#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৯
________________
বিষণ্ণতায় ঘেরা চারপাশ। কবিরাজ হাকিমকে আবারও ডাকা হলো তালুকদার ভিলাতে। সকাল সকাল এমন ঘটনায় সবাই হতভম্ব। ইমতিয়াজের মাথা দিয়ে আবার রক্ত বের হচ্ছে এটা তো ভালো লক্ষণ নয়। কবিরাজ বলেছে যত দ্রুত সম্ভব ইমতিয়াজকে শহরে নেয়ার জন্য। দাদিমার ইচ্ছে ছিল রাগান্বিতাদের জন্য নিজ হাতে পিঠা বানিয়ে খাওয়াবে কিন্তু এ ইচ্ছে বোধহয় এবার আর পূরণ হলো না। কবিরাজ পুনরায় ইমতিয়াজের মাথায় বাঁধা পট্টি খুলে নতুন করে জড়িবুটি দিয়ে পট্টি বেঁধে দিলো। তার ধারণা মাথায় অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে। কবিরাজ তার পটলিটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। পালঙ্কেই বসা ছিল ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা, দাদিমা দূরে দাঁড়িয়ে। মোতালেব তালুকদার পালঙ্কের কর্নারে বসা। রেজওয়ান নেই এখন। সে ফজরের নামাজের পর যে বেরিয়েছে আর ফেরে নি। কবিরাজ মোতালেব তালুকদারের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তালুকদার সাহেব জামাইডারে যত হয়ালে পারেন শহরে পাডাইয়া দেন। জখম কিন্তু খুব গভীর। হয়ালে চিকিৎসা না করাইলে বিপদ হইতে পারে।”
তালুকদার সাহেব চিন্তিত হলেন। বেশি না ভেবেই দুপুরের ট্রেনেই ওদের শহরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। রাগান্বিতা তার ব্যাগপত্র গোছানোর তোড়জোর করলো। বাকিরা একে একে কক্ষ থেকে বের হলো। দাদিমা চললেন এদের জন্য রান্না করতে।’
রাগান্বিতা উত্তেজিত হয়ে তার ব্যাগপত্র গোছানোর কাজটা করছে৷ ইমতিয়াজ তাকিয়ে আছে তার দিকে। হাবভাব দেখছে। মেয়েটা বড্ডই তাড়াহুড়ো করছে। ইমতিয়াজ ধীরে সুস্থে পালঙ্ক থেকে নামলো। মাথাটায় এত বেশি যন্ত্রনা হচ্ছে যে এখন ইমতিয়াজের অসহ্য হচ্ছে। হাতের কাছে বদমাশটাকে পেলে না আচ্ছা করে দিতো দু’গা। ইমতিয়াজ গিয়ে জানালার দিকে তাকালো। চিক চিক করা রোদ্দুরেরা ছুঁয়ে দিলো তাকে। ইমতিয়াজ তাকালো কুহুকে শুয়ে রাখা কবরের ওদিকটায়। তেমন কিছু নজরে আসছে না তার৷ ইমতিয়াজ একা মনে আওড়ালো,
“তুমি বিষ খেয়েছিলে কুহেলিকা! খুব যন্ত্রণা হয়েছিল নিশ্চয়ই।”
রাগান্বিতা এগিয়ে এসে ইমতিয়াজের কাঁধে হাত রাখলো। নরম গলায় বললো,
“উঠে আসলেন যে, শুয়ে থাকুন না।”
ইমতিয়াজ নীরব চোখে তাকালো রাগান্বিতার দিকে। শীতল সুরে বললো,
“তুমি এতো ভেবো না আমায় নিয়ে। আমার কিছু হয় নি।”
“জানি তো কিছু হয় নি। তাও শুয়ে থাকুন। আর বেশি কথা বলবেন না। আমার মনে হয় আপনি আমার সাথে এত কথা বলছিলেন বলেই মাথায় চাপ সৃষ্টি হওয়ার কারনে রক্ত বের হচ্ছিল।”
ইমতিয়াজ কিছু বলে না। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের হাত ধরে নিয়ে আসলো। ইমতিয়াজও বাধ্য হয়ে এগিয়ে আসো। রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে বসিয়ে দিলো পালঙ্কে। পুরোটা সময় ইমতিয়াজ শুধু দেখেই গেল রাগান্বিতা। হঠাৎই রাগান্বিতার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“তুমি তোমার আপাকে খুব ভালোবাসতে তাই না বউ?”
রাগান্বিতা দু’মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল ইমতিয়াজের প্রশ্নে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বললো,
“হুম বাসতাম তো খুব বাসতাম। আপা তো আমার প্রাণ ছিল।”
ইমতিয়াজ কিছু বলে না আর রাগান্বিতা মৃদু হেঁসে বললো শুধু,“শুয়ে থাকুন।”
ইমতিয়াজ শুয়ে পড়লো। রাগান্বিতা নরম হাতে তার মাথায় হাত বুলালো।
—-
হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ঢুকলো রেজওয়ান। চিন্তিত মুখ তার। কারন কাল থেকে তার বন্ধু মনজুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষবার কাল বিকেলে রেজওয়ানের সাথে দেখা হয়েছিল। প্রাণ প্রিয় বিশ্বস্ত বন্ধুটা হঠাৎ কোথায় গেল বুঝতে পারছে না রেজওয়ান। আজ ফজরের নামাজে মসজিদে আসতে না দেখেই কেমন যেন লাগে রেজওয়ানের কারণ মনজু কখনোই সুস্থ থাকতে নামাজ কাযা করে না। রেজওয়ান চিন্তিত হয়ে মনজুদের বাড়ি যায়। গিয়ে শোনে মনজু নাকি কাল রাত থেকেই বাড়ি ফেরে নি। কোথায় গেছে কে জানে! রেজওয়ান সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই মুখোমুখি হলো মোতালেব তালুকদারের। তিনি রেজওয়ানকে হন্তদন্ত হয়ে ভিতরে ঢুকতে দেখে গম্ভীর আওয়াজে বললেন,“রেজওয়ান দাঁড়াও।”
রেজওয়ান দাঁড়িয়ে পড়লো। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,“জি বাবা।”
মোতালেব তালুকদার এগিয়ে আসলেন। রেজওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কিছু কি হয়েছে? তোমায় খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।”
রেজওয়ান প্রথমে ভেবেছিল কথাটা চেপে যাবে। কিন্তু পরে ভাবলো না থাক। সে সরাসরিই বললো,
“আসলে বাবা আমার বন্ধু মনজুকে কাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর বৃদ্ধ বাবা-মা খুব চিন্তা করছেন তাই আর কি।”
মোতালেব তালুকদার চরমভাবে অবাক হলেন। বললেন,
“খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে। কোথায় গেছে?”
“সেটাই তো বুঝচ্ছি না। ও বলেছিল ও আজ থেকে আমার সাথে কৃষিকাজে যোগ দিবে।”
মোতালেব তালুকদার কিছু বললেন না। তবে চিন্তিত হলেন খুব। জলজ্যান্ত ছেলেটা গেল কোথায়?”
—–
নদীর ঘাটে বাক্সপেটরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা। ইমতিয়াজের ইচ্ছে ছিল গতবারের মতো এবারও তারা জাহাজে করে শহরে যাবে। কিন্তু মাথার জখম বড্ড বেশিই জ্বালাতন করছে। ভাড়ি লোহা জাতীয় কিছু দিয়ে মেরেছিল কি না কে জানে। রাগান্বিতা তার দাদিমা, বাবা আর ভাইকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কথা বললো। মনকে শক্ত রাখলো। কথা শেষে গিয়ে বসলো নৌকায়। ইমতিয়াজও মোতালেব তালুকদার আর দাদিমার সাথে দু’মিনিটের মতো কথা বললো। রেজওয়ানের দিকে তাকাতেই বুঝলো ছেলেটা কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করছে। অবশ্য সে শুনেছিল মনজু নামের রেজওয়ানের কোন প্রিয় বন্ধুকে নাকি কাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর এ গ্রামের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানেই তো ভাবলো না ইমতিয়াজ। সে শুঁকনো হেঁসে রেজওয়ানকে বললো,“ভালো থাকবেন ভাইজান।”
বিনিময়ে রেজওয়ানও হাল্কা হেঁসে বললো,“তুমিও ভালো থেকো। আমার বোনটার খেয়াল রেখো সঙ্গে নিজেরও। মাথার জখমটা ভালোভাবে দেখিয়ে নিও। আর সাবধানে যেও।”
ইমতিয়াজ হাল্কা হেঁসে বললো শুধু,
“জি ভাইজান।”
“এভাবে বলার দরকার নেই। আমরা তো সমবয়সই তুমি করে বললেই হবে।”
ইমতিয়াজও বিনিময়ে বলে শুধু,“ঠিক আছে।”
অতঃপর সবাইকে বিদায় জানিয়ে শহরের বাড়িতে পাড়ি জমালো রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ।’
রাগান্বিতারা বসতেই নৌকা ধীরে ধীরে চলতে লাগলো তার গন্তব্যের দিকে। বোরকা পরিধিত রাগান্বিতা নিকাবের আড়ালে বেরিয়ে থাকা তার আঁখিযুগল নিয়ে তাকিয়ে থাকলো বাবা, ভাই আর দাদিমার দিকে। না জানি আবার কবে দেখা হবে। দাদিমা তার চোখ মুছলেন বোঝাই যাচ্ছে কাঁদছে। মানুষটা রাগান্বিতাকে এত ভালোবাসে যা বলার বাহিরে। রাগান্বিতাও বাসে। খুব বাসে।’
ইমতিয়াজ তাকিয়ে আছে নদীর পানির দিকে। সেখানে কি যেন ভাসছে। সে বেশি গুরুত্ব দিলো না মাছটাছ হবে বোধহয়। ইমতিয়াজের মাথা ঘুরছে, সে ঝাপসা চোখে তাকালো নদীর ঘাটের দিকে। দু’মুহুর্তের জন্য হলেও তার মনে হলো কুহু বুঝি তাদের বিদায় জানাতে এসেছে। কি সাংঘাতিক ভাবনা! ওদিকে মেয়েটা শুয়ে আছে মাটির নিচে।’
ইমতিয়াজের অবস্থাটা খেয়াল করলো রাগান্বিতা। সে ইমতিয়াজের হাত ধরে বললো,“শরীর খারাপ লাগছে?”
ইমতিয়াজ মাথা নাড়ায়। বলে,
“খানিকটা।”
রাগান্বিতা চিন্তিত স্বরেই আশ্বাস দিয়ে বলে,
“একটু ধৈর্য্য ধরুন দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ইমতিয়াজ বিনিময়ে কিছু বলে না। তবে মনে মনে আওড়ায়,“সত্যি কি ধৈর্য্য ধরলে সব ঠিক হয়ে যায়!”
—–
সময় গড়ালো। দেখতে দেখতে কেটে গেল টানা পনের দিন। এই পনের দিন ইমতিয়াজের সেবার কাজেই নিয়োজিত ছিল রাগান্বিতা। গ্রাম থেকে ফিরেই সোজা ডাক্তারের কাছে যাওয়া। তারপর তার কথা অনুযায়ী সব করা। ইমতিয়াজ শুধু মুগ্ধ হয়ে এ ক’দিন দেখেছে তার বউকে। মেয়েটা তাকে এত বেশি ভালোবাসে কেন, কে জানে! সে নিজেও যে ভালোবাসতে শুরু করে নি এমনটা নয়। রোজ রাতেই সে রাগান্বিতার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে,
“মেয়েটা তাকে পাগল বানিয়েই ক্ষ্যান্ত হলো শেষে।”
তবে এসবের মধ্যে ঘটে যায় আরেকটা ঘটনা। যা ঘটে রেশবপুরে। রাগান্বিতাদের ফিরে আসার ঠিক দু’দিন পরই নদীর পানিতে ভেসে ওঠে মনজুর লাশ। লাশটা ভেসে গিয়েছিল আটপাড়ার ওদিকটায়। গ্রামবাসীরা এবার বেশ আতঙ্কে আছেন খালি গ্রামে মৃত্যু ঘটছে। প্রথমে মুরতাসিন, এরপর মাহাদ আর এখন মনজু। পুলিশ কেসটা নিয়েছে তদন্ত চলছে তবে এখনও কিছু জানা যায় নি। রেজওয়ান অনেকটা ভেঙে পড়েছে। তার প্রানপ্রিয় বন্ধুটার এমন মৃত্যুতে সে সত্যি শোকাহত। শোকের জন্য ঘর বন্দীও থেকেছে দু’দিন। গ্রামবাসীদের কারো কারো ধারণা গ্রামে বুঝি ভূত প্রেতের উপদ্রব হয়েছে যার কারণে এইসব অনৈতিক কাজকর্ম হচ্ছে। কেউ কেউ তো কুহুর হঠাৎ মৃত্যুতেই বুঝি গ্রামের দূর্দশা হয়েছে এসবও বলছে। কিন্তু আসলে কি ঘটছে তা তো কেউই জানে না!’
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]
#TanjiL_Mim♥️