#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪০
________________
বিষণ্ণ চারপাশ। নিস্তব্ধ পরিবেশ। কান্নার শব্দ নেই তেমন। বাড়ির পিছনে পুকুরঘাটের পাশে মশারি টানিয়ে চারপাশ বিছানার চাদর দিয়ে লেপ্টে শেষ গোসল করানো হচ্ছে দাদিমাকে। রাগান্বিতা মশারির বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে, তার অন্তর পুরে ছারখার হচ্ছে, ইচ্ছে করছে মাটির ওপর শুয়ে হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁদতে। সেই ছোট বেলা থেকে এই মানুষটা রাগান্বিতাকে অনেক যত্ন করেছে। মায়ের চেয়েও বোধহয় বেশি স্নেহ আর ভালোবাসা দিয়েছে। মাকে তো দেখে নি রাগান্বিতা দেখেছে দাদিমাকে। কুহু আপাকেও দারুণ ভালোবাসতো দাদিমা। রাগান্বিতাকে কতবার বাবার ঝার খাওয়া থেকে রক্ষা করেছে, কতবেলা নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে তার হিসাব নেই। সেই মানুষটা আর নেই। ভাবলেই কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে রাগান্বিতার। রাগান্বিতা নিজের ডান হাতটা মুখের চেপে ধরলো কেঁদে উঠলো আবার, তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এত কষ্ট সহ্য হচ্ছে না। দাদিমা কিছু বলতে চাইছিলেন, কি বলতে চাইলেন এই আফসোস যাচ্ছে না রাগান্বিতার। সে আরো আগে কেন এলো না এখানে, কেন আসতে পারলো না দাদিমার কাছে। এই শোক রাগান্বিতাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। যন্ত্রণায় পুরো শরীর বুঝি তীর তীর করে কাঁপছে। রাগান্বিতা ওখান থেকে সরে এলো। আর সইতে পারছে না। কুহু আপার মরণের সময় রাগান্বিতা কাঁদে নি। সে শক্ত ছিল, রাগ ছিল বলা যায় তাই বুঝি কাঁদতে পারে নি। কিন্তু আজ এতটা ভেঙে গেল রাগান্বিতা নিজেকে সামলাতেই পারছে না। রাগান্বিতা বাড়ির ভিতর ঢুকলো ইমতিয়াজ তখন কবর খননের কাজে বাহিরে। দাদিমার শেষ ইচ্ছে ছিল নাকি, কুহুর বামপাশে তাকে যেন কবর দেয়া হয়। কুহু আপা ছোট্ট কাল থেকে দাদিমার বুকের ডানপাশে শুয়ে থাকতে পছন্দ করতো। মোতালেব তালুকদার সেই ইচ্ছে রাখছেন। কুহুর বামপাশে কবর খনন করছেন দাদিমার জন্য।
রাগান্বিতা ঘরের সদর দরজা পর্যন্ত আসতেই দেখা মিললো মোতালেব তালুকদারের সঙ্গে। তিনি রাগান্বিতাকে দেখেই বললেন,
“রাগান্বিতা শুনো,
রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে পড়লো। বাবার দিকে অশ্রুভেজা আঁখি নিয়ে তাকালো। সেই শক্তপক্ত রাগান্বিত মেয়েটার চোখে অশ্রু দেখে ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠলো রাগান্বিতার বাবার। নিজেকে সামলালেন তিনি। রাগান্বিতা হেঁটে আসলো। মাথা নুইয়ে দাড়ালো। মোতালেব তালুকদার শক্ত গলায় বললেন,
“এত কাঁদছো কেন?”
রাগান্বিতা বাবার দিকে তাকালো তারও চোখ ভেজা। কি আশ্চর্য না। বাবা নিজেও কাঁদতে অথচ আমায় প্রশ্ন করছে এত কাঁদছো কেন! এখন রাগান্বিতা যদি প্রশ্ন করে,তুমি কেন কাঁদছো বাবা?” কিন্তু রাগান্বিতা প্রশ্নটা করলো না। রাগান্বিতার বাবা শক্ত পক্ত গলায় বললেন,
“শোনো রাগান্বিতা আজ কিছু কথা বলি তোমায়। জীবনে কোনো ক্ষেত্রে নিজেকে বেশি ভাঙতে দিবে না। শক্ত থাকবে ঘরের খুঁটির মতো। মনে রাখবে জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। তোমারও থাকবে না আমারও থাকবে না। মৃত্যু চিরন্তন সত্য আজ নয় কাল এটা ঘটবেই। আজ দাদিমা গেছেন, কাল আমিও যাবো। আজ তোমায় একটা আদেশ দিলাম, আমি মারা গেলে তুমি এক ফোঁটাও চোখের পানি ফেলবে না। শক্ত রাখবে নিজেকে। জীবনে কখন কি ঘটে যায় বলা যায় না। কখনো ভেঙে পড়বে না, নিজেকে শক্ত রাখবে সবসময়। জীবনের জটিল মুহুর্তগুলোর সময় নিজেকে ওই আকাশের মতো শীতল মনে করবে। চেষ্টা করবে নিজেকে আকাশের মতো স্থির রাখার। দেখো না হাজার ঝড় বৃষ্টি গেলেও আকাশ সবসময় তার জায়গায় স্থির থাকে। তুমিও তেমন থাকবে। তোমার নামটা আমি রাগান্বিতা কেন রেখেছি জানো,
রাগান্বিতা এবার বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো,“কেন?”
রাগান্বিতার বাবা সরল কণ্ঠে বলে উঠলেন আবার,
“তুমি ছোট থেকেই শক্তপক্ত ছিলে সহজে কাঁদতে না। ব্যাথা পেলেও কাঁদতে না যে জিনিসটা আমার ভীষণ ভালো লাগতো। তোমার চোখে ছিল আগুন, কেউ অন্যায় করলে তুমি তার দিকে যে দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে তা আমি এই রেশবপুরের কোনো নারীর চোখে দেখিনি। তাই আমি তোমার নাম রেখেছিলাম রাগান্বিতা। এই নামের কোনো অর্থ নেই। তোমার নামটা হলো অর্থহীন তবে এর ওজন কিন্তু ভাড়ি। সেই তুমি আজ এভাবে ভেঙে পড়ছো আমি নিতে পারছি না। তুমি আর কাঁদবে না। আর যদি কাঁদতে হয় তাও লোকসমাজে কাঁদবে না। মনে রাখবে, আনন্দ ভাগ করতে হয় সবার সামনে, কিন্তু কাঁদতে হয় আড়ালে। সবাইকে চোখের পানি দেখাতে নেই। বুঝেছো আমি কি বলেছি,
রাগান্বিতা তার চোখের পানি মুছে নিল। মাথা উঁচু করে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,“বুঝেছি বাবা।”
রাগান্বিতার বাবা জোরে একটা নিশ্বাস ফেললন। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
“তোমায় হাজার বছর বাঁচতে হবে রাগান্বিতা, এভাবে কাঁদলে চলবে না। কাঁদতে হলে একা কাঁদবে, মনে রাখবে মানুষের চোখের পানি অতীব মূল্যবান জিনিস এই জিনিস দেখার সৌভাগ্য সবাইকে দিতে নেই।”
রাগান্বিতা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো বাবার মুখের দিকে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বাবা কত শক্ত হয়ে কথাগুলো বললো। রাগান্বিতা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,“আমি তোমায় জড়িয়ে ধরবো বাবা?”
মোতালেব তালুকদার থমকে গেলেন। এত বছরের জীবনে এমন আবদার কোনোদিনও করে নি রাগান্বিতা। নিরুত্তর মোতালেব তালুকদার। রাগান্বিতা আবার বললো,“কি হলো বাবা আমি কি তোমায় জড়িয়ে ধরবো একবার।”
মোতালেব তালুকদার শক্ত গলায় উত্তর দিলেন এবার, “না।”
আহত হলো রাগান্বিতা। কারো ডাক শোনা গেল সেই সময়। মোতালেব তালুকদারকে ডাকছে। মাদরাসায় পড়ুয়া কিছু হাফেজ ছেলেরা এসেছে কোরআন শরীফ পাঠ করার জন্য।
রাগান্বিতা বাবার যাওয়ার পানে শুধু তাকিয়ে রইলো। একটু জড়িয়ে ধরতে দিলে কি খুব ক্ষতি হতো বাবার। অন্যদিকে মোতালেব তালুকদার ভাবছেন, মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে দেন নি এই কারণেই যে, এই মুহূর্তে মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে দিলে মোতালেব তালুকদার নিজেকে শক্ত রাখতে পারতেন না। এত কড়া কড়া কথা বললেন। অথচ যদি নিজেই রাখতে না পারে সেই কথা। তবে মেয়ে রাখবে কেমন করে। পৃথিবীতে সবসময় নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী অন্যকে কথা শোনানো উচিত। নিজে যেটা পারবো না সেটা অন্যকে বোঝানো নিতান্তই নিজেকে বড় দেখানোর একটা অযুহাত। যা একটা সময় ভয়ংকর বিপদে ফেলতে পারে। মেয়ে অভিমান করেছে এটা বুঝেছেন মোতালেব তালুকদার। তবুও উপায় নেই, কিছু কিছু জিনিসকে মাঝে মধ্যে ছেড়ে দিতে হয়। অপেক্ষা করতে হয় দ্বিতীয় সুযোগের।
—-
সন্ধ্যা ৭ঃ০০টা। নিজ কক্ষের জানালা দিয়ে কুহু আপার পাশের কবরখানার দিকে তাকিয়ে আছে রাগান্বিতা। নিঃশব্দে চোখ বেয়ে পানি পড়ছে তার। দুটো প্রাণের মানুষ, কাছের মানুষ কি সুন্দর মাটির নিচে শুয়ে আছে। আর সে জমিনের বুুকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখছে। দুনিয়া এত কঠিন কেন, সৃষ্টির কেন শেষ হয়। সৃষ্টিদেরকে আজীবন অমর রাখতে পারলো না আল্লাহ। তাহলে কত সুন্দর হতো। কোনো দুঃখ থাকতো না। রাগান্বিতার কাঁধে কারো স্পর্শ পাওয়া গেল। চেনা সেই স্পর্শ। রাগান্বিতা ঘুরলো না। তবে এই স্পর্শ যে ইমতিয়াজের এটা বুঝতে বাকি নেই রাগান্বিতার। ইমতিয়াজ আওড়ালো,“বউ।”
রাগান্বিতার ঠোঁটে কথা নেই। সে চুপচাপ। ইমতিয়াজ আবার বললো,“আমার সঙ্গে কথা বলবে না বউ।”
রাগান্বিতা না ঘুরেই স্থির কণ্ঠে বললো,“আপনি কাল আমায় মিথ্যে কেন বললেন, যে দাদিমা আমায় ছেড়ে যাবে না।”
ইমতিয়াজ নিরুত্তর! এখন কি বলবে। ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,“মাঝে মধ্যে কিছু ভালোর জন্য আমাদের মিথ্যে কথা বলতে হয় বউ।”
এবার ঘুরে তাকালো রাগান্বিতা। চোখে পানি নেই তার। তবে লাল হয়ে আছে। রাগান্বিতা বললো,
“কি ভালো হয়েছে?”
“ওই যে তুমি ঢাকার বাড়ি থেকেই মন খারাপ করে আসো নি। পুরো পথটা তো হাসিতে ছিলে। তুমি সারারাস্তায় মন খারাপ করে আসতে আমারও তো কষ্ট হতো। তাই আমি কিছু সময়ের জন্য স্বার্থপর হয়েছি। নিজের দিকটা দেখেছি। নিজেকে কিছুটা সময় ভালো রাখারই চেষ্টা করেছি।”
রাগান্বিতা আর কিছু বললো না। সে নিরদ্বিধায় জড়িয়ে ধরলো ইমতিয়াজকে। শক্ত করে ধরলো। ইমতিয়াজ অনুভব করলো সেটা। কিছু বললো না। স্থির। চুপচাপ। নিরিবিলি পরিবেশ। কোনো শব্দ নেই। রাগান্বিতার চোখ বেয়ে পানি জড়লো তবে তাতেও শব্দ আসলো না। সে বললো,
“আমার কি করার উচিত এখন?”
ইমতিয়াজ নীরব কণ্ঠে শুধালো,
“কিছু না। যেভাবে আছো সেভাবেই থাকো।”
“আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে।”
“আমি বুঝতে পারছি তাও শান্ত থাকো।”
“আমি চিৎকার দিয়ে কাঁদতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না।”
“বাবা বারণ করেছেন।”
“আপনি শুনেছিলেন সবটা।”
“হুম। দুয়ারের কর্নারে দাঁড়ানো ছিলাম তখন।”
“বাবা কি কিছু ভুল বলেছেন?”
“একদমই না।”
“কিন্তু আমার তো ইচ্ছে হচ্ছে আমি চিৎকার দিয়ে কাঁদি।”
“সব ইচ্ছে পূরণ করতে নেই।”
“আমি মানতে পারছি না।”
“সত্য তো মানতে একটু সময় লাগবে।”
“আমি আপনায় সারারাত জড়িয়ে ধরে থাকবো?”
“তুমি ছাড়তে চাইলেও আমি ছাড়ছি না।”
এমন অনেক কথা বললো না দুজন। রাত অনেক গভীর হলো। কিন্তু তাদের কথা শেষ হলো না। রাগান্বিতা কাঁদলো না। তার চোখের পানি আস্তে আস্তে কমে গেল। কষ্ট পাওয়া বন্ধ হলো। কি আশ্চর্যকর যাদু ছিল জানে না রাগান্বিতা। রাগান্বিতা প্রশ্ন করলো হঠাৎ,
“পা ব্যাথা করছে না?”
“তোমার যন্ত্রণার তুলনায় কম।”
“আপনার যন্ত্রনা হচ্ছে না?”
“হচ্ছে তো তোমায় দেখাতে চাচ্ছি না। মানুষ হারানোর শোক আমিও বহুবার পেয়েছি বউ। তুমি তো জানো।”
রাগান্বিতা চুপ। ইমতিয়াজও আর কিছু বললো না।রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে ফেললো, তখনই দাদিমার বলা সেই শেষ শব্দ দুটো কানে বাজলো। রাগান্বিতা মিলালো। চি,ডি মানে চিঠি। রাগান্বিতা গভীর এক ভাবনায় ভেবে মনে মনে বললো,“তবে কি দাদিমা আমার জন্য কোনো চিঠি লিখে গেছেন! কি থাকতে পারে সেই চিঠিতে কোনো বিষাদময় বার্তা নয় তো।”
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]
#TanjiL_Mim♥️