রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫৮| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
601

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫৮|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই রান্নাবান্নার কাজে লেগে পড়েছে ভূমি। ফিরোজার খুব জ্বর। আজ রান্নাঘরে মাধুরীকেও কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। তিনি ভূমির সঙ্গেই হাতে হাতে কাজ করছেন৷ সাবিনা বাড়িতে নেই। এইতো দিন তিনেক হলো সে তার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে৷ বলে তো গিয়েছে এক সপ্তাহের মতো থাকবে। বাকিটা সে-ই জানে। এদিকে ভূমি তরকারি বসাচ্ছে তো মাধুরী কাঁচাবাজার গুলো কে’টে ধুয়ে দিচ্ছেন। ভূমি এঁটো বাসন ধুয়ে দিচ্ছে তো মাধুরী সেগুলোকে মুছে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখছেন। একটা বাড়িতে তো আর কম কাজ থাকে না! এমনিতেই ফিরোজা সব কাজ খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে করেন। মাধুরীকে এক্ষেত্রে রান্নাবান্নার কাজ নিয়ে কোনো চিন্তাই করতে হয় না। আজ পূর্ণতা পুষ্পিতা কলেজে এডমিশন নেবে। প্রলয় তাদের দুজনকে কলেজে নিয়ে যাবে। সকাল দশটা থেকে ভর্তির কার্যক্রম শুরু হবে৷ স্কুলের বান্ধবীরা একেকজন একেক কলেজে ভর্তি হচ্ছে৷ এখন থেকেই সবাই আলাদা আলাদা জায়গায় পড়াশোনা করবে। স্কুলজীবনের এই দশটা বছর খুবই মধুর স্মৃতিবিজড়িত হয়। স্কুলজীবন হচ্ছে একটা আবেগ। একটু একটু করে হওয়া বন্ধুত্ব যখন গভীর হতে শুরু করে তখনই কয়েক লহমায় তা স্মৃতিপাতায় আটকা পড়ে যায়।

সকালের নাস্তা হিসেবে খিচুড়ি‚ বেগুন ভাজা আর ঝাল ঝাল করে মুরগী রান্না করা হয়েছে৷ খাবারগুলোকে ডাইনিং টেবিলের উপর রেখে এলেন মাধুরী। ভূমি সবগুলো খাবারের বাসন একসঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না। তিনি শুধু প্লেটগুলোকে রেখে আসতে বললেন৷ ভূমিও উনার কথানুযায়ী সেটাই করল৷ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হবার পর থেকেই পূর্ণতা পুষ্পিতার দৈনন্দিন রুটিন পালটে গেছে৷ দুপুর বারোটার আগে তাদের দেখা মেলে না৷ মাধুরী চলে গেলেন পূর্ণতা পুষ্পিতাকে ঘুম থেকে জাগাতে। যাওয়ার আগে ভূমিকে বলে গেলেন‚ এই দিকটা সামলে নিতে। ডাইনিং টেবিল গোছাতে গোছাতেই মোর্শেদ শিকদার‚ মেহরাব শিকদার‚ প্রলয় আর অর্পণ চলে এসেছে। ফিরোজাকে হালকা খাবার আর ঔষধ খাইয়ে দেওয়া হয়েছে আগেই। এরই মাঝে মাধুরীও চলে এলেন। এতক্ষণ ধরে পূর্ণতা পুষ্পিতাকে জাগানোর অভিযান চালিয়েছেন তিনি। সবে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়েছে। দুটোর তৈরি হতে আরও দশ বা পনেরো মিনিট সময় লাগতে পারে।

সকাল সাড়ে নয়টা…

সকলের খাওয়া হয়ে গিয়েছে আরও মিনিট দশেক আগেই। মোর্শেদ শিকদার আগেই বেরিয়ে পড়েছেন। অর্পণ তার বাইক নিয়ে আগেই বেরিয়ে পড়েছে। যাবার আগে একটিবারও মেহরাব শিকদারের সঙ্গে কথা বলেনি। বাবার সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে শুরু করেছে। মেহরাব শিকদার ছেলের এমন ব্যবহারে চরম অবাক। তিনি খেয়াল করলেন কাল থেকেই অর্পণের এমন অদ্ভুত ব্যবহার। যেই ছেলে কি-না বাবা বলতে অজ্ঞান। আজ সেই ছেলেই কি-না ক্রমাগত দেখেও না দেখার ভান করে যাচ্ছে৷ হুট করে হলোটা কী ছেলেটার? পূর্ণতা পুষ্পিতাকে নিয়ে প্রলয়ও হয়তো কিছুক্ষণের মাঝেই বের হবে। মেহরাব শিকদার নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে মাধুরীকে বললেন‚

“ফিরোজার একটু ভালো করে খেয়াল রেখ ভাবি।”

মেহরাব শিকদারের এহেন কথায় তাচ্ছিল্য করে বাঁকা হাসল ভূমি। এমনই একটা জীবন তো তার মায়েরও পাওনা ছিল৷ অথচ ভাগ্য কী খেলটাই না খেলাচ্ছে! ব্যাপারটা একদমই দৃষ্টি এড়াল না প্রলয়ের। ভূমিকে এভাবে হাসতে দেখে কিছুটা অবাক হলো। মেহরাব শিকদার চলে গেলেন৷ মাধুরী গিয়েছেন পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে। দরকারি কাগজপত্র গুলো গুছিয়ে নিতে হবে। বৈঠকখানায় শুধু মাত্র প্রলয় আর ভূমি উপস্থিত। প্রলয়ের মনে প্রশ্নটা আবার জাগতেই সে ভূমির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল‚

“তখন চাচ্চুর কথায় এভাবে হাসছিলে কেন?”

কথাটা পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে চাইলেও ভূমি তা করতে পারবে না। কিন্তু প্রলয়কে তো কিছু একটা বলতে হবে। তাই আর কোনো কিছু না ভেবেই ভূমি বলল‚

“উনাদের ভালোবাসা দেখে। কতটা গভীর উনাদের ভালোবাসা! একে অপরের প্রতি এত চিন্তা— এত ভালোবাসা।”

“সারা দুনিয়ার মানুষের ভালোবাসা নজরে পড়ল৷ অথচ আমি যে তোমাকে চোখে হারাচ্ছি— সেটার বেলা?”

এরই মাঝে পূর্ণতা পুষ্পিতা আর মাধুরী নিচে নেমে এলেন। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেল ভূমি। প্রলয় তার বোনদের সঙ্গে করে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। ভূমি এদিকে হাতের কাজগুলো শেষ করে নিজের ঘরে চলে গেল। দুপুরের আগে আর কোন কাজ নেই। যেহেতু সাবিনা নেই আর ফিরোজা অসুস্থ তাই সোনার কাজগুলো তাকে দেখতে হবে। অবশ্য সে পারবে সব কাজ করতে। এতদিনে সংসারের কাজ সে ভালোই শিখে গেছে।

গাড়ি থেকে নেমে পূর্ণতা আর পুষ্পিতাকে আগে আগে হাঁটতে বলে প্রলয় গাড়ি লক করল৷ ওরা দুবোন ধীর পায়ে সামনে এদিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ আর মাত্র কয়েক কদম তার পর থেকে কলেজ জীবন৷ কলেজ গেইট থেকে কিছুটা সামনে দুটো ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রলয় সামনে আর পূর্ণতা পুষ্পিতা দুজন দুজনের হাত ধরে সামনের দিকে এগোচ্ছে। তোদের দুবোনকে দেখে ছেলে দুটো শিস বাজিয়ে উঠল। কেমন করে যেন দাঁত কেলিয়ে হাসছে! পেছন থেকেই প্রলয়কে ডাকার জন্য উদ্যত হলো।

“বড়ো ভা…!”

পুষ্পিতাকে পুরো কথাটা বলতে না দিয়ে তার হাতটা ধরে ফেলল পূর্ণতা৷ ইশারায় চুপ থাকতে বলল৷ বড়ো ভাইয়ার রাগ সম্পর্ক ওরা দুজন বেশ ভালোই অবগত৷ এখনো পেছনে দুটো বখাটে ছেলে শিস বাজাচ্ছে৷ দেখে বোঝা যাচ্ছে বাবা মায়ের বিগড়ে যাওয়া ছেলে এরা। কোনো কাজকর্ম নেই। পূর্ণতা পুষ্পিতা আর প্রলয়কে কেউই চিনল না কারণ গাড়ি থেকে নামার আগেই মাস্ক পড়ে নিয়েছিল। ধুলোতে এলার্জি আছে প্রলয়ের। পূর্ণতা পুষ্পিতা কাঁচুমাচু হয়ে প্রলয়ের পেছন পেছন হাঁটছে। দুজনকে কলেজের গেইটের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে সেই ছেলে দুটোর সামনে এসে দাঁড়াল প্রলয়। রাগে তার চোয়ালে শক্ত হয়ে আছে। তখন সে স্পষ্ট শুনেছে যে এরা দুটোতে মিলে তার বোনদের টিজ করছিল। নেহাতই পূর্ণতা পুষ্পিতা পাশে ছিল তাই রাস্তা দাঁড়িয়ে সিনক্রিয়েট করেনি৷ তাই বলে এই নয় যে‚ সে সবটা মেনে নিয়েছে। প্যান্টের পকেটে হাত রেখে ছেলে দুটোর সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রলয়৷ তাকে দেখা মাত্রই চোখমুখ কুঁচকে রাগান্বিত হয়ে একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল‚

“সমস্যা কী?”

“ওই মিয়া সামনে থেকে সরেন তো!”

মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেলল প্রলয়। এ শহরে তাকে চেনে না এমন মানুষ খুবই কম আছে। ছেলে দুটো নড়েচড়ে দাঁড়াল। সামনে স্বয়ং এমপি ‘সেহরিশ আরশান প্রলয়’ দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে কি-না রেগে গেলে প্রলয়ঙ্কারী রূপ ধারণ করে। তবে তারা তো তেমন কিছুই করেনি। আর না এমপির চ্যালাপেলাদের সঙ্গে কিছু হয়েছে। দ্বিতীয় ছেলেটা জিজ্ঞেস করল‚

“কিছু হয়েছে স্যার?”

প্রলয় এবারও কিছু বলল না৷ ঠাস করে প্রথম ছেলেটাকে একটা থা’প্পড় মে’রে বসল। হুট করে এভাবে থা’প্পড় খেয়ে থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইল ছেলেটা। বুঝে উঠতে পারল না— সে করেছেটা কী? আশেপাশের পথচারীরাও কয়েকজন দাঁড়িয়ে সবটা দেখল। কেউ কেউ তো ভিডিও করতেও শুরু করে দিয়েছে৷ আজকালকার জেনারেশনটাই এমন। যা-ই ঘটুক— ভিডিও করা চা-ই চাই। ভাইরাল হবার ব্যাপার আছে কি-না!

“কী হয়েছে স্যার? ও কী কিছু করেছে?”

এবার এই দ্বিতীয় ছেলেটাকেও শরীরের শক্তি দিয়ে থা’প্পড় মে’রে বসল। পরপরই চেঁচিয়ে উঠল প্রলয়। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল ছেলে দুটোর। এখনো তারা কিছুই বুঝতে পারছে না৷ ভয়ে গলা শুয়ে আসছে৷ হাতপা থরথর করে কাঁপছে ক্রমাগত। এমপির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া চারটে খানি কথা না। এবার কিছুটা ভীড় জমেছে চারিপাশে৷ ট্রাফিক পুলিশ ছুটে এলেন। রাস্তা অপাশেই উনি ডিউটি করেন৷ প্রলয়কে চিনতে পেরেই বললেন‚

“কিছু কী হয়েছে স্যার? এরা কিছু করছে?”

এবার মুখ খুলল প্রলয়। ট্রাফিক পুলিশকে বলল‚ “এখানে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েদের টিজ করছিল।”

ছেলে দুটো নিজেদের বাঁচানোর জন্য বলল‚ “আপনার কোথাও ভূল হচ্ছে স্যার। আমরা তো এমনিতেই এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”

ট্রাফিক পুলিশ ওদের কথা বিশ্বাস করলেন না। কারণ তিনি এর আগেও এদের দুজনকে মেয়েদেরকে বিরক্ত না করার হুমকি দিয়েছিলেন কিন্তু এরা একটা কথাও শোনেনি। উল্টো আরও বেশি করে কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েদেরকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করেছিল৷ ট্রাফিক পুলিশ অফিসার সরাসরিই ছেলে দুটোর খারাপ আচরণের কথা সকলের সামনে বলে দিল৷ ছেলে দুটো তাকাল প্রলয়ের দিকে। এবার যেন চোখ দিয়েই গিয়ে খাবে ছেলে দুটোকে৷ শুকনো ঢোক গিলল। মানে মানে কে’টে পড়লেই যেন বাঁচে৷ পালাতে নিলেও পালাতে পারল না৷ এবার একটা শেষ হু’মকি দিল প্রলয়৷ ছেলে দুটো মনে মনে ভাবল‚ এ জীবনে আর রাস্তায় দাঁড়াবে না। মানসম্মান যা খোয়ানোর তার ইতিমধ্যেই খুইয়ে ফেলেছে ওরা৷ এতক্ষণে হয়তো লোকজন এটাকে লাইভ টেলিকাস্ট করে দিয়েছে।

সন্ধ্যে বেলা…

বৈঠকখানায় বসে রয়েছেন মোর্শেদ শিকদার‚ মেহরাব শিকদার‚ প্রলয় আর অর্পণ। রান্নাঘর থেকে তাদের জন্য চা আর গরম গরম পকোড়া ভেজে দিয়ে গিয়েছে ভূমি। ডাইনিং টেবিলের উপর লাল শাক বিছিয়ে রাখা৷ মাধুরী বসে বসে সেগুলোর আগাছা ময়লা পরিষ্কার করে শাকগুলো একটা ঝুড়িতে রাখছেন৷ রাতের খাবার রান্না হবে এখন। রান্নাঘরে ভূমি বাকি কাজগুলো করছে। এদিকে প্রলয় মুখ ফুটে মধুচন্দ্রিমার কথাটা বলতেই পারছে না৷ কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে তার! চার দেয়ালের মাঝে স্ত্রীর সামনে যে কথাগুলো বলা যায় তা তো আর সবার সামনে বলা যায় না! পুরুষ মানুষ হয়ে যে সব লাজলজ্জা ধুয়ে খেয়েছে এমনটাও নয়। মাঝে মাঝে পুরুষ মানুষও লজ্জা পায়। কিন্তু লজ্জা পেলে যে মনের কথা কখনোই মুখে আসবে না৷ মনে মনে ‘এক‚ দুই‚ তিন’ বলে সমস্ত লাজলজ্জার মাথা খেয়ে প্রলয় বলল‚

“আমি ভাবছি দু-একদিনের জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঘুরে আসি? মুশফিকা বার বার বলছে ওদের ওখানে যেন যাই।”

খাওয়া থামিয়ে মোর্শেদ শিকদার বললেন‚ “তোমার ব্যস্ততা কাটিয়ে যদি সময় থাকে তাহলে ঘুরে আসতেই পারো।”

শুকনো ঢোক গিলে প্রলয় আবারও বলল‚ “আমার বউকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাব।”

ঠোঁট টিপে হাসলেন মোর্শেদ শিকদার আর অর্পণ। এবার একটা মোক্ষম সুযোগ পেলেন মেহরাব শিকদার। নিজের পথের কা’টা উপড়ে ফেলবার জন্য এর থেকে ভালো সুযোগ আর হয়তো একটাও আসবে না৷ মনে মনে এক পৈশাচিক পরিকল্পনা করছেন তিনি। অতি উল্লাসে তিনি বলে উঠলেন‚

“তোদের দুজনের জন্য আমি নিজ দায়িত্বে রিসোর্ট বুক করছি। নিজেদের প্রয়োজনীয় শপিং করে নে৷ কালই রওনা দিস।”

সায় জানাল প্রলয়। ডাইনিং স্পেসে বসে সবটাই শুনলেন মাধুরী। তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করলেন না তিনি। উনার এমন ব্যবহার আজ সত্যিই অবাক করল ভূমিকে৷ এদিকে সে মেহরাব শিকদারের ব্যবহারেও খুবই অবাক। এই লোককে বিশ্বাস করা দায়। না জানি কোন ফন্দি আটছেন।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here