#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৬১|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
রাত তখন বারোটার কাছাকাছি। একটু একটু করে জ্ঞান ফিরছে ভূমির৷ মাথা ভার হয়ে আছে৷ এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতে লাগল। সংকীর্ণ কামরায় লাল নীল আবছা বাতি জ্বলছে। আবছায়ায় সবকিছুই অচেনা লাগছে৷ শোয়া থেকে উঠে বসার শক্তিটুকু নেই৷ সকালে নাজমা জোর করে দুটো রুটি খাইয়ে দিয়েছিলেন। এরপর আর সারাদিন তার খাওয়া হয়নি। মাথা তুলে উঠতে পারছে না। ঘরের লাল নীল বাতি নিভে গিয়ে আবছায়া ঘরটা আলোকিত হয়ে গেল৷ চোখমুখ কুঁচকে এলো ভূমির। কিছুক্ষণ পর নিজেকে ধাতস্থ করে‚ দুটো মেয়েকে তার মাথার আর পায়ের কাছে বসে থাকতে দেখতে পেল। মেয়ে দুটোকে সে চেনে না। আর না কখনো দেখেছে। পরক্ষণেই আম্মার কথা মনে পড়তেই ডুকরে কেঁদে উঠল সে। শুয়ে থেকেই ভূমি বলল‚ “এটা কোথায়? আমি এখানে কী করে এলাম?” ভূমির কাছ থেকে একথা শুনে পায়ের কাছে বসে থাকা মেয়েটা মুখ ভেংচি দিয়ে বলল‚
“ন্যাকামি না করে উঠ তো৷ পড়ে পড়ে তো অনেক ঘুমোলি!”
মাথার কাছে বসে থাকা মেয়েটা এবার বলল‚ “এভাবে বলিস না চামেলি। দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা অসুস্থ।”
“এসব অসুস্থতা তো ভান। ইচ্ছে করেই এমন করছে৷”
কিছুই বুঝল না ভূমি৷ আধস্বরে বলল‚ “আপনারা কারা? আমি এখানে কী করে এলাম?”
মাথার কাছে বসে থাকা মেয়েটা বলে উঠল‚ “তোমাকে আমরা রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়তে থাকতে দেখেছিলাম৷ এরপর আমাদের এখানে নিয়ে এসেছি।”
ভূমির মনে পড়ল‚ সে তো তার মায়ের কবরের সামনে গিয়েছিল৷ দূর থেকেই মায়ের কবরটা দেখতে চেয়েছিল। দূর্বল শরীর নিয়েই একটু একটু করে বেরিয়ে এসেছিল। প্রলয়কে পর্যন্ত বলেনি। হুট করেই ভূমির শরীরটা আবারও খারাপ করতে শুরু করে৷ শরীর ঘামতে শুরু করছিল। হাত পা দুটো নিঃসাড় হয়ে পড়ছিল৷ ভূমি দুচোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে পারছিল না৷ এরপর অচৈতন্য হয়ে ঢলে পড়েছিল৷ তারপর আর কিছু মনে নেই তার৷ সবকিছু মনে পড়ায় ভূমি বলল‚
“এই জায়গাটা কোথায়? দয়া করে আমাকে আমার বাড়িতে পৌঁছে দিন। আমার স্বামী হয়তো আমার জন্য চিন্তা করছেন।”
এরইমাঝে এখানকার সর্দারনি এলেন। পাতলা ফিনফিনে বাসন্তী রঙা শাড়ি৷ রঞ্জিত অধর কোণে হাসির ছোঁয়া। বড়ো বড়ো পা ফেলেই ঘরের ভেতরে এলেন তিনি। উনাকে দেখা মাত্রই মেয়ে দুটো দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ভূমি উঠে বসার চেষ্টা করল। অবশেষে সফল হলো সে। বালিশে আধশোয়া হয়ে বসল। মহিলা এবার বলে উঠলেন‚
“অসুস্থ বলে পাড় পেয়েছিস মেয়ে। একটা দিনের সময় দিলাম। ভালো মতো খাওয়াদাওয়া করে নিজেকে সুস্থ করে তোল। অ্যাই চামেলি‚ তিথি!”
“জি ম্যাডাম।”
“কাস্টমারদের ডিমান্ড বাড়ছে। তাদের নাকি নতুন মেয়ে লাগবে৷ এই মেয়েকে তোদেরই তৈরি করতে হবে৷ দেখতে শুনতে তো আগুন সুন্দরী। কাস্টমারের ভীড় জমে যাবে৷”
চামেলি বলল‚ “আপনি কোনো চিন্তা করবেন না ম্যাডাম।”
ভূমি এদের কথা কিছুই বুঝতে পারল না৷ তবে এরা যে মোটেও সুবিধের নয় সেটা এতক্ষণে বুঝে গিয়েছে। একটু একটু করে বিছানা থেকে নামতে আরম্ভ করল। মুখে বলল‚
“আমাকে আমার বাড়িতে পৌঁছে দিন। আমার স্বামী আর পরিবার হয়তো খুব চিন্তা করছেন।”
নিজের কাজে হস্তক্ষেপ সহ্য হয় না পিংকির। অল্পতেই রেগে গেলেন ভূমির উপর। রেগে গিয়ে ভূমির গাল চেপে ধরে বললেন‚
“এখানে একবার যে আসে মৃ’ত্যুর আগ অবধি এখান থেকে বেরতে পারে না। তুমি নিজেকে তৈরি কর। শুদ্ধ বাংলা ভাষায় বলছি— পুরুষ মানুষদের আনন্দ দিবি। আমার কথা না শুনলে তোর এমন হাল করব!”
তিথি এগিয়ে এসে বলল‚ “আমি সব বুঝিয়ে দেব ম্যাডাম।”
“হুম! বুঝিয়ে দিস ভালো করে। চামেলি আয় তো আমার সঙ্গে।”
সর্দারনি পিংকির পেছন পেছন চামেলিও চলে গেল। ভূমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বিছানায় বসে পড়ল। মাথা ঘোরাচ্ছে তার৷ তিথি তাকে ধরল। হাতটা সরিয়ে ফেলল ভূমি। সদ্য মাকে হারিয়ে এ কোন বিপদের মুখে পড়েছে সে? এরই মাঝে খাবার দিয়ে গেল চামেলি৷ পিংকি তাকে দিয়ে ভালো ভালো খাবার পাঠিয়েছেন৷ ভূমিকে যে দ্রুত সুস্থ হতে হবে। এখন থেকেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার চূড়ায় উঠে নাচছেন পিংকি৷ ঘর থেকে চামেলি চলে যেতেই তিথি খাবারের প্লেটটা বিছানার উপর রেখে ভূমিকে বলল‚
“খাবারটা খেয়ে নাও মেয়ে।”
“খাব না আমি। আমাকে দয়া করে আমার বাড়িতে পৌঁছে দিন।”
“খাবার না খেলে তুমি আরও দূর্বল হয়ে পড়বে।”
“আমি কিছু খাব না৷ চলে যান আপনি আমার সামনে থেকে।”
ভূমি এই তেজি ছটফটানো দেখে খুবই খারাপ লাগল তিথির। এখানে যখন প্রথম এসেছিল তখন তো সে-ও এমনই ছটফট করেছিল৷ এখান থেকে পালানোর কম তো চেষ্টা করেনি সে! এর জন্য দিনের পর দিন মার খেয়েছে পিংকিং হাতে৷ একটা সময় পর সবটাই সহ্য করে নিয়েছে৷ জানালা বিহীন চার দেয়ালের মাঝেই নিজেকে স্থাপন করেছে। হতে হয়েছে প্রতিদিন নিত্যনতুন পুরুষের শয্যাসঙ্গী। আজ ভূমিকে দেখে পুরোনো নিজের কথা মনে পড়ে গেল তিথির৷ বড্ড মায়া হলো মেয়েটার উপর৷ খাবারের প্লেটটা বিছানাতেই ডেকে রেখে বলতে লাগল‚
“শোন মেয়ে তোমাকে একটা কথা বলি।”
“আমি আপনার কোনো কথা শুনতে চাই না। আমার উপর দয়া করুন। যেতে দিন আমাকে এখান থেকে।
“এখানে যারা থাকে তারা কিন্তু সবাই খারাপ না৷ জীবনই তাদের পুরোপুরি বদলে দিয়ে খারাপে রূপান্তর করে। এখন থেকে পালাতে হলে তোমাকে আগে সুস্থ হতে হবে।”
চুপ করে গেল ভূমি। তিথির কথা শুনতে ইচ্ছে হলো। তিথিকে তার অন্যরকম মনে হলো৷ ভূমিকে বুঝতে পেরে এবার তিথি বলতে শুরু করল‚
“পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিলাম। বিয়েও করেছিলাম৷ এরপর ছোট্টো একটা সংসার পেতেছিলাম দুজনে। স্বামী সংসার নিয়ে স্বপ্ন আমারও ছিল৷ কিন্তু সেই স্বামীই আমাকে ধোকা দিয়ে পিংকি ম্যাডামের কাছে বিক্রি করেছিল৷ প্রায় দুই বছর ধরে আমি এখানে বন্ধি। অনেক চেষ্টা করেছি এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার। তবে আমি বারবারই ব্যর্থ হয়েছি।”
ভূমি থম মে’রে রইল। ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতকতা আর ধোকা পাওয়ার কষ্টটা হয়তো তার জানা নেই কিন্তু সে উপলব্ধি করতে পারে৷ এমন এক বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা তো তার আম্মার সাথেও ঘটেছিল। আম্মার কথা মনে পড়তেই আবারও কাঁদতে শুরু করল ভূমি। তিথি ব্যস্ত হয়ে ভূমির চোখের পানি মুছিয়ে দিল। এখানে অনেক মেয়েই এসেছে তবে তাদের মাঝে টাকার একটা তীব্র লোভ ছিল। তারা আপসেই গণিকার জীবনটাকে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু ভূমিকে তার আলাদা মনে হলো। তিথি ভেবে নিল— যত যা-ই হয়ে যাক‚ সে ভূমিকে এখান থেকে পালাতে সাহায্য করবে। সে জিজ্ঞেস করল‚
“তোমার নাম কী?”
ক্ষীণ দূর্বল স্বরে ভূমি বলল‚ “ওয়াজিহা মেহরাব ভূমি।”
“নামের মতই তুমি ভীষণ সুন্দরী‚ স্নিগ্ধ আর কোমল।”
“আমাকে এখানে কেন আটকে রাখা হয়েছে?”
“পিংকি ম্যাডাম যা যা বলল তা তো শুনেছই। এখানে আমাদের নিত্যদিন নিত্যনতুন কারোর না কারোর শয্যাসঙ্গী হতে হয়৷ পুরুষেরা এই জায়গাটাকে গণিকালয় অর্থাৎ নিষিদ্ধ পল্লিও বলে থাকে৷ রাতের আঁধারে এই সভ্য সমাজের পুরুষেরা এখানে আমাদের মতো গণিকাদের ভোগ করতে আসে৷”
‘গণিকা‚ গণিকালয়‚ নিষিদ্ধ পল্লি’ এই শব্দ গুলোর সঙ্গে পরিচিত নয় ভূমি৷ তবে তিথির কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরেছে সে৷ রুহ কেঁপে উঠল তার৷ কী করে এই নরক থেকে রেহাই পাবে সে! অঝোরে কেঁদে দিল মেয়েটা৷ তিথি উঠে গিয়ে একবার দরজার কাছে গেল৷ না বাহিরে এখন কেউ নেই। সেই সুযোগে ভূমির কাছে এসে বলল‚
“তুমি বড্ড সহজ সরল মেয়ে। আমি চাই না আমার মতো করে তোমার জীবনটাও এভাবে নষ্ট হয়ে যাক। আমি তোমাকে পুরোপুরি সাহায্য করব এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার৷ তবে তার আগে তোমাকে তো সুস্থ হতে হবে। তাই বলছি খাবারটা খেয়ে নাও।”
খাবারের প্লেটটা এবার ভূমির দিকে এগিয়ে দিল তিথি। নিঃশব্দে ভূমি তা নিয়ে নিল। তিথিকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো। এত অচেনার মাঝে তিথিকে সহযোগী মনে হলো। বিশ্বাস নিয়ে বলল‚
“দয়া করে আপনি আমাকে সাহায্য করুন। সত্যিই আমার পরিবারের সবাই আমার জন্য খুবই চিন্তিত। আমি আমার পরিবারের কাছে যেতে চাই। আমি এখানে থাকতে চাই না।”
তিথি বেশি কিছু না বলে শুধু এই কথাটাই বলল‚ “খাবারটা ঝটপট খেয়ে নাও।”
রাত আড়াইটা…
রাত তখন গভীর। ক্লান্ত শরীর নিয়ে মোড়ল বাড়িতে ফিরেছে প্রলয়৷ মোড়ল বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ ভূমির জন্য প্রচণ্ড চিন্তা করছে৷ অনিন্দ্যনগরে এমন কোনো বাড়ি বাকি নেই যে‚ ভূমির খোঁজ করা হয়নি। অনিন্দ্যনগর থানাতেও যোগাযোগ করা হয়েছে৷ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মেয়েটা যেন উবে গেল৷ ভূমির জন্য পাগল প্রায় অবস্থা প্রলয়ের। কোথায় খুঁজবে ভূমিকে? কেউ তার হদিস জানে না৷ বোনের জন্য অর্পণও খুব চিন্তিত। নিজের বোনকে পেয়েও আবার হারিয়ে ফেলল না তো? ভূমির চিন্তায় খাওয়াদাওয়া বন্ধ দুই ভাইয়ের৷ প্রলয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে‚ অনিন্দ্যনগরের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতেও খোঁজ নেবে। বিরোধী দলের কোনো চক্রান্তও হতে পারে৷ এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছে না সে। যদি এমন কিছু হয় তাহলে সে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় হানবে। তার ভূমি কন্যার কোনো ক্ষতি হলে কাউকে ছাড়বে না সে। কারো তোয়াক্কা করবে না। অর্পণ নিজের সঙ্গে সঙ্গে তার ভাইকেও সামলাচ্ছে৷ এ দুনিয়ায় ভূমির তো তাদের ছাড়া আর কেউই নেই। কোথায় যেতে পারে মেয়েটা? অর্পণ মনে মনে তার বাবাকে সন্দেহ করছে। পরপর এই ঘটনাগুলো অবশ্যই কাকতালীয় হতে পারে না। কোনো না কোনো রহস্য তো জড়িয়ে আছেই৷ তবে প্রলয়কে তা বলা যাবে না৷ আর না ভূমিকে দেওয়া ওয়াদা সে ভঙ্গ করবে। বহু কষ্টে প্রলয়কে হালকা কিছু খাবার খাইয়ে ঘমোতে পাঠিয়েছে অর্পণ। ভূমিকে খুঁজতে হলে তাদেরও সুস্থ থাকতে হবে।
চলবে?…..