#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৮
________________
ভোরের আলো সদ্য ফুটছে ধরণী জুড়ে। কিচিরমিচির পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। শীতল বাতাস ছুটছে অন্দরমহল ঘিরে। তালুকদার ভিলাটা বিশাল বড়। পুরো রেশবপুরে এই একটাই বিশাল বাড়ি আছে যার নাম তালুকদার ভিলা। এটা একটা পুরনো বাড়ি রাগান্বিতার বাবার দাদারও আগের আমলের বাড়ি। বছর শেষে রঙ দেয়া আর জিনিসপত্রের মেরামত করা হয় শুরু।’
রাগান্বিতা দাড়িয়ে আছে কুহুর কক্ষের সামনে। কেমন যেন বুক কাঁপছে। অস্থির অস্থির লাগছে। জোরে নিশ্বাস ছাড়লো রাগান্বিতা। কুহু মারা যাওয়ার পর রাগান্বিতা ভুলেও একঘরে পা রাখে নি। তার আপার ওপর ভীষণ রাগ ছিল,ক্ষোভ ছিল, আজও আছে। আপা তার কাছে অনেককিছু লুকিয়ে চলে গেছে এটা কি আপার অন্যায় ছিল না। এভাবে বিষ খেয়ে মরে গেলেই কি জীবনের সব যান্ত্রিকতা শেষ হয়ে যায়। মরে গিয়ে আপা কি খুব ভালো আছে। রাগান্বিতা আস্তে করে কুহুর কক্ষের দুয়ারের কপাট খুললো। ভিতরে ঢুকতেই আপার গায়ের গন্ধ যেন নাকে ভাসলো। রাগান্বিতার বুকটা হু হু করে কেঁপে উঠলো। কান্না আসতে চাইলো ভিতর দিয়ে। রাগান্বিতার তার আপাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতো। অথচ তার আপাই তাকে কিছু না বলে এভাবে পালিয়ে গেল। রাগান্বিতা আশেপাশে তাকালো পালঙ্কের দিকে চাইলো। তার মনে হচ্ছে তার আপা পালঙ্কেই শুয়ে আছে আর সে ডাকতে এসেছে। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে নিলো। ভাবলো এমনই এক সকালের কথা। রাগান্বিতা সেদিন প্রথম চা বানিয়েছিল বাড়ির সবার জন্য। কি আনন্দকর মুহুর্ত ছিল সেই দিনটা।সেই সকালটা।”
চায়ের কাপ হাতে কুহুর কক্ষের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা। ঠোঁটে তার মিষ্টি হাসি। কুহু কেবলই বই পড়ে শুয়ে ছিল পালঙ্কে। সেই মুহুর্তেই রাগান্বিতা ছুট্টে গিয়ে বললো,
“আপা, এই আপা উঠো জলদি দেখো আমি চা বানিয়ে এনেছি।”
কুহুর ঘুমে বে’ঘাত ঘটলো খানিকটা। সে কাঁথা মুড়ি দিয়ে অন্যদিকে ফিরে বললো,
“এখন খাবো না তুই পরে নিয়ে আসিস।”
রাগান্বিতা তাও গেল না অনেক সাধার পরও কুহুকে উঠতে না দেখে রাগান্বিতা চলে যায় কুহুর আয়নার দিকে। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে বললো,
“আপা তোর আলমারি থেকে আমি একটা ডাইরি নিলাম পড়ে আবার দিয়ে যাবো।”
সঙ্গে সঙ্গে লাফ মেরে উঠলো কুহু। কুহু আলমারিতেই তার বেশিরভাগ ব্যাক্তিগত ডাইরি লুকিয়ে রাখতো। কি যে লিখতো কে জেনে। রাগান্বিতা সেদিন একটা ডাইরি নিয়ে পুরো অন্দরমহল ছুটেছে আর তার পিছন পিছন কুহু। ডাইরির কিছু দেখি নি রাগান্বিতা শুধুমাত্র আপাকে ক্ষেপাতে ছুটেছিল। কি সুন্দর মুহুর্ত ছিল হাসি আর উল্লাসে ভরা। অথচ আজ সব ফাঁকা।’
রাগান্বিতা তার চোখ খুললো। কান্না ভেজা গলায় বললো,“এভাবে ছেড়ে না গেলে কি একদমই চলতো না আপা।”
রাগান্বিতা আশেপাশে তাকিয়ে সোজা চলে যায় আলমারির কাছে। নিশ্বাস কেমন ভাড়ি হয়ে আসছে তার। রাগান্বিতা আলমারি খুললো সঙ্গে সঙ্গে আপার গায়ে জড়ানো কিছু শাড়ি নজরে পড়লো। রাগান্বিতা হাত বুলালো শাড়িতে। একটা শাড়ি বুকে জড়িয়ে ধরে মুখ চেপে কাঁদলো। এত যন্ত্রণা নাহি সহে। রাগান্বিতা শাড়িতে চুমু কাটলো। নীরবে বললো,“তুই খুব খারাপ আপা। এভাবে চলে গিয়ে একদম ঠিক করিস নি। দাদিমা যা বলেছে তা যদি সত্যি হয় আমি তবে তাকে ছাড়বো না আপা, খুঁজে বের করে নিজ হাতে খুন করবো দেখে নিস। আমার পবিত্র আপাটাকে যে কলঙ্কিত করেছে তাকে আমি কিছুতেই ছাড়বো না কিছুতেই না।”
রাগান্বিতা শাড়ি ছেড়ে পুরো আলমারি দেখলো। অদ্ভুত ব্যাপার আপার লেখা একটা ডাইরিও এখানে নেই। সব গেল কই। দাদিমা সরিয়ে দেয় নি তো। রাগান্বিতার নিজেকে অসহায় লাগলো। রাগান্বিতা নিচে বসে পড়লো। সবকিছু কেমন শূন্যতায় আঁকড়ে ধরলো। রাগান্বিতা নির্বিকার, নির্লিপ্ত। তার মনে হচ্ছে আপার সাথে রাগ দেখিয়ে সে এ কক্ষে এতদিন না এসে ভুল করেছে। হঠাৎই আলমারির একদম নিচের তাকে থাকা একটা শাড়ির দিকে নজর গেল রাগান্বিতার। শাড়িটা খয়েরি রঙের। এই শাড়িটা রাগান্বিতা কুহুর দুজনের পছন্দের ছিল কিন্তু বাবা এনেছিল একটা। একবার ঝগড়াও হয়েছিল এর জন্য কিন্তু পরে রাগান্বিতায় দিয়ে দেয় শাড়িটা। রাগান্বিতা শাড়িটা বের করতেই একটা চিঠি খোসে পড়লো নিচে। রাগান্বিতা স্তব্ধ হয়ে চিঠিটা ওঠালো সাদা খামের মাঝে লেখা চিঠিটা। রাগান্বিতা তার চোখের পানি মুছে চিঠিটা খুললো। পড়তে লাগলো যেখানে প্রথমেই লেখা ছিল,
“প্রিয় বোন!
তুই যখন আমার এই লেখাটা পড়বি তখন বোধহয় আমি আর এই দুনিয়াতে থাকবো না। আমি জানি তুই ভীষণ রাগ করবি আমার ওপর, হয়তো কবরটাও দেখতে যাবি না। কিন্তু কি করবো বোন আমি যে নিরুপায়। মৃত্যু ছাড়া আমার যে আর কোনো উপায় নেই। আমি যে কলঙ্কিত!
রু’হুটা যে কেঁপে উঠলো রাগান্বিতার ‘আমি যে কলঙ্কিত’ কথাটা দেখে। তার আপা কলঙ্কিত নয়। রাগান্বিতার কথাটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে। রাগান্বিতা আবার চিঠিতে চোখ বুলালো। লেখা দেখলো,
বিয়ের আগে কখনো কোনো মানুষকে ভালোবাসবি না বোন। ভালোবাসা খুব যন্ত্রণার হয় যদি মানুষটা সঠিক না হয়। আমি ভালোবেসেছিলাম একটা মানুষকে। তার নাম ছিল আরফান মজুমদার। শহরে থাকতো। মানুষটাকে আমি বিশ্বাস করে ঠকেছিলাম। আমাদের বিয়ে হয়েছিল কিন্তু পরে জানি ওটা নাকি কোনো বিয়েই ছিল না। শুধুমাত্র একটা সাদা কাগজে আমার আর তার সই ছিল। নিজের সবটা দিয়ে যাকে ভালোবাসলাম, যার সন্তানের মা হতে চলেছিলাম সেই মানুষটা যখন বলে আমাদের বিয়েটা নাকি মিথ্যে ছিল শুধুমাত্র আমাকে ভোগ করার জন্য এত নাটক। অথচ বিয়ের আগে একবারও মনে হয় নি মানুষটা আমাকে ব্যবহার করছে। আমায় নিয়ে খেলছে। এত নিখুঁত অভিনয় ছিল তার। কষ্ট হচ্ছে বোন, তোদের ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকটা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তাও ছেড়ে যেতে হচ্ছে। সবসময় ভালো থাকবি। নিজের খেয়াল রাখবি। কখনো বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে কাউকে ভালোবাসবি না। বাবা তোর জন্য যাকে আনবে তাকেই বিয়ে করবি, ভালোবাসবি। আপার মতো ভুল করিস না কখনো। কতটা যন্ত্রণা নিয়ে যে পৃথিবী ছাড়ছি বোন যদি তোকে বোঝানো যেত। তোকে শেষ বারের মতো একবার জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সময় যে নেই। আজ চললাম ভালো থাকিস। নিজের যত্ন নিস পারলে আপাকে ক্ষমা করিস।
ইতি,
তোর অভাগী আপা
কুহুু”
এক বুক হাহাকার নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো রাগান্বিতা। চিঠিটা জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে বললো, আপা, আমার প্রিয় আপা! যন্ত্রণায় ছটফট করছে, হৃদয়টা কাতরাচ্ছে। কেমন যেন চারপাশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে রাগান্বিতার। এতদিনের রাগ নিয়ে জমানো কান্না বুঝি আজ বাঁধ ভাঙলো।
রাগান্বিতার এইভাবে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠার দৃশ্যটা বুঝি দুয়ারের কাছে দাড়িয়ে কেউ দেখলো। মুখ চেপে নিঃশব্দে কাদলো খুব।’
—-
সকালের রোদ মুখে পড়তেই ঘুমটা ভাঙলো ইমতিয়াজের। চোখ মেলে তাকিয়ে আশেপাশে রাগান্বিতাকে না দেখে আস্তে করে মাথাটা চেপে ধরে উঠে বসলো সে। এরই মাঝে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে ভিতরে ঢুকলো রাগান্বিতা। চোখ দুটো কেমন ফুলে গেছে। ইমতিয়াজ চেয়ে রইলো তার দিকে। রাগান্বিতা চায়ের কাপ টেবিলে রেখে। ইমতিয়াজের মুখোমুখি এসে পালঙ্কে বসলো। ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে?”
রাগান্বিতা জবাব দেয় না। ছলছল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে শুধু ইমতিয়াজের মুখের দিকে। ইমতিয়াজ চিন্তিত স্বরে শুধায়,
“কি হয়েছে বলো আমায়?”
আচমকাই ইমতিয়াজকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ হতভম্ব। রাগান্বিতা কাঁদলো। শক্ত করে ইমতিয়াজকে চেপে ধরে অনেক কাঁদলো। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল। ইমতিয়াজ নির্বিকার। অনেকক্ষণ চুপ থাকলো দুজনেই। শুধুমাত্র রাগান্বিতার গোঙানো ছাড়া কিছুরই শব্দ শোনা গেল না। ইমতিয়াজও কোনো প্রশ্ন করলো না মিনিট দশেক। সে অনুভব করলো রাগান্বিতার কান্নার স্বরে তার ভিতরটা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। চারপাশ ছারখার হচ্ছে। এত যন্ত্রণা তো আগে অনুভব হয় নি ইমতিয়াজের।’
ধীরে ধীরে প্রকৃতি হলো পুরোপুরি শান্ত। রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে ছাড়লো এবার বুঝি একটু হাল্কা লাগছে নিজেকে। রাগান্বিতা তাকালো ইমতিয়াজের দিকে। মানুষটাকে জড়িয়ে ধরলেই আলাদা শান্তি অনুভব করে রাগান্বিতা। রাগান্বিতা দেখলো, ইমতিয়াজ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো এবার। বললো,
“হাল্কা লাগছে?”
মাথায় নাড়ায় রাগান্বিতা। যার অর্থ হা লাগছে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার চোখের পানি হাত দিয়ে মুছতে মুছতে বললো,
“এবার বলো কি হয়েছে?”
রাগান্বিতা মাথা নুইয়ে বললো,
“আপা!’
ইমতিয়াজ বিস্মিত হয়ে বললো,“আপা মানে কুহু।”
আবারও মাথা নাড়ায় রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ বলে,
“আপার কথা মনে পড়েছে?”
নিষ্পলক চোখে ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলে রাগান্বিতা,
“আপনি জানেন আমার আপা বিষ খেয়ে আত্নহত্যা করেছিল।”
চমকে উঠলো ইমতিয়াজ। অবাক স্বরে বললো,“কেন?”
রাগান্বিতা বলবে ভেবেও কেন যেন চেপে গেল। মাথা নিচু করে বললো,“জানি না। হঠাৎই বিষ খায়।”
ইমতিয়াজ আর কিছু বলে না। অনেকক্ষণ চুপ থাকে। পরে প্রশ্ন করে,
“পুলিশকে জানানো হয় নি?”
“না বাবার সম্মানহানির ভয়ে চেপে গেছেন।”
হঠাৎই মাথায় হাত দিয়ে আহ্ করে উঠলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা ঘাবড়ে গেল উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“কি হলো?”
“যন্ত্রনা হচ্ছে।”
রাগান্বিতা খেয়াল করলো ইমতিয়াজের কপাল দিয়ে আবার রক্ত বের হচ্ছে। রাগান্বিতা হতভম্ব স্বরে বললো,“রক্ত!”
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]
#TanjiL_Mim♥️