রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৭১| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
511

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৭১|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

[তৃতীয় পরিচ্ছেদ]

ঘণ্টা দুয়েক সময় ধরে অর্পণ আর মৃত্তিকা এই আমগাছ তলায় বসে রয়েছে। নিজের জীবনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা ঘটনা সে অর্পণকে জানাল। মৃত্তিকার কাছ থেকে সমস্ত ঘটনা শুনে অর্পণের চোখ জোড়ায় পাবক শিখা দাউদাউ করে জ্বলছে। আর যাই হয়ে যাক‚ আজ এবং এখন থেকে সে সব সময় ভূমির পাশে ছায়ার মত থাকবে। মেহরাব শিকদারের মুখোশ উন্মোচনে ভূমিকে সদা সহায়তা করবে। ভাগ্যের জোরে সে তার বোনকে আজ আবারও ফিরে পেয়েছে। একই ভুল না সে করবে‚ আর না তার ভাইকে করতে দেবে। যে করেই হোক বোনের মান ভাঙিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। দুজনের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি দূর করবে। এভাবে দুজন ভালোবাসার মানুষ কিছুতেই আলাদা হতে পারে না৷ মৃত্তিকা খেয়াল করল অর্পণের হাতে থাকা কাগজটাকে। তাই সে জিজ্ঞেস করল‚

“তোমার হাতে এটা কীসের কাগজ ভাইয়া?”

বিলম্ব না করেই অর্পণ বলল‚ “ভাই তোর ডিএনএ টেস্ট করাতে দিয়েছিল।”

অবাক হলো ভূমি। ডিএনএ টেস্ট করতে গেলেও তো ভূমি আর মৃত্তিকা দুজনেরই স্যাম্পল লাগবে। মৃত্তিকার ডিএনএ স্যাম্পল যদিও পেয়ে যেতে পারে। তবে একবছর পর ভূমির ডিএনএ স্যাম্পল প্রলয় কোথা থেকে জোগাড় করল? প্রশ্ন একটা থেকেই যাই তাই সে অর্পণকে জিজ্ঞেস করল‚

“উনি আমার ডিএনএ স্যাম্পল কোথায় পেয়েছেন?”

“পুরো একবছর ধরে ভাই তোর ব্যবহার করা প্রত্যেকটা জিনিস গুলো খুব যত্নে আগলে রেখেছে৷ কাউকে তার ঘরে ঢুকতে দেয় না। যদি তোর ছোঁয়া জিনিসগুলোর উপর থেকে মুছে যায়। হয়তো সেখান থেকেই স্যাম্পল পেয়েছে৷ আর মৃত্তিকার ডিএনএ স্যাম্পল নেওয়া তার কাছে কোনো ব্যাপারই না।”

মৃত্তিকা তাচ্ছিল্য করে হাসল। এসব ভালোবাসা আর সম্পর্ক থেকে বহু আগেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নতুন করে কঠিন হৃদয়ে ভালোবাসার পুষ্প প্রস্ফুটিত হতে পারে না৷ আর না কখনো সেটার আভাস নিজের মনে উঁকি দিতে দেবে৷ বসে থেকে বাঁ হাত দ্বারা ডান হাতের নখ খুটতে গিয়েই কথাটা মন্দ পড়ল তার৷ তাই সে বলল‚

“তোমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে ভাইয়া!”

অবাক হয়ে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “কী কাজ?”

“এই ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট পাল্টে দিতে হবে৷”

“কিন্তু কেন? তুই আমার সঙ্গে বাড়ি ফিরে চল বোন।”

“আমি জীবনে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি। অতীত পানে আমি আর তাকাতে চাই না৷ আর যেখানে ভালোবাসার উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যায় সেখানে তো আমি কখনোই ফিরে যাব না৷ এই মৃত্তিকা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর স্ত্রী। নিষ্ঠুর তার হৃদয়। অবহেলা পেতে পেতে সে পাথর হয়ে গিয়েছে। আগের সহজ সরল ভূমি পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছে ভাইয়া৷”

“এভাবে বলিস না বোন৷ তোকে অবিশ্বাস করার শাস্তি ভাই নিজেকে প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছে৷”

এবারও তাচ্ছিল্য করে ভূমি বলল‚ “উনার শাস্তি আগামী দশ বছরেও শেষ হবে না৷”

মৃত্তিকাকে শান্ত করানোর জন্য অর্পণ বলে উঠল‚ “আচ্ছা বোন আমাকে একটা কথা বল তো!”

সঙ্গে সঙ্গে মৃত্তিকা জিজ্ঞেস করল‚ “কী কথা?”

“এই এক বছর তুই কোথায় ছিলিস?

সেই রাতের কথা মনে পড়তেই মৃত্তিকার আঁখিদ্বয় হতে উষ্ণ অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল। সে বলল‚ “সেদিন আমার অনাগত বাচ্চাটার সঙ্গে সঙ্গে ভূমি সত্তাকে সমাধি দিয়েছি৷”

এক বছর আগের ঘটনা…

“সেদিন অতিরিক্ত ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ভূমি যখন অচৈতন্য হয়ে রাস্তায় ঢলে পড়ে‚ তখন ছেলেগুলো ভেবেছিল মেয়েটা হয়তো মা‘রা গিয়েছে৷ তাই তাদের বসের কথানু্যায়ী ভূমির লা’শটাকে একটা লেকের ধারে ফেলে দিয়ে আসে। ভূমির নিথর শরীরটা সারাটা রাত বৃষ্টির পানিতে ভিজেছে৷ পরের দিন সকালে এডভোকেট মাহেন্দ্র রায়চৌধুরী জগিং করতে সেই লেকে আসেন। কিনারায় ভীড় দেখতে পেয়ে তিনি সেখানটায় যান৷ ভেজা শরীরে র’ক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে ভূমির দেহটা৷ কোনো দিক না ভেবেই তিনি তার কাছে যান৷ কপালে কে’টে যাওয়া স্থানে র’ক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে৷ মাহেন্দ্র রায়চৌধুরী নিজের ডান হাতের তর্জনী ভূমির নাকের কাছে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন‚ নিশ্বাস পড়ছে কি-না। সঙ্গে সঙ্গেই চমকে ওঠেন। মেয়েটার নিশ্বাস পড়ছে৷ এরপর যত দ্রুত সম্ভব ভীড় কমানোর চেষ্টা করেন তিনি৷ দুটো মেয়ের সাহায্যে ভূমিকে লেকের কিনারা হতে তুলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন তিনি৷ মেয়েটা এভাবে ভেজা অবস্থায় থাকলে আরও সমস্যা হতে পারে৷ মাহেন্দ্র রায়চৌধুরী ভাবলেন‚ এত কিছুর পরও যেহেতু মেয়েটা বেঁচে রয়েছে তার মানে— উপর ওয়ালা এই মেয়ের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন৷ যে করেই হোক মেয়েটাকে উনার বাঁচাতেই হবে৷ এমনটাই জেদ ধরেছিলেন তিনি৷ এরপর একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে ভূমির চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা হয়৷ এই ক্লিনিকে সুদর্শিনীর স্বামী অর্ণব ডক্টর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে মাস ছয়েক হবে। কিন্তু এই স্বল্প সময়ের মাঝেও দারুণ দারুণ কাজ করেছে সে। ভূমির সমস্ত চিকিৎসা মূলত অর্ণবই করেছে। পুরো বাহাত্তর ঘণ্টা পর ভূমির জ্ঞান ফেরে৷ সেদিন ভূমিকে বাঁচাতে পারলেও অনাগত নিষ্পাপ প্রাণটাকে বাঁচানো যায়নি। পেটে বেশ জোরে আঘাত পাওয়ার ফলে এমনটা হয়েছে। সেদিন ভূমি প্রচণ্ড কান্না করেছিল। প্রায় তিনমাস মেন্টাল ট্রমাতেই ছিল সে। নিঃসন্তান হওয়ার দরুন মি. এবং মিসেস রায়চৌধুরী মিলে ঠিক করেছিলেন‚ ভূমিকে দুনিয়ার সামনে নিজের মেয়ের পরিচয় দেবেন৷ ভূমি থেকে তার নামকরণ হবে “মৃত্তিকা” নামে৷ এরপর থেকে ভূমির একটা নতুন পরিচয় হয়। এই নতুন জীবনের পেছনে সবথেকে বড়ো অবদান হচ্ছে‚ মাহেন্দ্র রায়চৌধুরীর৷ দুনিয়ার নজরে ভূমিকে স্মার্ট আর শিক্ষিত করতে তারা উঠে পড়ে লাগেন। বিশেষ করে‚ সুদর্শিনী! টানা সাত মাসের কষ্টের ফসল হচ্ছে ভূমি থেকে মৃত্তিকা হবার গল্পটা৷ মাহেন্দ্র রায়চৌধুরী‚ তনুজা‚ সুদর্শিনী আর অর্ণব এটা উপলব্ধি করেছে যে‚ ‘জীবন যে নাটকের থেকেও নাটকীয়’ আর তার প্রমাণ তো ভূমি রয়েছেই৷ ভূমি তার লঙ্ঘিত অতীতের প্রত্যেকটা কথা উনাদের জানিয়েছে৷”

বর্তমান…

মৃত্তিকার এসব কথা শুনে অর্পণ বলে উঠল‚ “ওই মেহরাব শিকদারের ধ্বংস না দেখা অবধি আমার শান্তি হবে না। তুই আমাকে এ কোন যাঁতাকলে ফেললি বোন? টানা একবছর সব দেখেও না দেখার ভান করে আছি। একদিকে নিজের ভাইকে প্রতিনিয়ত গুমরে গুমরে নিঃশেষ হতে দেখছি আর অন্যদিকে সমস্ত সত্যিটা জানার পরও ওই অপরাধীকে চোখের সামনে দিব্যি ঘোরাফেরা করতে দেখছি। অথচ চেয়েও আমি সবাইকে সত্যিটা বলতে পারছি না৷ তোর কাছে দেওয়া ওয়াদাটা তুই তুলে নে বোন।”

“তুমি আর চিন্তা কোরো না ভাইয়া৷ এবার তো আমি এসে পড়েছি। আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমি তাদের সুদে আসলে ফিরিয়ে দেব।”

মৃত্তিকার কাছ থেকে বারবার একই উত্তর পেয়ে হতাশ অর্পণ। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে মৃত্তিকাকে বলল„ “তুই ভাইকে ভুল বুঝিস না।”

“ঠিকই ভাবছি আমি। উনার কাছে আমি আর ফিরে যেতে চাই না।”

আবারও হতাশ অর্পণ। জোর করে কিছুই যে হবে না তা সে বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে। মৃত্তিকা আবারও বলল‚

“উনার কাছে আমি শুধুমাত্র ভালোবাসা আর বিশ্বাস চেয়েছিলাম৷ কিন্তু সে আমাকে এক আকাশসম অপূর্ণতা উপহার দিয়েছে৷ আসোল কথা হচ্ছে— যে যা চায় তা সচরাচর পায় না অথচ না চাইতেই মানুষ অনেক কিছু পেয়ে যায়। উনার প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কোনো অনুভূতিই অবশিষ্ট নেই ভাইয়া।”

মৃত্তিকার এহেন কথার পরিপ্রেক্ষিতে অর্পণ বলল‚ “একটা কথা ভুলে যাস না— ঘৃণা তাকেই করা যায়‚ যাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসা যায়।”

অতি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মৃত্তিকা বলল‚ “এসব বানোয়াট কথাবার্তায় আমি বিশ্বাসী নই।”

“তোকে এই কথাটা মানতেই হবে। ভালোবাসার বিপরীতরূপ হচ্ছে ঘৃণা৷”

ভালোবাসার কথা উঠতেই মৃত্তিকার পালাই পালাই শুরু হয়ে গিয়েছে৷ প্রলয়ের ব্যাপারে কোনো কথাই বলতে চাইছে না সে। কথাটা কাটাতেই মূলত এমন করছে৷ তাই অর্পণের শেষ কথাগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে মৃত্তিকা বলল‚ “বেলা গড়াচ্ছে। আমাকে ফিরতে হবে৷”

চলে যাওয়ার কথা শুনে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “এখন কোথায় যাবি?”

“যারা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। যাদের বদৌলতে আমি এডভোকেট মাহেন্দ্র রায়চৌধুরীর মেয়ের পরিচয় পেয়েছি। মামনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন৷”

নিজের ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে মৃত্তিকা দাঁড়াল৷ তার সঙ্গে সঙ্গে অর্পণও দাঁড়াল৷ সেও এখন বাড়ি ফিরে যাবে। যাওয়ার আগে অর্পণের হাত ধরে মৃত্তিকা বলল‚

“আমি মৃত্তিকা হয়েই বাঁচতে চাই৷ তুমি প্লিজ এই রিপোর্টটাকে পাল্টে দিয়ো। আশাকরি তুমি আমার এই কথাটা রাখবে৷”

“তুই চিন্তা করিস না— আমি রিপোর্ট পাল্টে দেব।”

“আসছি ভাইয়া।”

“আমি পৌঁছে দিই?”

“আমি যেতে পারব।”

“কোনো কথা শুনছি না আমি। তুই একটু অপেক্ষা কর— আমি বাইক নিয়ে আসছি।”

মৃত্তিকা আর কিছুই বলল না৷ জানে‚ অর্পণ তার বারণ শুনবে না৷ সেই আম গাছটার নিচেই দাঁড়িয়ে রইল মৃত্তিকা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গেই অর্পণ তার বাইক নিয়ে আম গাছটার নিচে চলে এলো৷ এরপর হেলমেট এগিয়ে দিতেই হাসি মুখে মৃত্তিকা সেটা পড়ে বাইকে চড়ে বসল৷ অর্পণ তার বোনকে আগে বাড়ি পৌঁছে দেবে তারপর সে রিপোর্ট পরিবর্তন করার কাজে লেগে পড়বে। এতে করে হয়তো তার ভাই কষ্ট পাবে কিন্তু কিছুই করার নেই। একদিন হয়তো ওদের দুজনের মাঝে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই নিয়ে মৃত্তিকাকে কোনো জোর জবরদস্তি সে করবে না। তার বোন যেদিন মনে করবে যে‚ প্রলয়ের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত সেদিনই যাবে। আর সেদিনের প্রহর গুনছে অর্পণ। কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইক স্টার্ট দিল সে। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে৷ মিনিট দশেকের মাঝেই হয়তো সন্ধ্যা নেমে আসবে। আমগাছের ফাঁকফোকর থেকে হেলে পড়া প্রকাণ্ড সূর্যটা একটু একটু দেখা যাচ্ছে৷ বাইক চলছে তার আপন গতিতে। সূর্যের কমলাটে আলো আছড়ে পড়ছে দুজনের মুখের বাঁ পাশটায়। বাইক চলার গতিবেগ অনুযায়ী সাঁই বেগে বাতাস বইছে৷ বেশ ভালোই লাগছে মৃত্তিকার। সমস্ত ক্লান্তি যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গিয়েছে।

চলবে?…..

আজ থেকে তৃতীয় পরিচ্ছেদ শুরু৷ এখন থেকে মৃত্তিকাকে নিয়ে লেখা হবে পরবর্তী সকল পর্ব। আশাকরি কেউ ধৈর্যহারা হবেন না৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here