রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৭২| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
617

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৭২|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

অবসাদগ্রস্ত আঁধারিয়া বাহ্যজগতে৷ বাতাবরণে নেমেছে নিস্তব্ধতা। বারান্দায় রেলিং ঘেঁষে দূরাকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে প্রলয়। শ্যাম পুরুষের গম্ভীর মুখপানে আজ চিন্তার ভাজ৷ সে মূলত অর্পণের বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করছে৷ সেই যে সকালে বের হয়েছিল এখানো আসার নামগন্ধ নেই৷ আজই তো ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে আসার কথা৷ সে অসুস্থ বিধায় বাড়ি থেকে বের হবার অনুমতি নেই তার তাই অর্পণকে বলেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে‚ সে-ই তো নিয়ে আসতে পারত। প্রলয় একটা সিগারেট ধরাল। আজ এর প্রয়োজন খুব করে। একটা সময় এই জিনিসটাকে জীবন থেকে বিতারিত করেছিল৷ ভূমি সিগারেটে ধোঁয়া সহ্য করতে পারত না। মেয়েটার নাকি নিশ্বাস নিতে কষ্ট হত। ভূমি তার জীবন থেকে চলে গিয়েছে কিন্তু ভূমির অপছন্দের এই জিনিসটা আজও তার জীবনের ছায়ার মতো পড়ে রয়েছে৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রলয়। জীবনে এই দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। তার আজও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা‚ “যেদিন ভূমি তার জীবন থেকে।চলে গিয়েছিল। তার একটা ভুলের জন্যই আজ সবকিছু এলোমেলো। এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত সে কীভাবে করবে তার জানা নেই। সেদিন রাতে ভূমিকে অনেক জায়গায় খুঁজেছে কিন্তু কোথায় পায়নি। সারারাত‚ পরের দিন পর্যন্ত ভূমিকে খুঁজে বেরিয়েছে। এরপর একদিন হঠাৎ খবর এলো‚ মাঠের এক কোণে একটা মেয়ের লা’শ পাওয়া গিয়েছে৷ পুলিশ তদন্ত করে বুঝতে পারে‚ সেটা নাকি ভূমির লা’শ৷ পুলিশের পাওয়া লা’শটার মুখ স্পষ্ট ছিল না। সবাই সেটাকে ভূমির লা’শ ধরে নিলেও মানতে পারল না প্রলয় এবং অর্পণ। তাদের ধারণা এটা কিছুতেই ভূমি হতে পারে না। তারপর একদিন কিছু একটা খুঁজতে গিয়ে বিছানার পাশের টেবিলের একেবারে নিচের ড্রয়ারে জন্ম নিরোধক টেবলেটের প্যাকেটটা পায় সে। পুরো তিনটে পাতাই ভরতি ছিল৷ তার মানে ভূমি এই ঔষধ গুলো কখনো খায়নি। সেদিন কিছু বলতে নিচ্ছিল মেয়েটা। কিন্তু তার কথাগুলো অপূর্ণই রয়ে গেল৷ বাচ্চাটা তারই ছিল আর সে কি-না ভূমিকে অবিশ্বাস করার মতো জঘন্য ভুল করেছে৷ এরপর নিজেকে গম্ভীর কঠোর প্রমাণ করা শ্যাম পুরুষও সেদিন ভেঙে গুড়িয়ে পড়েছিল৷ নিজেকে সে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না।”

সবকিছু মনে পড়তেই প্রলয়ের অক্ষিকোটর হতে তরল অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে নিল সে। তার চোখের পানি সে কাউকেই দেখাতে চায় না৷ পুরো দুনিয়ার কাছে সে একজন গম্ভীর এবং দাম্ভিক মানুষ হয়ে বাঁচতে চায়। এরই মাঝে অর্পণ চলে এসেছে। বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে অর্পণের বাইকটা লক্ষ্য করেছে প্রলয়৷ হাত থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা নিচে ফেলে দিয়ে‚ দ্রুত পায়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল৷ বাড়ি ফিরে অর্পণ অবশ্যই তার ঘরে আগে প্রবেশ করবে। প্রলয় একবার ঘড়ির দিকে তাকাল৷ রাত নয়টা বাজতে চলল৷ এমনিতে তো অর্পণ হসপিটাল থেকে সন্ধ্যের পরপরই বেরিয়ে পড়ে। এবার প্রলয়ের ভাবনাই সঠিক হলো। অর্পণ প্রথমেই তার ঘরে এসেছে৷ তাকে এভাবে দেরি করে বাড়ি ফিরতে দেখে প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚

“এত দেরি কেন হলো তোর?”

প্রলয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে অর্পণ বলল‚ “হসপিটালে একটু ব্যস্ত ছিলাম ভাই। তাই রিপোর্ট আনতে দেরি হয়ে গিয়েছে।”

অর্পণ ইচ্ছে করেই মিথ্যে কথা বলল। ভুল রিপোর্ট দেখে তার ভাইয়ের রিয়েকশন কী হতে পারে তা সে বেশ ভালোই জানে। তবে ব্যাপারটাকে তো ধামাচাপা দিতেই হবে৷ ভূমি যেহেতু চাইছে তারমানে তার অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে। অর্পণ তার হাতে থাকা রিপোর্টটা প্রলয়ের হাতে দিয়ে নিজে থেকেই বলল‚

“ডিএনএ ম্যাচ করছে না ভাই৷”

“এটা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না৷ আমি অন্য কোনো ল্যাবে গিয়ে আবারও টেস্ট করাব।

“একটা কথা কেন ভুলে যাচ্ছ ভাই— পৃথিবীতে একই চেহারার সাতজন মানুষ রয়েছে৷”

“তার জন্য কী সব একই চেহারা কী বাংলাদেশেই বসবাস করছে? আমার কী মনে হয় জানিস? কিছু একটা গন্ডগোল অবশ্যই আছে৷ মৃত্তিকার কাছে গেলে আমি ভূমিকে অনুভব করি।”

“দুজনের চেহারায় মিল আছে তাই হয়তো তোমার এমন মনে হচ্ছে৷”

“এতটা মিল আদতে হয়?”

”এতটা মিল কোথায়? তুমিই তো বললে— ভূমির সঙ্গে নাকি ওই মেয়ের আকাশ পালাত তফাৎ!”

“তা অবশ্য ঠিক৷ ভূমি যদি জল হয়‚ ওই মেয়ে নির্ঘাত পাবক শিখা। এক কথায় বলতে গেলে ধানিলংকা।”

প্রলয়ের কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠল অর্পণ। একমাত্র সে-ই জানে তার বোন কতটা বদলে নিয়েছে নিজেকে! ভূমির পরিবর্তন সে আজ লক্ষ্য করেছে। একদিকে যেন প্রলয়ের জন্য তার খারাপ লাগছে‚ অন্যদিকে প্রলয়কে বোকা বানাতে পেরে হাসিও লাগছে তার। এদিকে তার এই হাসির কারণ ধরতে পারল না প্রলয়। হুট করে হাসারই বা কী হলো? সে কী কোনো হাসির কথা বলেছে? চোখ ছোটো ছোটো করে অর্পণের দিকে তাকিয়ে প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚

“হাসির কী বললাম আমি?”

ডান হাত দ্বারা মুখ বন্ধ করে অর্পণ বলল‚ “কই আমি তো তোমার কথায় হাসছি না৷ আমার একটা পুরোনো কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তাই হাসছিলাম৷ আচ্ছা শোন ভাই— আমার খুব ক্লান্ত লাগছে আমি ঘরে গেলাম।”

সায় জানাল প্রলয়। মুখে বলল‚ “হুম আয়!”

অর্পণ চলে যেতেই ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেয়ালে সজোরে আঘাত করল প্রলয়৷ একবার নয়— বেশ কয়েকবার। মুহূর্তেই হাতের পিঠ র’ক্ত রঞ্জিত বর্ণ ধারণ করেছে৷ জ্বলছে ভীষণ। প্রলয় ভেতরে ভেতরে গুমরে ম’রছে। অপরাধবোধ তাকে শেষ করে দিচ্ছে। কেন সেদিন ভূমিকে ভুল বুঝেছিল সে? নিজের দোষেই তো সে ভূমিকে হারিয়েছে৷ মেঝেতেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল প্রলয়৷ গলা ভেঙে আসছে। পুরুষ মানুষের কান্নাগুলো হয়তো গলাতেই আটকে যায়। পুরুষ মানুষ হচ্ছে পৃথিবীর রহস্যময় জীব। তাদের বুক ফাঁটে কিন্তু কারো সামনে চোখ ফেঁটে দু ফোঁটা জল গড়ায় না৷ তারা হয়তো গলা ঝেড়ে মেয়ে মানুষদের মতো কাঁদতে পারে না। কিন্তু কষ্ট তাদেরও হয়।

বাহির থেকে কারো পায়ের শব্দ আসছে৷ প্রলয় দ্রুত উঠে দাঁড়াল। রিপোর্টটাকে তোশকের নিচে লুকিয়ে রাখল৷ এরই মাঝে কথা বলতে বলতেই তৃপ্তি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল‚

“আন্টি আপনাকে খেতে ডাকছেন৷”

তৃপ্তির এভাবে হুট করে চলে আসায় ভীষণ রাগ হলো প্রলয়ের৷ নিজের চাপা রাগটাকে এবার প্রকাশ করেই ফেলল৷ প্রলয় চেঁচিয়ে বলল‚

“আপনাকে আমি ঠিক কতবার বলব যে‚ সময় অসময়ে কখনো আমার ঘরে আপনি আসবে না।”

“এভাবে হুট করে চলে আসায় আমি সত্যিই দুঃখিত। আন্টি আমাকে জোর করে পাঠালেন আপনাকে ডাকার জন্য।”

এবার প্রলয়ের হাতের দিকে খেয়াল করল তৃপ্তি। ঝরঝরে করে র’ক্ত ঝরছে।

“এ কী আপনার হাত থেকে তো রক্ত ঝরছে।”

“ও কিছু না। আপনি এখন আসতে পারেন। আমার সময় হলে আমি নিশ্চয়ই খেতে যাব। এই কথাটা আপনার আন্টিকে খুব ভালো করে বলে দেবেন। আর হ্যাঁ আপনার আন্টি যতই বলুক আমার ঘরের সামনে ঘুরঘুর করার কথা। কিন্তু আপনাকে যেন পরবর্তীতে আমার ঘরে আর না দেখি।”

প্রলয়ের কাছ থেকে এমন অপমানজনক কথা শুনে তৃপ্তির মুখটা থমথমে হয়ে গিয়েছে। বেচারি বোধ হয় যেকোনো সময় কেঁদে দিতে পারে। প্রলয় মোটেও গুরুত্ব দিল না৷ গম্ভীর স্বরে শুধু বলল‚

“আপনি এখন আসতে পারেন।”

তৃপ্তি আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। অপমানে জর্জরিত হয়ে তার ভীষণই কান্না পাচ্ছে। এর আগে এমন ভাবে তার সাথে কেউ কথা বলেনি। সে তো সেধে সেধে প্রলয়ের ঘরে যেতে চায়নি। শুধুমাত্র মাধুরীর কথায় সবটা হলো। উনি তো কথা শুনলেনই না উল্টো সবস্ত কটু কথা এসে জমা হলো তার উপর৷ না জানি তাকে নিয়ে প্রলয় কী না কী ভাবছে৷ তৃপ্তি চলে যেতেই প্রলয় একটা তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। হাতমুখ ধুয়ে এরপর নিচে যাবে৷

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here