুলে তেল লাগিয়ে দিতেন। এই চুলের যত্ন সবসময় তার আম্মাই করতেন৷ চুল বাঁধতে গিয়েও আম্মার কথা খুব মনে পড়ল ভূমি। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এরই মাঝে বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এলো প্রলয়। ভূমিকে আয়নার সামনে বসে থাকতে দেখে রাগ হলো তার৷ ঘরে এসেছে কিন্তু তাকে একটিবার ঘরে ডাকল না‚ ভাবতেই আরেক দফা রাগ হলো। তখন অর্পণ চলে আসায় খুবই বিরক্তবোধ হচ্ছিল। বউয়ের সাথে প্রেম করেও শান্তি নেই। কেউ না কেউ ঠিকই বাগড়া দিতে চলে আসবে! আজ অর্পণ এসেছে কাল অন্য কেউ আসবে। তারউপর তার অবস্থা দেখে ভূমিও হাসছিল। হুট করেই সেই কথাটা মনে পড়ে গেল তার। আয়নায় ভূমির প্রতিবিম্ব দেখেই বলল‚
“তখন খুব হাসা হচ্ছিল?”
চট করে ভূমি আয়নায় তাকাল। প্রলয়ের প্রতিবিম্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ লোকটা তার থেকে তিন হাত দূরত্বে রয়েছেন। লোকটা ঠিকই মনে রেখেছে। ভূমি না জানার ভান করে বলল‚ “কখন? আমার তো মনে পড়ছে না!”
ধীর পায়ে এগিয়ে এলো প্রলয়। ভ্রু উঁচিয়ে ভূমিকে একবার দেখল৷ সে জানে ভূমি ইচ্ছে করেই এমন করছে৷ ক্ষীণ হেসে ভূমির দিকে কিছুটা ঝুঁকে প্রলয় বলল‚
“এখন তো মনে পড়বেই না৷ তা আমি মনে করিয়ে দিই? তাহলে হয়তো মনে পড়বে তুমি কখন আর কোন কারণে হাসছিলে?”
প্রলয়ের গা থেকে সিগারেটের ধোঁয়ার বিদঘুটে গন্ধ আসছে৷ গা গুলিয়ে উঠছে ভূমির৷ সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয় না তার৷ কিন্তু লোকটা যে ওয়াদা করেছিলেন কখনো ধূমপান করবেন না। তাহলে সেই কথা মিথ্যে ছিল? ভূমির মন খারাপ হলো। মুখ ফিরিয়ে নিল প্রলয়ের দিক থেকে। কিঞ্চিৎ অভিমান উঁকি দিল৷ অভিযোগ করতে ইচ্ছে হলো৷ বলতে ইচ্ছে হলো‚ “কেন আপনি কথা দিয়েও কথা রাখলেন না? আপনি তো জানেন সিগারেটের গন্ধ আমার সহ্য হয় না৷” কিন্তু কিছুই বলতে পারল না ভূমি। প্রলয় তার আরেকটু ঝুঁকে৷ মসৃণ ওষ্ঠে শব্দ করে ওষ্ঠ ছোঁয়াল। এরপর ভূমির দিকে তাকিয়ে কথা বলার চেষ্টা করল৷ ভূমি ওড়না দ্বারা নিজের মুখ চেঁপে ধরল। অর্ধাঙ্গিনীর চিবুক ছুঁয়ে মুখটা নিজের দিকে ফেরাল। প্রলয় বলল‚
“ভুল হয়ে গেছে৷ কিন্তু তুমি চাইলেই সিগারেটের এই উটকো গন্ধকে দূর করতে পারো।”
ভূমি অবাক চোখে তাকাল। এভাবে তাকাতে দেখে প্রলয় বাঁকা হাসল। ভূমির বাহু ধরে উঠিয়ে বিছানায় নিয়ে গিয়ে বসাল। নিজে থেকে গিয়েই বারান্দার দরজা আর ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল। ঘুম বাতি জ্বলছে৷ হুট করে আলো নিভে যাওয়ায় সবকিছুই অন্ধকার লাগতে শুরু করেছে। কিছুটা সময় যেতেই ঘুম বাতির আবছা আলোয় সে দেখতে পেল প্রলয় একদম তার সামনে৷ চমকে উঠল সে৷ কিছুটা ভয় পাওয়ায় বুকে দুহাত চেপে রেখেছে৷ ভূমিকে বিছানায় শুইয়ে দিল প্রলয়৷ এতটা সময় অপেক্ষা করানোর শাস্তি তো পেতেই হবে৷ ভূমির উপর ঝুঁকে প্রলয় বলল‚
“নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে ঘন ঘন প্রেম আর আদর পাবে এটাই স্বাভাবিক৷”
ভূমিকে বিছানার সঙ্গে চেপে ওষ্ঠাদ্বয় মিলিয়ে দিল৷ খুবই রুক্ষ ভাবে চুম্বন সৃষ্টি করছে প্রলয়৷ নিজেকে নিয়ে ভূমির মাঝে কোনো খারাপ লাগা রাখবে না সে৷ না আর সিগারেট ধরবে। বেশ কিছুক্ষণ পর ভূমির ওষ্ঠদ্বয় ছেড়ে গ্রীবাদেশে নেমে এলো প্রলয়৷ মুহূর্তেই কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভূত হলো ভূমি। চিনচিনে ব্যথার সঙ্গে হালকা জ্বালাও করছে৷ সমস্ত ভর ভূমির উপর৷ বিছানার সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে মেয়েটা৷ এদিকে বিছানার গদি থেকেও ভূমিকে বেশি কোমল মনে হলো প্রলয়ের। ভূমিকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নেশালো শান্ত স্বরে বলল‚
“এতটা কোমল না হলেও পারতে! মাঝে মাঝে তো আমার ভয় হয়‚ কখন না জানি গলে যাও।”
প্রলয় আবারও মগ্ন হলো তার ভূমি কন্যাতে। তীব্র অনুভূতির চাবুকাঘাতে মূর্ছা যাচ্ছে দুটি দেহ৷ আবারও সেই সুমধুর লীলায় মেতে উঠল কপোত-কপোতী। সাক্ষী হয়ে থাকল একটি নির্জন প্রহর৷
রাতে দুটো…
একাধারে সিগারেটের ধোঁয়া বিলীন করছেন মেহরাব শিকদার। ঘুম আসছে না কিছুতেই। কিছু একটার চিন্তা উনাকে ঘুমতে দিচ্ছে না। বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় চলে এসেছেন তিনি। এরই মাঝে দুটো সিগারেট পুড়িয়ে ফেলেছেন। ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছেন ফিরোজা৷ রাত তো কম হয়নি। মেহেরব শিকদার নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য বড্ড চিন্তিত। কী হবে যখন ফিরোজা সব সত্যি জেনে যাবেন? তিনি যে বড্ড ভালোবাসেন নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে৷ মাথা ধরে আসছে উনার। অতীতের একটা ভুল সিদ্ধান্তে জীবনটা ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে৷ কিন্তু সেই ঘটনার জন্য মোটেও অনুতপ্ত নন তিনি। সেই অধ্যায় তো তখনই শেষ করে দিয়েছিলেন৷ কিন্তু অতীত পিছু ছাড়লে তো! তবে যা-ই হোক অতীত আর কিছু সত্য থেকে কখনোই পর্দা তোলা যাবে না৷ দরকার পড়লে নিজের পথের কা’টা তিনি যে কোনো মূল্যেই উপড়ে ফেলবেন। ঘুম না হওয়ায় চোখ অসম্ভব লাল হয়ে রয়েছে৷ তিনি আর সময় অতিবাহিত না করে ঘরে ফিরে এলেন৷ ফিরোজার চুলে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিয়ে কয়েকটা কথা ভীষণ ভাবে আওড়ালেন।
“আমার তোমাকে হারানোর বড্ড ভয় হয় ফিরোজা৷ অতীতকে আমি কিছুতেই তোমার সামনে আসতে দেব না৷ তার জন্য যা করতে হয় আমি করব৷ আমি মোটেও পিছুপা হব না৷ মহুয়া আর ভূমিকে আমার বর্তমানে কিছুতেই পদার্পণ করতে দেব না। তুমি আর অর্পণই তো আমার সব।”
কিন্তু আফসোস ফিরোজা উনার একটা কথাও শুনতে পেলেন না৷ শুনলে হয়তো গল্পটা অন্যরকম মোড় নিত৷ মেহরাব শিকদার অন্যপাশে শুয়ে পড়লেন৷ রাত তো কম হলো না৷ এবার একটু ঘুমনোর চেষ্টা করা প্রয়োজন। সকালে হসপিটালেও যেতে হবে৷ ঘুমতে না পারলে সারাদিন মাথা ব্যথা থাকবে৷
প্রত্যুষে…
নীলিমায় ধূসর রঙা মেঘের ঝাঁক। বাতাসের তালে ভেসে বেড়াচ্ছে। ভূমির বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে রয়েছে প্রলয়। মেয়েটাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে৷ একটু নড়াচড়া করার সু্যোগটুকু নেই। ঘুমের মাঝে নিজের উপর ভার কিছু অনুভূত হলো ভূমির৷ সূর্য এখনো উদয় হয়নি। তবে সকাল হতে শুরু হয়েছে। ভূমির ঘুম হালকা হয়েছে৷ একটু একটু করে চোখ মেলে তাকাল সে৷ ফজরের নামাজ আদায় করার জন্য এখনো অনেকটা সময় বাকি রয়েছে। এদিকে তাকে ঘুমের ঘোরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে প্রলয়। বহু কষ্টে হাত বের করে প্রলয়কে সরানোর চেষ্টায় লেগে পড়ল ভূমি। প্রথম কয়েকবার ব্যর্থ হলেও মিনিট দুয়েক পর ঠিকই সফল হলো। ভূমি বিছানা ছেড়ে নামল। ওয়ারড্রব থেকে নিজের প্রয়োজন জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ছুটে গেল। তাড়াহুড়ো করেই গোসল সারবে৷ কাল ফজরের নামাজ আদায় না করে পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। বেলা করে ঘুম ভেঙেছে। শাশুড়ী মা তো এসব মোটেও পছন্দ করেন না৷ রোজ দেরি করে ঘুম ভাঙা তারও পছন্দ না৷ এখন থেকে প্রলয়কে বলবে প্রতিদিন তার ফোনে এলার্ম দিয়ে দিতে৷ এরই মাঝে গোসল করে ফজরের নামাজ আদায় করে নিল৷ এরপর ভেজা কাপড় গুলো বারান্দায়। জানালার ধারে ঝুলে থাকা পর্দা গুলোকে সরিয়ে জানাল হুট করে খুলে দিল ভূমি৷ প্রত্যুষের তেজি সমীরণ এসে ভীড় জমাল পুরো ঘরময়৷ শীতল সমীরণে গা শিরশির করে উঠল৷ ভেজা চুলগুলো মেলে দিল ভূমি৷ এখন হয়তো কেউ-ই ঘুম থেকে ওঠেনি৷ সবে সাড়ে ছয়টা বাজছে৷ তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো ভালো করে মুছে নিল চট করে৷ প্রলয় ঘুমচ্ছে এখনো। তাকে আর জাগাল না সে৷ এ বাড়িতে আসার পর জেনেছে লোকটা একটু ঘুমকাতুরে। দেরি করে ঘুম থেকে উঠতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন৷ রাতে ঘুমানও দেরি করে৷ একটা দেড়টা অবধি জেগে থাকার অভ্যেসও রয়েছে এমপি মশাইয়ের।
চলবে?…..