#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৬৫|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
কেটে গেল আরও চারটে দিন। এ চারদিনে প্রলয় নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া ভুলে গিয়েছে। শ্যাম পুরুষের গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো বড়ো হয়েছে। চোখমুখ শুকিয়ে গিয়েছে৷ চোখের নিচে আবছা কালচে দাগ জন্মেছে। দেখে মনে হয় কত রাত ঘুম হয় না তার! নিজের পাশাপাশি আশেপাশের মানুষগুলোকে মাতিয়ে রাখা মানুষটা পাল্টে গেছে৷ সারাক্ষণ মনমরা হয়ে ঘরবন্দী থাকে। ক’দিন ধরে নিজের কাজের প্রতি বড্ড অবহেলা করছে প্রলয়৷ এমনটা কখনই একজন এমপির কাজ হতে পারে না৷ প্রলয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে‚ নিজের ভেতরকার অবস্থা দুনিয়ার মানুষকে কিছুতেই বুঝতে দেবে না। চারদিন পর আজ প্রলয় বাড়ি থেকে বের হয়েছে। হুট করেই মন বলল কোথাও একটা যেতে! এক উদ্দেশ্যহীন সফরে। জীবনের প্রতি এখন আর কোনো মায়া কাজ করে না। রাজনীতির স্বপ্নটাও আজকাল রঙহীন মনে হয়। ভূমিকে না পেয়ে প্রলয়ের অবস্থা ছন্নছাড়া। কোনো কাজেই মন বসাতে পারছে না। তবে শক্ত হাতে তো পুনরায় দায়িত্ব গ্রহণ করতেই হবে৷ রবিনকে দিয়ে‚ নাজিম চৌধুরীর উপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখার কাজে নিয়োগ করেছিল সে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। যা থেকে বোঝাই যাচ্ছে৷ ভূমির হারিয়ে যাওয়ার পেছনে নাজিম চৌধুরীর কোনো হাত নেই৷ তাহলে কী হয়েছিল সেদিন? ভূমি হারিয়ে গেল কী করে?
এদিকে ছেলের চিন্তায় চিন্তায় ঘুম হয় না মাধুরীর। ছেলেকে এভাবে গুমরে গুমরে নিঃশেষ হতে দেখে ক্রমশ তড়পাচ্ছেন তিনি। এরচেয়ে ভালো ছিল ভূমির এ বাড়িতে থাকা। অন্তত উনার ছেলেটা তো ভালো থাকত। এ কদিনে তিনি এই কথাটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছেন যে‚ প্রলয় একমাত্র ভূমির সঙ্গেই ভালো থাকবে। মাধুরী মনে মনে দোয়া করছেন যাতে করে ভূমিকে তাড়াতাড়ি ফিরে পাওয়া যায়। মসজিদে টাকা দান করবেন বলে মানতও করেছেন তিনি। শিকদার বাড়ির একজন ব্যক্তি বাদে সকলেই ভূমির জন্য ভীষণ চিন্তিত৷ ফিরোজারও খুব খারাপ লাগে ভূমির জন্য। মেয়েটা সদ্য তার মাকে হারিয়েছে৷ তারউপর হুট করে কোথাও একটা হারিয়ে গিয়েছে। হসপিটালের পাশাপাশি অর্পণ অনেক জায়গায় খোঁজখবর নিয়েছিল। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ভূমি তাকে দিয়ে এমন ভাবে ওয়াদা করিয়েছে যে‚ সে তার বাবার আসল রূপটা কারো কাছেই বলতে পারছে না৷ বলেও লাভ হবে বলে মনে হয় না৷ এরজন্য তো প্রমাণ প্রয়োজন। ভূমির হারিয়ে যাওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। বিষয়টি এমন ভাবে সাজানো যে‚ বোঝাই যাচ্ছে— ভূমি কারো সঙ্গে নিজে থেকেই পালিয়ে গিয়েছে।
মধ্যাহ্নে…
এখন সময়টা খাঁ খাঁ মধ্যদুপুর। মেদিনীর বুকে রাক্ষুসে রোদ আবির্ভূত হয়েছে। তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে আজ ছ’দিন হচ্ছে৷ পুরো ছয়দিন পর খোলা আকাশের নিচে গা ভাসাবে ভূমি। এ কদিনে অনেকটা শুকিয়ে গিয়েছে। ফুটফুটে সুশ্রীতে মলিনতার ছাপ৷ আগের মতো উজ্জ্বলতা নেই। দুটো মানুষ আলাদা আলাদা জায়গা হতে একে অপরের বিরহে বিলীন হচ্ছে৷ আজ তাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হবে। ডক্টরের সঙ্গে আগে থেকেই কথা বলা হয়েছে৷ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজই অ্যাবর্শন করানো হবে৷ সঙ্গে শুধুমাত্র সর্দারনি পিংকি যাবেন৷ অন্য আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। তিথিকে ভূমির কাছে পাঠিয়েছেন পিংকি৷ এদিকে ঘরে ভূমিকে তৈরি করিয়ে দিচ্ছে তিথি। রুমার কাছ থেকে বোরকা জোগাড় করে এনে দিয়েছে সে৷ ভূমির পড়নে রুমার সেই কালো বোরকা আর হাঁটু সমান ঢেকে রাখা হিজাব৷ মুখে নেকাব পড়িয়েছে তিথি। বাহিরে গেলে ভূমি সম্পূর্ণ পর্দায় থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে৷ বাহির থেকে পিংকি কিছুক্ষণ পরপর তাড়া দিচ্ছেন। এইতো এখনই বের হবে ওরা। রওনা হবার পূর্বে ভূমির কাছে দুটো কাগজ এগিয়ে দিয়ে তিথি বলল‚
“তোমাকে কায়দা করে হসপিটাল থেকে পালাতে হবে। আমি তোমার সাথে হসপিটালে যেতে পারব না। বাকিটা তোমাকে একাই করতে হবে। এ লড়াই তোমার একার। এই দুটো কাগজের মধ্যে একটা ঠিকানা আর একটা চিরকুট রয়েছে। আশা করি ঠিকানা নিয়ে সঠিক জায়গায় তুমি পৌঁছে যেতে পারবে। এটুকু মনের জোর অন্তত তোমার আছে।”
“ইনশাআল্লাহ! আমি অবশ্যই পারব৷ তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আপু।”
তিথি আবারও বলল‚ “আরেকটা কথা! পানির বোতলে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছি। ভুলেও তুমি ওই পানি পান করবে না। পারলে পিংকি ম্যাডামকে খাওয়ানোর চেষ্টা করবে।”
মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে ভূমি সায় জানাল। তিথিকে শেষ বারের মতো জড়িয়ে ধরল। এ ক’টা দিন তিথি খুব খেয়াল রেখেছে তার৷ তিথির কাছে ভূমি চিরকৃতজ্ঞ। তিথির উপকার সে কোনোদিনও ভূলবে না। নিজে নরকে থেকেও তাকে স্বর্গে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। এমন মানুষ হাজার খুঁজেও পাওয়া যায় না। তিথির হাত ধরে ভূমি বলল‚
“তোমার এই উপকারে কোনদিন ভুলব না। আমি সারা জীবন তোমাকে মনে রাখব।”
“আমার তোমাকে খুব মনে পড়বে। তুমি ভালো থেক। তোমার সন্তানের খেয়াল রেখ। তোমার জন্য অনেক অনেক দোয়া আর শুভকামনা।”
বাহির থেকে পিংকির বাজখাঁই কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। এই মহিলার কথা কানে আসতেই বিরক্ত হলো ভূমি। তিথিকে বলল‚ “আসছি আপু। তুমি ভালো থেক।”
“এই নরকে ভালো থাকার কথা বলছ? আমি ভালো থাকব শুধুমাত্র তোমার পুচকুর ভালো থাকায়৷ ওর খুব খেয়াল রাখবে। একজন ভালো মানুষ তৈরি করবে।”
অশ্রুসিক্ত আঁখিপল্লব ঝাপ্টে সায় জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ভূমি। তার পেছন পেছন তিথিও বের হলো। বাহিরে পিংকি সহ আরও সাতজন মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ এই মেয়েগুলো এখানেই থাকে। এদের মাঝে চামেলিও রয়েছে। যে কি-না পিংকির খুবই বিশ্বস্ত। ভূমিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পিংকি৷ যাওয়ার পূর্বে ভূমি একটিবার তিথির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। যদি এমন হত— সে তিথিকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারত? কিন্তু আফসোস! এমন কোনোদিনও হতে পারে না৷ ভূমি এখান থেকে বের হবার সময় জায়গাগুলো ভালো করে দেখে দেখে যাচ্ছিল৷ যেহেতু মাধ্যমিক অবধি পড়াশোনা করেছে তাই বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিও একটু আধটু বুঝতে পারে সে। জায়গাটা আর ঠিকানাটা খুব ভালো করে দেখে নিয়েছে ভূমি৷ ভালোই ভালোই বেঁচে ফিরতে পারলে একদিন অবশ্যই সে তিথিকে এখান থেকে উদ্ধার করবে।
❑
হসপিটালে নিজের কেবিনে বসে রয়েছেন মেহরাব শিকদার। আজ আর রোগী দেখার ঝামেলা নেই। আর না কোনো ওটি রয়েছে। তাই নিজের কেবিনে আয়েশ করে বসে রয়েছেন তিনি। এই সময়টায় অন্যদিন হলে ব্যস্ততায় পাড় হত। তবে আজ সম্পূর্ণই আলাদা। এভাবে বসে থেকেও বিরক্ত হচ্ছেন তিনি। মাঝে মাঝে ব্যস্ততার মাঝেও আলাদা শান্তি বিরাজ করে৷ এই যে এখন তিনি একেবারেই ফ্রী কিন্তু তবুও উনার কাজ করতে ইচ্ছে করছে৷ এমন ইচ্ছে কিন্তু সবসময় হয় না। আজই হঠাৎ মনে হচ্ছে। এরই মাঝে হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল মেহরাব শিকদারের৷ যেহেতু তিনি আজ ফ্রী তাই তিনি তৎক্ষনাৎ ফোন রিসিভ করলেন। পিংকি কল করছেন৷ হতে পারে কোনো কাজেই কল করেছেন। তিনি কিছু বলবেন তার আগেই অপাশ থেকে পিংকি বলে উঠলেন‚
“আপনার মেয়েকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছি অ্যাবর্শন করাতে।”
পিংকির মুখে ‘মেয়ে’ শব্দটা শুনে সহসাই অবাক হলেন তিনি৷ মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন‚ “হোয়াট ননসেন্স! কীসের মেয়ে?”
এবার কোনো রকমের ভণিতা ছাড়াই বক্তে আরম্ভ করলেন‚ “ওই মিয়া ভাব কম নিন। কী মনে করেছেন আমি কিছুই জানি না? সেদিন আমি আপনাদের কথা সব শুনেছি। আপনি মিয়া একটা নরপি’শাচ। আমি তো পেটের দায়ে মেয়ে ব্যবসা করে খাই। আর আপনি? ছিহ্! বাবারাও এমন হয়? আপনাকে দেখলে শরীরও ঘৃণায় জর্জরিত হয়।”
“মুখ সামলে কথা বল। আমাকে তুমি এখনো ভালো করে চেন না তাই আমার সম্পর্কে উল্টোপাল্টা কথা বলা বন্ধ কর।”
“আপনাকে তো সেদিনই ভালো করে চিনে নিয়েছিলাম৷ আপনি তো মিয়া বাবা জাতের কল’ঙ্ক। আমার বাবা যদি এমন হত না? তাহলে আমি তাকে খুন করে তার নিথর দেহটাকে কু’কুর দিয়ে খাওয়াতাম।”
“একটু বেশি বলে ফেলছ না? তা হঠাৎ করেই অন্য সত্তা জেগে উঠল ব্যাপার কী?”
“কিছু কথা অজানা থাকুক। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি— এমন বাবা কারো ভাগ্যে না জুটুক।”
কথাটা বলেই কল কে’টে দিলেন পিংকি। গাড়ি ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এখানকার রাস্তা খুব একটা ভালো না। গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দিয়েছে ভূমি৷ সে গাড়িতে জার্নি করতে পারে না৷ বমি পায়— তারউপর আবার সে অন্তঃসত্ত্বা। তবে এখনো পর্যন্ত একবারও বমি করেনি সে৷ আসার সময় তিথি সঙ্গে করে দুটো লেবু পাতা দিয়েছিল। বমি পেলে যেন সঙ্গে সঙ্গে নাকের কাছে ধরে রাখে৷ লেবু পাতার তীব্র সুবাসে গা গোলানো বন্ধ হয়েছে আপাতত। এদিকে পিংকি মোবাইলে গেইম খেলছেন৷ এতক্ষণ মেহরাব শিকদার আর পিংকির মধ্যেকার হওয়া সমস্ত কথাবার্তা সে শুনেছে৷ পিংকির কথাবার্তায় একটা মায়া ছিল৷ আজকের পিংকিকে একদম অন্যরকম মনে হয়েছে ভূমির কাছে৷ একদৃষ্টে পিংকির দিকেই তাকিয়ে রইল ভূমি। হুট করে মোবাইলের স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে তাকালেন পিংকি। এভাবে মুখ তুলে তাকানোতে ভূমি ঘাবড়ে গেল মুহূর্তেই৷ আড়ালেই ক্ষীণ হেসে তিনি ভূমিকে বললেন‚
“মেয়ে মানুষ কখনো ইচ্ছে করে খারাপ পথে পরিচালিত হয় না৷ তার পেছনে বিভিন্ন গল্প লুকিয়ে থাকে৷ সাধেই কী মেয়েদের রহস্যময়ী বলা হয়! সমাজের সকল লাঞ্ছনা বঞ্চনার শুধুমাত্র একজন নারীকেই সহ্য করতে হয়। সভ্য সমাজের পুরুষেরা তো শুধু পারে ভোগ করতে।”
চলবে?…..