রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫৩| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
593

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫৩|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

অবিরত দিনান্ত মূর্ছা গিয়েছে৷ মেদিনীতে নেমে এসেছে ঘোর আঁধারিয়া৷ হুট করেই আবহাওয়া খারাপ করেছে। ক্ষণে ক্ষণে মেঘ গর্জে উঠছে। টিমটিমে মোমবাতির শিখা মৃদুমন্দ সমীরণে কেঁপে উঠছে। ভূমি ঘরেই রয়েছে। মাগরিবের নামায আদায় করার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিয়েছে৷ আজ আইপিএসে সমস্যা দেখা দিয়েছে। চলছে না। এদিকে প্রলয় এখনো বাড়ি ফেরেনি। বাকিরা সবাই যে যার ঘরে রয়েছেন৷ বিছানার উপর বসে একটা হাদিসের বই পড়ছে ভূমি৷ বইটা ফিরোজা দিয়েছেন তাকে। ফিরোজার ঘরে গল্প‚ উপন্যাস আর ইসলামিক বই দিয়ে ভরপুর। তিনি বই পড়তে খুবই পছন্দ করেন। সেই সঙ্গে বই সংগ্রহ করাতেও উনার বেশ আগ্রহ। যখনই সময় পান নিজে গিয়ে পছন্দ করে‚ পড়ে তারপর বই কেনেন। ভূমি এখন নবীর জীবনী পড়ছে৷ মোমবাতি জ্বালিয়ে সেই টিমটিমে আলোয় বই পড়তে তার বেশ ভালো লাগছে। গ্রামের বাড়ির মতো অনুভূতি আসছে। ছোটো বেলায় এভাবেই কুপি জ্বালিয়ে পড়ত৷ তাদের তো বিছানা ছিল না তাই মেঝেতেই মাদুর বিছিয়ে তারপর পড়ত৷ দিনগুলো কতই না সুন্দর ছিল। এশারের আযান পড়েছে। বইটা বন্ধ করে বিছানার উপর রেখে ভূমি ওয়াশরুমে চলে গেল ওযু করবে বলে৷ আগে নামাজ আদায় করবে তারপর আবারও বইটা পড়বে৷ পঁচিশ পৃষ্ঠা অবধি পড়া হয়েছে তার৷ বই পড়ার মাঝেও বেশ সময় কাটছিল।

রাত নয়টা…

কলিং বেল চাপতেই সাবিনা সদর দরজা খুলে দিল৷ মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে প্রলয় সোজা নিজের ঘরে চলে এলো। কারণ বৈঠকখানায় এখন কেউই নেই৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা তাদের ঘরে পড়ছে৷ প্রলয় নিজের ঘরেই চলে এলো৷ এসে দেখল ভূমি বিছানার উপর বসে আছে। মোমবাতি জ্বলছে। জ্বলজ্বল করতে থাকা মোমবাতির উজ্জ্বল লালচে হলুদ আলো ভূমির সর্বাঙ্গে আছড়ে পড়ছে৷ প্রলয় দরজা আটকাতে উদ্যত হলো। হঠাৎ হওয়া শব্দে চমকে উঠল ভূমি। চোখ তুলে তাকাল দরজার দিকে। প্রলয়কে দেখতে পেয়ে কিছুটা স্থির হলো৷ বিছানা ছাড়ে নামল সে। এখন নিশ্চয়ই প্রলয় ফ্রেশ হতে ওয়াশরুম যাবে। বলার আগেই ভূমি ওয়ারড্রব থেকে প্রলয়ের জন্য ট্রাউজার‚ টিশার্ট বের করে রাখল বিছানার উপর। তোয়ালে খানা হাতে নিয়ে তার কাছে গেল। ইতিমধ্যেই প্রলয় তার হাত থেকে ঘড়িটা খুলে ফেলেছে। বুকের কাছ থেকে সাদা শার্টের বোতাম দুটো খুলে ফেলেছে। বুকের লোমশ গুলো আঁধারে দেখা গেল না। তবে এরই মাঝে বিদ্যুৎ চলে এলো। প্রলয়ের উন্মুক্ত বুক দৃষ্টিগোচর হলো। ভূমি চোখ ফিরিয়ে নিল। লজ্জারা হানা দিচ্ছে৷ হাতে থাকা মোবাইলটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলল প্রলয়৷ এরপর ভূমিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল।

“ফ্রেশ পরে হব। আগে বউকে আদর করে নিই।”

ভূমি বাহানা খুঁজতে লাগল৷ হুট করেই বলে উঠল‚ “দরজা খোলা আছে। যেকেউ চলে আসতে পারে!”

প্রলয় তোয়াক্কা করল না৷ বরঞ্চ ভূমির গ্রীবায় সিক্ত পরশ দিয়ে আস’ক্তিমাখা কণ্ঠে বলল‚

“এই বাহানা কাজে দেবে না। নতুন কিছু ভাবো।”

ভূমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভূমির ললাটে আলতো পরশ এঁকে দিয়ে আবারও বলল‚ “তোমায় আদরে আদরে মুড়িয়ে রাখব সোনা।”

কথাটা বলতে দেরি ভূমিকে পাঁজোকোলে তুলতে দেরি হয়নি। আচমকা কোলে তুলে নেওয়ায় ভয়ে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করল ভূমি। প্রলয়ের মতিগতি ঠিক লাগছে না তার। লোকটার তপ্ত নিশ্বাস গায়ের উপর আছড়ে পড়ছে৷ এক অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে। প্রলয়ের গলা জড়িয়ে ধরেছে সে। ভয়ে আছে যদি পড়ে যায়? তাহলে তো তার কোমর ভাঙবে। কিন্তু সে জানেই না প্রলয় তার ভূমি কন্যাকে কখনোই আঘাত পেতে দেবে না। চোখে মেলে তাকাল ভূমি। প্রলয় তাকে বিছানায় সন্তর্পণে শুইয়ে দিয়ে বলল‚

“তোমার এমপি মশাইয়ের এ জীবন থাকতে কোনো আঘাত তোমাকে ছুঁতে পারবে না ভূমি কন্যা। আর হ্যাঁ‚ এত পালাই পালাই করছ কেন? দুপুরে বলেছিলাম না আমার শরীরে বিন্দুমাত্র এনার্জি নেই৷ এনার্জি পেতে হলেও মিষ্টির ছোঁয়া প্রয়োজন।”

ভূমি তাড়াতাড়ি করে শোয়া থেকে বসে পড়ল৷ অধর কোণে মুচকি হাসির ছোঁয়া৷ প্রলয়ের কথা বোধগম্য হয়নি এতটা অবুঝ নয় সে। তাকে দেখে এমপি মশাইও বাঁকা হাসল৷ ভূমির পা টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। সিক্ত ওষ্ঠের ছোঁয়া একে দিল সঙ্গে সঙ্গেই। জোড়া অধরোষ্ঠের আলিঙ্গনে দম আটকে আসার উপক্রম। প্রলয়ের পিঠ খামচে ধরল ভূমি। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। লোকটা ব্যাকুল হয়ে তার ওষ্ঠদ্বয়ের উপর চড়াও হয়েছে৷ অনুভূতির তীব্র উচ্ছ্বাস সর্বাঙ্গে। শিরা উপশিরায় র’ক্ত ছলকে উঠল৷ দেদারসে হৃৎস্পন্দন বাড়তে শুরু করল৷ কোমল হাত দ্বারা প্রলয়ের চুলের পেছনে আকড়ে ধরল সে। ইতিমধ্যেই ভূমি কন্যার বুকের উপর থেকে ওড়না সরিয়ে নিয়েছে প্রলয়৷ কোমরে হাত রেখে নিজের অনেকটা কাছে টেনে নিল ভূমিকে৷ যতটা কাছে টানলে দুটি দেহের দূরত্ব ঘুচয়! সময় বয়ে যায়। প্রলয় আরও ব্যাকুল হতে শুরু করেছে৷ এরই মাঝে কেউ এসে দুয়ারে কড়া নাড়ল। হঠাৎ করে শব্দ হওয়ায় ঘাবড়ে গেল ভূমি। প্রলয়কে নিজের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু বলিষ্ঠ দেহের এই লোকের সঙ্গে সে পারবে? প্রলয় নিজের মাঝে নেই। ভূমিকে আরও কাছে পাওয়ার তাড়নায় মেতে উঠেছে সে৷ ভূমির অধরোষ্ঠে আরও রুক্ষ ভাবে আলিঙ্গন করতে শুরু করল। উন্মাদ হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। এবারও প্রলয়কে নিজের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল ভূমি। অসহায় মুখ করে সেই গম্ভীর চোখের দিকে তাকাল৷ প্রলয় থেমে গেল৷ হুট করেই রেগে গেল। তবে ভূমির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করল না৷ আবারও দরজার কেউ কড়া নাড়ছে। এবার যেন জ্বলন্ত অগ্নিশিখা নিভে গেল। প্রলয় উঠে বারান্দায় চলে গেল। মেঝে থেকে নিজের ওড়নাটা গায়ে আর মাথায় ভালো করে পেঁচিয়ে দরজা খুলে দিল ভূমি। অর্পণ দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রলয়ের সঙ্গে তার একটু দরকার ছিল। খুবই গুরুত্বপূর্ণ দরকার। মাথা নিচু করে ভূমিকে জিজ্ঞেস করল‚

“ভাই ঘরে আছে?”

ভূমি মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে বলল‚ “জি!”

অর্পণের গলার আওয়াজ শুনেই ঘরে চলে এসেছে প্রলয়। এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন অর্পণকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। বুকের কাছ থেকে শার্টের বোতাম খোলা৷ হাত গুটিয়ে রাখা৷ অর্পণ আড়চোখে প্রলয়কে দেখে জিজ্ঞেস করল‚

“কী হয়েছে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন ভাই?”

সব সময়কার মতো আজও প্রলয়ের ত্যাড়া জবাব‚ “তোকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে তাই তাকিয়ে আছি।”

প্রলয়ের কথা শুনে মাথায় হাত অর্পণের। তার ভাই বিয়ের পরও শুধরোবে না৷ চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে অর্পণ বলল‚

“ভেবেছি বিয়ে হয়েছে এবার অন্তত তোমার ওসব উদ্ভট কথাবার্তা থেকে রেহাই মিলবে। কিন্তু তা আর হলো কই? তুমি সেই একই আছ।”

“তুই আমাকে রেহাই দিলি কোথায়? সেই তো বাগড়া দিতে চলেই এলি।”

প্রলয়ের কথার মানে অর্পণ বুঝতে না পারলেও ভূমি ঠিকই বুঝতে পেরেছে। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে হেসে উঠল৷ বড়ো বড়ো চোখের শাসানো দৃষ্টিতে তাকাল প্রলয়। যেন চোখ দিয়ে বলছে‚ ‘আজ আর রক্ষে নেই’ ভূমি আর দাঁড়াল না প্রলয়ের সামনে। দুই ভাইকে কথা বলতে দিয়ে সে বেরিয়ে গেল৷ রাতের খাবার কারোরই খাওয়া হয়নি এখনো। ভূমি নিচে চলে গেল৷ খাবার গরম করতে হবে। সবাই হয়তো কিছুক্ষণ পরই খেতে বসবে৷

ফিরোজা আর ভূমি সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। গুলবাহার আগেই খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। উনার আবার ব্লাড সুগার। খাওয়াদাওয়া পর ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়েন। প্রলয়ের গ্লাসটাতে পানি ভরে দিয়ে পাশেই বসে পড়ল ভূমি৷ নিজের প্লেটে আজ অল্প করে ভাত নিয়েছে৷ খেতে ইচ্ছে করছে না৷ সন্ধ্যেবেলা ফিরোজা মুড়িমাখা করেছিলেন ঝাল ঝাল করে৷ সেগুলো খেয়েই মূলত পেট ভরা৷ এদিকে সকলে খেতে শুরু করে দিয়েছে৷ খাওয়ার এক পর্যায়ে প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚

“পরীক্ষা কেমন হয়েছে পূর্ণ পুষ্প?”

“আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো হয়েছে বড়ো ভাইয়া৷”

“বাকিগুলোর প্রস্তুতি কেমন?”

“সবগুলোই ভালো।”

পুষ্পিতা বলল‚ “আমার ম্যাথ নিয়ে সমস্যা আছে।”

মাধুরী চটে গেলেন মেয়ের উপর। ক্রুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন‚ “সারাবছর কী করেছিস? আগে বলিসনি কেন?”

পানি পান করে মোর্শেদ শিকদার বললেন‚ “এ নিয়ে পরেও কথা বলা যাবে৷ খাওয়ার সময় শুধু শুধু মেয়েটার উপর চেঁচিয়ো না তো।”

“হ্যাঁ আমি কিছু বললেই তো তা চেঁচানো হয়ে যায়।”

কেউ কিছুই বলল না। যে যার মতো খাওয়ায় মনোযোগী হলো। ভূমি প্রলয়ের পাতে ভাত আর তরকারি দিল। এরপর নিজেও খেতে শুরু করল। আড়চোখে একবার মাধুরীর দিকেও তাকিয়েছিল। আজ আর তেমন কিছুই বললেন না তিনি। হয়তো উনার রাগ কমে আসছে কিছুটা।

সবে রাতের খাবার খেয়ে ঘরে এসেছে অর্পণ। সময় কাটছে না তার। আজ সারাদিনে একবারও ইরার সঙ্গে কথা হয়নি। মেয়েটা নিজে থেকেও একটিবার কল করেনি। সে দিয়েছিল কিন্তু ধরেনি। হয়তো ফোন কাছে ছিল না। এমনিতে তো ঘণ্টা পর পর কথা হয় তাদের৷ অর্পণ ভাবল ইরাকে একবার কল করবে। যেই ভাবা সেই কাজ৷ চার্জিং থেকে ফোনটা নিয়ে ইরার নাম্বারে ডায়াল করল সে৷ রিং হবার সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলল ইরা। অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚

“কী করছিলে?”

“পড়ছি।”

“তাহলে মোবাইল হাতে কেন?”

“রুটিন দেখছিলাম তখনই আপনি কল করলেন। তা বলুন কোনো দরকার?”

“সারাদিন যে একটিবারও কল দিলে না?”

“আসলে আমার সেমিস্টারের রুটিন দিয়েছে। প্রচুর পড়তে হবে।”

“তাহলে বিরক্ত করলাম৷ তুমি পড়। আর হ্যাঁ‚ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে৷ রাত জাগবে না৷ বাকি পড়া কাল কভার করবে।”

ফোন কানে রেখেই ইরা বলল‚ “হুম!”

কল কে’টে দিল অর্পণ। ফোন আবারও চার্জিং এ দিয়ে বিছানা ঘুছিয়ে শুয়ে পড়ল। অবশ্য এখন তার ঘুম আসবে না। প্রতিদিন এই সময়টাতে ইরার সঙ্গে কথা বলে৷ তবে আজ তো ইরা ব্যস্ত তার সে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিল।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here