#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৬
________________
নিকষ কালো অন্ধকারে ঘেরা চারপাশ। ঘরের ভিতর ল্যাম জ্বলছে। বাহিরে ঝিরিঝিরি শব্দে বৃষ্টি হচ্ছে। রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ বসে আছে কুঁড়েঘরের সামনে মাটির সিঁড়ির ওপর পা রেখে। উপরে ছাউনি থাকায় বৃষ্টির পানি লাগছে না তাদের গায়ে। রাগান্বিতার পাশেই রয়েছে হেরিকেন। আলো দিচ্ছে তাদের। রাগান্বিতা আবদারের স্বরে বললো,
“শুনুন এবার বাড়ি ফিরে একটা টেলিফোন কিনবেন। বাবার সাথে কথা বলবো। কতদিন হয়ে গেল বাবার সাথে চিঠি বিলি হয় না।”
প্রতিউত্তরে শুধু এতটুকুই বলে ইমতিয়াজ,
“আচ্ছা।”
“জি। বাবাকেও বলতে হবে টেলিফোন কেনার কথা। বাবা বোধহয় আমায় ভুলেই গেছে না হলে চিঠি লেখে নি কেন?”
“এখন বোধহয় লিখেছে আমরা তো বাড়ি নেই ডাকপিয়ন নিশ্চয়ই রবিন চাচার কাছে চিঠি দিয়ে গেছে।”
“আপনি সত্যি বলছেন?”
“মনে হচ্ছে।”
রাগান্বিতা জোরে একটা নিশ্বাস ফেললো। বললো,
“দাদিমাকে আজ সকালে স্বপ্নে দেখেছিলাম আমায় বাড়ি যেতে বলছে।”
“আচ্ছা যাবো আনে।”
রাগান্বিতা খুশি হয়ে বললো,
“সত্যি যাবেন।”
“হুম।”
রাগান্বিতা ইমতিয়াজের ডান হাতখানা শক্ত করে চেপে ধরলো। কাঁধে মাথা দিয়ে বললো,
“আমি কি চাই জানেন?”
ইমতিয়াজ সামনের দিকে চোখ রেখেই বলে,
“কি বলো,”
“আমি চাই, আমাদের জীবনটা এভাবেই যেন সাদাসিধে ভাবে কেটে যাক। কখনো ঝড় না আসুক।”
আকাশে তখন প্রবলবেগে একটা বিদ্যুৎ চমকালো। মেঘটাও গর্জে উঠলো। ইমতিয়াজ মৃদু হাসলো। মনে মনে বললো,“প্রকৃতি বোধহয় এমনটা চায় না।”
ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকালো। চোখ মুখ খুশিতে পুরো জ্বলজ্বল করছে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার কপালে কাছে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিলো। তারপর রাগান্বিতার হাতে থাকা কাঁচের চুড়িগুলোতে হাত বুলিয়ে বললো,
“আর আমি কি চাই জানো?”
রাগান্বিতা অতি আগ্রহ নিয়ে বললো,
“কি চান বলুন!”
ইমতিয়াজ বৃষ্টির পানে তাকালো। বললো,
“আমি চাই, আমি তোমার হাতের শখের ভাঙা চুড়ি হবো। না তুমি পড়তে পারবে, না তুমি ফেলতে পারবে বউ।”
রাগান্বিতা বিস্মিত নজরে তাকালো ইমতিয়াজের দিকে। বললো,“ভাঙা চুড়িই কেন?”
ইমতিয়াজ মৃদু হেসে রাগান্বিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,“এমনি।”
——
সময়গুলো অতিদ্রুত চলতে থাকলো। দেখতে দেখতে কেটে গেল পুরো ছ’টা দিন। এই ছ’দিন যেন সময়গুলো কেটেছে পুরো স্বপ্নের মতো। রোজ নৌকা নিয়ে নদীর চারিপাশে ঘুরে বেড়ানো। মাছ ধরা, রান্না করা, একসাথে গোসল করা। বিকেল হলে পুরো দ্বীপের মাঝে ছোটাছুটি করা, দোলনায় দোলা, ইমতিয়াজের বাঁশির আওয়াজ শোনা সবই যেন অন্যরকম ছিল। গরু ছাগলকে নিয়ে আশেপাশে চড়ানো এটাও ছিল দারুণ। রাগান্বিতা যেন এ জীবনেই পুরো আনন্দিত ছিল। এর মধ্যে যেটা সবচেয়ে মিষ্টিমধুর ছিল তা হলো ভোর হলেই টিয়াপাখির ডেকে ওঠা, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম। জীবন যেন ভীষণ সুন্দর!
.
নতুন একটা সকাল! প্রকৃতি জুড়ে তখন হিমশীতল বাতাস বইছিল। মোরগ ডাকছিল। টিয়া পাখিটাও ডাকছিল। রাগান্বিতা প্রতি সকালের মতো আজও নামাজ সেরে কোরআন পাঠ করছিল। ইমতিয়াজ আজ আর ঘুমায় নি। সে চেয়ে চেয়ে শুধু দেখছিল রাগান্বিতাকে। মেয়েটা নিষ্পাপ কিন্তু সে পাপী কথাটা ভাবলেই কলিজাটা কেঁপে ওঠে ইমতিয়াজের। ভয় এসে গ্রাস করে তাকে। কি যে যন্ত্রণার, তা বলার মতো নয়। দিন যত এগোচ্ছে ইমতিয়াজের যন্ত্রনাও বুঝি একটু একটু করে বাড়ছে। সহ্য করা দিনে দিনে বুঝি দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আচ্ছা যদি এমনটা হতো, যে কিছুই হতো না। ইমতিয়াজ মাথা নাড়ালো। কিছু কি হয়েছে হয় নি তো তাহলে! খামোখাই আবোলতাবোল। দিনে দিনে কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে ইমতিয়াজ! স্বপ্ন বুনছে, আবার ভাঙছে! হতাশ হচ্ছে আবার সামলে নিচ্ছে!’
….
রেশবপুরে নিজ কক্ষে বসে আছে রাগান্বিতার বাবা মোতালেব তালুকদার। কিছুদিন হলো রেজওয়ানের জন্য মেয়ে দেখছেন তিনি। কিন্তু মন মতো কোনো পাত্রীই পাচ্ছেন না। এর মধ্যে ঘটে গেল আরেকটা ঘটনা দাদিমা পুকুরপাড়ে নাইতে গিয়ে হোটচ খেয়ে পড়ে গেছিলেন পানিতে। কাছে পাশের বাড়ির মোর্শেদের মা থাকায় বেঁচে যান। কিন্তু ভয় যে একটা কঠিন পেয়েছেন তা বোঝা গেছে। সেই পড়ে যাওয়ার দিন থেকে মানুষটা বিছানায়, ঠিকভাবে উঠতেও পারে না। ডাক্তার ডাকা হয়েছিল। ডাক্তার আড়ালে নিয়ে বললেন দাদিমার গুরুতর অসুখ করেছে। শহুরে ডাক্তার দেখালে বোধহয় সুস্থ হতেন। দাদিমাকে শহরে নেয়া দুষ্কর ব্যাপার ছিল তাই রেজওয়ানকে বলে শহুরে ডাক্তারকে গ্রামের আনার ব্যবস্থার করেন। তাও লাভ হয় নি। অবস্থা তেমন ভালো নয়। বর্তমানে দুশ্চিন্তা গ্রস্ত মোতালেব তালুকদার। মা সমতুল্য মানুষটার জন্য বড্ড মন কাঁদে তার। রাগান্বিতাকে দেখতে চাচ্ছেন খুব। তাই বর্তমানে টেবিলে বসে চিঠি লিখছেন রাগান্বিতার জন্য যদি মেয়েটাকে একটা বার দাদিমার কাছে আনা যায়।
প্রিয় কন্যা,
কেমন আছো তুমি। আশা রাখি আল্লাহর রহমতে জামাইকে নিয়ে সুখেই আছো। বহুদিন পরে তোমার নামে চিঠি লিখতে বসেছি। কি লিখবো ভেবে পাচ্ছি না হুটহাট এমন সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যে আমি নিজেই খুব হতাশাগ্রস্ত! রেজওয়ানের জন্য মেয়ে দেখছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে ঘটে গেল দুষ্কর একটা ব্যাপার তোমার দাদিমা নাইতে গিয়ে পড়ে গেছিলেন পানিতে। সেই থেকেই অসুস্থ তোমার দাদিমা। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে কথাটা বলছি তোমায় দিনে দিনে তোমার দাদিমার অবস্থা খুবই গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমায় খুব দেখতে চাচ্ছেন। যদি পারো তবে জামাইকে নিয়ে রেশবপুরে এসে দেখে যেও। পারলে কাল পরশুর মধ্যেই রওনা দিও আর কিছু লিখতে পাচ্ছি না। ভালো থেকো।’
ইতি,
তোমার বাবা।’
কথাগুলো লিখে কলম চালানো থামালেন রাগান্বিতার বাবা। এমন সময় তার কক্ষের দুয়ারের সামনে হাজির হলো কাশেম। হাল্কা কাশি দিয়ে বললো,
“আমু সাহেব?”
কাশেমের কণ্ঠটা কানে আসতেই দুয়ারের পানে তাকালেন মোতালেব তালুকদার। বললেন,
“হুম আয়।”
কাশেম ভিতরে ঢুকলো। বললো,“আমারে নাকি খুঁজতাছিলেন?”
মোতালেব তালুকদার নিরুত্তর চাহনি নিয়ে চাইলেন। যা দেখে কাশেম বললো,“চিন্তা কইরেন না দাদিমা ঠিক হইয়া যাইবো আনে।”
দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন মোতালেব তালুকদার। হাতে লেখা চিঠিটা ভাজ করে খামে ভরে ঠিকানা লিখে কাশেমের হাতে দিয়ে বললো,
“চিঠিডা পোস্ট অফিসে দিয়া আয়। সাবধানে যাইস।”
“আইচ্ছা সাহেব।”
চলে গেল কাশেম। আর মোতালেব তালুকদার আকাশ পানে চাইলেন। কিসের যেন খুব ভয় পাচ্ছেন তিনি। ইদানীং ঘুমালে খুব উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখছেন। সেই সেদিনই দেখলেন, দাদিমা তাকে কিছু না বলে কোথায় যেন চলে যাচ্ছেন। কতবার ডাকলেন দাদিমাকে কিন্তু দাদিমা ঘুরেই তাকালেন না।”
বড় কষ্ট লাগছে মোতালেব তালুকদারের। এই স্বপ্নের অর্থ তো ভালো নয়। চিন্তা লাগছে খুব।
—–
পরন্ত বিকেলের মিষ্টিমধুর সুন্দর সময়। রাগান্বিতা ইমতিয়াজ শুয়ে আছে সবুজ ঘাসের বুকে। তাদের ঘিরে ছুটছে হাঁস, মুরগী আর ছাগলের একটা বাচ্চা।
ইমতিয়াজ আকাশ পানে তাকিয়ে শুধালো,
“কাল সকালে আমাদের নিতে ট্রলার আসবে সবকিছু গুছিয়ে রেখো কেমন!”
রাগান্বিতার মনটা কথাটা শুনেই খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ নিয়েই বললো,
“কালই চলে যাবো আর ক’টা দিন থাকলে হতো না।”
“না প্রেমনগরে বেশিদিন থাকতে নেই। মায়া পড়ে গেলে।”
“পড়লে পড়তো কি এমন ক্ষতি তাতে।”
ইমতিয়াজ গম্ভীর এক আওয়াজে বললো,
“একটা কথা সবসময় মাথায় রাখবে জীবনে কোনোকিছুর প্রতিই বেশি মায়া জন্মাতে দিবে না। এই মায়া বড্ড ভয়ংকর জিনিস। দুঃখ ছাড়া বেশি কিছু দেয় না।”
“মায়াতে ভালোবাসা থাকে।”
“যেদিন মায়া ছাড়াতে কষ্ট হবে সেদিন বুঝবে।”
রাগান্বিতা আর কিছু বলে না। চুপ হয়ে যায়। চোখে মুখে এক গম্ভীরতার ছোঁয়া ভেসে ওঠে। ইমতিয়াজ আবার বলে,“রাগ করলে?”
রাগান্বিতা জবাব দেয় না। ঠিক সেই মুহুর্তেই আকাশ পথ বেয়ে ছুটে গেল সাতটি রঙে আবদ্ধ হওয়া রংধনু। ইমতিয়াজ হাত দিয়ে তা দেখিয়ে বললো,
“তুমি আমার জীবনে আসা ঠিক ওইরকম সাতরঙা রংধনুর রঙ।”
রাগান্বিতা তাকালো। চট করেই অভিমানটা গায়েব হয়ে গেল। সে হাসলো। বললো,
“আর আপনি আমার জন্য এই সাতরঙার ভিড়ে থাকা বিশাল আকাশ।”
ইমতিয়াজ রাগান্বিতার থুতনিতে আলতো স্পর্শ করে বলে,
“হাসি ফুটলো তবে বউয়ের মুখে।”
আবারও হাসে রাগান্বিতা। বলে,
“হাসাতে জানানো মানুষটা গম্ভীর মুখে থাকতে দেয় কই।”
“তুমি কি জানো তুমি আমার জন্য স্নিগ্ধতার সকালে ফুটে ওঠা এক পদ্মফুল বউ যাকে যতই দেখি মন ভরে না।”
লাজুক হাসে রাগান্বিতা। কি মায়াময়ী লাগে সেই হাসি!’
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]
#TanjiL_Mim♥️