#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৫১
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
“ডাক্তার বাইরে গাড়ি দেখলাম তুমি কোনোহানে যাইবা নাকি। আমি তো জানতামই না তুমি আজকে এতো আগেই হাসপাতাল থেইকা বাড়ি আইছো।”
তাজেলের কথায় মেহবিন হাসলো একটু আগেই হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসে গোসল করল। বারান্দায় দাড়াতেই তাজেল এসে উক্ত কথাটা বলল। মেহবিন বলল,,
“হ্যা নেত্রী যাবো। আজ আমি শ্বশুরবাড়ি যাবো তাই অর্ধেক সময় হওয়ার পর ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছি।”
“পুলিশ পাঞ্জাবি ওয়ালার বাড়িতে যাইবা?”
“হুম!”
“ওহ আইচ্ছা!”
“তুমি যাবে নাকি নেত্রী?”
“না আমি বিকালে আব্বার সাতে মেলায় যামু। আব্বা আইজ আমার জন্য ছুটি নিয়া আগেই বাড়ি আইবো। আব্বা কইছে আমারে মেলায় নিয়া যাইবো।”
“ওহ আচ্ছা!”
“তোমার নিগা কিছু নিয়াসমানি আমি।”
“আচ্ছা! আমিও তো বিকেলে যাবো।”
“ওহ আইচ্ছা আমি গেলাম দেহি আব্বা আইলো নাকি।”
তাজেল খুশিমনে চলে গেল। আজ অনেকদিন পর তাজেল ওর বাবার সাথে কোথাও যাবে এই জন্য সে ভিশন খুশি। মেহবিন একটু রোদে দাঁড়ালো চুল শুকানোর জন্য। তারপর হালকা কিছু খেয়ে নিল। এরপর ধীরে সুস্থে রেডি হলো। সাড়ে চারটা বাজে মেহবিন রেডি হয়ে বের হলো। মুখর দের বাড়িতে যেতে দূই থেকে আড়াই ঘন্টা লাগবে। ও রাস্তায় আসতেই দেখলো তাজেল আর ওর বাবা আসছে। পাকা রাস্তায় গিয়ে তাজেল মেহবিনের কাছে গিয়ে বলল,,
“ডাক্তার তোমারে একদম পরীর মতো লাগতাছে।”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“তুমি পরী দেখেছো নেত্রী?”
“হুম একবার টিভিতে দেখছিলাম। এইরকম ড্রেস পরা থাহে। তাগো হাতে একটা কাঠিও ও থাহে জাদুর। তোমার হাতে থাকলে তুমিও একদম পরীই থাকতা।”
“আচ্ছা তাই বুঝি। তা তুমি তো মেলায় যাচ্ছো মেলা থেকে তাহলে আমার জন্য একটা জাদুর কাঠি আনিও।”
“পাইলে আনবানি।’
“আচ্ছা!”
“হ আইজক্যা তো পুলিশ পাঞ্জাবি ওয়ালা তোমার দিক থেইকা চোখই সরাইবো না। আইজক্যা তোমারে মেলা সুন্দর লাগতাছে।”
‘ধন্যবাদ নেত্রী।”
মেহবিন তাজেলের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,,
“মেলা কোনদিকে চলুন আপনাদের নামিয়ে দিই।”
তাজেলের বাবা বলল ,,
“আপনি তো বোধহয় স্টেশনের দিকে যাইবেন আমাগো রাস্তা উল্টোদিকে আপনার আমাগো নামান লাগবো না। তাছাড়া আমরা তো হাইট্যাই যাইতে পারুম পরের গ্ৰামেই মেলা।”
“আচ্ছা। আপনার সাথে মেলায় যাবে দেখে নেত্রী আজ বেশ খুশি।”
“কাল রাইতে আবদার করলো। কোনদিন তো কিছু করতে পারি না তাই ভাবলাম মাইয়াডারে নিয়া মেলায় যাই একটু। তাজেলের মাইরেও কইছিলাম কিন্তু হেতি আইলো না। আর আরেক মাইয়ারে ও আসতে দিল না।”
তখন তাজেল বলল,,
“ওদের জন্য কিনা নিয়া আসমুনি কিছু। ডাক্তার তোমার দেরি হইতেছে তাইলে যাও গা তুমি। সাবধানে যাইয়ো।
মেহবিন মুচকি হেঁসে তাজেলের মাথায় হাত রেখে বলল,,
“তুমিও সাবধানে যেও আর হ্যা আমার জন্য মেলায় থেকে কিছু কিনতে হবে না। তুমি ওখানে গিয়ে খুব মজা কোরো।”
“আমি তো যায়া আগে তোমার জাদুর কাঠি খুজুম। কিছু হইলে তুমি সেই জাদুর কাঠি দিয়ে সব ঠিক করবা।
মেহবিন হেঁসে বলল,,
“ওসব কাঠি মেলায় পাওয়া যায় না। সত্যি বলতে ওরকম কাঠি নেই পৃথিবীতে।”
“তাও আমি খুজুম যদি পাই।”
“তোমায় বোঝানোর সাধ্য নেই।”
“আইচ্ছা যাও তুমি তোমার দেরি হইতেছে।”
“হ্যা যাচ্ছি।”
মেহবিন হাঁটা ধরলো তখন তাদের চিৎকার করে বলল,,
“তাড়াতাড়ি আইসো কিন্তু ডাক্তার!”
মেহবিন পেছনে ফিরে বলল,,
“হ্যা আসবো।”
মেহবিন গাড়িতে উঠে গাড়িটা স্টার্ট দিল একটু যেতেই একটা ট্রাক এলো রাস্তা দিয়ে আর সেটা এলোমেলো ভাবে চালাচ্ছে। মেহবিন কোন রকমে গাড়িটাকে সাইড করলো। ট্রাক চলে গেল কিন্তু এলোমেলো ভাবে চালাচ্ছে ও মাথা বের করে রাস্তায় তাকালো। তাজেল ওর বাবার হাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। মেহবিন নেত্রী বলে চিৎকার করে ডাক দিল। তার আগেই ট্রাক টা ওদের দিকে গেল তাজেল রাস্তার মাঝখানে দেখে ওর বাবা ওকে টান দিল কিন্তু শেষ রক্ষা হলো ট্রাকটা দুজন কেই ধাক্কা মারলো। সবকিছু নিজের চোখে দেখতে পেল এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো ওর পৃথিবীটাই থমকে গেল। ও তাড়াতাড়ি করে বের হবে তখন একটা রিক্সা এলো ধাক্কা লেগে পরে গেল । রিক্সাটা থামায় বেশি কিছু হলো না। ও একটু মাথায় আঘাত পেল । ওর দৃষ্টি তাজেলদের দিকে। ও উঠে দৌড় দিল ততক্ষণে ওখানে রাস্তা রক্তে ভিজে গেছে। মেহবিন দেখলো তাজেলের বাবা খুব শক্ত করে তাজেলকে ধরে রেখেছে। তাজেল আর তাজেলের বাবার শরীর রক্ত দিয়ে মাখামাখি। তাজেল আর তাজেলের বাবার চোখ নিভু নিভু। মেহবিন আগে তাজেলকে ধরলো। আর বলল,,
“কিছু হবে তোমাদের নেত্রী আমি এখনি হাসপাতালে নিয়ে যাবো। প্লিজ সাহায্য করুন কেউ শুনতে পাচ্ছেন এখানে এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
যারা ওখানে ছিল সবাই চলে এলো। মেহবিন উঠে দাঁড়াবে তখন তাজেলের বাবা ওর হাত ধরলো আর বলল,,
‘ডাক্তার তাজেলরে বাচান। ডাক্তার আমার মনে হইতেছে আমার সময় ফুরাইয়া আইছে। আপনি তাজেলরে দেইখেন। ওরে কহনো একলা ছাইরেন না। আমার মরার পর ওর মা ওরে বাড়ি থাকবার দিবো না আমি জানি। ওরে আপনি দেইখেন আমি ওরে আপনার কাছে দিয়া দিলাম।”
মেহবিন ওনার হাত ধরে বলল,,
“কিছু হবে না আপনার। দেখুন সবাই এসে গেছে আপনাদের দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো।”
“আপনি তাজেলরে দেইহেন ডাক্তার।”
বলতেই বলতেই তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। মেহবিন চেক করে দেখলো তিনি মারা গেছেন। ও এক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তাজেলের দিকে নজর পরতেই ও তাজেলকে কোলে নিয়ে দৌড়াতে লাগলো। ততক্ষণে তাজেলের পরিবার রাস্তায় এসেছে। নওশি কে দেখে ও তাজেলকে ওর কাছে দিয়ে বলল,,
“আমি গাড়ি নিয়ে আসছি ”
মেহবিন এক মিনিটের মধ্যেই তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরিয়ে নওশির সামনে থামলো। মেহবিন দরজা খুলে ভেতরে আসতে বলল। মেহবিন যত দ্রুত পারলো গাড়ি চালিয়ে হাসপাতাল এলো। ও তাজেল কে চোখ খোলা রাখতে বলছিল বারবার। তাজেল ও অসহায় ভাবে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে ছিল। মেহবিন তাজেল কে কোলে নিয়ে ভেতরের দিকে দৌড় দিল আর বলতে লাগলো,,
“নেত্রী চোখ খোলা রাখো। এই যে তোমার ডাক্তার তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে কিছু হবে না তোমার। যাই হোক না কেন নেত্রী তুমি কিন্তু তোমার ডাক্তারকে ধোঁকা দেবে না।”
মেহবিন লিফটের এখানে এসে দেখলো লিফট ওপরে উঠে গেছে। ও দেরি না করে সিড়ি দিয়েই উঠতে লাগলো। তিন তালায় সবকিছু আছে। ও এসে দুজন নার্সকে ডাকলো আর বলল ইমার্জেন্সি। মেহবিন নিজেই তাজেলের ট্রিটমেন্ট শুরু করলো ওর হাত পা কাঁপছিল তবুও ওর নেত্রীর কথা ভেবে শুরু তো করে দিল ও তেমনভাবে আজ পারছিল না। তখন নার্স দেখে অন্য ডাক্তার ডেকে আনে। ডাক্তার আসতেই মেহবিন তাকে ট্রিটমেন্ট করতে বলে। সমস্ত সময় মেহবিন তাজেলের হাত ধরে ছিল। ডক্টর নার্সরা বলল ওকে সরতে কিন্তু মেহবিন একটুও সরলো না। তাজেলের মাথায় প্রচন্ড জোরে আঘাত লেগেছে একটা হাত আর পা ভেঙ্গেছে। ওকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হলো। মেহবিন ওর সাথেই ছিল। অতঃপর ঘন্টা দুয়েক পর তাজেলের অপারেশন সাকসেসফুল হলো কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে তাজেলকে আর বাঁচানো যাবে না। মেহবিন সবকিছুই বুঝতে পারলো তবুও যেন কিছুই বুঝলো না। ওকে কেবিনে শিফট করা হলো। বাইরে এসেই দেখলো নওশি আর নওশির মা। মেহবিন ওদেরকে তাজেলের কথা বলল নওশিদের বলল বাড়ি চলে যেতে আর তাজেলের বাবার দাফন করে ফেলতে। মেহবিন কিছু টাকাও দিল যাতে তাজেলের বাবার দাফনে কোন সমস্যা না হয়। কারন তাজেলের বাবার সাথে তার ভাইদের সম্পর্ক ভালো নয়। ওরা চলে যেতেই মেহবিনের খুব একা লাগলো। ওর ভিশন তাজেলের কথা মনে পরছে। ও তাজেলের কেবিনে গেল আর তাজেলের হাত ধরে শান্ত স্বরে বলল,,
“তুমি সবসময় আমাকে বলতে আমি যেন তোমাকে ধোঁকা না দিই। আজ বলছি নেত্রী আমি তোমায় কখনো ধোঁকা দেব না। আমাকে ধোঁকা না দেওয়ার কথা বলে তুমি কেন আমাকে ধোঁকা দিতে চাইছো নেত্রী? তুমি জানো তোমার মতো করে এই তোমার ডাক্তারের কেউ খেয়াল রাখে না। তুমি যদি তোমার ডাক্তারকে ধোঁকা দাও তাহলে তোমার ডাক্তারের খেয়াল রাখবে কে? তোমার মতো।”
এটুকু বলতেই মেহবিনের কাছে একজন নার্স এসে বলল,,
“ম্যাম আপনার ফোন এসেছে?”
মেহবিন মাথা উঁচু করে তার দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আমার ফোন তো আমার সাথে আনিনি তাহলে?”
“আপনার কেবিনের ল্যান্ড লাইনে আমি একটা ফাইল আনতে গিয়ে দেখলাম আপনার ফোন বাজছে। ধরলাম পরে আপনাকে চাইলো বলল খুব ইমার্জেন্সি।”
‘ঠিক আছে আপনি যান আমি যাচ্ছি।”
নার্সটা চলে গেল। মেহবিন তাজেলের হাত ছেড়ে ওর কেবিনে গেল। আর ফোন কানে নিয়ে বলল,,
‘হ্যালো?”
“কেমন হবে যদি? তোমার মায়ের মতো তোমার আরেকজন প্রিয় মানুষ তোমায় ছেড়ে চলে যায়।”
“নিশাচর!”
‘হুম আমি। আমার কেন যেন তোমার সুখ সহ্য হচ্ছিল না তাই এরকমটা করতে হলো।”
ওর জন্য আজ তাজেলের এই অবস্থা দেখে ও পাথরের মতো হয়ে গেল। ওর ভেতরে রাগের উন্মোচন হলো। ও চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,,
“এই ছোট্ট বাচ্চা আর ওর বাবা কি ক্ষতি করেছিল তোর যে তুই এরকমটা করলি।”
“না তারা কোন ক্ষতি করেনি তবে তোমার সাথে বাচ্চাটার খুব ভালো সম্পর্ক তো তাই। আমি তো বাচ্চাটাকে আঘাত করতে চাইছিলাম শুধু কিন্তু বাচ্চাটার বাবা এসে গেল এখানে আমার কি করার।”
‘তোর নূন্যতম মনুষ্যত্ব নেই তাইনা? ওহ থাকবে কি করে? তুই মানুষ নাকি তুই তো মানুষ নামের পশু।”
“আজ যাই বলো না কেন?আমার গায়ে লাগবে না। কারন আজ আমি ভিশন খুশি।”
“নিশাচর!”
“আরে আস্তে আস্তে চিৎকার করো না। আচ্ছা তোমার মনে আছে আজকের মতো একটা রাতেই তোমার প্রিয়জন হাসপাতালে ছিল আর এবারের মতো সেবারও তুমি একা । এই মুহুর্তে যদি সেবারের মতো কিছু হয় তখন তুমি কি করবে? আচ্ছা আমি তো শুনেছিলাম তুমি ঘুমিয়েছিলে সেই সুযোগে তোমার মা দুনিয়া ছেড়ে চলে। যদি এবার ও তোমার অগোচরে কেউ চলে যায় তুমি তখন কি করবে। ইশশশ কি দুঃখ তাই না। কিন্তু কেন যেন তোমার দুঃখ আমায় অনেক আনন্দ দিচ্ছে।”
মেহবিন সব শুনে এক মিনিট চুপ রইলো তারপর বলল,,
“আমার ব্যাপারে যখন জেনে গেছিস। তাহলে এটাও শুনে নে কিছুদিন আগে শেখ সায়িদের সাথে যা হয়েছে সেটা আমারই কাজ। আমি ওর শরীরে হাত লাগাইনি তাই এই অবস্থা আর যদি হাত লাগাতাম তাহলে কি হতো। তৈরি থাক তোর সময় ঘনিয়ে এসেছে। তোকে আমি কি করবো আমি নিজেও জানি না।”
অপরপাশ থেকে হাসির আওয়াজ শোনা গেল। আর বলল,,
“আরে তোর কথায় আমি বেশ মজা পেলাম জানিস। কারন আমিই সায়িদকে মারতে চাইছিলাম ব্যাটা বেশ ধূরন্দর কিভাবে মারবো ভাবছিলাম কিন্তু তোর জন্য কাজটা সহজেই হয়ে গেল। আর আমার সাথে কি করবি তুই শুনি। আমি কে আমাকে তুই চিনিস? আমি তো নিশাচর যার নামতো সবাই শুনেছে কিন্তু কেউ দেখেনি এরকম ভাবে আমি সবার সাথে চলাচল করি। যাই হোক সেসব বাদ!
এইটুকু শুনে মেহবিনের হাত শক্ত হয়ে এলো। কিন্তু ও জোশে হুশ হারানো মেয়ে নয় তাই ও কিছুই বললো না। তবে এইটুকু বলল,,
“এতো তাড়াতাড়ি বাদ দিলে চলে নাকি নিশাচর। নিজের নতুন অভিজ্ঞতার জন্য তৈরি হয়ে নে। কে জানে কখন কি হয়।”
মেহবিনের কথা আমলে না নিয়ে নিশাচর বলল,,
“হ্যা তা ঠিক কে জানে কখন কি হয়। দ্যাখ মনে কর সেই উনিশ বছর আগের কথা সেদিন ও তুই একা, হাসপাতালে তোর প্রিয়জন। আজ ও তুই একা আর আজকেও তোর প্রিয়জন হাসপাতালের বেড এ। আচ্ছা সেবারের মতো কিছু এবার হলে মন্দ হয় না কি বলিস। ইশশ বেচারি মেহেরুন নিসা ঘুমের মধ্যেই পরপারে চলে গেল। মেয়েটাকে রেখে ইশশ মেয়েটা মরা মায়ের বুকেই শুয়ে ছিল কি দুঃখ কি দুঃখ।”
বলেই ফোন কেটে দিল। মেহবিনের পুরোনো কথা শুনে হাত পা কাঁপতে লাগলো। ওর পুরোনো সেই দিনটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। ওর ভিশন একলা ফিল হচ্ছিল ও কাউকে ওর পাশে চাইছিল। ওর ভয়গুলো চারপাশে দানা বাঁধতে শুরু করলো। ও তাড়াতাড়ি করে তাজেলের কেবিনে গেল আর তাজেলের হাত ধরে বলল,,
“এই নেত্রী তুমিও কিন্তু মায়ের মতো আমাকে ধোঁকা দিও না। এই যে তোমার ডাক্তার তোমার হাত ধরে আছে তোমাকে কোথাও যেতে দেবে না। আমি তোমাকে মায়ের মতো হারাতে চাই না। কারো স্বার্থপরতার কাছে তোমায় বিলীন হতে দিতে চাই না। মনে রেখো তোমার ডাক্তার তোমার অপেক্ষায় আছে। তোমাকে ফিরতেই হবে নেত্রী।
মেহবিন আরো কিছুক্ষণ কথা বলল তারপর চুপ হয়ে গেল। আর এক দৃষ্টিতে তাজেলের দিকে তাকিয়ে রইল। কখন কোথা দিয়ে ওর সময় চলে গেছে ও টেরই পায় নি।
******
বর্তমান,,
মেহবিনের আজকের সবকিছু মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। ও পরে যেতে নিল। না অজ্ঞান হয়ে নয় জ্ঞান থেকেই। যে লোকটা ওকে জড়িয়ে ধরে ছিল সেও শক্ত করে ধরলো। মেহবিন নিজেকে সামলে বলল,,
“চলে যান এখান থেকে আমার কাউকে দরকার নেই।নিশাচর ও তার সাগরেদদের তোলার ব্যবস্থা করুন। তাদের শাস্তি দেওয়ার সময় এসে গেছে। অনেক হয়েছে আর না এবার এসপার নয়তো ওসপার কিছু একটা করতেই হবে। আমাকে ভেঙে পরলে চলবে না কঠোর হতে হবে।”
বলেই মেহবিন সামনের জনকে সরিয়ে দিল। তাকে সরিয়ে দিলেও তার মুখে অদ্ভুত হাঁসি। তারমানে সে মেহবিন কে সামলাতে পেরেছে। কিছু না বলেও। এইটুকুই মেহবিন চাইছিল কেউ ওকে সামলে নিক। লোকটা বলল,,
“ওকে পার্টনার। আর হ্যা মেহবিন মুসকানকে কঠোরতায়ই মানায় দূর্বলতায় নয়। ইনশাআল্লাহ আপনার নেত্রীর কিছু হবে না। নিজের পোষাক ছেড়ে নিন। আর অন্য একটা পোষাক পরিধান করুন যা আপনি শাস্তিঘরে পরেন।”
“মানে?”
‘আমি আপনি বলার আগেই তাদের তুলে নিয়েছি এখন শুধু তাদের শাস্তি দেওয়ার পালা।”
“তাদের শাস্তি আজ নয় সাতদিন পর হবে। আগে আমার নেত্রী একটু সুস্থ হোক। এতদিন পর্যন্ত তাদের না হয় কারেন্ট খায়িয়ে আর পচা ডোবায় চুবিয়ে বাঁচিয়ে রাখুন। সাথে একটু পোড়া রুটি আর নুন।”
“আপনার বলতে হবে না আমি তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছি।”
‘এতো বছর পর আপনাকে একটা কাজ করতে হবে বুঝেছেন পার্টনার।”
“আপনি শুধু বলুন আমি আছি।”
কথাটা শুনে মেহবিনের মুখে অদ্ভুত হাঁসি ফুটে উঠলো। তা দেখে সামনের মানুষটার ও মুখে হাঁসি ফুটে উঠলো। এতোক্ষণ মুখর অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলেও এবার সে এগিয়ে এলো। সেই সাথে সকলেই কেউ কিছু বলবে তার আগেই লোকটা তাড়াতাড়ি করে চলে গেল। মুখ ঢাকা দেখে কেউ দেখতে পারলো না। মুখর মেহবিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,
“মেহু?”
মেহবিন মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আমার নেত্রীর কিছু হবে না তাই না কাব্য?”
হুট করে তাজেলের কথা শুনে মুখর থমকে গেল। ও বুঝতে পারছিল না হাসপাতালে কে আছে কিন্তু মেহবিনের একটা কথায় ও বুঝে গেল কে হাসপাতালে। মুখরের চোখ ছলছল করে উঠলো। ও সব ভুলে মেহবিন কে জড়িয়ে ধরলো। আর বলল,,
“ইনশাআল্লাহ কিছু হবে না নেত্রীর। তার ডাক্তারের ভালোবাসা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে।”
মেহবিন কোন রিয়াক্ট করলো না। শান্ত ভাবে বলল,,
“আপনি কি দাদিজানের মতো আমার ওপর রাগ করেছেন কাব্য?
মুখরের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো। ও বলল,,
‘না যাওয়ার জন্য একটুও রাগ করিনি বিহঙ্গিনী। তবে এখন যে রাগ করতে ইচ্ছে হচ্ছে কারন তুমি নেত্রীর পাঞ্জাবি ওয়ালার কাছে নেত্রীর খবর পৌছাও নি।”
“সবার আমার ওপর রাগ করার অধিকার আছে কাব্য আমার কেন নেই। আপনি জানেন আমারও ভিশন রাগ হচ্ছে নেত্রীর ওপর কেন সে আজ রাস্তায় বেরিয়েছিল আর কেনই বা তার বাবার হাত ধরে লাফাতে লাফাতে মেলায় যাচ্ছিল। সে রাস্তায় না বের হলে তো এসব কিছুই হতো না তাই না।আপনি জানেন আজ ওর বাবা মারা গেছে। আর ওর শরীর দিয়ে কতো রক্ত পরছিল। আজ তো ওর রক্ত দেখে মনে হচ্ছিল আমার ও মিশুর মতো রক্তে ফোবিয়া আছে। আপনি জানেন আমি সর্বক্ষন নেত্রীর হাত ধরেছিলাম। আপনারা আসার আগ পর্যন্ত যাতে নেত্রী আমায় ধোঁকা না দিতে পারে।
মেহবিনের কথাগুলো আজকে বাচ্চাদের কথার মতো লাগছে। মুখর টের পাচ্ছে তার বিহঙ্গিনী ভয় পাচ্ছে। তাই সে বলল,,
“ভয় পেও না বিহঙ্গিনী তোমার নেত্রীর কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ।”
মেহবিন মুখর কে ছেড়ে বলল,,
“আরে আমি তো ভুলেই গেছি নেত্রী একা আছে ওর কেবিনে। আপনি বাড়ি চলে যান কাব্য।”
বলেই মেহবিন হাঁটা ধরলো। মুখর দুই তিনবার ডাকলো কিন্তু মেহবিন সাড়া দিল না। মুখরের চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। ওর তাজেলের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে পরলো। ওর কানে বেজে উঠলো,,
‘পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা তোমার কথা হুনলে আমার শরম করে।”
মুখর না চাইতেই একটু পুরোনো কথা ভেবে হেঁসে উঠলো। তবে মুহুর্তেই এখনকার কথা মনে পরে হাঁসি গায়েব হয়ে গেল।ও এগুতে যাবে তখন মাহফুজ শাহরিয়ার বললেন,,
‘কোথায় যাচ্ছিস?
“নেত্রীকে দেখতে। আচ্ছা তোমরা এর আগে এই মেহু কে দেখো তাই না। আমিও দেখি নি তবে আজ দেখলাম।”
‘নেত্রী কে?”
“মেহুর নেত্রী!”
“মানে?”
‘চলো বসো আজ ডাক্তারের নেত্রীর গল্প শোনাই তোমাদের। এই মুহূর্তে মেহুকে ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না। কারন ও বাকিদের মতো নয় ওর সান্তনাও পছন্দ নয়।
মুখর সবাইকে নিয়ে বসলো আর একে একে নেত্রীর সব বলতে লাগলো। প্রথম প্রথম সবাই খুব হাসলো কিন্তু শেষে এসে সবার মন খারাপ হয়ে গেল।সবাই বাইরে থেকে মেহবিনের নেত্রীকে দেখে এলো। মেহবিনের জন্য সবার খারাপ লাগল।মুখর সবাইকে বাড়ি চলে যেতে বলল। তখন আছিয়া খাতুন বললেন,,,
“মুখর আমার নাতবউ রে ছাড়া তুই শাহরিয়ার ভিলায় পা রাখবি না। আর ডাক্তারের নেত্রীরেও কিন্তু লগে নিবি।”
মুখর বলল,,
“ঠিক আছে!”
সবাই যেতেই মুখর মেহবিনের কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলো। আর বলল,,
“বাইরে চলো ড্রেস চেঞ্জ করে নাও।”
মেহবিন মাথা তুলে বলল,,
“বৃষ্টি কি এখনো আছে?”
“হুম! থেমেছিল একবার এখন আবার এসেছে।
মেহবিন মুখরকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেল। আর সোজা ছাদে চলে গেল। বেশ জোরেই বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে থেমেছিল সেই সুযোগে শাহরিয়ার পরিবার সবাই চলে গেছে। মেহবিন ছাদে উঠে ছাদের মাঝখানে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে চিৎকার করতে লাগলো। মুখর মেহবিনের পেছনেই এসেছিল। মেহবিনকে চিৎকার করতে দেখে ও গিয়ে মেহবিনকে জড়িয়ে ধরলো। মেহবিন তাও জোরে জোরে চিৎকার করলো। কারন ও কাঁদতে পারছে না ভেতরে সব কষ্ট জমে গেছে তাই চিৎকার করে কমানোর চেষ্টা করছে। একটা সময় মেহবিন বলল,,
“আপনি আমার দূর্বলতা এটা যেন নিশাচর না জানে এই জন্য আমি আপনাকে সবার আড়ালে রাখতাম। কিন্তু আমি নেত্রীকে পারি নি ওর ভালোবাসা আমাকে কারো থেকে আড়াল করতে দেয় নি। এই জন্যই তো নিশাচর আমার দূর্বলতায় আঘাত করলো কাব্য। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আমার জন্য আজ নেত্রীর এই অবস্থা যা আমায় ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিচ্ছে কাব্য। আমি নিজেকে কি করে ক্ষমা করবো। আমার মা বলেছিল আমার দ্বারা কারো ভালো ছাড়া যেন ক্ষতি না হয়। আর আজ আমার জন্যই আমাকে এতো ভালোবাসার মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে। এটা আমি মেনে নিতে পারছি না।”
এদিকে,,
একটা লোক হাত পা বাঁধা অবস্থায় ও হাসছে আর বলছে,,
“আমি জানতাম মেহবিন মুসকান শাহনাওয়াজ। তুমি আমায় খুব তাড়াতাড়ি ধরে ফেলবে এই জন্যই তো শেষ চালটা চাললাম। এইবার আমি কিছুই করিনি যা হওয়ার একাই হয়েছে। তবে তোমাকে অথৈ সাগরে ভাষানোর জন্য মিথ্যা গুলো বলতে হলো। এবার তুমি নিজেই নিজের কাছে অপরাধী থাকবে। আর সারাজীবন বয়ে বেড়াবে। আমি যদি মারাও যাই তবুও তোমায় শান্তিতে বাঁচতে দেব না। সেই ব্যবস্থায় করেছি এবার। তবে তোমাকে কে সাহায্য করছে এটাই বুঝতে পারছি না। কে আছে তোমার পেছনে মেহবিন মুসকান শাহনাওয়াজ?
~চলবে,,
বিঃদ্রঃ আজকে কেন যেন সকাল থেকে কিছুই ভালো লাগছে না। লেখাতেও মন বসাতে পারছিলাম না পর্বটা অগোছালো হতে পারে এই জন্য দুঃখিত। ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।