#মন_শহরে_বসন্ত_হাওয়া |৮|
#কে_এ_শিমলা ®
রক্তিম ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হয়ে এলো ঘর থেকে। ডাইন ইন টেবিলে আসতেই দেখলো মুখ গুমরো করে বসে আছে নূরা। তাকে দেখিয়েই রক্তিম মাথা মুছতে লাগলো বেশি করে। যেন আগের মতো নূরা এসে তাঁর মাথা মুছে দেয়। অথচ নূরা যেন দেখেও তা দেখছে না। আগের মতোই মুখ করে বসে আছে। গোপন এক তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে রক্তিম গিয়ে বসলো চেয়ার টেনে নূরার পাশে। প্লেট ঠিক করে দিয়ে নূরা পাশ থেকে উঠে গেল। কিচেন থেকে পায়েসের বাটি নিয়ে এসে বসলো গিয়ে সম্মুখে।”
রক্তিম বললো, খাবে না?”
‘না ক্ষুধা নেই।”
রক্তিম খাচ্ছে একমনে। নূরা কিয়ৎক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘তুমি আমাকে সন্দেহ করছো রক্তিম?”
‘কেন? তোমার কেন মনে হলো আমি তোমাকে সন্দেহ করছি? সন্দেহ করার মতো কিছু করেছো তুমি?”
‘না! তোমার কথাবার্তায় কেমন জানি লাগে। মনে হয় যেন তোমার আড়ালে আমি কারো সাথে লুকিয়ে কথা বলছি।”
‘এরকম কিছুই না। তুমি শুধু শুধুই এমনটা ভাবছো। শুনো আমি কাল ভাবছি মা বাবাকে আবার আমাদের কাছে নিয়ে আসবো।”
নূরার মুখভঙ্গি পরিবর্তন হলো। দাঁতে দাঁত পিষ্ট করলো সে। রেগেমেগে কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ‘হঠাৎ কেন? ওখানে কী উনারা ভালো থাকছেন না? সপ্তাহে, এমনকি মাসে গিয়েও বাজার করে নিজে রেঁধে দিয়ে আসি। এখানে আসার আর কী প্রয়োজন? আমি বাসায় থাকি না। তুমিও না। ওখানে উনারা নিজেদের মতো ভালোই তো আছেন।”
‘দেড় বছর যাবৎ আমার মা বাবা আমাদের কাছে নেই নূর। তুমি এখনো বলছো দূরে রাখতে উনাদের।”
‘আমি এভাবে বলতে চাইনি রক্তিম। তোমার মা বাবা আমার চলাফেরা পছন্দ করেন না। তোমার মাও আমার সাথে ঠিকঠাক ভাবে কথা বলেন না। একটু নির্বিঘ্নে আমি হাঁটতে পারি না বাসায়। ওখানে তো ভালোই আছেন উনারা। কাজের মানুষ ও আছে। এমন তো নয় নিজেদের কাজ করে খেতে হয়।”
‘অবশ্যই করে খেতে হবে না। উনাদের ছেলে টাকা ইনকাম করে। একজন কেন তিনজন কাজের মানুষ রেখেও দিলেও কিছু না।”
‘শুধু আমার বেলাতেই হিসেব তাই না রক্তিম।”
‘শুধু নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা কেন তোমার নূর। বিয়ের আগে তুমি বলেছিল আমার মা বাবার সাথে থাকবে। একটা সুন্দর সংসার করবে। আদর্শ বউ হবে। অথচ এখন আমার মা বাবা বাসায় থাকেন না। বাদ দাও! উনারা উনাদের মতো ওখানে ভালো আছেন। এখানে তুমি তোমার মতো। শুধু শুধু অন্য চিন্তা ভাবনা মনে পোষবে না প্লিজ।”
নূরা চোখ মুখ খিচিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে গলায় এবং গালে এক হাত রেখে অপর হাত টেবিলে রেখে রক্তিমের দিকে চেয়ে আছে। মন চাইছে এখুনি এই বাসা ছেড়ে বের হয়ে যেতে। অথচ পারছে না শুধু।”
রক্তিমের খেতে খেতে মনে পড়লো একজন মানুষের কথা। কিয়ৎক্ষণের জন্য সে ডুবে গেল সেই মুহুর্তটায়।”
‘রণয়ী চলো কোথাও থেকে এক সপ্তাহ গিয়ে ঘুরে আসি। বোরিং লাগছে আমার। তোমার তো দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ।”
রক্তিমের খালি বুকে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে করতে রণয়ী বললো, ‘কী বলো রক্তিম এক সপ্তাহ! মা বাবা একা থাকবেন কীভাবে বাসায়?”
‘আরে মা বাবা আবার কীভাবে থাকবেন? কাজের মানুষ আছে না? তুমি কী চাইছো আমাদের সাথে মা বাবাকেও নিতে!”
‘হুম! সমস্যা কী? চারজন গিয়ে ঘুরে আসি চলো। আমাদের ও ভালো লাগবে উনাদের ও ভালো লাগবে। একা একা একটা সপ্তাহ থাকবেন উনারা? যতই কাজের মানুষ থাকুক।”
‘মা বাবা যেতে চাইবেন না। না হলে তো নিতাম।”
‘তুমি বলে দেখো যাবেন। যাও গিয়ে বলো।”
‘রক্তিম! কোথায় হারিয়েছো?”
নূরার ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো রক্তিমের। রণয়ী! মেয়েটা কত ভালো ছিল। তাঁর পরিবার নিয়েই সবসময় ভাবতো। অথচ মা! তিনি কখনোই ভালো চোখে দেখতে পারেননি তাকে। আর তিনি চেয়েছিলেন নূরাকে। অথচ আজ নূরা তাদের দূরে রাখে সরিয়ে। রণয়ী জীবনে থাকলে হয়তো দিনগুলো অন্যরকম কাটতো। কিন্তু নূরা! সে তো রক্তিমের ভালোবাসার মানুষ। সেজন্যই পারেনি রক্তিম তাকে ফিরিয়ে দিতে। রণয়ী কে সে ভালোবেসেছিল ঠিক! কিন্তু নূরা পুনরায় জীবনে আসার পর আর তাঁর প্রতি ভালোবাসা বুঝতে পারছিল না রক্তিম। তাই তো তাকে মুক্তি দিল। মেয়েটা সত্যিই তাকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু নিজেরই বা কী করার ছিল?”
‘কোথাও হারাইনি। বলো কী বলবে?”
‘এই নাও পায়েস খাও। তোমার জন্য বানিয়েছি যত্ন করে। তুমি তো ভাবো সারাদিনই বোধহয় আমি ফোন নিয়ে ব্যস্থ থাকি। এখন দেখো কিছু করি কী না। কতকিছু করি আমি।”
‘তুমি যদি সবকিছু করো তবে রুনার কী কাজ। ওকে কাজ থেকে বাদ দিয়ে দাও। পায়েস খেতে খেতে কথাটা বললো রক্তিম, খানিকটা রসিকতার ছলে। কিন্তু নূরা মোটেও তা রসিকতা হিসেবে নিতে পারলো না। কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা যেন।”
রক্তিম পায়েসের বাটি এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘ধন্যবাদ! ভালো ছিল পায়েস।”
‘শুধু ভালো!”
‘না! ভালোবাসার মতো আদর করার মতো ভালো। রুমে আসো বুঝিয়ে দেই কেমন ভালো হয়েছে। আসো আসো! পাঁচ মিনিটে এসো। আ’ম ওয়েটিং ফোর ইয়ু।”
রক্তিমের দিকে তাকিয়ে রইলো নূরা। রক্তিম একটা চোখ টিপ দিয়ে নিজেদের ঘরে চলে গেল। নূরা কিছু খেলো না। মূলত খেতে ইচ্ছে করছে না। সন্ধ্যে বেলায় নুডুলস খেয়েছে। ক্ষধা নেই আর। তাই রুনা কে খেয়ে গুছিয়ে নেওয়ার কথা বলে সোফা থেকে ফোন নিয়ে নিজেদের ঘরে চলে এলো। যেই দুইদিন দূরে ছিল আজ হয়তো আর হবে না। কবে যে এমন দমবন্ধকর পরিস্থিতি আর সম্পর্ক থেকে মুক্তি পাবে সে! সেই অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।”
~~~~~•
আরেকটি নতুন ভোরের আগমন। দিনের আগমন। সময়ানুযায়ী অফিসে এসে পৌঁছায় রণয়ী। লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। লিফটের সম্মুখেই একটি ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে ছিল আবির। রণয়ীর হাঁটার গতি থেমে গেল তাকে দেখতেই। শুকনো দুটো ঢোক গিলে এগিয়ে যেতে লাগলো মন্তর পায়ে। হাতের ফাইল চেপে ধরে সে বুকের সাথে। আবির ক্রুর হেঁসে তাকিয়ে দেখছে অপলক রণয়ী কে। কে বলবে এই নারী বিবাহিতা ছিল। শরীরের গড়ন এখনো যেন যুবতীদের মতোন। অজান্তেই আবিরের এক হাত চলে গেল থুতনিতে। বুড়ো আঙ্গুলের সহায়তায় উক্ত স্থান চুলকে রণয়ীর সম্মুখে দাঁড়াল। বাঁধ সাধলো রণয়ীর পথে। রণয়ী নিজেও এটাই চাইছিল। মোটেও এই লোকের সামনে লিফটে উঠা যাবে না। যদি সে ও উঠে যায়?”
রণয়ী এসব বুঝতে না দিয়ে বললো, ‘আপনার সমস্যা কী? এভাবে কী দেখছেন? পথ আটকে দাঁড়িয়েছেন কেন?”
‘জানো না কেন? আর কত একা থাকবে? এবার তো আমার ডাকে সাড়া দাও সুন্দরী।”
‘তাই! আপনার মনে হয় আমি কারো ডাকে সাড়া দেবো! আর তাও আপনার?”
‘আমার মধ্যে কম কী বলো? মেনে না নেওয়ার কারণ কী?”
‘আপনি নারীদের সম্মান করতে যানেন না। আপনার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা নেই। আপনার মন সুন্দর নয়। কামনা কুলষতায় ভর্তি। আর আপনি ভালো মনের হলেই বা কী? তবুও যদি ভালো হতেন। একজন মেয়ের ভবিষ্যত তবে একটু ভালো হতো।”
অপমানে আবিরের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। মুখের উপর এমন কথা। হাত মুষ্টিমেয় করে রাগ সামলাতে চাইলে ব্যর্থ হলো। এক কদম এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত পিষ্ট করে বললো, ‘দেখে নিও একদিন আমি তোমাকে নিজের করেই ছাড়বো।”
রণয়ী দ্রুত এক কদম পিছিয়ে গেল। যেন আগুনের আঁচ লেগেছে। সেও শক্ত গলায় কিরমির করে বললো, ‘এমন পরিস্থিতি আমার কখনোই আসবে না। দ্বিতীয় বিবাহের। আর যদিও আসে আপনি কেন? আপনার মতো অন্য কেউ হলেও আমি মৃত্যু বেছে নেবো জীবন নয়।”
‘কী ব্যাপার আবির সাহেব! কাজ কেমন চলছে আপনার? কেবিনে আসবেন আজ একবার।”
দুর্জয়ের গলা শুনতেই ছিটকে দূরে সরলো আবির। হকচকিত গলায় সালাম করলো। রণয়ীও মিনমিন স্বরে সালাম দিল। খুব প্রয়োজন ছিল এই মুহূর্তে কারো আসার। অতঃপর এই মানুষটা!”
দুর্জয় দুজনের সালামের জবাব দিল। অতঃপর লিফটে উঠে পড়লো। আবির আড়চোখে কটমট করে রণয়ীর দিকে তাকিয়ে চলে গেল। রণয়ী দাঁড়িয়ে আছে দেখে দুর্জয় বললো, ‘চলে আসুন মিস রণয়ী রহিম! যদি সমস্যা না থাকে তো।”
রণয়ী বিনা দ্বিধায় উঠলো। এই মানুষটা কে অবিশ্বাস করার প্রশ্নই আসে না। লিফটের দুই কর্ণারে দু’জন। দুর্জয় একবার হাতের ঘড়িতে সময় দেখে নিল। রণয়ী আড়চোখে তাকে দেখছে। শুনেছে কী এই মানুষটা তাদের কথা?”
চোয়ালদ্ধয় কেমন শক্ত লাগছে। কপালের পাশের রগ গুলি বোধহয় ফুলে উঠছে ক্রমেই। কালো কোটে মানিয়েছে বেশ মানুষটাকে। রণয়ী দ্রুত দৃষ্টি সংযত করলো। কী করছে সে! তিন তলায় গেল দু’জন একসাথে। রণয়ীর আগে আগেই চলে এলো দুর্জয়।”
ভীষণ খারাপ! ভীষণ খারাপ লাগছে। অন্যান্য কর্মচারীদের ও তো বেশ কয়েকবার দেখেছে কথা বলতে এভাবে। তখন তো এমন হয়নি। এবার কেন এমন লাগছে। প্রচন্ড বিরক্ত হলো দুর্জয় নিজের প্রতি। গত রাতে ঘুমোতে পারেনি এমনিতেই। জাগ্রততে ভাবনায়! ঘুমন্তবস্থায় স্বপ্নে। আজ আবার এভাবে মাথায়! হচ্ছে টা কী? কেন এই নারী এতোটা ভাবনায় চলে আসবে? কেন আজ খারাপ লাগছে আবিরের কথায়? কেন সময়ে অসময়ে ভাবনায় আসবে সে? অনুভূতি তো চাপা’ই ছিল! আবার কেন উদয় হবে। নিজেকে সামলাতে হবে। অন্য সবার মতোই তো সেও।”
রণয়ী কেবিনে এসে বসলো পরিচিতদের সাথে কিছু কথাবার্তা বিনিময় করে। ফাইল দুটো সামলে রাখলো। পানি পান করলো। কিয়ৎক্ষণ বসে থাকার পর ফাইল দুটো খুললো। চেইক করলো ভালো করে। এখনই যাবে না দুর্জয়ের কেবিনে। তাই দুটো সরিয়ে রাখলো পাশে। কম্পিউটার অন করলো। অসম্পন্ন কাজের ফাইলে গিয়ে প্রবেশ করলো। হঠাৎ টুং করে ফোনে শব্দ হলো। রণয়ী না চাইতেও কীবোর্ড থেকে হাত সরিয়ে মোবাইল হাতে নিল। এবং স্ক্রিনে মেসেজ আর একটি নাম দেখতেই বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। বক্ষস্থল সহ হাত কেঁপে উঠলো। কম্পিত হলো সর্বাঙ্গ। পিন নাম্বার দিয়ে লক খুলে প্রবেশ করলো ফোনের ম্যাসাজ অ্যাপসে। দুটো মেসেজের দিকে তাকিয়ে থাকলো নির্নিমেষ। জ্বলজ্বল করা চোখের তারায় জ্বালা শুরু হলো বোধহয়।”
আজ এতো দিন পর রক্তিম! দুই দুইটা বছর হয়ে গিয়েছে কল কিংবা মেসেজ করেনি রক্তিম। এর আগে অবশ্য করতো। রণয়ী কে ছেড়ে দেওয়া। তাঁর বাবা মারা যাওয়া। সেজন্যই খোঁজ খবর নিত। অতঃপর রণয়ী সাফ সাফ নিষেধ করে দেয়। নাম্বার ও ব্লক করে দেয়। রক্তিম নিজেও আর কখনো কল কিংবা মেসেজ করেনি। আজ এতো দিন পর। তাঁর প্রথম মেসেজটি, ‘কেমন আছো রণয়ী?
দ্বিতীয়টি, ‘আমি রক্তিম বলছি। একটু কথা বলবো তোমার সাথে। কল করি?”
কী নিসংকোচে আবেদন। ঠিক যেন আগের মতোন। একটুও কী ভেতরে অপরাধবোধ নেই? এক স্যরিতেই সব শেষ? জীবন যে এলোমেলো করে দিল। রণয়ী বেশি কিছু নয়। আলগোছে নাম্বারটা ব্লক করে দিল। যে বিষের মতো হৃদয় বিষাক্ত করে দিচ্ছে। হৃদয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বিষাদ বেঁধে দিয়েছে। তাঁর সাথে কথা বলার প্রয়োজন নেই। উহু একটুও না। তবে কেমন যাচ্ছে তাঁর সংসার জীবন? ভালো! বিনা দোষে একজন কে ঠকিয়ে সত্যিই কী ভালো সংসার করছে? শুনতে জানতে ইচ্ছে করলো রণয়ীর। যদি অশান্তির হয়! তবে বোধহয় একটু দগ্ধ হৃদয় শীতল হতো। আর যদি বিপরীতে ভালো শুনতো। তবে! না জানাই থাক তাহলে।”
রণয়ী ফোন রেখে দিল হাত থেকে। পাশ থেকে টিস্যু নিয়ে চোখ মুছলো। পুনরায় কীবোর্ডে হাত রাখলো। চোখ ঝাপসা হলে চোখ মুছলো। কাজে মন বসছে না। ভেতরটা কেমন অস্থিরতায় ভরে গিয়েছে। দমবন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে কোনোকিছু গলা চেপে ধরেছে শক্ত করে। কাঁটার মতো বিঁধে আছে কিছু। না গিলতে পারছে! আর না তো উগড়ে দিতে পারছে। বড্ড শান্তি প্রয়োজন! মস্তিষ্কের ছুটি প্রয়োজন। কীটপতঙ্গের মতো চর্বণ করছে বিষাক্ত স্মৃতি মুল্যবান এই মস্তিষ্ক কে। হৃদয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ব্যথা। দাঁড়ালো ছুড়ির ফলার ন্যায় বিষাদ যন্ত্রণা। প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসের সহিত আঘাত লাগলেই রক্তক্ষরণ ঘটে যেন।
রণয়ী মাথা এলিয়ে দিল চেয়ারে। চোখ বন্ধ করতেই কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো উষ্ণ নোনাজল। রণয়ীর দৃষ্টি সম্মুখে ভেসে উঠলো অতীত। শুরু থেকে একদম শেষ অব্দি! যেন এক নাটক, গল্প। যা শুরু থেকে শেষ অব্দি কারো হাতে লেখা। সূচনা সমাপন নিপুন হাতে সাজানো। রণয়ী আজ নিজেকে সামলালো না। বাধা দিল না। অতীতে ডুব দিল। যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজের ভুল খুঁজতে চাচ্ছে। একটাই ভুল ছিল নাকি? একাধিক! দুই বা ততোধিক।”
অতীত_______
একটি সোনালী সকাল এক ষোড়শী কন্যার জীবনে। রণয়ী তখন দশম শ্রেনীর ছাত্রী। মাস তিনেক হবে ভালো ফলাফলের সহিত নবম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেনীতে উত্তীর্ণ হয়েছে। গ্ৰুপ হিসেবে দুই ভাইয়ের মতোই ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ বেছে নিয়েছিল নবম শ্রেণীতে। ভালোই ফলাফল করতে পেরেছে। অংক পারে ভালো রণয়ী। তবে কোচিং করে। বাড়িতে একজন টিচার আসেন। তিনি গ্ৰুপ সাবজেক্ট গুলো পড়ান।”
আজ রণয়ীর কোচিং ছিল না। তাই ফজরের নামাজ আদায় করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মা কয়েকবার ডেকে গিয়েছেন। তবুও উঠেনি। গভীর ঘুম চলে আসে। যখন উঠে তখন দেখলো আর মাত্র পনেরো কী বিশ মিনিট আছে হাতে। দ্রুত তৈরি হয়। চুল কোনোরকমে বেঁধে স্কাফ বেঁধে নিল মাথায়। রাবিয়া খানম নিজ হাতে কয়েক লোকমা খাইয়ে দেন। অতঃপর বের হয়েছিল রণয়ী বাসা থেকে। বেশ দূরে ছিল না স্কুল বাসা থেকে। তাই হেঁটেই যাচ্ছিল রণয়ী। কিন্তু পথিমধ্যে বাঁধে বিপত্তি।
|আগের একটি পর্বে দিয়েছিলাম অংশটুকু| ধাক্কা লেগে পড়ে যায় রণয়ী। সেদিনই ছিল রণয়ী রক্তিমের প্রথম দেখা।”
সেদিনের মতো স্কুলে গেলেও শুভ্র রঙা মুখশ্রীখানা রণয়ী ভুলতে পারেনি। একবার দেখলে মনে থাকার মতোই ছিল মানুষটা। আর তাঁর কন্ঠ! এই কথার স্বর শুনেই রণয়ী চেয়েও পারেনি বেশি রূঢ় গলায় কথা বলতে। সেদিনের মতো রাত কাটে। পরের দিনটায় স্কুল থেকে আসার পথে দেখা আবারো দেখা হয় দু’জনের। কিছু প্রয়োজনে পাশের দোকানটিতে গিয়েছিল রণয়ী সইদের সাথে। সেখানে তাঁর সাথে দেখা হয়। রক্তিম যে খাতাটি দেখে রেখেছিল সেই খাতাটা গিয়ে রণয়ীও হাতে নেয়। ভেবেছিল এমনিই বের করে রাখা।দোকানীকে দামটাম জিজ্ঞেস করে নিজের জন্য বরাদ্দ করে ফেলে। তখন রক্তিম বলে, ‘এই মেয়ে এই খাতা আমি নিজের জন্য রেখেছি। তুমি নিয়েছো কেন?”
রণয়ী কিছু বলতে গিয়েও তাঁর মুখ আর কথা শুনে আটকে যায়। আলগোছে খাতাটি তাঁর দিকে সরিয়ে দিয়ে নতুন আরেকটি খাতা দিতে বলে দোকানী কে। রক্তিম নিজেও অবাক হয় খানিক তবে পাত্তা দেয় না। সেদিনে রণয়ী আবারো নতুন করে ভাবনায় ডোবে। কিশোরি দুরন্তপনা মন। সহজেই একজন কে নিয়ে ভাবনায় মশগুল হয়ে গিয়েছিল। তেমনি দিন যায়! এভাবেই নানা ভাবে তাদের দেখা হয় রাস্তা ঘাটে। দোকানে! শপিং মলে।”
একদিন রণয়ী জানতে পারে রক্তিম তাদেরই ক্লাসের মানবিক বিভাগের ছাত্রী আয়রার কাজিন। আয়রার সাথে রণয়ী পড়ে ষষ্ট শ্রেণী থেকে। তাই সখ্যতা ছিল বেশ। অবসরে এসে বসতো। কথা বলতো। কথায় কথায় জানতে চাইতো রক্তিমের কথা। আয়রা ছিল সরল মনের অধিকারী। রণয়ীর মনোবাসনা এতো বুঝতো না। তাই সরল মনে সেও বলে দিত।”
এভাবেই দিন যায়। দশম শ্রেনীর অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়। রণয়ী বুঝলো রক্তিম শুধু এখন আর তাঁর ভাবনায় নেই। ভালো লাগে তাকে। ভাবতে ভাবতে কখন যে ভালোলাগা হয়ে উঠেছে বুঝে এলো না রণয়ীর। তবুও সে তাঁর কিশোরী মনের নতুন নব্য অনুভূতি কে দমায় না। ভালো লাগা বাড়তে থাকে দিনকে দিন পাল্লা দিয়ে। রক্তিমের পরিচিত হয়ে উঠেছিল সে এক প্রকার। পথিমধ্যে দেখা হলে সালাম করতো। রক্তিম মৃদু হেসে সালামের জবাব দিয়ে নিজেই জিজ্ঞেস করতো ‘কেমন আছো রণয়ী?’রক্তিমের সেই মৃদু হাসিটাই ছিল রণয়ীর ভালো লাগা বাড়িয়ে দিয়ে আরো গভীরে যাওয়ার অন্যতম কারণ।”
এভাবেই দিন যেতে থাকে। আয়রার থেকে ফেসবুক আইডি জেনে নেয় রণয়ী। ভাগ্য ভালো প্রোফাইল পাবলিক ছিল। তখন এক্টিভ ছিল রক্তিম সামাজিক মাধ্যমে। প্রতিদিনকার পোষ্ট দেখতো সে। কমেন্ট দেখতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কোন মেয়ে কী কমেন্ট করলো না করলো সব। সেখানকার রক্তিমের একেকটি বিরহী কথা যেন রণয়ীর মনে লাগতো। মন খারাপ হয়ে যেতো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সব। আগের পোষ্টসমূহ দেখে এটুকু ধারণা চলে আসে হয়তো সম্পর্কে আছে। আর তখনকার পোষ্ট দেখে বুঝতো হয়তো শেষ।”
একদিন রিকোয়েস্ট পাঠায়। ভেবেছিল রক্তিম একসেপ্ট করবে না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে রক্তিম আধ ঘন্টার মধ্যে একসেপ্ট করে। কিন্তু মেসেজ করে না রণয়ী নিজে থেকে। রক্তিম ও করে না। এভাবেই দিন যায় তাদের। টেস্ট পরীক্ষা ঘনিয়ে এলো। মোবাইলের ব্যবহার কমে এলো রণয়ীর। সপ্তাহে একদিন হঠাৎ প্রবেশ করতো ফেসবুকে। রক্তিমের সব পোষ্টে রিয়াক্ট করতো। দেখতো মনোযোগ দিয়ে। এটা যেন তাঁর খুব ভালো লাগার প্রিয় একটা কাজ ছিল।”
টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়। আর খুব বেশি দিন নেই হাতে ফাইনাল পরীক্ষার। পুরোদমে পড়ায় লাগে। ব্যস্থতায় হয়তো আগের মতো ঘনঘন ভাবতে পারতো না তাকে। কিন্তু ভাবনা থেকে যায় না সে। ঠিক মনে পড়তো! ভাবনায় আসতো। কখনো কখনো বা লজ্জায় আড়ষ্ট হতো রণয়ী। কত রঙ বেরঙের স্বপ্ন দেখতো কিশোরী মন তাঁর। অতঃপর ঘনিয়ে এলো পরীক্ষার দিন গুলো।”
চলবে!