রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫৬| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
618

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫৬|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

সময় প্রবহমান। দেখতে দেখতে তিনটে মাস কী অবলীলায় কে’টে গেল। প্রলয়ের সঙ্গে সংসার জীবন বেশ ভালোই কাটছে ভূমির৷ এরই মাঝে পূর্ণতা পুষ্পিতার মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বের হয়েছে৷ দুজনেই গোল্ডেন প্লাস পেয়েছে৷ পরিবারের সবাই খুব খুশি ওদের এই রেজাল্টের জন্য। মহুয়া এসেছিলেন আরশের সঙ্গে। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি এসে দুদিন থেকে গিয়েছেন তিনি। একমাত্র ভূমির জোরাজুরিতেই তিনি এসেছিলেন। শিকদার বাড়িতে আসার কোনো ইচ্ছেই উনার ছিল। মেয়ের কথা ফেলতে পারেন না তিনি। দুদিন থেকে আজ ফিরে গিয়েছেন গ্রামের বাড়িতে। তিনি যতদিন ছিলেন একমুহূর্তের জন্য উনাকে সহ্য করতে পারছিলেন না মেহরাব শিকদার। মহুয়া উনার সম্পর্কে এমন কিছু সত্যি জানেন যেটা উনার জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে৷ তাইতো মহুয়া উনার চক্ষুশূল। যাওয়ার আগে মহুয়া ঘুরেফিরে সেই একই কথা বলে গিয়েছিলেন‚ “একটু সাবধানে থাকবেন৷ আপনার মুখোশ ক্রমশ উন্মোচিত। যেই সন্তানকে এতদিন অবহেলা করেছেন একদিন সেই সন্তানকেই দুনিয়ার কাছে পরিচয় দিতে হবে। তখন কোথায় পালাবেন? আপনার জন্য পালানোর পথ আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাবে।” মেহরাব শিকদারের সেদিন খুব মাথা গরম হয়েছিল। মহুয়াকে খু’ন করতে ইচ্ছে হচ্ছিল। তাই তিনি ভাবলেন ভূমিকে আজ সাফ সাফ কিছু কথা বলে দেওয়াই প্রয়োজন। ভূমির ঘরের সামনে এসে কড়া নাড়লেন মেহরাব শিকদার। সঙ্গে সঙ্গেই ভূমি গিয়ে ঘরের দরজা খুলে দিল৷ কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে মেহরাব শিকদার ঘরের ভেতরে চলে এলেন। কোনো রকমের ভণিতা ছাড়াই বললেন‚

“তোমার আম্মাকে বলে দিও পরবর্তীতে যেন এ বাড়িতে আর না আসে।”

“শিকদার বাড়ির লোকেরা বুঝি কুটুমদের আপ্যায়ন করতে ভয় পায়?”

“তোমরা মা মেয়ে মিলে চাইছটা কী? শিকদার বাড়ির বউ হয়েছ বউয়ের মতই থাকবে‚ বাড়ির মেয়ে হওয়ার চেষ্টাও করবে না। তোমার মায়ের কাছ থেকে এই কথাটা তো জেনেছ যে‚ আমি তোমাকে নিজের মেয়ে বলে স্বীকার করি না। আর না কোনদিন করব।”

“আপনাকে যতই দেখি ততই আপনার প্রতি ঘৃণা তড়তড় করে বাড়তে শুরু করে। বাবারা বুঝি এমনই হয়? যতই সত্যিটা লুকানোর চেষ্টা করুন না কেন— সত্যিটা একদিন সবার সামনে আসবেই! একটা মানুষ কী করে এতটা জঘন্য হতে পারে!”

“তোমার যা ইচ্ছে তুমি ভাবতে পারো। আমার কিছু যায় আসে না।”

“আপনাকে নিজের বাবা ভাবতেও ঘৃণা করে।”

“আমি তো তোমাকে মেয়ে বলেই মানি না। আর না তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক আছে আমার।”

তাচ্ছিল্য করে হাসল ভূমি। প্রথম দিনের সম্মানবোধ আজ আর নেই৷ এমন একটা লোকের প্রতি কী করে সম্মান আসবে? এত পাপ— এত অন্যায় করার পরও তার মাঝে কোনো অপরাধবোধ নেই। চোখে চোখ রেখে তেজি স্বরে বলল‚

“র’ক্তের সম্পর্ক কী এত সহজে মুছে ফেলা যায়?”

ভুমির এমন আত্মবিশ্বাস আর সাহস দেখে রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে মেহরাব শিকদারের৷ সমস্ত রাগ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেও রাখতে পারছেন না তিনি। চোখ দিয়ে যে আগুন ঝড়ছে। শিকদার বাড়ির র’ক্ত বলে কথা। রাগ তো এদের র’ক্তে রয়েছে। মেহরাব শিকদার মৃদু চেঁচিয়ে বললেন‚

“বেশি বাড় বেড় না মেয়ে। আমার সম্পর্কে এখনো তোমার কোনো ধারণাই হয়নি।”

“ধারণা হবার বাকিটা কী রেখেছেন? কী মনে করেছেন‚ আমি আপনার সম্পর্কে কিছুই জানি না?”

“একটু বেশিই জেনে ফেলেছ! আমার অন্য রূপটা স্বচক্ষে দেখনি তাই এত সাহস দেখাচ্ছ।” বলেই বাঁকা হাসলেন মেহরাব শিকদার। তবে উনার হাসিকে খুব বেশি সময় স্থায়ী হতে দিল না ভূমি৷ সে বলল‚

“একটিবার ভাবুন তো! যদি আপনার সব সত্যিটা আমি সবার কাছে বলে দিই? আর ভয়? সেটা তো আমি আমার বাবাকেও পাই না। ভুলে যাবেন না শিকদার বাড়ির র’ক্ত আমার শরীরেও বইছে।”

“তুমি কী ভেবেছ তুমি বলবে আর সবাই তোমার মুখের কথা বিশ্বাস করে নেবে?”

“শুধু মুখে কেন বলব? প্রমাণ করে দেখাব।”

এবার কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন মেহরাব শিকদার। ক্রমশ ঘামতে শুরু করেছেন তিনি। সত্যিই কী ভূমি মুখে যা বলছে তেমনটাই করবে? না! এমনট তো হতে দেওয়া যায় না। এত বছরের সমস্ত খ্যাতি‚ সম্মান এক নিমিষেই যে শেষ হয়ে যাবে। তা কী করে হতে দেওয়া যায়! আর একমুহূর্ত দাঁড়ালেন না তিনি। বড়ো বড়ো পা ফেলে ভূমির ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মেহরাব শিকদার চলে যেতেই কয়েক ফোঁটা অশ্রুকণা আঁখিপল্লব হতে গড়িয়ে পড়ল। এতক্ষণ নিজেকে ক্রমাগত শক্ত রাখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সেও তো একটা মানুষ। বাবাকে বাবা বলার অধিকার তো তারও আছে। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস— যেখানে বাবাকে বাবা বলে ডাকা যায় না। তাকে তো সন্তান হিসেবে পরিচয়ই দেন না মেহরাব শিকদার। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে ভূমির। মাঝে মাঝে পূর্ণতা পুষ্পিতাকে দেখলে বড্ড আফসোস হয় তার। মোর্শেদ শিকদার কত স্নেহ করেন ওদের দুটোকে! এমনটা তো তার ক্ষেত্রেও হতে পারত। বহু কষ্টে কান্না সংবরণ করল ভূমি। ওড়না দিয়ে চোখ মুছে নিল সঙ্গে সঙ্গে। ঘরের দরজা খোলা। যে কেউ চলে আসতে পারে। প্রলয়ও যেকোনো সময় চলে আসতে পারে। এরই মাঝে দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। ভূমি নিজেকে একবার আয়না পর্যবেক্ষণ করল। ভেতর থেকে অনুমতি পেয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল অর্পণ। তার হাতে একটা লাল ব্যাগ। আসার সময় আইসক্রিম কিনে এনেছিল। ব্যাগটা ভূমির দিকে এগিয়ে দিয়ে অর্পণ বলল‚

“এটা তোমার জন্য।”

“এটাতে কী আছে ভাইয়া?”

“তোমার জন্য আইসক্রিম। এটা শুধুই তোমার জন্য। পূর্ণতা পুষ্পিতার জন্যও এনেছি।”

ভূমির চোখমুখে দারুণ চঞ্চলতা। অজান্তেই অর্পণ তার ভাই হবার দায়িত্ব পালন করছে। ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে করতে ইচ্ছে করছে। উঁহু! দুঃখে নয়— সুখে কান্না পাচ্ছে তার৷ কম্পিত কণ্ঠে বলল‚ “ধন্যবাদ ভাইয়া৷”

“তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

“জি ভাইয়া বলুন।”

“তখন তুমি বাবার সঙ্গে এভাবে কথা বলছিলে কেন? আর বাবাই বা তোমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছিল কেন?”

ভূমি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু চেষ্টা করেও এড়িয়ে যেতে পারল না৷ হুট করেই অর্পণের হাতটা নিজের মাথায় রাখল। কথাগুলোকে মনে মনে সাজিয়ে বলল‚

“তার আগে আমার মাথায় হাত রেখে বল‚ এই কথাগুলো আর কাউকে কোনোদিন বলবে না?”

ভূমির এমন ব্যবহার খুবই অবাক করল অর্পণকে৷ কী এমন কথা আছে যা শোনার জন্য মাথা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করতে হবে তাকে? কিন্তু জানাটাও খুবই প্রয়োজন। অর্পণ মেনে নিল৷ শুকনো ঢোক গিলে বলল‚

“কাউকে বলব না৷ তুমি বল!”

ভূমি সব কথাই বলল অর্পণকে৷ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না অর্পণ। না কথাগুলো ফেলে দিতে পারছে। তখন মেহরাব শিকদার আর ভূমির মাঝে হওয়া কথাগুলো সবই শুনেছে সে। তবুও ভূমির মুখ থেকে আরও কিছু সত্যি জানার ছিল তার। যাকে নিজের আইডল‚ নিজের ইন্সপিরেশন মনে করত‚ সেই লোকটাই এতদিন মুখোশ পড়ে ভালো মানুষের নাটক করেছেন৷ বাবার প্রতি ঘৃণায় জর্জরিত হলো চিত্ত এবং মস্তিষ্ক। দাউদাউ করে জ্বলছে ভেতরটা। ভূমির চোখের দিকে চোখ মেলাতে পারছে না। অজান্তেই যাকে বোনের সম্মান দিয়েছে‚ সেই মানুষটাই তার আপন বোন৷ তারও ছোটো বোন রয়েছে৷ ভূমির হাতখানা ধরে কান্না করে দিল অর্পণ। কথায় আছে পুরুষ মানুষের কান্না করতে নেই । অথচ আজ নিজের চোখেই নিজেকে খারাপ মনে হচ্ছে। নিজের র’ক্তকে কলুষিত মনে হচ্ছে। ওড়না দিয়ে অর্পণের চোখের পানি মুছে দিয়ে ভূমি বলল‚

“আম্মা আর উনার পর আমার এটা মনে হবে না যে আমার কেউ নেই। আমি একা নই— আমার নিজের ভাই রয়েছে৷”

স্নেহময় হাতে ভূমির মাথায় হাত বুলিয়ে অর্পণ বলল‚ “আমারও একটা বোন রয়েছে। কেউ তোর পাশে থাকুক বা না থাকুক— আমাকে তোর পাশে সবসময় পাবি বোন।”

একটু থেমে অর্পণ আবারও বলল‚ “পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে ভাই বোনের সম্পর্ক। ছোটো বেলা থেকেই খুব করে চাইতাম আমার একটা বোন হোক। পূর্ণতা পুষ্পিতা তো আমার বোন তবুও আমার একজন বোনের অভাব ছিল। আল্লাহ আমার সেই অভাবটা তো বহু আগেই পূরণ করে দিয়েছিলেন। অথচ তা অজানাই ছিল। আমার বোন আমার চোখের সামনেই ছিল কিন্তু আমি জানতেই পারলাম না৷ ভাই বোনের নাকি রক্তের টানের থেকে আত্মার টান বেশি গভীর হয় তবে আমি কেন একটুও বুঝতে পারলাম না?”

ভূমি অশ্রুসিক্ত চোখে অর্পণের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না। এক হাতে এখনো আইসক্রিমের ব্যাগটা ঝুলছে৷ এতক্ষণে হয়তো গলতে শুরু করেছে৷ অর্পণ তা খেয়াল করে বলল‚

“দেখেছিস— আমাদের বাক্যালাপে আইসক্রিম হয়তো গলতে শুরু করেছে৷ তুই তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আমি ঘরে যাচ্ছি।”

আঁখিপল্লব ঝাপ্টে সায় জানাল ভূমি। অর্পণ আর দাঁড়াল না৷ ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ঘরের দরজা চাপিয়ে দিয়ে গেল৷ সমস্ত মন খারাপকে দূরে রেখে ভূমি বিছানায় বসে আইসক্রিম খেতে শুরু করল৷ এটা তার ভাই অনেক ভালোবেসে তার জন্য কিনে নিয়ে এসেছে। আনন্দ হচ্ছে ভীষণ। ইচ্ছে হচ্ছে আইসক্রিমের বক্সটাকেই বুকের ভেতরে আগলে রাখতে। এই কথাটা অন্তত আম্মাকে জানানো দরকার। এরই মাঝে বেহায়া ফোনটা বাজতে শুরু করল৷ একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসছে৷ অচেনা নাম্বার বিধায় ধরল না ভূমি৷ ফোনটা সেভাবেই ক্রমাগত বাজতেই থাকল৷ এদিকে মনের সুখে আইসক্রিম খাচ্ছে ভূমি। ভ্যানিলা ফ্লেভারের আইসক্রিম খেতে বেশ লাগছে৷ আবারও ফোন বেজে ওঠায় বিরক্ত হলো ভূমি। এবার ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করল৷ লাউড স্পিকারে রেখে সালাম জানাল সে।

“আসসালামু আলাইকুম! কে বলছেন?”

“আমি তোমার দুষ্টু বর বলছি।”

ভূমি চট করে ফোনের স্ক্রিনে তাকাল৷ নাম্বারটা চেনে না কিন্তু এমপি মশাইয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। ভূমি ফোনটাকে আবারও কানে রাখল। প্রলয় বলছে‚

“আমার ভোলা ভালা বউটা কী করছিল?”

“আইসক্রিম খাচ্ছিলাম৷ আপনি খাবেন?”

“তুই এইসময় আইসক্রিম পেলে কোথায়? আর খাচ্ছ যেহেতু কম খাবে! নয়তো ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।”

“ভাইয়া এনে দিয়েছে৷ আর ইতিমধ্যেই খেয়ে নিয়েছি সবটা।”

“ঠান্ডা লাগলে তোমাকে বারান্দা নয়তো ওয়াশরুমে ঘুমতে পাঠাব।”

ছোটো বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে জিজ্ঞেস করল‚ “ঘরে থাকতে দেবেন না কেন?”

“আমার বারণ শুনলে না কেন?”

“আইসক্রিম খেতে বেশ ভালো লাগছিল তাই আপনি কিছু বলার আগেই সবটা খেয়ে নিয়েছি। ঠান্ডা লাগবে না।”

কথাটা বলতে দেরি কিন্তু ভূমির হাঁচি দিতে দেরি হলো না৷ ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো৷ ভূমি আবারও গাল ফোলাল৷

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here