#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৯
ডঃ সাবিনা ইয়াসমিন এর তত্ত্বাবধানে এখন থেকে সারফারাজ শেহদাত থাকবে। কথাটি জানামাত্র সারফারাজ একটু ঘাবড়ে গেল। কারণ সে তো এতোদিন ডঃ শরিফুল ইসলাম এর তত্ত্বাবধানে ছিল কিন্তু কিছুদিন আগেই তিনি দেশের বাইরে গেছেন কোন একটা কাজে। আপাতত এখন তাকে ডঃ সাবিনা ইয়াসমিন এর তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। শুনেছে তিনি অনেকটা রাগী। সে অবশ্য তাকে এখনো দেখেনি যতটুকু লোকজন থেকেই জেনেছে। একটু ভয়েই আছে। সে একা নেই। তার সাথে আরো আছে শাহাদাত আর শুভ। হ্যাঁ, পরীক্ষায় পাস করবে না করবে না বলে ছাগল দুটো ঠিকই এমবিবিএস পাশ করে ফেলেছে আর এখন ইর্ন্টানশিপ ও করছে। আর বেশি দিন বাকি নেই। এই তো ছ’মাস হয়ে গেল। শাহাদাত গলা থেকে স্টেথোস্কোপ নামিয়ে টেবিলে রাখল। সারফারাজ টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একজন রোগীর ফাইল ঘাটছে। শুভ কফি নিয়ে হাজির। সারফারাজ মুচকি হেসে বলল, “খুব টায়ার্ড নাকি?”
কফির কাপ গুলো টেবিলে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল শুভ। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “সে আর বলতে, ইমার্জেন্সিতে আসা পেশেন্ট। কতো কষ্ট করতে হলো বল তো। ভাগ্য ভালো আল্লাহ হায়াত রেখেছিলো।”
শাহাদাত কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “ওই যে দেখে এলাম কান্নাকাটি করছে।
”হ্যাঁ রোগীর আত্মীয়! প্রথমবার হার্ট অ্যাটাক করল। পরিবারের সামলে উঠতে অনেক কষ্ট হবে।
“হুম। এ অবধি কতো মৃ/ত্যু দেখলাম কতো প্রিয়জনকে কাঁদতে দেখলাম। এখন এসব শয়ে গেছে।
শাহাদাত স্বরে বিরহের সুর পাওয়া যাচ্ছে। শুভ কিঞ্চিৎ ভেবে বলল, “বেড নং ২১ এর পেশেন্ট কি আর…
বাকি কথা বলতে হলো না। শাহাদাতের মলিন হাসি সমস্ত কিছুই বলে দিলো। শুভ নিশ্চুপ হয়ে কফি কাপে চুমুক দিলো। কিছুক্ষণ চারদিক ছেয়ে গেল নিস্তব্ধতায়। একজন ডাক্তার তার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করে একজন রোগীর প্রাণ বাঁচাতে। কিন্তু শেষমেশ যখন শেষ রক্ষা আর করতে পারেনা, যখন হেরে যায় তখন হতাশায় ডুবে যায় সবকিছু। সারফারাজ গায়ের এপ্রোন খুলে রাখল। বলে উঠল, “কিছু করার নেই। আমাদের হাতে এতোটুকুই। সৃষ্টিকর্তা এর চেয়ে বেশি শক্তি আমাদের দেননি কি করার।”
“আমার মনে হয়, একজন ডাক্তার হতে হলে প্রথমেই মনটা পাথর করে ফেলতে হয়। পাথর না হলে কিছু করার নেই।”
”তা বটে।”
“সারফারাজ! তোর হাতে ওটা কার ফাইল!”
“নতুন এক পেশেন্ট এসেছে। হার্টের সমস্যা কিন্তু সমস্যাটা কি বোঝা যাচ্ছে না। আপাতত কিছু পরীক্ষা দিয়েছি দেখা যাক রিপোর্ট কি আসে।”
“ডঃ সাবিনা চলে এসেছেন। তাকে গিয়ে রিপোর্ট দেখাও এক ঝটকায় বলে দিবেন।
শাহাদাত তড়িখড়ি করে বলল, “এসে গেছে নাকি।
”হ্যাঁ, চলে এসেছে। কেবিনে আছে। একটু পরেই খবর এলো বলে। সারফারাজ তৈরি হও।”
“আমি একা যাবো নাকি? তোরাও তো যাবি।
“না বাবা, যা শুনলাম তার নামে। তবে এটা বলতেই হয়, তিনি একজন এক্সট্রাঅর্ডিনারি! অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।নামকরা একজন কার্ডিওলজিস্ট।”
“তবে নাকি অনেক রাগী!”
”সেটা জানতে হলে তো দেখে আসতে হবে, তাই না!” বলতে বলতে খবর চলেও এলো। প্রথমে ডাক পড়ল সারফারাজ। সারফারাজ এপ্রোন পরে হাতে ফাইল নিয়ে বেরিয়ে গেল। শুভ যাবার আগে বলে উঠল, ”দোয়া করি বৎস!“
“চুপ কর!“
হেসে উঠল তারা দুজন। সারফারাজ ডঃ সাবিনা ইয়াসমিন এর কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে নক করল। অনুমতি পেয়ে ভেতরে ঢুকে চমকে গেল বটে। তার ব্যাপারে শুনে যেমনটা ধারণা করেছিলো সে মোটেও তেমন নয়। নীল রঙের শাড়ির উপর তার সাদা এপ্রোন, গলায় ঝুলছে স্টেথোস্কোপ। এসেই কি পেশেন্ট দেখা শুরু করে দিয়েছে নাকি। হাতে একটা ফাইল ও দেখা যাচ্ছে। চেয়ার ছেড়ে টেবিলের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ফাইল দেখছিলেন। চোখ মেলে এদিকে তাকালেন। চোখের চশমা খুলে শুধালেন, “ডঃ শেহদাত!”
“জি।”
“আসুন , বসুন।”
কণ্ঠস্বর অনেকটাই ধারালো। সারফারাজের খানিকটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। ডঃ সাবিনা নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন। সারফারাজের হাতে ফাইলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “কোন পেশেন্ট?”
সারফারাজ ফাইল এগিয়ে দিল। বলে উঠল, “নতুন পেশেন্ট। একটা পরীক্ষা করেছিলো তার রিপোর্ট। আমি আরো কিছু পরিক্ষা করতে দিয়েছি।”
“আপনার কি ধারণা, কি হয়েছে?”
“সমস্যা টা দেখে মনে হচ্ছে হার্ট ব্লক। ৫০% চান্স আছে। পুরোপুরি শিউর হবার জন্যে রিপোর্টের অপেক্ষা করছি।”
ফাইলের থেকে চোখ সরিয়ে বলে উঠলেন, ”হার্ট ব্লক। আমি ১০০%। যাই হোক, নতুনদের জন্য আরো কিছুটা সময়ের দরকার। আমি বলছি অভিজ্ঞতা থেকে।”
”আপনার অভিজ্ঞতা?”
“৮ বছরের!”
সারফারাজ বিস্ময় প্রকাশ করল। দেখে মনে হয়নি তার থেকে এতোটা বড়। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। ডঃ সাবিনা মৃদু হেসে বললেন, “ডঃ শরিফুল ইসলামের আন্ডারে আমিও ছিলাম। খুব ভালো একজন ডাক্তার। নিশ্চিত অনেক কিছু শিখতে পেরেছেন।”
“শিখার চেষ্টা করছি।”
”প্ল্যান কি আপনার ডঃ সারফারাজ। যতটুকু জানি আপনি একজন কার্ডিয়াক সার্জন হতে চান। কোথায় যাবেন ঠিক করলেন কিছু? আপনার জন্য কিন্তু ভালো সুযোগ আছে। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলেন শুনলাম।”
“আমি এখনো ভাবছি?”
“এখনো ভাবছেন? আশ্চর্য। আপনার হাতে সময় আছে সবে ৬ মাস। আমি তো বলব এখন থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে নিন। ইংল্যান্ড কিংবা আমেরিকাতে যাবেন। কমপক্ষে ৪ – ৫ আপনার স্ট্রাগল করতে হবে। আরো কমও হতে পারে কজ আপনি ব্রিলিয়ান্ট। এরপর দেশে ফিরে দেশে নামকরা একজন কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে সবাই চিনবে। কি ব্যাপার অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে?”
“না আমি শুনছি আপনার কথা।
”বিবাহিত!”
“জি।
“কয়বছর হলো? সে যতো বছরই হোক না কেন? পুরুষ মানুষের জন্য তা ব্যাপার হলো নাকি? ম্যারিড মেয়েদের নিয়ে অনেক সমস্যা। অনেক ঝামেলা হয় আপনার তো তেমন কিছু নেই। তাহলে ভাবছেন কি?”
সারফারাজ মুখ ফসকে বলে দিল, “এইজন্যই আপনি তাহলে আনমেরিড!”
“ইমপ্রেসিভ। আমার ব্যাপারে একেকটা খবর খুব ভালো ভাবেই নিয়েছেন দেখছি। বাট মিস্টার হ্যান্ডসাম আপনি কিন্তু ম্যারিড!”
সারফারাজ ইতস্তত বোধ করল। ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে সে। ডঃ সাবিনা হেসে উঠলেন। তাকে দেখে কোনভাবেই মনে হলো না সে রাগী একজন।
“ওকে ওকে, মিস্টার শেহদাত। আপনি তো দেখছেন ঘাম ছুটিয়ে ফেলেছেন। ডাক্তাদের এতো তাড়াতাড়ি অস্থির হলে চলে না। আপনাকে একটা কথা বলি ডঃ শেহদাত। কার্ডিয়াক সার্জনের ছড়াছড়ি কিন্তু দেশে তেমন নেই। কোন হেলাফেলা নয় এটা। আপনাকে আগে দৃঢ় মনোবল বানিয়ে নিতে হবে। যদি কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে চান তো নিজের ক্যারিয়ারের দিক দিয়ে সিরিয়াস হন। আপনাকে একটা ভালো সাজেস্ট দিই, আপনি ইংল্যান্ডে গিয়ে FRCS করতে পারেন। FRCS খুবই লিউক্রিটিভ ডিগ্রী। সর্বদেশে সম্মানিত। কিন্তু এটা এতোটা সহজ না। আপনাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে, প্রচুর ঘাটতে হবে। অথচ আপনি এখনো এক জায়গায় গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। ভেরি মাচ ডিসাপয়েন্টিং। আপনার থেকে আরো ভালো আশা করেছিলাম। ডঃ শরিফুল আপনার সম্পর্কে আমায় অনেক বলেছে।”
সারফারাজ মনোযোগে বিঘ্ন ঘটল। হঠাৎ তার মনে পড়ল অর্নিলার কথা। টানা দুই বছর তাকে ছেড়ে ছিলো সে। আবারো কি ছেড়ে চলে যাবে দূরদেশে। ও এবার মেনে নিতে পারবে তো!
“ডঃ শেহদাত।
”জি।
”কথাগুলো কি রিপিটেটিভ মনে হচ্ছে। আগে কোথাও শুনেছেন?
“ডঃ শরিফুল আমায় অনেক আগেই বলেছেন।
“তারপরেও আপনার এই হাল। এ মাই গড। এরপর ডঃ শরিফুল কিভাবে আপনাকে নিয়ে এতো ভাবতে পারেন আমি সেটাই ভাবছি। আমি হলে কবেই হাল ছেড়ে দিতাম!
”সরি ডঃ।
ডঃ সাবিনা বোধহয় বিরক্ত হলেন। পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, ”ওপেন হার্ট সার্জারি করেছেন কখনো?”
“হ্যাঁ মানে না।”
“তাহলে তৈরি হন। আপনি এখন বাসায় যান। বিশ্রাম নিন। রাত দেড়টার দিকে একটা ওপেন হার্ট সার্জারি আছে। আপনি সেখানে আমার সাথে যাবেন। ঠিকানা আমি আপনাকে মেসেজ করে পাঠিয়ে দিবো।
“আচ্ছা।”
“ভয় পাচ্ছেন?”
”না, ভয় কেন পাবো?
”হুম। তবে আপনাকে দেখে অনেক অস্থির মনে হচ্ছে। কাজ করুন আপনার এড্রেস আমায় দিয়ে যান। রাত্রির ১১ টার দিকে আপনাকে পিকআপ করতে চলে যাবো। ওকে।
“ওকে ডঃ!
ডঃ সাবিনার রুম থেকে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সারফারাজ। এখন মনে হচ্ছে তিনি আসলেই অনেকটা ভয়ানক!
.
হাসপাতাল থেকে বের হয়েই প্রথমে সে কল করল অর্নিলাকে। কিছুদিন আগেই নতুন গাড়ি কিনেছে। কিনেছে বললে ভুল হবে বাবা পাঠিয়েছে। এখানে ওখানে যাবার জন্য গাড়ির দরকার ছিলো। তার লাইসেন্স তো আগে থেকেই ছিল। ভাবছে অর্নিলার লাইসেন্স করিয়ে ফেলবে। ভালোই হবে তাহলে। অর্নিলার ক্লাস শেষ হতে ঘণ্টাখানেক বাকি আছে। সারফারাজ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অর্নিলাকে পিকআপ করতে। তার পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেকের মতোই লাগল। ভার্সিটির বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে অর্নিলার জন্য। টানা ১৫ মিনিট পর বের হতে দেখল অর্নিলাকে। সারফারাজ হঠাৎ করেই একটু তটস্থ হয়ে গেল। কয়েকটা ছেলেমেয়ে ঘিরে আছে অনিকে। দেখে মনে হচ্ছে বন্ধুবান্ধব। অর্নিলার ছেলে বন্ধুও আছে। কই? সে তো জানে না। ব্যাপারটা যেনো তার পছন্দ না। তারা দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছে। অথচ সারফারাজের অস্বস্তি হচ্ছে। হুট করে গাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল সে। পানির বোতল বের করে এক নিঃশ্বাসে খেতে লাগল। হঠাৎ গাড়ির জানালায় কেউ কড়া নাড়ল। সারফারাজ ফিরে তাকাল। অনি হাত নেড়ে বলছে, “ফারাজ ভাই!”
#চলবে….
( আরো কিছু লেখার ইচ্ছা ছিলো। ভেবেছিলাম চমকপ্রদ কিছু দিবো। কিন্তু অসহ্য মাথা যন্ত্রণার কারণে কিছুই লিখতে পারছি না। ক্ষমা করবেন! )