#মন_শহরে_বসন্ত_হাওয়া |১১|
#কে_এ_শিমলা ® |২৩০০+শব্দসংখ্যা|
সে রাতটা কেটে যায় রণয়ীর অঘুমে। জড়োবস্তুর মতো পড়েছিল ছাদের এক কোণে। অন্যসময় হলে ভয় লাগতো তাঁর। কিন্তু সে রাতে ভয় পায় না। পূর্ণ চাঁদ! চাঁদের আলোয় আলোকিত আশপাশ। ভেতর থেকে ছাদের দরজা লাগিয়ে দিয়েছিল বিধায় কেউ খুলতে পারেনি। চেয়েও যেতে পারেনি তাঁর কাছে। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে রক্তিম বর্ণের চোখমুখ নিয়ে নিচে আসে। বিধ্বস্ত রুপ বদলে স্বাভাবিক হয়। সুন্দর করে শাড়ি পড়ে। নিজের ব্যবহারাদি যাবতীয় সব গুছিয়ে বাসায় পাঠায়। পার্সেলে খাবার আনায়। ডাইন ইন টেবিলে বসে সবার আগেই খায় একা একা। আটটা সাড়ে আটটার দিকে নূরা আসে। রণয়ী কে এমন স্বাভাবিক অবস্থায় দেখে বড্ড বেশি অবাক হয়। কী সুন্দর ফিটফাট করে শাড়ি পড়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে টেলিভিশন দেখছে। যেন রাণী বসে আছেন। হাতে একটা কফির কাপ। খোঁপা করা চুলে গাজরা, গোলাপ গুঁজে দিয়েছে। সতেজ গোলাপের সুবাস আশেপাশে ছড়িয়ে ছিল তাঁর। দুটি বেলী ফুল! ঘ্রাণে মম করেছিল তাঁর আশপাশ। সোফায় বসে নূরাও সেই সুঘ্রাণ পাচ্ছিল। তাঁর গায়ের দামি কড়া পারফিউমকে ও হারায় মানায় সে ঘ্রাণ। তাঁর দিকে ভুলেও তাকায় না রণয়ী। যেন সে তাকে দেখতেই পায়নি। অপলক চোখ তার টেলিভিশনের পর্দায়।”
সময় ঘনিয়ে আসে। ডিভোর্স পেপার রক্তিম তাঁর সামনে এনে রাখে কম্পিত হাতে। নূরার মতো সেও অবাক রণয়ী কে এমন স্বাভাবিক অবস্থায় দেখে। যে মেয়ে গতকাল রাতেও চিৎকার করে পাগলের মতো কাঁদছিল। এক রাতের ব্যবধানে সে এমন নিশ্চুপ স্বাভাবিক। শোক কাটিয়ে উঠতে পেরেছে কী না সন্দেহ! সেই মেয়ে সকাল সকাল পরিপাটি হয়ে বিরিয়ানী আনিয়ে খায়। অবাক করার বিষয়ই বটে। রক্তিমের ডিভোর্স পেপার রাখতে দেড়ি রণয়ীর সে পেপার কাছে টেনে সই করতে দেড়ি হয় না। সই করার পর পরই একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মাথা ঝাঁকিয়ে অতঃপর উচ্চ শব্দে হেসে উঠে। সে কী নজরকাড়া হাসি।”
রক্তিমের বিস্মিত বিবর্ণ মুখাবয়বের পানে দৃষ্টি রেখে বলে, কী ভেবেছিলেন! রাতে কেঁদেছি বলে এখনো কাঁদবো? আপনার বেইমানির জন্য নিজেকে পাগলের মতো করে রাখবো? আমি পাগল হয়ে যাবো? ওহে প্রতারক পুরুষ! আপনাকে হারানোর আগে কেঁদেছি ঠিক। আর সেটাই ছিল আমার শেষ কান্না। আপনাকে হারানোর পরে আর আমি কাঁদবো না। উহু প্রশ্নই আসে না। কাঁদা তো তাঁর জন্যই যায়, যে ফাঁকি দিয়ে খোদা তায়ালার কাছে চলে যায়। কোনো বেঈমান প্রতারকের জন্য কান্না সাজে না। আর আমি এই রণয়ী রহিমের তো একদমই না। আমি বলছি আপনাকে শুনুন। আপনাকে হারানোর শোকে পাথর হয়ে কাতর হয়ে পড়ে রইবো না আমি। যোগ্যতা অর্জন করবো। যতটা যোগ্যতা অর্জন করলে আপনি আমার যোগ্য থাকবেন না।”
স্যরি বাট নট স্যরি! আপনার মতো মানুষ আমার যোগ্য কিংবা আমার ভালোবাসা পাওয়ার নূন্যতম যোগ্যতাটুকুও রাখে না।”
আপনাকে চাইলেই পুলিশ ফাঁড়ি জেলখানায় দৌড়াতে পারতাম। কিন্তু কী বলুন তো। টাকায় মুক্তি পেলে পেয়েও যেতে পারেন। আমি তো আপনার সমাপ্তি দেখতে চাই। সুখী! কতটা সুখী হোন দেখতে চাই। আর যে আমার হয়ে থাকতে চায়না। আমি তাকে কোনোকিছুর ভয় দেখিয়ে রাখতে চাইনা। বেহায়া হতে পারি কিন্তু কোনো বেঈমান কে ধরে রাখার জন্য কোনো বেহায়াপনার কোনো স্থান আমার মাঝে নেই।”
‘তুমি ভালো থেকো।”
ইনশাআল্লাহ! ভালো আমি অবশ্যই থাকবো। তবে শেষবারের মতো কিছু কথা বলি শুনুন।
‘একজনের অতীত আছে জেনেও, কেউ কাউকে খুব ভালোবাসুক।
কিন্তু আপনার মতো মানুষ কে নয়।”
দ্বিতীয়বারেও কাউকে কেউ খুব ভালোবাসুক! নতুন ভালোবাসার সুখে হৃদয়, জীবন সুখময় করুক।
কিন্তু আপনার মতো মানুষ কাউকে দ্বিতীয়বার ভালো না বাসুক।”
আপনি ভালোবাসি বলেও ভালোবাসতে পারেননি দ্বিতীয়া কে। কদর করেননি তাঁর। সত্যি বলছি আমি! অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে, ছলনাময়ী প্রথমার কাছে যাওয়া আপনার মতো মেরুদন্ডহীন! আত্মসম্মানহীন পুরুষ কাউকে ভালো না বাসুক।”
শুনো! ওহে নিটুর প্রতারক পুরুষ,
‘তুমি প্রথমার সাথে ভালো থেকো
দ্বিতীয়া কে ভুলে!
কেঁদো না পুনরায়, হারিয় না সর্বশ্ব
ফের ছলনাময়ীর ছলে।”
‘অভিশাপ দিচ্ছি তোমায়! তুমি না হয় ভালোই থেকো। তবে শুনো তোমার মতো পুরুষ!
‘তোমরা অঙ্গীকারবদ্ধ হও ঠিক! তবে রক্ষা করতে জানো না। তাই দয়া করে প্রথমে হেরে গেলেও, মেরুদন্ডহীন হলে কাউকে দ্বিতীয়বার ভালোবেসো না।”
‘ভালো থাকবেন মিস্টার রক্তিম হাসান! ওরফে আমার জীবনের বেঈমান পুরুষ।”
রক্তিম দ্রুত পদে নিজের ঘরে চলে যায়। বুকের ভেতরটা জানি কেমন করছে আজ। এতো তিক্ত কথা! এই নরম মানবীর মুখে শুনে বিষাক্ত লাগছে তাঁর।”
রণয়ী তাঁর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে তাচ্ছিল্য হাসে। রাহিমা সুলতানার গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে যেন। রাজিবুল হাসান নিরবে চেয়ে দেখছেন। এতো কঠোর মানবীও এতোটা নরম ছিল শুধু ভালোবাসার জন্য। কেন যেন মনে হচ্ছে আজ। মেয়েটা আগে ঠিকই ছিল। যাকে হারানো উচিত নয়। তাকেই হারালো ছেলে! হারালেন উনারা। তিনিও উঠে চলে গেলেন ঘরের দিকে। ধাঁধায় ফেলে গেল মেয়েটা। মেনে নিয়েও দূরে ঠেললেন। আফসোস হচ্ছে? নাকি সামনে হবে।”
রণয়ী কঠিন দৃষ্টিতে রাহিমা সুলতানার দিকে তাকালে তিনিও চলে যান স্বামীর পিছু পিছু। কম কিছু তো করেননি তাঁর সাথে। যদি প্রতিশোধ নিতে মাত্রাতিরিক্ত কিছু করে বসে বা বলে ফেলে তবে তো মান সম্মান শেষ। কিন্তু মান থাকলেই না যায়।”
ড্রয়িংরুম ফাঁকা। রণয়ী সোফা থেকে সাইড ব্যাগ তুলে নিল। হাতের রিমোট ছুড়ে মারলো টেলিভিশনের দিকে। নূরা মজা লুটতে খুঁচিয়ে বললো, ‘কারো ভালোবাসা কেড়ে নিলে এমনই হয়।”
এই মেয়ের সাথে বুঝাপড়া বাকি ছিল। কিছু সত্য তাকে জানিয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে হলো রণয়ীর। তাই ঘুরে বুকে হাত ভাঁজ করে বললো, ‘কেড়ে আমি নিয়েছি নাকি তুমি? টাকাওয়ালা ছেলের হাত ধরে তো খুব চলে গিয়েছিল। প্রেমিক! পাঁচ বছরের সম্পর্ক রেখেও। আর ফিরে এসে এক নারীর স্বামী সংসার নিলে। এখন দেখো তো হিসেব কষে, কেড়ে নিয়েছে কে? পারবে কীভাবে সত্য বুঝতে? পড়েছো তো ঠিকই লাখ লাখ টাকা খরচা করে প্রাইভেট ভার্সিটিতে। নূন্যতম বিষয় সম্পর্কেও তো ধারণা নেই। অন্যের ঘাড়ে পা রেখে বিদেশবাড়িও ঘুরে এসেছো। কত পুরুষের কাছে গিয়েছো কে জানে।”
‘এই মেয়ে মুখ সামলে কথা বলো। বেয়াদব কোথাকার।”
‘এই চুপ! সত্য হজম হয় না তাই না। আমি বেহায়া নারী দেখেছি। কিন্তু তোমার মতো বেহায়া, আত্মমর্যাদাহীন মেয়ে দেখিনি। আমিও ভালোবাসা! ভালোবাসার মানুষ কে পাওয়ার জন্য বেহায়াপনা করেছি। অবুঝপনা করেছি। কিন্তু তোমার মতো অবৈধভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেইনি। শুনো তুমি কেড়ে নিয়ে যদি সুখীও হও, তবে হয়ে যাও। চাইলে কলঙ্ক তোমার আমি পুরো শহর জানাতে পারি। কিন্তু তোমার মতো নিচ আমি নই। বিচার তো তোমার বিধাতা করবেন।”
‘তোমার থেকে আমি কেড়ে নেইনি। লাইব্রেরীতে যেভাবে একটি বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে একজন পড়ার জন্য বেছে নেয়। কিন্তু পড়ে না রেখেই চলে যায় অন্য বইয়ের কাছে অন্য কিছুর খোঁজে। তুমিও তেমন করেছো। রক্তিম তোমার নয় আমার পঠিত বই। নতুন বই পেয়েও তুমি পড়োনি। কিন্তু আমি তা সংগ্রহ করে পড়েছি। আমার পঠিত পুরাতন বই তুমি নিয়েছো। সমাপনে দেখছো তো বই কী করলো? কেঁদো না আমার মতো বইয়ের সমাপ্তি পড়ে তুমিও।”
‘আশ্চর্য! তোমার সাথে কেন এভাবে নরম ভাষায় কথা বলছি আমি? তোমার সাথে কীসেরই বা বোঝাপড়া আমার। এক নষ্ট*র সাথে আমি রণয়ীর কথা বলা সাজে না।”
‘এই মেয়ে! তুমি নষ** কাকে বলছো হ্যাঁ! তোমাকে আমি।”
হাত উঠাতে গেলে রণয়ী ধরে নেয় তা। মুচড়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষ্ট করে বললো, ‘কেন রে! নিজের সত্য নিজেই এতো জোর দিয়ে বলছিস লজ্জা করছে না? ভুলে গেলি সব। বেয়াদব তুই না আমি দেখিস। চরিত্রহীন! এক চরিত্রহীনের সাথে আরেকজনকেই মানায়। তোর জন্য শুভকামনা রইলো। সংসার কর! প্লিজ বিয়েটা করে অন্তত সংসার করিস। পাপ কত করবি আর? আর বিয়ের পরেও কাকে আর ফাঁসাতে পারিস দেখিস।”
ঝাড়া দিয়ে নূরার হাত ছেড়ে তাকে ধাক্কা মেরে সোফায় ফেলে রণয়ী জুতোর কটকট আওয়াজ তুলে বড় দুয়ার দিয়ে বেড়িয়ে গেল। নূরার প্রচন্ড রাগ হলেও নিজেকে সামলে নিল। আজ খুশির দিন। এই মেয়ে শোকে পাথর হয়ে এসে বলে গিয়েছে।”
দিন কাটে রণয়ীর উদাস দৃষ্টিতে আকাশ পানে চেয়ে। পিপাসায় যেমন ভেতর ছটফট করে! তেমনি ব্যথায় বিষিয়ে উঠেছিল তাঁর ভেতরখানাও। ভালোবাসার মানুষ সে! বলেছিল কাঁদবে না। কিন্তু মন ও যে বেঈমানি করে। হৃদয় আকুলতায় ব্যকুলতায় কাঁদে। হৃদয়ের মেঘ বৃষ্টি হয়ে বর্ষিত হয় চোখজোড়ায়।”
বিচ্ছেদের শোক কাটিয়ে না উঠার মধ্যেই, পিতৃ বিয়োগের শোকে মৃত প্রায় রণয়ী। পরিবারে শোকের ছায়া তো নেমে আসেই। সাথে রণয়ী অধিক শোকে পাথর। সারাদিন দরজা বন্ধ করে ঘরে পড়ে থাকতো। মন মেজাজ কারোরই ভালো নেই। তাই কেউ খোঁজ ও রাখতো না। সেই ভাবী দু’জন অবশ্য আগলে রাখে তাকে। অসুস্থা সেড়ে খানিকটা ভালো হয়ে রহমান রহিম ছোট ছেলেকেও নিজের পছন্দের মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করিয়ে দিয়েছিলেন। আরো বছর দেঢ় দুই আগেই।”
মানুষ মরণশীল। যতদিনের আয়ু ততোদিনই এ ধরার অতিথি। তাঁরপর চির বিদায় নিয়ে চলে যেতে হয়। তবে সেই চলে যাওয়াতে ভেঙ্গে পড়ে আপনজনেরা। সময়ে অসময়ে তাদের চোখজোড়া ভিজে। আরো যদি হোন তিনি বাবা! তবে সন্তানের আহাজারি বাতাসেও প্রতিধ্বনি তুলে। প্রিয়তমা স্ত্রী কাঁদেন গুমরে গুমরে। অপেক্ষা কবে যাবেন তিনিও প্রিয়তমের কাছে। সবকিছু নিয়েই সামনের দিন গুলোতে চলতে হয়। একজনের বিয়োগে সবাই তো আর থেমে থাকবে না। থাকার কথাও নয়। তেমনি রহমান রহিমের মৃত্যুর দুই মাসের মধ্যেই বদলি হয়ে যায় রনকের। তাকে অপারগ হয়ে ঢাকায় যেতেই হয় মা কে এমন পরিস্থিতিতে! বোনকে এমতাবস্থায় রেখে! পুরো পরিবারকেই কে এমন পরিস্থিতিতে রেখে। একটি মাত্র শাখায় সে কাজ করতো। এখন বড় মূল অফিসটাতেই তাকে ডাকা হয়েছে। প্রমোশন! এমন সুযোগ কে হাত ছাড়া করবে? তাই রাবিয়া খানম নিজেই পূত্র এবং পূত্রবধূ সহ নাতি নাতনিদের পাঠিয়ে দেন। চেয়েছিলেন রণয়ী কেও তাদের সাথে পাঠাতে। যদি মেয়েটা একটু ভালো থাকে তো সেখানে গিয়ে। কিন্তু তাঁর যে মাস্টার্সের ক্লাস। তাই থেকে যেতে হয় মা মেয়েকে ও রাজশাহীতে রামিনের সাথে।”
অতঃপর বছর কাটে। রণয়ীর মাস্টার্স কমপ্লিট হলো। ঢাকায় চলে এলো মা কে নিয়ে। তারপর থেকে চাকরী দেখতো। চাকরী করবে কী না। তা নিয়ে অবশ্য রনক কোনো কথা বলেনি। যদি ইচ্ছে হয় করো। নয়তো এক বোনের খরচাপাতি দিতে কোনো সমস্যা নেই। আর কম ও নয় রনকের। দুই ভাই কী পারবে না মা বোনের দায়িত্ব বহন করতে? তবুও তাঁর যখন ইচ্ছে কিছু বলে না রনক। কিন্তু বোনের দিকে তাকালে বুক ফেটে যায় তাঁর। ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরে বনুটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে ভুলে যা সব! শ্রেফ এক দুঃস্বপ্ন ভেবে। কিন্তু কোথাও একটা কিছু তাকে আটকে দেয়। এতো দিনের দূরত্বে সে পারে না আগের মতো হতে।তবে রনক রণয়ীর অগোচরে একজন ভালো পাত্র খুঁজে এখনো। তাঁর বিশ্বাস রণয়ীর জীবনে কেউ আসবে। সঠিক মানুষের আসাটা এখনো বাকি।”
অতীত সমাপন_____
‘এই রণয়ী!”
রোজার কথায় পেছন ফিরে তাকায় রণয়ী। বললো, ‘কী হয়েছে?”
‘আজ তুমি ফ্রি আছো? রাতে?”
‘কেন? ফ্রি তো থাকিই। বলো তুমি।”
‘আমার একটু বাহিরে যেতে হতো। কিছু কেনাকাটা প্রয়োজন। তোমার বাসার অদিকেই যাবো। তাই ভাবলাম তোমাকে বলি। একটু ঘুরেও আসা যাবে তাহলে। কী বলো তো! দিনশেষে তোমার মতো আমিও একা। তোমার তো পরিবার আছে। আমার তাও নেই। একা এই শহরে থাকতে হয়। কথা গুলো বলে ফিচেল হাসার চেষ্টা করলো সে।”
রণয়ী মৃদু হেসে বললো, ‘আমরা আছি না। আমরাই তো একটা পরিবার। শুধু রাতটাই বাসায় কাটে। দিন তো কাটে এখানে। আর সমস্যা নেই। আমি তোমায় যাওয়ার সময় বলে দেবো। আমারো কিছু কেনাকাটা প্রয়োজন। আজ না পারলেও কাল নিশ্চিত যাবো।”
‘আচ্ছা বেশ! স্যারের কেবিনে যাচ্ছো?”
‘হ্যাঁ এই ফাইল দুটো দিতে হবে।”
‘হুম! দেখলাম ফ্যাক্টরীর ম্যানাজার তিনজন একসাথে এলেন। বোধহয় তাদের সাথে আলোচনা।”
‘হ্যাঁ! আরো তিনদিন আগে আসার কথা ছিল। কিন্তু উনারা আসেননি। আজ আসলেন। কাল তো আবার হলিডে।”
‘হুম! আচ্ছা যাও তবে।”
বলে রোজা চলে গেল। রণয়ী অগ্রসর হয় দুর্জয়ের কেবিনের দিকে। বাহির থেকে অনুমতি নিল। ভেতর থেকে দুর্জয় অনুমতি দিলে প্রবেশ করলো সে। সম্মুখ চেয়ারে বসা তিনজন। দুর্জয় তাঁর আসনে। পাশেই আবু সাঈদ দাঁড়িয়ে। রণয়ী গিয়ে দাঁড়ায় এ পাশে। দুর্জয়ের দিকে ফাইল বাড়িয়ে দিলে। দুর্জয় দুটো ফাইল কাছে টেনে নেয়। একটি নিজের কাছে রাখে। এবং অপরটি আবু সাঈদের হাতে দেয়। আপাতত আবু সাঈদ দেখলেই হবে। রণয়ী স্বভাবসুলভ দাঁড়িয়ে রইলো। ভুল পেলে তো সংশোধন করে দিতে হবে।”
অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে নিজের অজান্তেই রণয়ীর শাড়ি সরে গিয়েছিল। শুভ্র উদর পাশ থেকে দৃশ্যমান। সেদিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রয় এপাশে বসা ম্যানাজার মুবিন। দৃষ্টি কাড়ে দুর্জয়ের। পায়ের রক্ত যেন মাথায় ছলকে উঠে। দাঁতে দাঁত পিষে ঠাস করে, ফাইল বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। রণয়ী ভরকে যায়। হলো কী হঠাৎ!”
দুর্জয় চেয়ার ছেড়ে উঠে রণয়ীর এপাশে এসে দাঁড়ায়। আড়াল হয়ে যায় রণয়ী। দুর্জয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে মুবিন ম্যানাজার কে। সে ভয় পেয়ে কপালের ঘাম মুছে। দুর্জয় মনে মনে আওড়ায়! ‘শালা দুই বাচ্চার বাবা হয়ে গেছিস! মেয়ে মানুষ দেখলে ঠিক থাকতে পারিস না। তোকে ম্যানাজার পদে দেওয়া তো ভুল হয়েছে। বিরাট ভুল।”
দুর্জয় এখানে দাঁড়িয়েই বললো, ‘আবু সাঈদ! তুমি শুরু করো।”
আবু সাঈদ নিজেকে প্রস্তুত করে কথা শুরু করলো। রণয়ী ওপাশে সরাতে দুর্জয় নিজেও খানিকটা সরে আসার সুযোগ পেল। ফাইলে আবার দৃষ্টি দিয়ে নিম্ন স্বরে যেভাবে রণয়ী শুনে বললো, ‘শাড়ি ঠিক করুন।”
জমে গেল রণয়ী বরফের ন্যায়। ভেতরে ধক করে উঠলো তাঁর। দ্রুত মাথা নিচু করে দেখলো উদরে। মুঠোবন্দী করে শাড়ি দিয়ে ঢাকলো উন্মুক্ত উদরের অংশ। রক্ত জমলো শুভ্র দু’কপোলে। উফফ! কেন খেয়াল ছিল না। দেয়াল ফাটল ধরুক। সে তাতে ঢুকে যাক। খুব করে চাইছে রণয়ী এই মুহুর্তে। স্বাভাবিক কথা। একজন বলতেই পারে। কিন্তু এই মানুষটা বলায় কেন এতো লজ্জা করছে? ঠিক যেন আজ থেকে আরো নয় সাড়ে নয় বছরের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। শুধু তুমির জায়গায় আপনি। ওড়নার জায়গায় শাড়ি। ‘ওড়না ঠিক করো! শাড়ি ঠিক করুন।”
ওহ এতো লজ্জা!”
দুর্জয় নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো। আবু সাঈদ খানিকটা থামলে রণয়ীর উদ্দেশ্যে বললো, ‘আপনি যেতে পারেন মিস রণয়ী রহিম।”
রণয়ী সেকেন্ডর মধ্যে উধাও হয়ে গেল। ভেতরে ভেতরে হাসলো দুর্জয়। আবু সাঈদ কে থামিয়ে সে নিজেই সহজ করে বুঝিয়ে দিল। ঘুমন্ত কোনো কর্মচারী কে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। সবাই কে পরিশ্রমী হতে হবে। এবং ফাকি দেওয়া, কাজে না আসা, অলস এদের তো ফ্যাক্টরীর ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেওয়া বারণ। সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে আলোচনা শেষ করলো। তিনজন সবকিছুর হিসেব বুঝিয়ে দিয়ে বের হলো অফিস থেকে। দুর্জয় সিসিটিভিতে দেখলো মুবিনের খুঁজে বেড়ানো দৃষ্টি। সে খুঁজছে অতিব সুন্দরী নারী কে। রাগে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিল দুর্জয়। আবু সাঈদ এলো আবার নতুন কয়েকটা ফাইল সাথে নিয়ে। দুর্জয় চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে আবু সাঈদের উদ্দেশ্যে বললো, ‘আবু সাঈদ!”
‘ইয়েস স্যার।”
‘নতুন ম্যানাজার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দাও। নয়তো যারা সিভি জমা করেছে তাদের মধ্য থেকে চার পাঁচ জন কে বাছাই করে ইন্টারভিউ নেওয়ার ব্যবস্থা করো।”
আবু সাঈদ অবাক হয়ে বললো, ‘কিন্তু স্যার পদ তো খালি নেই।”
‘মিস্টার মুবিন আউট। তাকে বলবে আগে চরিত্র ঠিক করে অতঃপর অন্য কোনো অফিস কোম্পানিতে চাকরি নিতে।”
আবু সাঈদ কথা বাড়ালো না আর। ঠিক আছে বলে ফাইল দেখাতে লাগলো। স্যার বলেছেন মানে অবশ্যই প্রয়োজনীয়। কেবিনে গিয়ে জানিয়ে দিতে হবে তাকে। এসব পুরুষরাও না। এবার পরিবারের কী হবে! বেয়াদব গুলো কোথাকার।”
নিয়মানুযায়ী সময় ঘনিয়ে এলো। রাত এখন আটটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। রণয়ী যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। রোজা এলো তাঁর কেবিনে। রণয়ী কিছু বলবে তাঁর আগেই মুখটা ভোতা করে বললো, ‘দূর কী বলেছিলাম। আজ বাহিরে যাবো। এখন কাজ। মেইল করে নাকি পাঠাতে হবে তাও রাত এগারোটায়। বের হলে আর কাজ হবে না।”
‘আজ তো আর পারবো না। আগামীকাল যাই। একদম নিশ্চিন্তে ঘুরতে পারবে।”
‘কাল অন্য কোথাও যাওয়ার প্লান ছিল। ভাই! এই কাজের জন্য ঘুরাফেরার শখ মেরে ফেলতে হবে।”
‘কী যে বলো না তুমি রোজা।”
‘যা সত্যি তাই বললাম। যাই প্ল্যান করি না কেন শেষে নাই। ভাবলাম তোমার জন্য সারপ্রাইজ থাকুক। এখন! কালকেই যেতে হবে।”
তাই! তাহলে দিনে যেখানে যেতে চেয়েছো যাও। সন্ধ্যার পর না হয় কেনাকাটা করতে যাও।”
‘এটাই ভাবছিলাম আমি। কিন্তু যেখানে যেতে চাই রাতে গেলে সুন্দর হতো। ভালো লাগতো। যাই হোক দেখি কী করা যায়। এখন তো তোমায় বলে দিলাম। না করবে না কিন্তু।”
রণয়ী কেবল হাসলো খানিকটা। বললো, ‘কথা দিতে পারছি না। পারলে অবশ্যই যাবো।”
দুজনে একসাথে বের হয়ে গেল অফিস থেকে। খানিকটা পথ গিয়ে দুইজন দুই রিকশায় উঠে চলে গেল নিজ নিজ বাসার উদ্দেশ্যে।”
চলবে!
“(অতীত শেষ! কিছু বাকি থেকে থাকলে অল্প অল্প করে বাঁকি পর্ব গুলোতে জানানো হবে। আর প্রশ্ন থাকলেও করে যাবেন। বর্তমান নিয়ে কয়েকটি পর্ব এরপর সমাপ্তি ইনশাআল্লাহ। চেষ্টা করবো রমজানের আগেই শেষ করতে।)”🥀