প্রিয়_রাগান্বিতা🩷 #লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷 পর্ব-৩৭

0
246

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৭
________________
আকাশ কেঁপে বাহিরে ঘন বর্ষণ হচ্ছে। বর্ষণের চাপে মাটিরা ভিজে চিপচিপে হচ্ছে। খড়ের ছাউনিতেও শব্দ শোনা যাচ্ছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকে কতক্ষণ কতক্ষণ পর বাহিরে আলো এসে পরিবেশটা দেখাচ্ছে। ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে আছে জানালার ধারে রাগান্বিতা ঘুমে বিভোর। ইমতিয়াজের মাথায় কিছু চলছে, তার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না কেমন বিষণ্ণ বিষণ্ণ লাগে চারপাশ। জীবনে সে অনেক বড় ভুল করে বসেছে। অবশ্য ভুল বললেও ভুল হবে। সামনে কি করে ফেলবে তারও ঠিক নেই। কিছু তো করতেই হবে নয়তো শান্তি ছাড়া এভাবে বাঁচবে কিভাবে! মাঝে মাঝে ইমতিয়াজের মনে হয় এভাবে বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়া সুন্দর। কিন্তু ইদানীং মরতেও ইচ্ছে হয় না, সারাক্ষণ ইচ্ছে করে রাগান্বিতার সাথে সংসার করতে। তাকে নিয়ে নতুন করে বাঁচতে– আচ্ছা এই চাওয়া কি খুব অন্যায়। নয় তো। ইমতিয়াজ জোরে নিশ্বাস ফেললো। চোখের কোণে পানি জমলো তার। আম্মার কথা আজ বড্ড মনে পড়ছে। ইমতিয়াজ চোখ বন্ধ করে বললো,“আম্মা কতদিন হয়ে গেল তোমায় দেখি না, কতগুলো বছর পার হলো। জীবনটা কি একটু ভিন্ন রকম হতে পারতো না। তুমি যদি একটু বুদ্ধিমান হইতা, কবিরাজরে বিশ্বাস না কইরা আব্বারে বিয়া না দিতা তবে আজ আমার গল্পটা ভিন্ন হইতো। কেন করলা এমন অবুঝের মতো ভুল। জীবন তো শেষ হয়ে যাচ্ছে, হৃদয়ে কষ্ট লাগে আম্মা। কি একখান অবস্থা! আমায় যারা ভালোবাসে তারাই খালি আমারে রাইখ্যা চইল্লা যায় কেন আম্মা। আমি কি শুরু থেকেই খারাপ আছিলাম কও। জানো আম্মা আমার এখন খালি বাঁচতে মন চায়। রাগান্বিতাকে নিয়া ছোট্ট সংসার করতে ইচ্ছা করে। মেয়েটা আমারে কত ভালোবাসে জানো। তুমি কি ওই আকাশে বইসা দেখো আম্মা। আমি এইবার বাড়ি গিয়া তোমার কাছে যাবো অনেকদিন হইয়া গেছে তোমারে দেখতে যাই না। আমার লগে কথা কইবা তো আম্মা একবারও কথা কও না আমিই শুধু একলা একলা কথা কই! আম্মা তোমার শরীরের ঘ্রাণ কতযুগ ধরে পাই না। আমারে শেষবার বুকে সেই কবে নিছিলা। তোমার আমারে একটুও মনে নাই তাই না। তোমার মনে নাই জমিনের বুকে তুমি একটা পোলা থুইয়্যা গেছো। কত নিষ্ঠুর হইয়া আমারে একা রাইখ্যা থুইয়া গেলা আম্মা। তোমারে আমি বাঁচাইতে পারলাম না। আমি কাউরেই বাঁচাইতে পারি না। খালি মারি।”

চোখ ভিজে আসলো ইমতিয়াজের। বুকে যন্ত্রণা উঠলো আচমকা। কতকিছু একা মনে বলে ফেললো ছেলেটা। প্রকৃতির ঝড়ের সাথে সাথে বুঝি ইমতিয়াজের বুকেও ঝড় উঠেছে। প্রবলবেগের ঝড়। কেউ তার যন্ত্রণা বুঝচ্ছে না, কেউ না। কাঁধে কারো শীতল স্পর্শ অনুভব করলো ইমতিয়াজ হকচকিয়ে উঠলো এতে। দ্রুত চোখ মুছতে নিলো সে। এরই মাঝে রাগান্বিতা শীতল সুরে শুধালো,“ভেজা চোখ আড়াল করতে চাইলেই কি সব আড়াল করা যায় প্রিয়। আমি আপনার সব কথা শুনে নিয়েছি।”

ইমতিয়াজ আর পারলো না নিজেকে সামলাতে সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাগান্বিতাকে। বললো,“আমার আম্মাডারে আইন্না দিবা বউ আমার না তারে খুব দেখতে মন চায়।”

রাগান্বিতা নিরুত্তর। এই কথার কোনো উত্তর কি এই জগতে আছে, নেই তো। রাগান্বিতা কেন পৃথিবীর কোনো মানুষই মৃত ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনতে পারে না। রাগান্বিতার চোখ বেয়ে পানি ঝড়লো। ইমতিয়াজ যেন এই প্রথম অবুঝের মতো তার কাছে একটা আবদার করে বসলো। যে আবদার পূরণ করার সাধ্য রাগান্বিতার নেই। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের পিঠে হাত বুলালো বললো,“এভাবে ভেঙে পড়বেন না আমি তো আছি দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।”

ইমতিয়াজ নীরব। তার মুখে কোনো কথা নেই। আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো আবার। বৃষ্টি হচ্ছে প্রবল বেগে। ঘর জুড়ে অন্ধকার আর হৃদয় জুড়ে বিষণ্ণতা নিয়ে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রাতটা বুঝি বড্ড বেশিই যন্ত্রণার কাটলো।’

শীতল ছোঁয়ায় পঞ্চমুখ চারপাশ। চারপাশে ঠান্ডা বাতাস বইছে। সেই বাতাস ঘরে এসে ঠেকছে। বৃষ্টি থেমেছে ঘন্টাখানেক হবে। রাগান্বিতা বসে আছে ইমতিয়াজের মাথার কাছে। কাল সারারাত সে ঘুমায় নি তার কোলে মাথা দিয়ে ইমতিয়াজ ঘুমিয়ে ছিল আর রাগান্বিতা জেগে জেগে ইমতিয়াজের মাথায় বিলি কেটে দিয়েছে শুধু। মানুষটার কত যন্ত্রণা ভাবলেই কষ্ট লাগছে রাগান্বিতার। পালঙ্কের পাশে থাকা ইমতিয়াজের হাত ঘড়িটা দেখলো ভোর পাঁচটা বাজে নামাজ আদায়ের সময় হয়ে গেছে।’

রাগান্বিতা আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে ডাকলো ইমতিয়াজকে। বললো,“শুনছেন, উঠুন জলদি। নামাজ পড়বেন না। আম্মার জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করবেন। উঠুন তাড়াতাড়ি।”

ইমতিয়াজ নড়েচড়ে উঠলো। মাথাটা ভাড় ভাড় ঠেকছে তার। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকালো। বললো,“নামাজ পড়বে?”

রাগান্বিতা মাথা নাড়িয়ে বললো,“জি উঠুন।”

ইমতিয়াজ বিনা বাক্যে উঠে বসলো। রাগান্বিতা পালঙ্ক থেকে নেমে হেরিকেনটা জ্বালালো। চারপাশ এখনো তেমন পরিষ্কার হয় নি। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“নদীর ঘাটে যাওয়ার কোনো দরকার নেই তুমি এখানে বসো আমি বালতি ভরে পানি নিয়ে আসছি। বৃষ্টি পড়েছে চারপাশ কাঁদা হয়ে রয়েছে। পড়ে গেলে তাই তুমি বসো আমি পানি নিয়ে আসি।”

ইমতিয়াজ পালঙ্ক থেকে নেমে রন্ধন শালায় রাখা বালতিটা হাতে নিয়ে বাহিরে বের হলো। বাহিরে তখন আবছা আলো বইছে। দেখা যাচ্ছে অনেকটা। রাগান্বিতা টিয়াপাখির পাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,“সাবধানে যাবেন।”

ইমতিয়াজ কথাটার জবাব না দিলেও শুনতে পেয়েছে ঠিকই। মিনিট পনের যেতেই ইমতিয়াজ বালতি ভরে পানি নিয়ে রাখলো পিড়ার ওপর(মাটির সিঁড়ি)। ইমতিয়াজ বালতিটা রেখে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,“আমি ওজু করে এসেছি তুমিও আসো। আমি অপেক্ষা করছি।”

রাগান্বিতা মাথা নাড়িয়ে মৃদুস্বরে বললো,“ঠিক আছে।”
——
ঘড়িতে তখন আটটার কাটায় ছুঁই ছুঁই। ইমতিয়াজ তাদের ব্যাগপত্র গুছাতে ব্যস্ত। আসবাবপত্রের কিছুই নিবে না এমনটা ভেবেছে ইমতিয়াজ। রাগান্বিতাও বারণ করে নি। মাঝে মাঝে এখানে আসবে এমন পরিকল্পনা তার। ট্রলারের আওয়াজ শোনা গেল। ট্রলারটা সোজা এসেছে নদীরঘাটপাড়ে যার দরুন এত নিকটে আওয়াজটা পাওয়া যাচ্ছে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে তাড়া দিল। বললো,“দ্রুত বোরকা হিজাব পড়ে নেও বউ, আমি বাকিদের গুছিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”

রাগান্বিতা মাথা নুইয়ে হেঁসে বললো,“ঠিক আছে।”

….
“কি গো বন্ধুরা এই সাতদিন মজা পাইছো তো খালি ঘুরাঘুরি সঙ্গে খাওন আর খাওন।”

গরুর রশি খুলতে খুলতে কথাগুলো গরু-ছাগলকে উদ্দেশ্য করে বললো ইমতিয়াজ। তারা বুঝলো কি না বোঝা গেল না। তবে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থেকেছে ঠিকই। এই গরু’ছাগলগুলো এক লোকের কাছ থেকে ভাড়ায় এনেছিল ইমতিয়াজ, হাঁস-মুরগীও তেমন। খালি টিয়াটা নিজ টাকায় কিনে আনা। এরও একটা বিশেষ কারণ আছে। ইমতিয়াজ গরু-ছাগলগুলোকে সঙ্গে করে চলে গেল ট্রলারের উদ্দেশ্যে। এই সাতদিনে খেয়ে খেয়ে ভালোই মোটা হয়েছে গরুর ছাগলগুলো। কি অবস্থা। প্রেমনগর ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না গরুছাগল, ইমতিয়াজ ঠেলে ঠেলে নিয়ে গেল ওগুলোকে। হাঁস-মুরগী খাঁচায় থাকায় বেশি সমস্যা হয় নি। খুব সহজেই নিয়ে রাখলো ট্রলারে। চারপাশ গুছিয়ে ইমতিয়াজ ঘরে ঢুকতেই দেখলো রাগান্বিতা বোরকা হিজাব পড়ে তৈরি। সে বললো,“হয়ে গেছে তোমার?”

রাগান্বিতাও তাদের কুটিরে থাকা ছোট্ট আয়নাটায় একবার নিজেকে দেখে বললো,“জি চলুন।”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার হাত ধরে বাহিরে আনলো। তখনই টিয়াপাখিটা বলে উঠল,“বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম।”

রাগান্বিতা নিকাবের আড়ালে হাসলো। বললো,“একে ট্রলারে নিবেন না?”

ইমতিয়াজ খাঁচা থেকে পাখিটা বের করতে করতে বললো,“না।”

রাগান্বিতা অবাক হয়ে বললো,
“কেন?”
“কারণ একে মুক্ত করে দিবো ওই আকাশে।”
“আমাদের সঙ্গে কেন নিবেন না?”
“সবাইকে সঙ্গে নিতে নেই।”

এই বলে পাখিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু কাটলো ইমতিয়াজ। সঙ্গে বললো,“তোকে বলেছিলাম না রোজ সকালে যদি নিয়ম করে তিনবার বলতে পারিস বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম তবে সাতদিন পর তোর মুক্তি। কি কথা রাখলাম তো। সবসময় ভালো থাকিস। আমাদের ভুলিস না কেমন। রোজ তিনবেলা খাইয়েছি মনে রাখিস কিন্তু।”

বলে আরো একবার টিয়ার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা এবার বুঝলো ইমতিয়াজ কেন পাখিটাকে ছেড়ে দিতে চাইছে। রাগান্বিতা আর মন খারাপ করলো না। নিকাবটা হাল্কা উঠিয়ে পাখির কপালে চুমু কেটে। শীতল সুরে বললো,“ভালো থাকিস সবসময়।”

অতঃপর ইমতিয়াজ রাগান্বিতা দুজনেই দু-হাতে টিয়াটাকে ধরে উড়িয়ে দিল আকাশে। সঙ্গে সঙ্গে টিয়া পাখিটি মুক্ত আকাশে ডানা ঝাপটাতে লাগলো। আবারও চেঁচিয়ে বলতে বলতে গেল,“বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম।”

রাগান্বিতার চোখে পানি চলে এতো। কত সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত কাটালো তারা। স্মৃতি হয়ে থাকবে সব।’

অবশেষে নদীরঘাটপাড়ে গিয়ে ট্রলারে উঠলো রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। তারা উঠতেই ট্রলার চলতে শুরু করলো। একটু একটু করে তারা চলে আসতে লাগলো প্রেমনগর ছেড়ে। রাগান্বিতার চোখ ভেসে আসছে, কি সাধারণ জীবনযাপণ করলো এই কয়দিন। জীবন যে কি নিদারুণ সুন্দর ছিল গত সাতদিন। নৌকাটা নজরে আসলো, ঘাটপাড়ের বড় গাছটার সঙ্গে এখনো বাঁধা, ঢেউয়ের স্রোতে ভাসছে। মুক্ত আকাশে কিছু পাখি উঠছে, সেই দূরে দোলনাটা দেখা যাচ্ছে, ইমতিয়াজের বাঁশি বাজানোর সেই গাছটাও নজরে আসলো। ছোট্ট কুঁড়েঘরটা পড়ে রইলো একা, সামনেই ঝুলে রইলো শূন্য হওয়া সেই টিয়াপাখির খাঁচাটা। রাগান্বিতা যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণই তাকিয়ে রইলো প্রেমনগরের দিকে পাশেই ইমতিয়াজ দাঁড়ানো। হঠাৎই রাগান্বিতা কেমন এক বিষণ্ণ সুরে আওড়ালো,
“আমরা আবার কবে আসবো এখানে?”

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“প্রকৃতি যেদিন আবার চাইবে।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here