#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫২|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
নিমজ্জিত দুপুর। রোদের ছিটেফোঁটা নেই৷ এক কথায় একটি বিরস দিবস। সকালে বাড়ির সব মেহমানরাই চলে গিয়েছেন৷ মহুয়াও গ্রামে ফিরে গিয়েছেন। মায়ের জন্য মন খারাপ ছিল ভূমির। ঘর থেকে আর বের হওয়া হয়নি। ঘণ্টা দুয়েক সময় ঘুমিয়েই পাড় হয়েছে৷ শরীরটা এখন কিছুটা ভালো লাগছে। খুবই চনমনে লাগছে। কাল বাড়ি ভরতি মানুষ ছিল আর এখন বাড়িতে শুধুমাত্র গুলবাহার‚ মাধুরী‚ ফিরোজা‚ সাবিনা আর সে। বাকিরা নিজেদের কাজে। পূর্ণতা পুষ্পিতার পরীক্ষা সকাল দশটা থেকে শুরু হয়েছে৷ এখন সাড়ে বারোটা বাজে৷ পরীক্ষা শেষ হবে দুপুর একটায়৷ কিছুক্ষণ পরই যোহরের আযান পড়ে যাবে৷ বিছানার চাদর সকালেই পাল্টে ফেলা হয়েছিল৷ ওয়াশরুম থেকে বালতিতে করে পানি নিয়ে এলো ভূমি। তারপর ঘরটা মুছে নিল৷ ঘরের জানালাগুলো খুলে দেওয়া। সাঁই বেগে দখিনা বাতাস ঘরের ভেতরে আছড়ে পড়ছে। খটখট করে সিলিং ফ্যান ঘুরছে। মেঝে তাড়াতাড়িই শুকিয়ে যাবে। ঝড়ের গতিতে বিনে থাকা আধোয়া কাপড়গুলো ধুয়ে বারান্দায় মেলেও দিল৷ কাজগুলো তাড়াহুড়ো করেই করতে লাগল সে। অদূরেই আযানের মধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। ওয়াশরুমে গিয়ে ওযু করে এলো। নামায আদায় করেই ঘর থেকে বের হবে। ফিরোজা হয়তো একা হাতে রান্নার কাজ করছেন। ধীরে সুস্থে নামাজ আদায় করে ঘর থেকে বের হলো ভূমি। যাওয়ার আগে ঘরের দরজা ভালো করে চাপিয়ে দিয়ে গেল। শশব্যস্তভাবে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল। রান্নাঘরে শুধু সাবিনা কাজ করছে। বৈঠকখানায় কেউ নেই। হয়তো রান্নার ভার সাবিনা উপর দিয়ে বাকিরা নিজের ঘরে রয়েছেন। ভূমি ঝটপট রান্নাঘরেই গেল। তরকারি বসানো হয়েছে। শুধু ভাত‚ ডাল আর ডিম সেদ্ধ হয়েছে। এখনো দুটো রান্না বাকি রয়েছে। সবজি দিয়ে রুই মাছ আর টমেটো দিয়ে শিং মাছের ঝোল রান্না হবে। একটি চুলোয় রুই মাছের তরকারি ইতিমধ্যেই বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরেক চুলোয় দুধ গরম বসানো হয়েছে। সাবিনা ডিমের খোসা ছাড়াচ্ছে। দুটো ডিম দেখে ভূমি জিজ্ঞেস করল‚
“দুটো ডিম দিয়ে কী হবে?”
“এই দুইডা তো পূর্ণ পুষ্প আফার লাইগা। খালা বারবার কইয়া দিছে যাতে হেরা আইলেই দুধ আর ডিমখানা দুই বইনেরে দিয়া দেই।”
“হ্যাঁ‚ আমি খেয়াল করেছি সকালে পূর্ণ পুষ্প কেউই ডিম খেয়ে যায়নি। শুধু দুটো করে পরোটা আর গোশত খেয়েছিল। অথচ সবার জন্যই ডিম সেদ্ধ করা ছিল। আমি শুনেছি পরীক্ষা সময় নাকি পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়। তাতে পড়া মনে থাকে।”
“কিন্তু ভাবি হেরা ডরায়।”
অবাক হলো ভূমি। ডিম খাওয়া নিয়ে আবার কীসের ভয় পাওয়া? ডিম তো স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এমনিতে তো ওরা প্রতিদিনই সকালে ডিম আর দুধ খেয়ে নেয়। তাহলে আজ কী হলো? ভূমি সাবিনাকে জিজ্ঞেস করল‚
“ভয় পায় কেন?”
“পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগে‚ ডিম খাইয়া গেলে নাকি পরীক্ষায় আন্ডা পাইব! এই নিয়া তো ছুডু ভাইজান ম্যালা ক্ষ্যাপায় হ্যাগো দুই বইনেরে।”
সাবিনার কথা শুনে হেসে দিল ভূমি। সঙ্গে করে সাবিনাও হাসছে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে৷ একটা বাটিতে শিং মাছ ভিজিয়ে রাখা হয়েছে। আলু সেদ্ধ‚ পেঁয়াজ‚ কাঁচামরিচ‚ টমেটো আর ধনিয়াপাতা কেটে রাখা রয়েছে। ভূমি ত্রস্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“আপু তুমি বাকি কাজগুলো করে নাও আমি শিং মাছের ঝোলটা রান্না করছি।”
সাবিনা বলল‚ “আমি করতে পারমু। আপনি ঘরে যাইয়া আরাম করেন। সকালে বড়ো ভাইজান কইয়া গেছিল‚ আপনেরে যাতে কাজ করতে না দেই।”
“আমি তো অসুস্থ নই। আমি করতে পারব। তাছাড়া আমি চাইনা এই নিয়ে কোনো ঝামেলা হোক।”
ভূমির কথার ইঙ্গিত বুঝল সাবিনা। ক্ষীণ স্বরে বলল‚ “তাইলে ভাবি আপনার সামনে দাঁড়ায় থাকেন আমি কাম করতাছি।”
“তুমিও তো সেই সকাল থেকেই কাজ করছ।”
“আমার অভ্যাস হইয়া গেছে।”
“আর কোনো কথা না আপু। তুমি দাঁড়িয়ে থাক‚ আমি রান্না করছি৷”
শিং মাছ হতে বরফ ছুটে গিয়েছে। ময়লা পানিটুকু ফেলে দিল ভূমি৷ দুধ গরম হয়ে গিয়েছে৷ চুলো থেকে নামিয়ে রাখল সাবিনা৷ পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। তাকে আর কিছু করতে দেয়নি ভূমি। সে সবগুলো উপকরণ দিয়ে মাছগুলোকে ভালোভাবে কষিয়ে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে ঢেকে দিল। চুলোর আঁচ প্রথমে বাড়িয়ে দিয়ে মিনিট পাঁচেকের জন্য ঢেকে দিল। এরপর তরকারি বলক উঠতেই চুলার আঁচ আবারো মাঝারি আঁচে করে দিল। সবটাই দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিল সাবিনা৷ সে জিজ্ঞেস করল‚
“ভাবি আমি তাইলে লেবু কাইট্টা রাখমু?”
আঁখিপল্লব ঝাপ্টে সায় জানাল ভূমি। ফ্রিজ থেকে দুটো লেবু বের করে ভালোমতো ধুয়ে কে’টে রাখল সাবিনা। সদর দরজার কলিং বেলটা বাজতে শুরু করেছে। ঘড়িতে একটা পনেরো বাজে। হয়তো পূর্ণতা পুষ্পিতা চলে এসেছে। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সদর দরজা খুলে দিল। যেটা ভেবেছিল সেটাই। পূর্ণতা পুষ্পিতা চলে এসেছে। তাকে দেখেই দুবোন হেসে উঠল। পরীক্ষা কেমন হয়েছে সে কথা পরেও জিজ্ঞেস করা যাবে! ভূমি সদর জায়গার সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। পূর্ণতা পুষ্পিতা বৈঠকখানায় এসে সোফার উপর বসল। দুজনের ব্যাগ টি টেবিলের ওপর রাখা। ভূমি এসি চালু করে দিল। দু-বোনেরই ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। পূর্ণতা ক্লান্ত স্বরে বলল‚
“ভাবিমণি একটু ঠান্ডা পানি খাওয়াবে? বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।”
“আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।” কথাটা বলেই রান্নাঘরের দিকে ছুটল ভূমি। তাড়াহুড়ো করে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বোতল বের করল। এরপর জগে ঢেলে নিল সঙ্গে দুটো গ্লাস নিল। এদিকে সোফায় আয়েশ করে বসেছে দুটোতে। গা থেকে অ্যাপ্রোন খুলে রেখেছে। দুজনকে পানি দিয়ে জগটাকে টি টেবিলের উপর রেখে দিল। পূর্ণতা পুষ্পিতাকে দেখে বড্ড ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ভূমি জিজ্ঞেস করল‚
“এত ঘেমেছ কেন? গাড়ি করে আসনি?”
“না ড্রাইভার আঙ্কেল তো যাইনি। তাই আমরা রিকশা করে চলে এসেছি। ভাগ্যিস পুষ্পিতার কাছে টাকা ছিল।”
“সে কী? তোমাদের বড়ো ভাইয়া তো উনাকে বারবার বলে দিয়েছিলেন।”
“থাক সেসব কথা৷ আমরা ঘরে যাচ্ছি৷”
পূর্ণতার কথা শেষ হতেই পুষ্পিতা বলল‚ “রান্নাবান্না হয়েছে? পরীক্ষা দিয়ে বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে ভাবিমণি।”
ভূমি কিছু বলবে তার আগেই পূর্ণতা ফোড়ন কে’টে বলল‚ “মাত্রই না ঝালমুড়ি খেতে খেতে এলি।”
পূর্ণতার কথার পিঠে পুষ্পিতা ভেংচি কে’টে বলল‚ “আমি ভাত খাব৷ ভাতের ক্ষিধে কী আর ঝালমুড়ি দিয়ে মেটে?”
পুষ্পিতার বাহুতে চাপড় মে’রে পূর্ণতা বলল‚ “পেটুক একটা।”
এরপর দুবোন নিজেদের ঘরে চলে গেল। ভূমি রান্না ঘরে চলে এলো। তরকারি থেকে ঝোল অনেকটা কমে ঘন হয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে হয়েও গিয়েছে। চুলো থেকে তরকারির পাতিল নামিয়ে ফেলল সে৷ একটা সার্ভিং বোলে তরকারি ঢেলে নিল। সাবিনাকে দিয়ে প্লেট‚ গ্লাস আর পানির জগ সবকিছু ডাইনিং টেবিলের রাখতে পাঠিয়ে দিল। রান্নাবান্নার কাজ শেষ। ভূমি একবার গুলবাহারের ঘরে উঁকি দিল। ভদ্রমহিলা নামাজ পড়ছেন। তাই আর বিরক্ত করল না। আলগোছে দরজা চাপিয়ে চলে গেল ভূমি। ফিরোজা আর মাধুরী নিজেদের ঘরেই রয়েছেন। ভূমি সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে গেল। রান্নাঘরের উষ্ণ তাপে ঘেমে গিয়েছে সে।
❑
মাত্র সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া শেষে যে যার ঘরে চলে গিয়েছেন। ফিরোজা ঘরে গেলেন না। ভূমির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে এঁটো প্লেটগুলো রান্নাঘরে রেখে এলেন। ভূমি জোর করে ওনাকে ঘরে পাঠিয়ে দিল। এরপর সাবিনাকে এঁটো প্লেটগুলো ধোয়ার দায়িত্ব দিল আর ধোয়া প্লেটগুলো সে মুছে মুছে তুলে রাখল। এখনের মত আপাতত আর কোন কাজ নেই। সাবিনাকে বিশ্রাম নিতে বলে সেও ঘরে ফিরে এলো। ভরপেট খাওয়ার পর শরীর মিইয়ে আসছে। আবারও ঘুম পাচ্ছে তার। যে-ই না শুতে নেবে তার আগেই ফোনটা বেজে উঠল। বিরক্তি নিয়ে বালিশের পাশে অযত্নে পড়ে থাকা ফোনটা তুলে নিল। স্ক্রিনে “এমপি মশাই” লেখাটা জ্বলজ্বল করছে। মুখে হাসি ফুটে উঠল ভূমির। তাড়াহুড়ো করে ফোন রিসিভ করল। ওপাশ থেকে গম্ভীর সেই কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হওয়ার আগেই সালাম জানাল। প্রলয়ও সঙ্গে সঙ্গে সালাম গ্রহণ করল। ভূমি ভাবল আর কী জিজ্ঞেস করা যায়? তার ভাবনার মাঝেই প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚
“কী করছিলে তুমি? এখন শরীর খারাপ লাগছে?”
“না। আপনি যাওয়ার পরে ঘুমিয়েছিলাম।”
“দুপুরে খেয়েছ?”
“জি আমি খেয়েছি। আপনি খেয়েছেন?”
“হ্যাঁ খেয়েছি। তা ম্যাডাম আমাকে কী একটুও মিস করা হচ্ছে না?”
ভূমি উল্টো প্রশ্ন করল‚ “কেন?”
“কেন আবার! কাল তোমাকে এত এত ভালোবাসা দিলাম। ভাবলাম হয়তো মিস করছ!”
প্রলয়ের কথায় লজ্জা পেল ভূমি। অধর কোণে উঁকি দিল লজ্জা মিশ্রিত মিষ্টি হাসি। নিমীলিত কণ্ঠে বলল‚ “আপনার মুখে কিছু আটকায় না!”
“লজ্জা পেলে কী বউকে বেশি বেশি আদর দিতে পারব নাকি?”
এসব লাগাম ছাড়া কথায় তরুণী লজ্জায় মূর্ছা যাচ্ছে। লোকটা ইচ্ছে করেই তাকে লজ্জায় ফেলছে। এটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে সে। ভূমি কথা বাড়াল না। তবে একটা কখন খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু বলা আর হলো না৷ কথাটা এমন যে‚ “এমপি মশাই আপনি বড্ড দুষ্টু!” ভূমিকে চুপ থাকতে দেখে প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚
“তা বিবিসাহেবা কী কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছেন?”
হকচকিয়ে গেল ভূমি। শশব্যস্তভাবে বলে ফেলল‚ “কই না তো!”
আনমনেই হেসে উঠল প্রলয়৷ ভূমিকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করল‚ “পিল খেয়েছিলে?”
মিথ্যে বলতে ইচ্ছে না হলেও ভূমি আজ মিথ্যে বলল। সত্যি বললে যদি প্রলয় রেগে যায় তাই সে সত্যিটা চেপে গেল। মুখে বলল‚ “হুম!”
প্রলয় পুনশ্চ বলল‚ “আমার শরীরে একফোঁটা এনার্জিও অবশিষ্ট নেই গো বউ।”
ভূমি বিচলিত হয়ে বলতে লাগল‚ “মানে? আপনার কী শরীর খারাপ করছে?”
“এত ব্যস্ত কেন হচ্ছ? আমার তো তুমি নামক এনার্জির প্রয়োজন। ইচ্ছে করছে ছুটে তোমার কাছে চলে আসি৷”
আলগোছে বিছানায় শুয়ে পড়ল ভূমি। ডান হাত দ্বারা মুখ ঢেকে নিল। লজ্জা পাচ্ছে ভীষণ। সকালে লোকটার দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারছিল না৷ সকালে খাওয়ার সময়ও কেমন মুখ টিপে হাসছিল! ভাবনার ঘোর কাটল প্রলয়ের শীতল কণ্ঠস্বরে।
“তোমার লজ্জা মাখা মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছে৷”
প্রলয় কল কে’টে দিয়ে ভিডিও কল দিল৷ বুক টিপটিপ করছে ভূমির৷ লজ্জা মিশ্রিত অনুভূতি জেঁকে বসেছে। তবুও কল রিসিভ করল সে৷ তাকে দেখা মাত্রই বুকে হাত রাখল প্রলয়। যাক এতক্ষণে কলিজা ঠান্ডা হয়েছে তার৷ অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে ভূমি৷ আর প্রলয় তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে।
চলবে?…..