প্রিয়_রাগান্বিতা🩷 #লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷 পর্ব-৩৯

0
140

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৯
________________
“রাগান্বিতা হুনো জীবনে হগল মানুরে বিশ্বাস করবা না। সব মানুষ কিন্তু ভালা হয় না।”

প্রচন্ড কঠিন গলায় কথাটা বললো দাদিমা। দাদিমার কথা শুনে রাগান্বিতা বিস্মিত গলায় বললো,“কেন দাদিমা কি হইছে?”

দাদিমা ক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে বললো,
“তুমি কোনো কথা কইবা না তুমার লগে আমার আড়ি। তুমারে এতবার কইলাম বাড়িত আও তাও আও না আমার লগে আর কোনো কথা কইবা না।”
“দাদিমা শুনো,

রাগান্বিতা বহুবার ডাকলো কিন্তু দাদিমা ফিরে তাকালেন না। হনহনিয়ে চলে গেলেন কোথায়। রাগান্বিতা হেঁটে গেলো সামনে কিন্তু কালো ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখলো না। রাগান্বিতা চেঁচিয়ে ডাকলো, “দাদিমা, দাদিমা কোথায় তুমি!” কিন্তু না দাদিমার আর খোঁজ নেই কণ্ঠ শোনা গেল না তার।

ঘুমের মধ্যে আচমকাই হকচকিয়ে উঠে বসলো রাগান্বিতা। আশেপাশে তাকাতেই বুঝলো সে ইমতিয়াজের পাশে নিজ কক্ষে বসে আছে। তার মানে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। ইমতিয়াজের ঘুমটা ভেঙে গেল রাগান্বিতাকে হতভম্ব দেখে প্রশ্ন করলো,“কি হয়েছে বউ?”

রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টিতে ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমতিয়াজ আবার প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে বাজে স্বপ্ন দেখেছো?”

রাগান্বিতা মাথা নাড়ালো। আতঙ্ক নিয়ে বসে রইলো। দাদিমা তাকে ছেড়ে গেল কোথায়! রাগান্বিতার মাঝে অজানা এক ভয় অনুভব হলো। সে ইমতিয়াজকে বললো,“আমার দাদিমা কোথায় যেন চলে গেছেন আমায় ছেড়ে?”

ইমতিয়াজ বিস্মিত হলো সে দ্রুত পালঙ্ক থেকে নেমে রাগান্বিতার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে খাইয়ে দিল রাগান্বিতাকে। রাগান্বিতাও ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেল। ভয়ে ভয়ে বললো,
“আমার দাদিমা আমায় ছেড়ে কোথাও চলে যাবেন না তো?”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার পাশে বসলো। আশ্বাস দিতে বললো,
“ভয় পেও না কোথাও যাবে না তোমার দাদিমা।”

রাগান্বিতা তাও শান্ত হতে পারলো না। তার কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“আমরা কখন যাবো?”
“এই তো ভোরের আলো ফুটলেই।”

রাগান্বিতা থরথর করে কাঁপছে। ইমতিয়াজ বিষয়টা বুঝতে পেরে রাগান্বিতাকে কাছে আনলো মাথাটা বুকে চেপে ধরে বললো,
“এত ভয় পেও না কিছু হয় নি। তুমি শুধু একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছো আর কিছু না।”

রাগান্বিতার চোখে পানি চলে আসলো। এই স্বপ্নের ইঙ্গিত তো ভালো নয়। রাগান্বিতা মৃদু স্বরে বললো,
“আপনি সত্যি বলছেন আমার দাদিমা কোথাও যাবে না তো আমায় ছেড়ে।”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার মাথায় হাত বুলাতে বললো,
“না কোথাও যাবে না।”

কথাটা বলে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো ইমতিয়াজ। সঙ্গে ভাবলো “কোথাও যাবে না” কথাটা বলে তো দিল। কিন্তু রাগান্বিতার বাবার চিঠি তো অন্য কথা বলছে। ইমতিয়াজ আনন্দপুর থেকে ফিরতেই একটা চিঠি পায় যেটা ছিল রাগান্বিতার বাবার। দাদিমার অবস্থা ভালো নয়, এ কথাও স্পষ্ট লেখা ছিল চিঠিতে তাই তো ইমতিয়াজ রেশবপুরে যাওয়ার কথা বলে। রাগান্বিতাকে আপাতত কিছু জানাতে চাচ্ছে না ইমতিয়াজ। সোজা বাড়ি গিয়েই না হয় দেখুক।

ধীরে ধীরে রাগান্বিতা শান্ত হলো। ইমতিয়াজের বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো। ইমতিয়াজও রাগান্বিতকে নিয়েই শুয়ে পড়লো। মাথায় বিলি কাটতে লাগলো আপনমনে। আকাশের চাঁদটা তখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল জানালা দিয়ে। ইমতিয়াজ তাকিয়ে রইলো সেই চাঁদটার পানে। খানিকটা মেঘ জমেছে তার চারপাশে। বোধহয় বৃষ্টি হবে। ইমতিয়াজ হঠাৎই বিড়বিড় করে বললো,
“মেঘ বলেছে বৃষ্টি হবে
আকাশটা তাই অন্ধকার;
মনের মাঝে ঝড় উঠেছে
তাকে হারানোর আশঙ্কার।”
—–
সকালের ট্রেনে চড়েই রেশবপুরের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালো রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রাস্তায় সে কি কথা রাগান্বিতার। বাড়ি গিয়ে দাদিমাকে চমকে দিবে, জড়িয়ে ধরে এটা বলবে সেটা করবে,প্রেম নগরের ওই জায়গাটার বর্ণনা করবে, টিয়াপাখির সেই মিষ্টি ডাকটার কথা তো সবার আগে বলবে। এমন নানা কিছু বলছে রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ শুধু শুনে যাচ্ছে উত্তরে শুধু হুম, হা, ঠিক আছে এসব বলছে। মেয়েটার উত্তেজনা দেখে ইমতিয়াজ ভিতরে ভিতরে গুমরে মরছে, সে কি ভুল করলো আবার কিন্তু বললেও তো ঠিক হতো না। সারারাস্তায় মেয়েটা গুমরে থাকতো তা দেখে ইমতিয়াজের আরো হৃদয় পুড়তো। ইমতিয়াজের কেন যেন মনে হচ্ছে সে একের পর এক ভুল করছে। অথচ সঠিক কি তাও বুঝচ্ছে না। কি এক বিচ্ছিরি ব্যাপার।

আগেরবারের তুলনায় এবার বুঝি বেশ দেরি হচ্ছে রেশবপুর যেতে রাগান্বিতা খুব উত্তেজিত হয়ে বলছে,“এখনো আমরা যাচ্ছি না কেন?”

ইমতিয়াজ আলতো হাতে রাগান্বিতাকে ক্যাভিনের পালঙ্কে বসালো। নীরব স্বরে বলল, “এত উত্তেজিত হয়ো না।”

রাগান্বিতা চুপটি করে বসে রইলো। বোধহয় সত্যি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছে।’

সময় চললো কয়েক ঘন্টা পেরোতেই রাগান্বিতারা ট্রেন পেরিয়ে নৌকায় এসে পৌঁছালো রেশবপুরের ঘাটের কাছে। রাগান্বিতা দ্রুত দ্রুত নৌকায় ছেড়ে নামলো সে পারুক দৌড়ে ছুটে যাক বাড়ি। কিন্তু পারছে না। ইমতিয়াজ আসলো রাগান্বিতার পাশে দাঁড়ালো কিন্তু আশেপাশে কোনো গরু বা মহিষের গাড়ি দেখছে না এবার তারা যাবে কিভাবে। মিনিট দশ যেতেই একটা ছোট্ট গরুর গাড়ির দেখা মিললো রাগান্বিতা দ্রুত ছুটে গিয়ে বসলো সেই গাড়িতে তাড়া দিয়ে বললো,“দাদুভাই, তাড়াতাড়ি তালুকদার ভিলায় নিয়ে চলুন।”

গাড়িচালক রাজি হলো। ইমতিয়াজ উঠে বসলো। মেয়েটার এত উত্তেজনা একটুপরই কমে যাবে কথাটা ভাবলেই ইমতিয়াজের খারাপ লাগছে। দেখতে দেখতে দেড়ঘন্টার মাথায় এসে গরুরগাড়ি পৌঁছালো তালুকদার ভিলার সামনে। রাগান্বিতা আগেই গরুর গাড়ি থেকে নামলো বাড়ির ভিতরটায় তাকাতেই কেমন যেন বিষণ্ণ বিষণ্ণ লাগলো। বুকটা আচমকাই কেঁপে উঠলো। সে ইমতিয়াজকে রেখেই ছুটে গেল বাড়ির ভিতরে। উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগলো,“দাদিমা, দাদিমা, আমি এসেছি দাদিমা।”

বাড়ির ভিতর ঢুকতেই বুকটা থমকে গেল রাগান্বিতার। কারণ বাড়ির মধ্যে অনেক মানুষের মুখ। রাগান্বিতা স্তব্ধ হয়ে গেল, আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলো। আতঙ্কের স্বরে বললো,“কি হয়েছে, তোমরা সবাই এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

ততক্ষণে ইমতিয়াজও সদর দুয়ারে পা রাখলো। একটু দূরেই চিন্তিত মুখে বসে আছে রাগান্বিতার বাবা। ইমতিয়াজ সেদিকে গেল। ভিতর কক্ষেই মহিলাদের ভীড়। রাগান্বিতা সেই কক্ষেই গেছে মাত্র। ইমতিয়াজ মোতালেব তালুকদারের কাছে দাঁড়িয়ে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম জমিদার সাহেব।”
মোতালেব তালুকদার ঘুরে তাকালেন মিনমিনিয়ে বললে,
“ওলাইকুম আসসালাম। ভালো আছো বাবা?”
“জি ভালো। দাদিমা কেমন আছেন?”

উত্তরে ছলছল দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। দৃষ্টি দেখেই বোঝা গেছে দাদিমা ঠিক নেই।

উপস্থিত সবার দিকেই বিস্মিত নজরে তাকিয়ে আছে রাগান্বিতা। এরই মাঝে আতিব দৌড়ে এসে কান্নাভেজা স্বরে বললো,
“আফা তুমি আইছো আফা দেহো দাদিমা কতা কয় না খালি হগলডির দিকে তাকাইয়া থাহে।”

আতিবের কথা শুনে বুঝি এক নিমিষেই রাগান্বিতার সব উত্তেজনা বন্ধ হয়ে গেছে। পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। তড়িৎ গতিতে তার হৃপিন্ডটা বুঝি কেঁপে উঠলো। সবাই সামনে থেকে সরে গেল পালঙ্কের পাশেই নিচে শুয়ে আছে দাদিমা। রাগান্বিতা দৌড়ে গেল। থরথর কণ্ঠে বললো, “তুমি এভাবে শুয়ে আছো কেন দাদিমা কি হয়েছে তোমার?”

দাদিমা কিছু বলতে পারলেন না শুধু ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলেন রাগান্বিতার মুখের দিকে তার ঠোঁট কাঁপছে কিছু একটা বলতে চাইছেন তিনি কিন্তু বলতে পারছেন না। রাগান্বিতার কথার মাঝে ওর এক সহপাঠি মিলি এসে বললো,“কয়দিন আগে দাদিমা নাইতে গিয়া পানিতে পইড়া গেছিল হেরপর থেইকাই অসুস্থ। আইজগো বেশি খারাপ।”

রাগান্বিতা কিছু বললো না শুধু শুনেই গেল। রাগান্বিতা দাদিমার দিকে তাকিয়ে বললো,“আমার উপর রাগ করছো দাদিমা আমার সাথে কথা কইবা না।”

দাদিমা চেষ্টা করছেন সে কিছু বলতে চাইছেন দুই তিনটা শব্দ বের হচ্ছে মুখ থেকে কিন্তু সেই শব্দগুলো এত অল্প স্বরে বলছে যে রাগান্বিতা কিছু শুনতে পাচ্ছে না। রাগান্বিতা তার কানটা দাদিমার নিকট নিলো। দুটো শব্দ শুনতে পেল শুধু,“চি ডি”

রাগান্বিতা আসার তিনঘন্টা পরই দাদিমা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তার অসমাপ্ত কথাটা শেষ করার অনেক চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। কান্নার রোল পড়লো পুরো তালুকদার ভিলায়। আজরাইল বুঝি অনেক আগে থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছিল দাদিমার পুরো কক্ষে শুধুমাত্র রাগান্বিতা আসার শেষ ইচ্ছেটুকু পূরণ করার জন্যই বুঝি এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলো। সবার কান্নার শব্দ পেতেই ছুটে আসলেন মোতালেব তালুকদার আর ইমতিয়াজ শোনা গেল ”দাদিমা আর নেই”। ভেঙে পড়লেন মোতালেব তালুকদার ইমতিয়াজ তাকে ধরলো। মা সমতুল্য মানুষটা আর নেই। ভাবতেই বুকে ছিঁড়ে যাচ্ছে মোতালেব তালুকদারের। শেষমেশ দাদিমা সত্যি সত্যি তাকে কিছু না বলে চলে গেল। রেজওয়ান ছুটে আসলো। চারপাশ কেমন ধোঁয়াশায় পরিণত হলো। রাগান্বিতা স্তব্ধ তার কান্নার শব্দ আসছে না। আচমকাই দাদিমাকে জড়িয়ে ধরে সে কেঁদে উঠলো। পুরো তালুকদার ভিলা বুঝি কেঁপে উঠলো রাগান্বিতার সেই কান্নার শব্দে। ইমতিয়াজের ভিতরটা কেঁপে উঠলো। ধারালো ছুরির আঘাত লাগলো বুঝি বুকে। কি মর্মান্তিক সেই যন্ত্রণা!’

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here