#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৩
________________
হা হয়ে তাকিয়ে আছে রাগান্বিতা পুরো ট্রলারের দিকে। কারণ তার সামনে রয়েছে দুটো গরু একটা বাছুর, তিনটে ছোট ছোট ছাগল,দুটো মোরগ, দুটো মুরগী সঙ্গে তাদের ছানা পোনা, দুটো বড় বড় হাঁস তাদের একটা ছাও(বাচ্চা), সঙ্গে একটা টিয়াপাখি, গরু আর ছাগল বাদে বাকি সবগুলোই খাঁচায় বন্দী। গরু ছাগল দড়ি দিয়ে বাধা। ট্রলারে জায়গা নেই তেমন। অথচ মানুষ হিসেবে আছে তারা তিনজন বাকি যারা আছে তাদের একজনও মানুষ না। রাগান্বিতার এই মুহূর্তে ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেয়া উচিত বুঝতে পারছে না। ইমতিয়াজ স্বাভাবিক। যেন এটা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। নিত্যদিনের ব্যাপার। ট্রলারের কর্নারের দিকটায় চেয়ার পেতে পাশাপাশি বসে আছে ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা। ট্রলার চলছে তার আপন গতিতে। কোথায় যাচ্ছে রাগান্বিতা জানে না। রাগান্বিতা নদীর পানির দিকে তাকালো। ঢেউয়েরা ছুটছে তুমুল বেগে। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের মুখের দিকে তাকালো। খুব অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,“আমরা কি আর ফিরবো না?”
ইমতিয়াজ একপলক রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“যদি বলি না ভয় পাবে খুব।”
রাগান্বিতা নিজেকে ধাতস্থ করলো। অবাক হয়েই বললো,
“ভয় পাবার কি আছে?”
“সত্যিই নেই?”
“আমি তো দেখি না।”
“তুমি দেখো না,নাকি দেখতে চাও না।”
“আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন বলুন তো।”
“তোমায় আমি খুন করবো বউ।”
সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ শব্দে হেঁসে ফেললো রাগান্বিতা। শব্দটা এতটাই জোরে ছিল যে নিকাবের আর ট্রলারের শব্দের ভিড়েও ইমতিয়াজ খুব ভালো ভাবে টের পেল। ইমতিয়াজ বিস্মিত কণ্ঠে বললো,“তুমি ভয় পাচ্ছো না?”
রাগান্বিতা আরো কিছুক্ষণ হাসলো। মিনিট দুই যেতেই থেমে বললো,“আপনার কথায় আমি কখনোই ভয় পাই না। উল্টো আপনার কথা শুনলেই আমি নতুন করে প্রেমে পড়ে যাই।”
ইমতিয়াজ তাজ্জব বনে গেল। কি সাংঘাতিক কথা! মেয়েটা তার খুন শব্দের মধ্যেও ভালোবাসার ছোঁয়া পায়। ইমতিয়াজ নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
“আমায় এত বিশ্বাস কেন করো বউ? জানো না মানুষকে বেশি বিশ্বাস করতে নেই।”
“দুনিয়ার সবাইকেই অবিশ্বাস করলে জীবনটা রঙিন হবে কি করে বলুন।”
“তুমি রঙিন জীবন চাইছো ওদিকে আমার নিজের জীবনই অন্ধকারে টইটম্বুর।”
“আগে ছিল মানছি। কিন্তু এখন আর থাকবে না আমি আছি তো রঙিন করার দায়িত্ব আমার।”
মৃদু হাসে ইমতিয়াজ। বলে,
“তুমি কি জানো দিনে দিনে আমি বড্ড ভীতু হচ্ছি?”
“আমি মেয়ে হয়ে ভীতু হই না আর আপনি ছেলে হয়ে ভীতু হচ্ছেন। এত ভয় কিসের আপনার?”
“তোমায় বলবো না বলে দিলেই আমি ধ্বংস।”
রাগান্বিতা এবার কি বলবে বুঝতে পারছে না। প্রায়শই ইমতিয়াজের এমন শেষ কথায় আঁটকে যায় রাগান্বিতা। প্রতিউত্তরে কিছুই বলতে পারে না।আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হলো না। রাগান্বিতা চুপ হয়ে গেল। হঠাৎই আবার বলে উঠলো ইমতিয়াজ,
“তুমি কি মানবে একদিন তুমি আমায় খুন করতে চাইবে?”
সঙ্গে সঙ্গে চোখে মুখে বিস্ময়ের ছায়া ফুটে উঠলো রাগান্বিতার। যদিও রাগান্বিতার নিকাবের কারণে চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ইমতিয়াজ। তবুও ওই চোখ দেখেই ইমতিয়াজ অনেককিছু বুঝলো। রাগান্বিতা কেমন এক দৃষ্টি নিয়ে থমথমে কণ্ঠে বললো,“আমি আপনায় কেন খুন করতে চাইবো। আপনায় খুন করার আগে যেন আমি ঝলসে যাই।”
বিনিময়ে ইমতিয়াজ আর কিছু বলে না। উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বুকচাপা এক দীর্ঘশ্বাস বের হয়। ইমতিয়াজ আকাশ পানে তাকিয়ে বলে,- শুরু যেমন হয় শেষও তেমনি ঘটে। সৃষ্টি যখন হয়েছে ধ্বংস তখন অনিবার্য! শুধু দেখার পালা ধ্বংসের পথটা কতদূর। খুব দূরে নাকি অতি নিকটে!’
নিজ ভাবনার মাঝে কাঁধে কারো স্পর্শ অনুভব করলো ইমতিয়াজ। সে তাকালো। রাগান্বিতা তার কাঁধে মাথা দিয়েছে। ইমতিয়াজ কি ভেবে যেন বলে উঠলো,“আমি চাইবো বউ তোমার আমার পথটা যেন বহুকালের দীর্ঘ হয়।”
রাগান্বিতা নিকাবের আড়ালে মুচকি হাসলো। এতক্ষণ পর মানুষটা দারুণ কিছু বললো। রাগান্বিতা ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো,“তা তো হবেই। এই রাগান্বিতা এত দ্রুত আপনার পিছু ছাড়বে না।”
—-
চারঘন্টার পথ অতিক্রম করে ইমতিয়াজদের ট্রলার এসে থামলো একটা ছোট্ট দ্বীপের মতো জায়গাতে। রাগান্বিতা পুরো জায়গাতেই চোখ বুলালো। একটা গোলাকার বৃত্তের মতো জমি। যার পুরোটায় সবুজ ঘাসে ভর্তি। সামনের দূরের দিকের একাংশে রয়েছে অসংখ্য বড় বড় গাছ। মাঝখানে ফাঁকা। আর গোলাকার বৃত্তের চারপাশে নদীর। দূরদূরান্তে কিছু দেখা যাচ্ছে না। এক কথায় বিশাল নদীর মাঝে একটা ছোট্ট গোলাকার দ্বীপ। রাগান্বিতা ইমতিয়াজ ট্রলার ছেড়ে নামলো। রাগান্বিতা আবারও আশপাশটা দেখলো। এখানে তারা থাকবে কই তাই বুঝচ্ছে না রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার হাত ধরলো। ট্রলার চালককে বললো,“আপনি এখানে থাকুন আমি একটু আসছি।”
এই বলে রাগান্বিতাকে নিয়ে চললো ইমতিয়াজ। হেঁটে আসলো একদম ওইমাথায়। অনেকখানি এগোতেই রাগান্বিতা দেখলো। চারপাশে গোল করে বেড়া দিয়ে রয়েছে নারকেল, সুপারি আর কলা গাছের শুকনো পাতা। বেড়ার কারনে ওপাশে কি আছে দেখা যাচ্ছে না। ইমতিয়াজ হেঁটে এসে মাঝ বরাবর দাঁড়ালো। তারপর হাত দিয়ে দুদিকের মাঝখান বরাবর বেড়া ফাঁক করে দিলো সঙ্গে সঙ্গে রাগান্বিতা দেখতে পেল। ফকফকা মাটির উঠান। উঠানের সামনেই একটু দূরে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর। খড়ের তৈরি ছাউনী তার। চারপাশে দেয়াল হিসেবে রয়েছে মাটি। ঘরে ঢোকার আগে উপরে খড়ের চাউনী থাকলেও চারপাশে বেড়া নেই। জমিনের মাটি থেকে একটু উঁচুতে ঘরটা। সামনে দুটো মাটির তৈরি সিঁড়িও আছে। রাগান্বিতা সামনে যত আগাচ্ছে তত মুগ্ধ হচ্ছে। চারপাশ এত সুন্দর কেন! তাদের সামরাজ্যের ওই জমিদার ভিটার চেয়েও কি নিদারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে এই কুঁড়েঘরটা। রাগান্বিতা “বিসমিল্লাহ” বলে ঘরে প্রবেশ করলো। চারপাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়তো বৃষ্টি হবে। বাতাস বইছে পুরো প্রকৃতি জুড়ে। রাগান্বিতাকে ঘরের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে ইমতিয়াজ বললো,“তুমি এখানে চুপটি করে দাঁড়াও আমি বাকিদের থাকার ব্যবস্থা করছি। এই বলে চলে গেল ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা চেয়ে রইলো। চারপাশ দেখলো, তাদের ঘরে কর্নারের হাতের বামদিকের মাথাতেই আছে একটা বিশাল পেয়ারার গাছ। ডানদিকের কয়েককদম পেরিয়েই নদীর পাড়। যেখানে ঘাটলা আছে। ঘাটলার পাশে বিশাল রেন্টিগাছ। রেন্টি গাছের সাথে রয়েছে একটা কালো কুচকুচে রঙের নৌকা বাঁধা। ঢেউয়ে সেটা ভাসছে। তবে বর্তমানে রাগান্বিতা তা দেখতে পায় নি। ঘাটের অন্যপাশে বসার জন্য তক্কা দিয়ে বানানো উঁচু বেঞ্চ। তাদের ঘরটা দ্বীপের মাঝে নয় কর্নারে। যার কারনের নদীর ঘাট একটু নিকটে। কম করে হলেও বিশ পা এগোতে হবে। ইমতিয়াজ এগিয়ে আসলো সঙ্গে করে নিয়ে আসলো তিনটে গরু আর তিনটে ছাগল। তাদের রাখার জন্য বামদিকের পেয়ারা গাছের পরে অনেকখানি জায়গা ফাকা রেখে লম্বা ঘর বানানো। সেটার ছাউনীও খড় দিয়ে বানানো। ইমতিয়াজ তাদের সেই ঘরে বেঁধে রাখলো। কোথা থেকে যেন ঘাস এনে রাখলো সামনে তাঁরাও আনন্দে খেতে থাকলো। ইমতিয়াজ আবার গেল ট্রলারের কাছে এবার ফিরে এলো হাঁস মুরগী নিয়ে। সেগুলোর জন্য তৈরি আছে সুন্দর মাটির খোঁপ। হাঁসমুরগীকে ট্রলারে বসে খাওয়ানো হয়েছিল তাই আজ আর বার না করে সোজা খোঁপে ঢুকিয়ে দিয়ে সামনে থেকে মাটির দরজা আঁটকে দিল তক্কা দিয়ে। ঘরের সামনেই বাঁশের সাথে বেঁধে খাঁচায় ভরে ঝুলিয়ে রাখা হলো টিয়াপাখি। ইমতিয়াজ শিখিয়ে দিলো। বললো,“সবুজপাখি আমার বিবিকে বলো,“বউ স্বাগতম”!”
পাখিটি শুনলো মিনিট দুই যেতেই বলে উঠলো,“বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম।”
রাগান্বিতা আপনাআপনি হেঁসে ফেললো। পুরোটা যেন স্বপ্ন লাগছে মনে হচ্ছে চোখ খুলতেই এই দারুণ স্বপ্নটা ভেঙে যাবে। যা এই মুহূর্তে রাগান্বিতা মোটেও চাচ্ছে না। রাগান্বিতা কতক্ষণ আগেই তার বোরকা হিজাব খুলে ফেলেছে যার দারুণ ইমতিয়াজ রাগান্বিতার শেষের হাসিটা দেখতে পেল। মনে মনে আওড়ালো, “তোমার এই হাসি যেন কোনো হাসি নয় বউ, এ আমার বিস্মিত বুকটা ঠান্ডা করার এক অদ্ভুত মায়াজাল। যা আমায় বার বার ভেঙে গুঁড়িয়ে আবার শক্তপক্ত করে।”
বুকে হাত দিয়ে মৃদু হাসলো ইমতিয়াজ।’
—-
ইমতিয়াজ রাগান্বিতা ঘরের ভিতর প্রবেশ করলো। রাগান্বিতা দেখতে পেল একটা ছোট চৌকি। সঙ্গে কিছু আসবাবপত্রও আছে বোঝাই যাচ্ছে তারা আসার আগে ইমতিয়াজ এখানে এসে অনেককিছু গোছগাছ করে গেছে। তারজন্যই চারপাশ এত পরিপাটি। ধীরে ধীরে প্রকৃতি আরো রঙ বদলালো, মেঘাচ্ছন্ন আকাশটা হলো আরো গাড়ো। ধীরে ধীরে ধরনী জুড়ে বর্ষণ শুরু হলো। এই যেন অন্যরকম বর্ষণ, বোধহয় প্রেম বর্ষণ।
~ ধরণী জুড়ে হচ্ছে নির্জীব এক খেলা
দুপুর হয়েও যেন দেখাচ্ছে সন্ধ্যাবেলা
মাটি নদী মিশে হচ্ছে ঘর্ষণ
প্রকৃতি জুড়ে যেন নেমেছে এক অদ্ভুত প্রেমবর্ষণ!
#চলবে…..
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। শেষের দৃশ্যপট সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক বাস্তবে এমন আছে কি না লেখিকা জানে না]
#TanjiL_Mim♥️