#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৪
________________
শিশির ভেজা একটা সকাল। বাতাসের ধ্বনি ধ্বনিতে ভেসে বেড়াচ্ছে একটা মিষ্টিমধুর সুরেলা কণ্ঠ। পুরো নির্জন মাখা সকালের প্রকৃতিরা সেই ধ্বনি শুনছে মন দিয়ে। বাড়তি কোনো শব্দ নেই, নেই কোনো কোলাহল। আছে শুধু এক রূপবতী রমণীর কণ্ঠে ভাসা কোরআনের সুর। রাগান্বিতা কোরআন শরীফ পাঠ করছে। অনেক আগেই সে আর ইমতিয়াজ উঠে একসাথে ফজরের নামাজ পড়ে। ইমতিয়াজ নামাজ আদায় করেই ঘুমিয়ে যায় কিন্তু রাগান্বিতা ঘুমায় নি। সে বাড়ি থেকে আসার সময় সঙ্গে করে কোরআন শরিফ নিয়ে আসে। রাগান্বিতা প্রায়শই নামাজ আদায় করে কোরআন পাঠ করে। আজও করছে। চারপাশ চুপচাপ আর নিরিবিলি। মাঝে দু’ একবার খোপের ভিতর থাকা মোরগের ডাক শোনা গেলেও পরে আর যায় নি তেমন। রাগান্বিতা জানালার ধারে মুখ করে চৌকির উপর বসে কোরআন পাঠ করছে। বাহিরেই খাঁচায় বন্দী করা তাদের সঙ্গে থাকা টিয়া পাখিটি চোখ বুজে ঝিমাচ্ছে। ধীরে ধীরে সময় গড়ালো। রাগান্বিতা তার কোরআন পাঠ শেষ করে মনে মনে কিছু দোয়া দরুদপাঠ করে ইমতিয়াজের কপালে ফুঁ দিয়ে দিলো। ইমতিয়াজ ঘুমে মগ্ন থাকায় তেমন টের পায় নি আর। রাগান্বিতা কোরআন শরিফ বন্ধ করে চুমু কাটলো দু’বার। তারপর এগিয়ে যায় সামনেই উচু তাকের কাছে সেখানে কোরআন শরীফ রেখে আবার এগিয়ে আসে ইমতিয়াজের দিকে। সকালের নাস্তা বানাতে হবে। কিন্তু তার আগে ঘর ঝাড়ু দিতে হবে। রাগান্বিতা ঘর ঝাড়ু দিয়ে, ঝাড়ু হাতে বের হলো বাহিরে সঙ্গে সঙ্গে শীতল ভেজা সকালের বাতাসেরা তাকে ছুঁয়ে দিলো। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে ফেললো। সকালের এই মুহূর্তটা তার দারুণ লাগলো। রাগান্বিতা বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে কোমড়ে আচল বেঁধে তাদের কুঁড়েঘরের সম্পূর্ণ আঙিনাটা একবার ঝাড়ু দিলো। তারপর রান্নাঘরের দিকে গেল। কুঁড়েঘরের ভিতরে ঢুকে হাতের ডানদিকে একটা দুয়ার আছে সেই দুয়ারের পরেই মাটির উনুন পেতে রন্ধনশালা বানানো। চুলার পাশেই জ্বালানোর জন্য ছিল শুঁকনো কিছু ডালপালা। রাগান্বিতা দেশলাই দিয়ে মাটির চুলা বা উনুন জ্বালালো। সর্বপ্রথম ছোট্ট পাতিল পেতে পানি দিলো গরম করার জন্য। রাগান্বিতা গরম গরম পরাটা আর দুধ চা বানাতে চাচ্ছে সকালের নাস্তা হিসেবে।
—-
“তুমি আমায় ভুলে গেছো তাই না”
“আমায় এভাবে ভুলে কি করে গেলে দা..”
সঙ্গে সঙ্গে হকচকিয়ে উঠলো ইমতিয়াজ। ঘুমটা ভেঙে গেল আচমকা। ইমতিয়াজ আশেপাশে তাকালো। জোরে একটা নিশ্বাস ফেললো। তখনই জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাওয়া টিয়াটা বলে উঠল,“বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম!” রাগান্বিতাও শুনতে পেল টিয়ার কথাটা লজ্জায় নুইয়ে গেল। টিয়ার মুখে কথাটা শুনলেই তার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। ইস্! ইমতিয়াজ এ কি শিখালো টিয়াটাকে। আনমনেই হেঁসে ফেললো রাগান্বিতা।
এদিকে, ইমতিয়াজ সেও তাকিয়ে রইলো টিয়াটার দিকে। অনেক্ক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে করলো শান্ত। তারপরই গলা খাগাড়ি দিয়ে ডাকলো,
“বউ, এই বউ, কোথায় তুমি?”
রাগান্বিতা তক্ষৎনাৎ তার কাজ রেখে দৌড়ে আসলো। এক হাতে আঠা মাখানো। রাগান্বিতা চিন্তিত স্বরে বললো,“কি হলো, কি হলো?”
রাগান্বিতার কণ্ঠ শুনেই ইমতিয়াজ তাকালো রাগান্বিতার দিকে। কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি (গ্রামীণ স্টাইলে পড়া),হাতে অল্প কিছু কাঁচের চুড়ি, মাথায় একপাশে সিঁথি কেটে চুলগুলো খোঁপা করা, দু’কানে ছোট্ট পুঁতির দুল, গলায় ছোট্ট একটা চেন সঙ্গে লাল রঙা ঠোঁটে রাগান্বিতাকে পুরো ভিন্নরকম লাগছে। ভাড়ি গহনাগাঁটি ছাড়াও এই সাধারণ শাড়িতেও কত মায়াবী দেখাচ্ছে রাগান্বিতাকে। ইমতিয়াজ পলকবিহীন তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতার দিকে।
ইমতিয়াজকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন করলো রাগান্বিতা,“কি হলো কিছু বলছেন না কেন! কি হয়েছে? এভাবে ডাকছিলেন যে।”
ইমতিয়াজ রাগান্বিতার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। বললো,“কি হবে কিছুই হয় নি। কোথায় ছিলে তুমি?”
রাগান্বিতা কিছুটা এগিয়ে এসে বললো,
“সকালের নাস্তা করছিলাম তো।”
”তুমি জানো তোমায় না দেখে আমার কত খালি খালি লাগছিল?”
রাগান্বিতা হাসে। বলে,“আপনিও না তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে আসুন আমি খাবার তৈরি করছি।”
রাগান্বিতা চলে গেল। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে শুধালো,
“আজ তোমায় খুব সুন্দর দেখাচ্ছে বউ!”
রাগান্বিতা কথাটা শুনতে পেলেও বিনিময়ে কিছু বললো না। মুচকি হেঁসে চলে গেল চুলার পিটে।’
ইমতিয়াজ আরো কিছুক্ষণ চৌকিতে বসে থেকে বের হয় কুঁড়েঘর থেকে। জোরে নিশ্বাস ফেলে প্রকৃতির বুকে। তারপর হেঁটে যায় হাঁস-মুরগী আর গরু-ছাগলের কাছে। গরুর ছাগলদের ঘাস দিয়ে। হাঁস-মুরগীর খোপ খুলে দিলো, সঙ্গে সঙ্গে হাঁস-মুরগী বেরিয়ে এসে তাদের ছোট্ট ছোট্ট পা নিয়ে চলতে শুরু করলো। হাঁস দু’টো আর তাদের এক বাচ্চাটা দৌড়ে ছুটে গেল পানির কাছে। মুরগীর জন্য চাল এনে খেতে দিলো ইমতিয়াজ। সঙ্গে বললো,
“তোদের এখানে এনেছি কেন জানিস যাতে মনে হয় এই ছোট্ট দ্বীপে আমি রাগান্বিতা শুধু নই। তোদের মতো আরো কিছু প্রাণী আছে যারা গুনগুন করে আমাদের এই ছোট্ট সংসারে ঘোরাফেরা করবে। সঙ্গে মনে হবে এই প্রকৃতির সবটা নির্জীব নয়। সতেজও আছে।”
রাগান্বিতার হাঁক শোনা গেল। সে একটু উচ্চস্বরেই বললো,“আপনার কি হয়েছে? আমার কিন্তু রান্না প্রায় শেষ।”
ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়ালো। রাগান্বিতাকে বললো,“এই তো হয়ে গেছে আমি ঘাটপাড় থেকে এক্ষুণি মুখ ধুয়ে আসছি।”
রাগান্বিতা শুনলো। বললো,“আচ্ছা জলদি আসবেন।”
—–
ইমতিয়াজ হাতমুখ ধুয়ে ঘরে পা রাখতেই রাগান্বিতা হাসি মুখে তার দিকে গামছা এগিয়ে দিলো ইমতিয়াজও নিলো। বললো,“ধন্যবাদ বউ।”
রাগান্বিতা বিনিময়ে হাল্কা হাসে। বলে,“পাটি কি ঘরের ভিতর বিছাবো নাকি বাহিরে?”
উত্তরে নিজের মুখখানা গামছা দিয়ে মুছে বললো ইমতিয়াজ,“বাহিরে।”
কুঁড়েঘরের সামনেই দুয়ারের একটু কিনার দিয়ে মাটির মেজেতে পাটি বিছিয়ে পাশাপাশি বসে আছে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ তাদের সামনেই রয়েছে দু’কাপ দুধ চা আর একটা প্লেটে কিছু গরম গরম তৈলাক্ত পরাটা। ইমতিয়াজ একটা পরাটা হাতে নিয়ে গোল করে ভাজ করে দুধ চায়ের সাথে ভিজিয়ে খেতে শুরু করলো। রাগান্বিতাও খেতে লাগলো। তবে তার আগে জিজ্ঞেস করলো,“কেমন হয়েছে?”
ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“দারুণ!”
রাগান্বিতা অবাক স্বরে বললো,
“কিন্তু আপনি তো এখনও খান নি?”
“তুমি রান্না করেছো মানেই সেটা দারুণ হবে।”
“মানুষকে কিভাবে কথার জালে ফাঁসানো যায় তার উপর পড়াশোনা করেছিলেন বুঝি।”
হাসে ইমতিয়াজ। বলে,
“তুমি ফাঁসলে না তো?”
“কে বলেছে ফাঁসি নি, আমি তো সেই কবেই ফেঁসে বসে আছি। আজও জানলেন না আপনি?”
চায়ের কাপে চুমুক দিলো ইমতিয়াজ। বললো,
“জানি তো তাও তোমার মুখে শুনতে ভালো লাগে।”
“আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন আমি প্রতিবার বিভোর হয়ে যাই।”
“তোমাকে বিভোর বানানোর জন্যই বোধহয় আমার জন্ম।”
“আপনি কি জানেন প্রিয় আমার প্রায় মনে হয় আমার সৃষ্টি আপনার জন্যই। আপনি ছাড়া বোধহয় আমি অসম্পূর্ণ।”
ইমতিয়াজ বিনিময়ে কিছু বলে না। ইচ্ছে করে চুপ করে রয়। তবে তার বলতে খুব মন চাচ্ছে,
“আমার তো মনে হয় আমার বিনাশের অস্ত্র বুঝি তোমার হাতে।”
কিন্তু ইমতিয়াজ বললো না। রাগান্বিতার ঠোঁটে থাকা হাসিটাকে এই মুহূর্তে কোনোভাবেই মিলিয়ে দিতে চায় না ইমতিয়াজ। সে একটা সিদ্ধান্ত নিলো, রাগান্বিতার সাথে উল্টোপাল্টা আর কোনো কথাই সে বলবে না। ইমতিয়াজ এ ক’দিনে হারে হারে টের পেয়েছে, রাগান্বিতাকে দুঃখ দেয়া ইমতিয়াজের কম্ম নয়!”
——
সময়টা প্রকৃতি মেপে বোধহয় সকাল দশটা। রাগান্বিতা ইমতিয়াজ নৌকায় চড়ে কোথায় যেন এসেছে। বর্তমানে নদীর মাঝে বইঠা রেখে পানিতে ভাসছে। ইমতিয়াজের হাতে মাছ ধরা জাল। রাগান্বিতা কিছুটা অবাক স্বরেই বললো,
“আপনি কি মাছ ধরতে চাচ্ছেন?”
ইমতিয়াজ নদীর এদিকে সেদিক তাকিয়ে বললো,“হুম।”
কথাটা শেষ করেই হাতের জালটাকে বিছিয়ে ছুঁড়ে মারলো নদীর পানিতে। রাগান্বিতা একটু চমকে উঠলো এতে। মনে মনে বললো,“আপনি মাছ ধরতেও জানেন?”
ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললো,“একটু আকটু।”
খানিকটা কম্পন সৃষ্টি হয় রাগান্বিতার মাঝে। ধীরে স্বরে বলে,“মানুষটা তার মনে মনে বলা কথাগুলোও বুঝতে পারে কি করে?”
ইমতিয়াজ হাল্কা হাসে। ধীরে ধীরে উঠাতে শুরু করে নদীতে বিছিয়ে দেওয়া মৎস্য আটকানো তার জালটাকে।
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]
#TanjiL_Mim♥️