“রাগান্বিতা! এই রাগান্বিতা! উঠ জলদি তোর নামে চিঠি এসেছে। উঠে দেখ। আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছিস? রাগান্বিতা, এই রাগান্বিতা!”
আচমকাই কারো কণ্ঠ শুনে শোয়া থেকে উঠে বসলো একটি মেয়ে। এলেমেলো চুল,চোখের নিচে কালো দাগ, গায়ের জামাটাও বেশ জায়গা দিয়ে ছেঁড়া, পালঙ্কের সাথে লাগিয়ে পায়ে শিকল বাঁধা। মেয়েটি আশেপাশে তাকালো তার পালঙ্কের পাশ দিয়েই সাদা পৃষ্ঠায় লেখা একটা চিঠি রাখা। মেয়েটি চিঠিটা উঠালো এদিক সেদিক দেখে চিঠিটা খুললো সঙ্গে সঙ্গে একটা লেখা দেখলো,
“আমি ফিরে এসেছি রাগান্বিতা, দেখো রাগান্বিতা আমি ফিরে এসেছি।”
লেখাটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠলো। বাবা, বাবা বলে চেঁচিয়ে উঠল সে উচ্চস্বরে। সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের মানুষজন দৌড়ে আসলো কিন্তু মেয়েটির বাবা আসলো না কারণ মেয়েটির বাবা মারা গেছে আরো পাঁচবছর আগে। মেয়েটি এলেমেলোভাবে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে হাতে তালি দিতে দিতে বলতে লাগলো শুধু,
“বাবা, ইমতিয়াজ ফিরে এসেছে বাবা। দেখো আমার নামে চিঠি পাঠিয়েছে। বাবা।”
সবাই চিঠিটা দেখলো একটা সাদা পৃষ্ঠা ছাড়া কিছুই লেখা নেই সেখানে। ততক্ষণে রাগান্বিতাদের বাড়ির কাজের লোক রামু ডাক্তার নিয়ে হাজির। ডাক্তারের নাম ইলিয়াস। মাঝ বয়সী একটা ছেলে। ইলিয়াস দ্রুত ভিতরে ঢুকলো। ডাক্তারকে দেখে বিছানায় বসে থাকা মেয়েটি আরো চেঁচিয়ে উঠলো আশপাশের মহিলাদের রাগান্বিতাকে শক্ত করে ধরার ইশারা করলো ইলিয়াস। মহিলারা তাই করলো, মেয়েটিকে শক্ত করে চেপে ধরতেই মেয়েটি চেচাতে লাগলো আরো। বললো,
“তোমরা এভাবে আমায় ধরেছো কেন ছাড়ো বলছি।”
কিন্তু কেউ ছাড়লো না। ইলিয়াস দ্রুত একটা ইনজেকশন পুস করলো মেয়েটির হাতে। ধীরে ধীরে মেয়েটা শান্ত হলো। কিন্তু তখনও বলতে ছিল।’
“তোমরা ছাড়ো আমায়। বাবা, ইমতিয়াজ ফিরে এসেছে বাবা,তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো ইমতিয়াজ ফিরে এসেছে।’
বলতে বলতে নেতিয়ে পড়লো মেয়েটি। সময় গড়ালো ঘর হলো শান্ত মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়লো। মেয়েটি ঘুমাতেই ঘর থেকে একে একে বের হলো সবাই। কেউ কেউ বলতে লাগলো,
“আহারে মাইয়াডার এমন অবস্থা আর দেহোন যাইতাছে না বাপ ভাই সব তো মইরা গেল আর মাইডাও পাগল হইয়া এমন পইড়া আছে। কার যে নজর লাগছিল এই জমিদার বাড়িতে সব পুরা ধ্বংস কইরা দিলো। সামনে যে কি হইবো মাইয়াডার কে জানে?”
বলতে বলতে সবাই প্রায় আফসোস করে চলে গেল বাহিরে। শুধু যায় নি ইলিয়াস আর রামু। রামুর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। রাগান্বিতার অবস্থাটায় তার খুবই খারাপ লাগছে। আর ইলিয়াস সেও নীরবে তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতার মুখের দিকে। মেয়েটার সাথে কি হয়েছিল তা জানার জন্য দিনে দিনে যেন তার অস্থিরতা আরো বাড়ছে। প্রায় ২০ মিনিটের মতো রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে থাকলো ইলিয়াস। হঠাৎ রামু বললো,
“ডাক্তার বাবু বাইরে যাইবেন না?”
ইলিয়াসের হুস আসলো খানিকটা হতভম্ব হয়ে বললো,
“হুম যাবো চলো।”
রামু আর ইলিয়াস বের হলো রাগান্বিতার কক্ষ থেকে। কক্ষ থেকে বেরিয়ে দরজাটা পুনরায় সামনে থেকে আঁটকে দিলো রামু। তালাটা আঁটকে দিল মুহুর্তেই। রামু তার চোখ মুছলো ইলিয়াস তখনও রামুর পাশে দাঁড়ানো কিছু একটা ভাবছিল। রামুর তালা আটকানো শেষ হতেই ইলিয়াসকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“লন যাই।”
হাঁটতে শুরু করলো রামু আর ইলিয়াস। হঠাৎ ইলিয়াস প্রশ্ন করলো রামুকে,
“তোমায় একটা প্রশ্ন করবো রামু?’
রামুও হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিলো,
“হুম কন,
“রাগান্বিতার সাথে কি হয়েছিল রামু?”
রামু দাঁড়িয়ে পড়লো। রামুকে দাঁড়াতে দেখে ইলিয়াস আবার প্রশ্ন করলো,
“কি হলো রামু? আমায় বলো গত পাঁচ বছর যাবৎ থেকে আমি রাগান্বিতার চিকিৎসা করছি এখনও জানতে পারি নি রাগান্বিতার সাথে ঠিক কি হয়েছিল? আমি তো শুনেছি মেয়েটা আগে এমন ছিল না তাহলে পাঁচ বছর আগে কি এমন ঘটলো যে মেয়েটা এমন পাগল হয়ে গেল। আর ইমতিয়াজই বা কে?”
রামু জবাব দেয় না। শুধু থরথর করে এতটুকু বলে,
“আমি এগুলান জানি না ডাক্তার বাবু।”
“তুমি মিথ্যে বলছো রামু তুমি এই রাগান্বিতাদের বাড়ি আরো দশ বছর থেকে কাজ করছো তাহলে তুমি কিভাবে জানো না আমায় বলো আমি শুনতে চাই এই জমিদার বাড়ির ঘটনা। সবাই বলে কার নাকি নজর লেগেছিল এই জমিদার বাড়িতে। এটা কি সত্যি?”
এবার রামু মুখ খুললো। বললো,
“এসব কিছু আমি জানি না ডাক্তার বাবু। পাঁচ বছর আগে আমি ছয় মাসের লাইগ্যা ছুটি নিয়া আমগো বাড়িতে গেছিলাম তখনই কি জানি হইছিল তবে ইমতিয়াজ নামের এক পোলা এই জমিদার বাড়ি আইছিল আমার লগে দেহাও হইছিল।”
রামুর কথা শুনে ইলিয়াস নড়েচড়ে উঠলো। উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“তার মানে ইমতিয়াজ নামের সত্যি সত্যিই কেউ ছিল রাগান্বিতার জীবনে।”
“হ।’
“তাহলে ছেলেটাকে আনছো না কেন আজই খবর দেও ছেলেটাকে ছেলেটা আসলেই তো রাগান্বিতা ঠিক হয়ে যাবে মনে হয়। এত বছরে তুমি এই কথা আজকে আমায় বলছো রামু,
“আগ্গে হইছে কি ডাক্তার বাবু?’
রামু আরো কিছু বলবে এরই মাঝে রাগান্বিতার রুম থেকে বিকট শব্দের একটা আওয়াজ আসলো ইলিয়াস আর রামু দুজনেই চমকে উঠলো এতে। হতভম্ব হয়ে বললো ইলিয়াস,
“আওয়াজটা রাগান্বিতার রুম থেকে এলো না রামু।”
রামুও দ্রুত জবাবে বললো,
“হয়।”
“চলো দ্রুত।”
দৌড়ে ছুটলো ইলিয়াস আর রামু। দরজা খুলতেই দেখলো রাগান্বিতা এখনও ঘুমিয়ে আছে তাহলে শব্দটা আসলো কিসের তখনই একটা গ্লাস পড়ে থাকতে দেখলো তারা। আর জানালা বেয়ে ছুটতে দেখলো একটা বিড়ালকে। দৃশ্যটা দেখেই বুঝেছে তারা শব্দটা কিসের ছিল আর কিভাবে হলো। রামু আবার দরজা আঁটকে দিল। তালাবদ্ধ করে আবার হাঁটতে লাগলো দুজন।’
বিছানায় বেঘোরে ঘুমানো ছিল রাগান্বিতা। তার খাটের পাশেই ছিল একটা ছোট্ট টেবিল। টেবিলের ওপর কিছু এলেমেলো বই আর একটা ঝুলি। ঝুলির মধ্যে ছিল অনেকগুলো সাদা, নীল, সবুজসহ নানা রঙের চিঠি আর চিরকুট। ঝুলিটার ঢাকনা ছিল আলগা। মাত্রই বিড়ালটা সেই ঝুলিটার ওপর দিয়ে যাওয়ার কারণে ঢাকনাটা পড়ে যায় নিচে। হঠাৎই বাহির থেকে একটা দমকা হাওয়া আসতেই ঝুলির ভিতর থেকে একটা চিরকুট পড়লো নিচে। যেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল,
“প্রিয় রাগান্বিতা”
___________________________
সাল ১৯৮১। বড় বোনটা মারা গেছে আজ ৭দিন হলো। গ্রামের নাম রেশবপুর। বাড়ির নাম তালুকদার ভিলা। বিশাল জমিদার বাড়ির দুই কন্যা কুহু আর রাগান্বিতা। বড় বোনের নাম কুহু আর ছোটজনের নাম রাগান্বিতা। রেশবপুর গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী দুই নারী কুহু আর রাগান্বিতা। কুহুর মুখে ছিল মায়াতে ভরা আর রাগান্বিতা নামের মতো মানুষটাও ছিল শক্তপক্ত আর রাগের তেজ। দেখতেও ছিল অত্যাধিক সুন্দর। চোখে সবসময় থাকতো তার গাড়ো কাজল দেয়া।’
প্রকৃতি ছিল খুব থমকানো। গাছের শুকনো পাতায় ভড়পুর বাড়ির আঙিনা উঠান। জমিদার বাড়ির মালিকের নাম মোতালেব তালুকদার। তারই দুই কন্যা কুহু আর রাগান্বিতা। এছাড়াও একজন সুদর্শনীয় যুবক ছেলে আছে যার নাম রেজওয়ান। ৭ দিন আগে বোনকে যখন দাফনের জন্য নেওয়া হয়েছিল রাগান্বিতা তখন দাড়ানো ছিল তাদের বাড়ির দোতলার বারান্দায়। চোখে মুখে ছিল শক্ত ভাব। আজও সেই জায়গাতেই দাঁড়ানো। সাতদিন আগে বোনটা হুট করেই বিষ খেয়ে মারা গেল, বিষ খাওয়ার কারণ এখনো ঠিকভাবে বোঝা যায় নি, কারণ কুহুর পরিবারগত কোনো সমস্যাই ছিল না। না তাদের মাঝে এমন কোনোকিছু ঘটেছিল যার জন্য কুহু বিষ খেতে পারে। তারপরও কিছু তো একটা ঘটেছিল কুহুর সাথে যার জন্য মেয়েটা বিষ পান করে মারা গেল। রাগান্বিতা পণ করেছে বোনের মৃত্যুর রহস্য সে জেনেই ছাড়বে। এত সহজে বিষয়টাকে হাল্কাভাবে নেয়া হবে নাকি। বাবা যতই সম্মানের জন্য বিষয়টা লুকিয়ে রাখুক তাকে তো জানতেই হবে বোনটা কেন মারা গেল?’
রাগান্বিতা যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত ঠিক সেই মুহূর্তেই তাদের বাড়ির উঠানে সাইকেলে চড়ে ডাকপিয়ন আসলো। রাগান্বিতার নামে নাকি একটা চিঠি এসেছে। রাগান্বিতা অবাক হলো কথাটা শুনেই। একটা আট বছরের বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে বললো রাগান্বিতাকে,
“ছোটো আফা আমনের নামে চিডি আইছে ডাকপিয়ন আমনেরে ডাকতাছে।”
রাগান্বিতা খানিকটা বিরক্ত প্রকাশ করলো এতে। বললো,
“আতিব তোকে না বার বার বলেছি আমার সামনে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবি। আর কে পাঠিয়েছে চিঠি?”
আতিব খানিকটা নিচু স্বরে বললো,
“তা তো জানি না ছোডো আফা আমনেরে ডাকপিয়ন ডাকে চিডি গিয়া নিয়া আহেন।”
রাগান্বিতা বিরক্ত হলেও এবার আর কিছু বললো না। এ আতিবকে তো পরে দেখে নিবে। আগে চিঠিটা কে দিলো দেখতে হবে। রাগান্বিতা নেমে পড়লো নিচে। নিচে নামতেই সাইকেলে বসা এক ডাকপিয়নকে দেখলো রাগান্বিতা যা দোতলায় দাড়িয়েও দেখে ছিল। রাগান্বিতা নীরবে এগিয়ে গেল। রাগান্বিতা যেতেই ডাকপিয়ন তাকে চিঠিটা দিয়ে একটা সই নিয়ে চলে গেল। ডাকপিয়ন যেতেই রাগান্বিতা চিঠিটা খুললো। চিঠিটা খুলতেই লেখা দেখলো সে।’
“মেঘ করেছে মনের ভিড়ে,
তোমার তো দেখা নাই,
আমি তো এক নিস্তব্ধ মানুষ
তোমার খোঁজ কোথায় পাই?”
#চলবে…..
#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
— পর্বঃ০১
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। আসসালামু আলাইকুম গাইস। প্রায় ১ মাস পর আবার নতুন করে তোমাদের জন্য কিছু লিখলাম। আশা করি তোমাদের ভালো লাগবে। তোমাদের রেসপন্স ভালো হলেই নেক্সট পার্ট দিবো। প্রথম পর্ব কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবে সবাই।]
#TanjiL_Mim♥️
#everyone 🦋.