#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৬০|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
শেষরাতের দিকে কালো রঙা গাড়িটি এসে থেমেছে মোড়ল বাড়ির বাগানে। মণ্টু‚ মণিসহ মোড়ল বাড়ির সবাই সদর দরজার কাছে বসে রয়েছেন। সকলেই কাঁদছেন৷ শাহাদাৎ মোড়ল আর নাজমা খুবই স্নেহ করতেন মহুয়াকে। ছোটো বোনের নজরেই দেখে এসেছেন তিনি। মোড়ল বাড়িতে প্রায় পনেরো বছর ধরে কাজ করছেন মহুয়া। নিজের কাজ সবসময় খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন তিনি। কখনো কোনো কাজে গাফেলতি করেননি। আরশ‚ ইরা‚ মণি আর মন্টুও খুবই সম্মান করত মহুয়াকে। এমনটা কেউ-ই আশা করেনি। সামনেই একটা খাটিয়ায় পড়ে রয়েছে একটা নিথর দেহ। যার আপাদমস্তক সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই ভূমির মাঝে। হাত পা কেমন অসাড় হয়ে আসছে। প্রলয় তার হাতটা শক্ত করে ধরে রয়েছে। সারাটা রাস্তা বেশ অস্থিরতায় কেটেছে৷ এক মুহূর্তের জন্য দুচোখের পাতা এক করেনি ভূমি। বারবার প্রলয়কে জিজ্ঞেস করেছে তার আম্মা ঠিক আছে তো? আশানুরূপ কোনো জবাবই মেলেনি প্রলয়ের কাছ থেকে। ভূমিকে নিয়ে সামনে দিকে এগোলো প্রলয়। তাদের দেখা মাত্রই দাঁড়িয়ে পড়েছে সকলে। ইরা উঠে এগিয়ে এলো ভূমির কাছে। অর্পণও এসেছে সঙ্গে। প্রলয়ের কাছ থেকে কথাটা শোনার পর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি সে। মায়ের সমতূল্য মহুয়াকে খুবই সম্মান আর শ্রদ্ধা করত সে৷ ওরা তিনজনই সদর দরজার কাছে এগিয়ে গিয়েছে। প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে ভূমি জিজ্ঞেস করল‚
“এখানে ক..কে শুয়ে রয়েছে?”
কেউ-ই কোনো উত্তর দিতে পারল না৷ প্রলয়ও কিছু বলছে না। কী করেই বা কথাটা বলবে সে? তারও যে বড্ড খারাপ লাগছে৷ মহুয়া যে তারও মায়ের সমতূল্য। কেউ কিছু বলছে না দেখে এবার ভূমি কিছুটা চেঁচিয়ে প্রলয়কে বলল‚
“আপনি অন্তত কিছু বলুন! সে সন্ধ্যে থেকে এখন অবধি চুপ করেই রয়েছেন।”
ইরা এগিয়ে এসে ভূমিকে শান্ত করার চেষ্টা করল৷ কিন্তু কিছুতেই কিছু করতে পারল না। ভূমি ক্রন্দনরত কণ্ঠে ইরাকে বলল‚
“অন্তত তুমি কিছু বল ইরা!”
ভূমির কাঁধে হাত রেখে ইরা বলল‚ “নিজেকে সামলাও ভূমি। মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড়ো সত্যি হচ্ছে— সবাই চিরকাল বেঁচে থাকে না৷ মৃ’ত্যু দিয়েই তাদের জীবনের উপসংহার ঘটে। মহুয়া আন্টি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। উনি আর কোনো আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। এই সত্যিটাকে তুমিও মেনে নাও।”
মাথা ঘুরে উঠল ভূমির। নিটোল পা দুটো কাঁপছে। শরীরে শক্তি পাচ্ছে না সে। প্রলয় এখনো তার হাতখানা শক্ত করে ধরে রেখেছে৷ “তার আম্মা আর নেই” কথাটা শ্রবণ করা মাত্রই জীবনটা যেন এখানেই থমকে গেল। “তার আম্মা আর নেই” তারমানে আজ থেকে তার দুনিয়াটাই বৃথা৷ নিজের বলতে আর কেউ রইল না তার। হাঁটু গেড়ে মাটির উপর বসে পড়ল ভূমি। লা’শের কাছে গিয়ে মুখের উপর থেকে সাদা কাপড়টা তুলল৷ লাইটের আলোতে মায়ের মায়াময়ী মুখটা মুহূর্তেই দৃষ্টিগোচর হলো। সঙ্গে সঙ্গে হুহু করে কেঁদে উঠল ভূমি। আলতো হাতে মায়ের মুখটা ছুঁয়ে বলতে লাগল‚
“অ্যাই আম্মা চোখ খুলে দেখ— তোমার ভূমি এসেছে! কথা বলবে না আমার সঙ্গে? তুমি তো বলেছিলে অহর্নিশ আমার পাশে পাশেই থাকবে। কখনো একা করে দেবে না। তাহলে আজ কেন কোনো কথা বলছ না আম্মা? তুমি কী তোমার কথা রাখবে না? তাহলে কেন আমাকে বিয়ে দিয়েছিলে? কেন আমাকে তোমাকে কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিলে আম্মা? অভাবের মাঝেও তো আমরা ভালোই ছিলাম আম্মা। না আমাকে বিয়ে দিতে আর না আজকে এমন একটা দিন আসত। তুমি বড্ড স্বার্থপর আম্মা! বড্ড স্বার্থপর!”
ভূমির এত কাতরতাও আজ তার আম্মাকে স্পর্শ করছে না৷ দিব্যি চোখ দুটো বন্ধ করে আছেন। লা’শ কী আর তাকাতে বা কথা বলতে পারে? স্তব্ধ চাহনিতে ভূমি চিৎকার করে বলল‚ “আম্মা…!”
ভূমিকে শান্ত করার জন্য প্রলয় এবার চেঁচিয়ে বলল‚ “চুপ! আর একটা কথাও না৷”
কিছুটা শান্ত হলো ভূমি। তবে নীরবে অশ্রুপাত করছে মেয়েটা। ভূমিকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল প্রলয়৷ সে অনুভব করল ভূমির শরীরটা নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়েছে তার উপর। পরক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে এবং ভূমিকে। পাঁজো কোলে তুলে মোড়ল বাড়ির ভেতরে চলে গেল৷ ভূমির কিছুটা বিশ্রামের প্রয়োজন। মেয়েটা জার্নি করতে পারে না। বেশ কয়েকবার বমিও করেছে গাড়িতে৷ তারপরও দুচোখের পাতা এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ করেনি। ভূমির অবস্থা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে প্রলয়।
ভোর হতে শুরু করেছে। গ্রামে পাড়াপড়শি অনেকেই আসছে। কেউ কেউ তো মিথ্যে কান্নায় মন ভোলানোর চেষ্টা করছে। মহুয়া জীবিত থাকাকালীন এমন কোনো মানুষ বাকি ছিল না যারা উনাকে কটু কথা শোনাননি। কৌশলে অনেকেই অনেক খারাপ কথা শুনিয়েছেন। অথচ আজ তারাই মিথ্যে কান্নায় মন ভোলাচ্ছেন। ইরা আর নাজমা কোরআন তেলাওয়াত করছেন। ভূমি কেমন নিশ্চুপ ও নিস্পৃহ হয়ে গিয়েছে! নিজেকে তার অভিশপ্ত মনে হচ্ছে৷ তার আম্মার এমন জীবনের জন্য একমাত্র দোষী সে নিজেই। আজ থেকে ভূমির জীবনে শুধুই হাহাকার নেমে এসেছে। সকাল দশটার পর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। পুরো মোড়ল বাড়িতে মানুষের ভীড় জমেছে। এমন নিশ্চুপ ভূমিকে দেখে বুকের ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে প্রলয়ের৷ মহুয়ার নিথর দেহটা এখনো বাহিরের খাটিয়ায় শুইয়ে রাখা হয়েছে৷ লা’শকে গোসল করানো হয়েছে ভোর রাতে। মহুয়ার মৃ’ত্যুর সংবাদ মসজিদে মাইকিং করা হচ্ছে। শোক সংবাদের প্রতিটা ধ্বনি কানে ঝংকার তুলছে।
সকালে ঘুম ভাঙতেই মায়ের লা’শের সামনে এসে বসে পড়ল ভূমি। মায়ের শঙ্কাহীন বুকটা কেমন শক্ত আর হিম হয়ে আছে! মুখ তুলে তাকাল চির নিদ্রায় শায়িত প্রাণপ্রিয় মায়ের নিষ্পাপ মুখাবয়বে। ভূমি কন্যার সিক্ত ফোলা আঁখিদ্বয়ে অস্পষ্ট অভিলাষ। এই বুঝি আম্মা চোখ মেলে তাকাল৷ এই বুঝি ভূমি বলে কাছে ডাকল। কিন্তু হায়! আম্মা যে আর চোখ মেলে চাইবেন না। একটিবার ভূমি বলে ডাকবেন না। ভূমি ডুকরে উঠল। বাস্তবতা যে বড়ো-ই তিক্ত! ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলতে লাগল‚
“তোমার ভূমি যে একা হয়ে গেল আম্মা। একদম একা। না তার বাবা আছে আর না তার আম্মা৷ তুমি কেন আমাকে একা করে চলে গেলে আম্মা? এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় তোমার ভূমি যে বড্ড একা।”
বেলা বাড়তে শুরু করছে৷ সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোদের রুষ্টতা। ভূমিকে কিছুতেই লাশের পাশ থেকে সরানো যাচ্ছে না। মেয়েটা কেমন পাথর হয়ে গেছে! চোখ দুটো হয়ে আছে শুকনো। প্রলয় জোর করে ভূমিকে তুলে নিয়ে ইরার কাছে দিয়ে এলো৷ এতে করে পাগলামি আরও বেড়েছে মেয়েটার। ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে শুরু করেছে অনবরত।
❑
শোকের মাঝে সারাটাদিন কী অবলীলায় কেটে গিয়েছে! বিষণ্ণা উদাসীন ভূমি সুনিপুণ ভাবে নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী করে রেখেছে। কারো সাথে কোনো কথা পর্যন্ত বলেনি। কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে! খাওয়াদাওয়া ঠিক করে করেনি। এতে করে আরও দূর্বল হয়ে পড়েছে। সারাক্ষণ শুয়েই থেকেছে। মাথা তুলে উঠে বসার শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই। এদিকে তিনদিন অনিন্দ্যনগর থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রলয়। মহুয়ার কুলখানির আয়োজন বেশ বড়োসড়ো করে করা হবে৷ মসজিদে মিলাদ দোয়া পড়ানো হবে৷ পুরো গ্রামবাসী আর এতিমদেরকে খাওয়ানো হবে। সেটা নিয়ে বৈঠকখানায় কথাবার্তা চলছে। শাহাদাৎ মোড়ল‚ আরশ আর অর্পণও এখানেই বসে রয়েছে। কথায় কথায় প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚
“মহুয়া আন্টির কী হয়েছিল আঙ্কেল?”
“কাল দুপুরের খাবার খাওয়ার পর আমরা সবাই ঘুমিয়েছিলাম৷ মহুয়াও নিজের ঘরে গিয়ে হয়তো শুয়েছিল৷ এরপর যখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে এলো তখন তোমার আন্টি মহুয়াকে ডাকতে গেল। গিয়ে দেখল কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছে মহুয়া। অথচ কাল খুব গরম ছিল। তো যাই হোক! তোমার আন্টি ডাকল মহুয়াকে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পেল না। মুখের উপর থেকে কাঁথা সরাতেই দেখতে পেল মহুয়া একদম নিস্তেজ হয়ে শুয়ে রয়েছে। নিশ্বাস অবধি নিচ্ছিল না। তাড়াহুড়ো করে আমাদেরকে ডাকে। এরপর আরশ নিজে মহুয়ার নাড়ী পরীক্ষা করে। কিন্তু ততক্ষণে মহুয়া আর নেই!”
নাজমা বললেন‚ “এমন কিছু যে ঘটবে এটা আমাদের কল্পনাতীত ছিল৷ কখনো ভাবিইনি যে‚ মহুয়া আমাদেরকে এভাবে ছেড়ে চলে যাবে! ভূমির দিকে তাকানো যাচ্ছে না বাবা। মেয়েটা খুবই ভেঙে পড়েছে। একমাত্র মা-ই তো তার সব ছিল।”
মহুয়ার জন্য খুবই খারাপ লাগতে শুরু করেছে৷ ভূমিকে কী করে সামলাবে সেটাই ভেবে যাচ্ছে প্রলয়! মেয়েটা খুবই ভেঙে পড়েছে। মহুয়াকে হারিয়ে ভূমি দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়েছে। কেমন পাথর হয়ে গিয়েছে! শাহাদাৎ মোড়ল আর নাজমার কথা শুনে খুবই খারাপ লাগল অর্পণের। মহুয়া জীবিত থাকাকালীন সময় কখনোই নিজের যোগ্য সম্মান পাননি। অর্পণ মনে মনে একটা কথা আওড়াল‚ “নিজের অপারগতা আমি ধিক্কার জানাই। সত্য জেনেও আমি আপনার জন্য কিছুই করতে পারিনি আন্টি। আপনাকে ন্যায় দেওয়াতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। বাবার অন্যায়কে আমি নীরবে হজম করেছি৷ তবে আপনাকে কথা দিচ্ছি‚ বড়ো ভাই হয়ে ভূমির পাশে আমি সবসময় ছায়ার মতো থাকব। কোনো বিপদ ওকে ছুঁতে পারবে না। বাবার ভালো মানুষের মুখোশ একদিন সবার সামনে উন্মোচন হবে।” মনে মনে খুবই আফসোস করতে শুরু করল অর্পণ। কিছুই ভালো লাগছে না তার৷ মেহরাব শিকদারের সত্যিটা যদি তার মা জানতে পারে তাহলে কী হবে? মাকে কী করে সামলাবে সে? মহুয়া আর ভূমির মতো তার মায়ের জীবনটাও যে এলোমেলো হয়ে যাবে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এখনই খুব চিন্তিত সে।
অদ্ভুত অস্থিরতায় সাঁঝ পেরুল। কেটে গেল আরও কয়েকঘণ্টা। ব্যস্ততার মাঝে ভূমির সঙ্গে দেখা হয়নি বেশ অনেকটা সময় হয়েছে। ইরার কাছে ভূমির দায়িত্ব দিয়ে সে একটু বেরিয়েছিল। এরপর ঘরে গিয়ে ভূমিকে কোথাও পায়নি। প্রলয় যখন ঘরে আসে তারপরই ইরাও খাবারের প্লেট নিয়ে ঘরে আসে। ইরাকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল‚ “ভূমির নাকি খুব ক্ষিধে পেয়েছিল তাই সে রান্নাঘরে গিয়েছিল ভূমির জন্য খাবার নিতে।” এবার কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল প্রলয়। কোথায় যেতে পারে মেয়েটা? এমনিতেই ভূমির শরীরটা খুবই দূর্বল। একা একা কোথাও যাওয়ার মতো শক্তি অন্তত নেই! প্রলয় তাড়াতাড়ি করে সারাবাড়ি খুঁজতে শুরু করল৷ না! কোথাও নেই ভূমি! খুবই চিন্তায় রয়েছে প্রলয়৷ যেন দম আটকে আসছে তার। এরপর অর্পণের ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“ভূমিকে দেখেছিস?”
অবাক হয়ে অর্পণ বলল‚ “কেন ও কী ঘরে নেই?”
চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রলয় বলল‚ “ঘরে আর সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কোথাও পাচ্ছি না তো।”
“সে কী! কোথায় গেল মেয়েটা? ভাই চল— একটিবার বাহিরের দিকটা খুঁজে আসি। অথবা ওদের সেই পুরোনো বাড়িটায়।”
সায় জানাল প্রলয়। মুখে বলল‚ “হুম— চল!”
চলবে?…..