#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৬২|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
প্রত্যুষের আলো ফুটতে শুরু করেছে। করিডরে হাঁটাহাঁটি করছে প্রলয়। সারাটা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি। বারবার শুধু ভূমির সেই ক্লান্ত মুখটাই চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। আজকের রাতটা অর্পণ প্রলয়ের সাথেই ছিল। এক মুহূর্তের জন্য নিজের ভাইকে একা করেনি। মাঝরাতের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছিল তার৷ অর্পণ এখনো ঘুমচ্ছে৷ করিডরে হাঁটাহাঁটি করতে করতে একবার ঘরেও এসেছিল প্রলয়। এরপর কী মনে করে যেন‚ নিজের লাগেজটা গুছিয়ে নিল। ভূমির কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনো। আর না থানা থেকে কোনো খবর এসেছে৷ প্রলয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা ফিরে যাবে৷ চার্জে বসানো ফোনটাকে হাতে নিয়ে ভূমির একটা ছবি বের করল সে। হাস্যজ্বল মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেল? একটা দিনের মাঝে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল! প্রলয় নিজে নিজেই আওড়াল‚
“হুট করে কোথায় হারিয়ে গেলে ভূমি কন্যা? তোমাকে ছাড়া আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্লিজ আমার কাছে ফিরে এসো। তুমি ছাড়া আমি একটুও ভালো নেই। আমার সবকিছুই নিঃস্ব তুমি বিহীন।”
প্রলয়ের কথা কিছুটা কর্ণগোচর হতেই ঘুম হালকা হয়ে এলো অর্পণের৷ উঠে দেখল বিছানার এক কোণায় বসে রয়েছে প্রলয়৷ একা একাই কথা বলছে৷ অর্পণের সুবিধের মনে হলো না৷ দ্রুত উঠল পড়ল সে। প্রলয়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল‚
“ভাই তুমি ঠিক আছ?”
অর্পণের ডাকে মুখ তুলে তাকাল প্রলয়৷ নিজেকে আটকে রাখতে পারল না৷ অর্পণকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। ভূমিকে না পেয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা তার৷ না নিজের অবস্থা কাউকে বোঝাতে পারছে‚ না সে তার নিজের অবস্থা প্রকাশ করতে পারছে আর না নিজেকে সামলাতে পারছে। কোথায় যাবে— কোথায় পাবে তার প্রেয়সীকে? অর্পণ তাকে সামলে নিয়ে বলল‚
“নিজেকে সামলাও ভাই। ভূমিকে আমরা অবশ্যই খুঁজে পাব।”
“হুট করে কোথায় চলে গেল? আচ্ছা ওর কোনো বিপদ হয়নি তো? বিরোধী দলের কেউ এমনটা করেনি তো? ভূমি তো অসুস্থ‚ দূর্বল৷ মেয়েটা নিজেকে কী করে সামলাবে?”
“এভাবে কেঁদ না ভাই৷ খুব শীগ্রই আমরা ভূমিকে খুঁজে বের করব৷ ভূমিকে খুঁজতে হলে তো তোমাকে আগে স্ট্রং হতে হবে৷”
চোখের পানি মুছে প্রলয় বলল‚ “আমি স্ট্রং আছি। একদম স্ট্রং৷” একটু থেকে প্রলয় আবারও বলল‚
“আমি আজই ঢাকা ফিরে যেতে চাই৷ শহরের প্রত্যেকটা থানায় ভূমির ছবি পাঠাতে হবে৷ নিউজে ভূমির ছবি ছাঁপাতে হবে। যেভাবেই হোক ভূমিকে আমার চাই৷ ও ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।”
অর্পণ বুঝল ভূমির প্রতি তার ভাইয়ের ভালোবাসার গভীরতা। প্রলয়কে সামলে নিল সে। মহুয়ার মৃ’ত্যু নিয়ে কাল থেকেই মনটা খচখচ করছে। তবে নিশ্চিত হয়ে কিছুই ভাবতে পারছে না সে। মনে মনে ভেবে নিল‚ এ সমস্ত ঘটনার জন্য যে বা যারা দায়ী তাদেরকে নিজে শাস্তি দেবে। এতে যদি তার বাবার হাতও থাকে তবুও সে পিছুপা হবে না। এক একটাকে শাস্তি পেতে হবে।
❑
সকাল গড়িয়ে বেলা দুপুরে এসে ঠেকল৷ সংকীর্ণ জানালা বিহীন কামরায় রোদেরা উঁকি দিল না। ভূমি বুঝতেই পারল না বেলা কীভাবে গড়াচ্ছে! অদতেও তার জানা নেই। শরীর ভীষণই দূর্বল তার৷ সকালে খাবার খেতে গিয়ে দু’বার বমি করেছে৷ আর তা দেখে চামেলি নাক সিটকালেও তিথি যত্ন নিয়ে ভূমির খেয়াল রেখেছে৷ সবকিছু সে নিজেই পরিষ্কার করে দিয়েছে। পরবর্তীতে ভূমির জন্য চুরি করে একটি আপেল আর বেদানা নিয়ে এসেছিল৷ যা পিংকি নিয়ম করে দু’বেলা খান। তখন চামেলি কোথাও ছিল না। থাকলে নিশ্চয়ই নালিশ দিয়ে বসত পিংকির কাছে৷ এই মেয়ের আবার কথা লাগানোর স্বভাব আছে। আর বাকিরাও নিজেদের কাজে ব্যস্ত ছিল। অন্য খাবার মুখে তুলতে না পারলেও ফল দুটো খেতে পেরেছিল ভূমি। এখান থেকে পালাতে হলে তো সুস্থ হতেই হবে। শরীরে শক্তি না পেলে পালাবে নী করে?
এদিকে সর্দারনি পিংকি তখন নিজের কামরায় ছিল৷ উনার কামরা দেখতে বেশ সুন্দর এবং পরিপাটি৷ রঙিন বিছানার চাদর। ঘরের আসবাব গুলোও সাজানো গুছানো। রঙ বেরঙের ফুল এবং ফুলদানি। সচরাচর কাউকে নিজের কামরায় ঢুকতে দেন না তিনি। তবে আজ নিজে থেকেই চামেলিকে নিজের ঘরে ডেকেছেন৷ সকালে চম্পার কাছ থেকে নতুন মেয়েটার ব্যাপারে একটু আধটু কথা শুনেছিলেন তিনি৷ এখানে চামেলি হচ্ছে পিংকির ডান হাত৷ গণিকা মহলে কী চলছে আর কী কী কথাবার্তা হচ্ছে তার সমস্ত খবরাখবর চামেলিই উনাকে দেয়! একে করে বখশিশও ভালো পায় চামেলি। পিংকির ভাবনার মাঝেই ঘরের দরজায় কারো কড়া নাড়ার শব্দ হলো। হয়তো চামেলিই এসেছে। পিংকি বিছানায় আয়েশ করে বসে‚ ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দিল। অনুমতি পেতেই ঘরের ভেতর প্রবেশ করল চামেলি৷ পিংকি তাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন‚
“ওদিকের কী খবর রে চামেলি?”
পিংকির কথার প্রত্যুত্তরে চামেলি বলল‚ “ম্যাডাম ও মেয়ে তো সেই সকাল থেকেই বমি করছে। আমার কিন্তু বিষয়টা ভালো ঠেকছে না৷”
“সকালে খাবার দিয়েছিলি?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম। খাবার মুখের সামনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বমি করে মেঝে ভাসিয়ে দিয়েছে। সকাল থেকে দুইবার বমি করেছে।”
এবার কিছুটা চিন্তায় পড়লেন পিংকি। মনে মনে ভাবলেন এই মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা নয় তো? তাহলে তো আরেক সমস্যা৷ বিবাহিত মেয়ে নিয়ে এলেও উনার ডেরায় এখনো পর্যন্ত অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে আসেনি। পিংকি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন‚
“তাহলে তো চিন্তার বিষয়। এ কেমন মেয়ে ধরিয়ে দিল মেহরাব শিকদার!”
“ম্যাডাম আমার মনে হয় একবার ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন।”
“আমি আগে মেহরাব শিকদারের সঙ্গে কথা বলে নিই।”
চামেলি চলে গেল। পিংকি নিজের ফোন বের করে মেহরাব শিকদারের নাম্বারে কল লাগালেন৷ রিং হলেও অপাশ থেকে কেউ কল রিসিভ করল না৷ পিংক আবারও কল লাগালেন। রাগে গা কাঁপছে৷ উনার এই এক সমস্যা! অল্পতেই রেগে যান তিনি৷ ইচ্ছে মতো বিশ্রী ভাষায় গালি দিতে শুরু করলেন। চতুর্থ বার ডায়াল করার সঙ্গে সঙ্গেই কল রিসিভ হয়ে গেল৷ মেহরাব শিকদার কিছু বলবেন তার আগেই পিংকি বলে উঠলেন‚
“মিয়া এ কেমন মেয়ে দিলেন? মেয়ের অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা।”
অপাশ থেকে মেহরাব শিকদার বললেন‚ “ডক্টর দেখিয়েছ?”
পিংকি তো আন্দাজেই ঢিল মেরেছিলেন। এখনো পর্যন্ত ডাক্তার দেখানো হয়নি। তাই তিনি বললেন‚ “না।”
“আগে ডাক্তার দেখাও তারপর নিশ্চিত হয়ে কথা বলবে। আর যখন তখন আমাকে কল দেবে না।”
“এখন কী করতে হবে সেটাই বলুন! যদি এই মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয় আর এই মেয়েকে দিয়ে যদি ব্যবসাই করতে না পারি তাহলে এই মেয়েকে তো বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারি না। আমার টাকা তো আর উড়ে উড়ে আসে না।”
এবার বিরক্ত হলেন মেহরাব শিকদার। কালই এতগুলো টাকা দিলেন তিনি৷ কণ্ঠস্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে বললেন‚ “আচ্ছা সমস্যা নেই। কাল আমি এসে একবার দেখা করে যাব৷”
কথাটা বলেই কল কেটে দিলেন মেহরাব শিকদার। পিংকি ফোনটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য ভূমিকে একবার দেখে আসবেন৷ যেতে যেতে ডাক্তারের নাম্বারে কল লাগালেন তিনি। বিকেলে একবার দেখা করার কথা বললেন তিনি। কথা বলতে বলতেই ভূমিকে যেই ঘরটার রাখা হয়েছে সেই ঘরটার সামনে গেলেন। ভূমি তখন বিছানায় শুয়ে ছিল। ঘুমচ্ছে কি-না সেটা দরজার কাছ থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। তিথি এ ঘরেই ছিল। পিংকি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই তিথি বসা থেকে উঠে দাঁড়াল৷ সারাদিন এ ঘরের সামনেই তাকে ঘুরঘুর করতে দেখে কিছুটা সন্দেহ হলো পিংকির। সন্দেহের সুরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন‚
“কাল থেকে দেখছি এ ঘরের সামনেই ঘুরঘুর করছিস! কী ব্যাপার?”
“ম্যাডাম মেয়েটা অসুস্থ। তাই ভাবলাম ওর কাছে কাছেই থাকি৷ যদি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে!”
“এই মেয়েকে এত সঙ্গ দিতে হবে না৷ শুধুমাত্র খাওয়ার সময় দেখে দেখে যাবি৷ আজ গ্রাহক আসছে। রেডি হয়ে থাকিস।”
“আচ্ছা ম্যাডাম।”
ভেতরটা হুহু করে উঠল৷ আর কতদিন সভ্য সমাজের পুরুষদের কাছে ভোগ্যবস্তু হতে হবে? এ জীবন থেকে কী কখনোই মুক্তি মিলবে না? নিজের অপূর্ণ ইচ্ছে গুলোকে ভূমি চোখেও দেখতে পায় সে। মেয়েটা একটু একটু করে তড়পাচ্ছে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য। নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার কাতরতা স্পষ্ট দৃশ্যমান। তিথি মনে মনে ভেবে নিল‚ খুব শীগ্রই ভূমিকে সুস্থ হবার সঙ্গে সঙ্গেই এখান থেকে পালাতে সাহায্য করবে৷ তা না হলে যা সর্বনাশ হবার তা হয়েই যাবে৷ পিংকি তো পারে না এক্ষুনি ভূমিকে নিজের কাজে ব্যবহার করেন!
অন্যদিকে…
ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা একাই হাসছেন মেহরাব শিকদার। সত্য লুকোনোর তাড়নায় দিনকে দিন উন্মাদ হয়ে উঠছেন তিনি৷ প্রথমত উনিশ বছর আগে মহুয়াকে চরম ভাবে ঠকিয়েছেন। দ্বিতীয়ত নিজের অনাগত সন্তানকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্বেই নষ্ট করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন৷ তৃতীয়ত নিজের অজানা সত্যি যেন দুনিয়ায় সামনে না আসে সেই জন্য মহুয়াকে খু’ন করান। নিজের ভাড়া করা লোক দিয়ে খু’ন করিয়েছেন তিনি। খু’ন এমন ভাবে করিয়েছেন যেন‚ সারা দুনিয়ার কাছে মনে হয় মহুয়ার মৃ’ত্যুটা নিছকই স্বাভাবিক মৃ’ত্যু। এতে করে তিনি সফলও হয়েছেন৷ মহুয়াকে খু’ন করার সময় তিনি ভিডিও কলেই ছিলেন৷ নিজের চোখে মহুয়ার মৃ’ত মুখখানা দেখে পৈশাচিক আনন্দ লুটেছেন তিনি৷ মহুয়াকে বালিশ চাপা দিয়ে মা’রা হয়েছে৷ তখন মোড়ল বাড়ির সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে গভীর নিদে আচ্ছন্ন ছিল৷ আর মহুয়াও নিজের ঘরে ঘুমচ্ছিলেন৷ ভূমির কাছে থেকে অর্থাৎ শহর থেকে আসার পর থেকেই তিনি অসুস্থ ছিলেন৷ আরশ বলেছিল‚ নিয়ম করে প্রতিদিন দুপুরের খাবার খেয়ে কয়েকঘণ্টা ঘুমনোর কথা। অতএব মহুয়া যে খু’ন হয়েছে এতে কাকপক্ষীতেও টের পায়নি। চতুর্থত কারণ হচ্ছে‚ ভূমিকে গণিকালয়ে পাঠানো৷ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মেহরাব শিকদার এমনই উন্মাদ হয়ে উঠছেন যে‚ নিজের সন্তান‚ নিজের রক্তকে পর্যন্ত বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। একটা একটা করে নিজের পথের কা’টা দূর করছেন৷
চলবে?…..