#মন_শহরে_বসন্ত_হাওয়া |১৬|
#কে_এ_শিমলা ®
বিদায়ের ক্রন্দনরত পরিবেশ। রণয়ী জড়িয়ে ধরলো অনুরিমা কে। অনুরিমার মা কাঁদছেন একটি চেয়ারে বসে। তিনিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আরো মানুষজন। অনুরিমার বাবা আসলেন। ভাইও আসলো। দুজনে এগিয়ে নিয়ে গেলেন তাকে বাহিরের দিকে। পেছন থেকে অনুরিমার মা এসে আবার জড়িয়ে ধরলেন। অঝোরে কাঁদলেন তিনি। মা কে বুঝানোর ক্ষমতা কিংবা ভাষা আজ কোনোটাই নেই অনুরিমার। এই পঁচিশ ছাব্বিশটা বছর মায়ের আদর যত্নে বলতে গেলে আঁচলের নিচে থেকে কাটিয়েছে। আজ সেই শীতল শান্তির জায়গা, সে মমতাময়ী কে রেখে দূরে থাকার জন্য চলে যাচ্ছে। নিজের ঘর শুন্য করে পরের ঘর পূর্ণ করতে। নিজেরই তো বুক ভেঙ্গে আসছে। এই অবস্থায় সে কীই বা বলবে। গাড়িতে তুলে দেওয়া হলে তাকে। অনুরিমার মা কে ধরে রাখলো তার ভাই। অনুরিমার বাবার থেকে বিদায় নিল সিফাত। ফুলে সজ্জিত গাড়িটি ক্রমশ এগিয়ে যেতে লাগলো। অতঃপর চোখের আড়াল। অনুরিমার মা কে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন বাবা। বিয়ের বাড়ির জমজমাট পরিবেশ ধীরে ধীরে কমে আসতো লাগলো। অতিথিরা বিদায় নিচ্ছেন। বাড়ির অন্যরা সামলে নিচ্ছেন সব।”
বেরিয়ে এলো রণয়ী রোজা চৈতি নয়না ওরা। চৈতি বিদায় নিল ওদের থেকে। পায়ে হেঁটেই সে যেতে পারবে। ওরা দুজন পাশাপাশিই থাকে। তাছাড়া তাঁর ভাইও সাথে আছে। নয়না এবং তাঁর স্বামী গাড়িতে। তাদের সাথে রোজাকেও পাঠিয়ে দিল রণয়ী। তাকেও জোর করেছে ওরা। কিন্তু রণয়ী রাজি হয়নি। এমনিতেই সবাই ক্লান্ত। তাছাড়া সুমন অফিস করে বিয়ে বাড়িতে এসেছে। এতো টুকু পথ তাকে দিতে যাবে। আবার আসবে। পথিমধ্যে যদি জ্যাম হয় তাহলে তো হলোই। তাছাড়া রোজাও এতোটা পথ আবার তাঁর জন্য উল্টো যাবে। বাধ্য হয়ে সবাই চলে গেল। রণয়ী মোড়ে দাঁড়ালো। খুব বেশি রাত হয়নি। আটটা বেজে ঊনচল্লিশ মিনিট। রিকশা পাওয়া যাবে দ্রুত।”
মিনিট কয়েকের মধ্যে একটি গাড়ি সামনে এগিয়ে গিয়েও আবার পিছিয়ে এসে রণয়ীর সামনে থামলো। বরাবরের মতো কাঁচ উঠানো নেই। বরং আজ নামিয়ে রাখা। জানালার উপর হাত দিয়ে রেখেছে দুর্জয়।”
চোখের চশমা খুলে বললো, ‘চলে আসুন।”
‘আমাকে দিয়ে আপনি আবার আসবেন। তাঁর থেকে ভালো আমি রিকশা পেয়ে যাবো।”
‘আমার এটা গাড়ি! শ্রেফ গাড়িই। আপনি যেরকম অনিহা প্রকাশ করেন গাড়িতে উঠতে গেলে। এরকম করলে তো কিছুদিন পর আপনার জন্য নতুন গাড়ি খরিদ করতে হবে। তাও সমস্যা নেই। আজ চলে আসুন।”
সরল চোখে দেখলো রণয়ী দুর্জয় কে। দুর্জয় চোখে চোখ রাখলো না। বরং দৃষ্টি সরিয়ে হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। রণয়ী ধীর পায়ে গিয়ে আসলো। পেছনের ডোর খুলে দেওয়া হলে উঠে বসলো। আজকাল তেমন একটা অস্বস্তি হয়না তবে খানিকটা হয়ই।”
দুর্জয় দেখে নিল একবার রণয়ী কে। কিছু কথা বলার ছিল। কিন্তু তাকে দেখে মনে হলো ক্লান্ত। থাক! রেখে দিল সে। এতোটা ও গুরুত্বপূর্ণ নয়। কাল বলা যাবে অফিসে সুযোগ মিললে। আর সুযোগ মিলবে কী? অবশ্যই তাকে দুই থেকে তিনবার কেবিনে যেতেই হবে।”
রণয়ী কে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল দুর্জয়। প্রতিবারের মতো এবারেও মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে রণয়ী এমন নয়। বরং গলা অব্দি আসে আমাদের বাসায় আসুন। কিন্তু মুখ দিয়ে আর বের হয় না। সেদিন বলায় সরাসরি দুর্জয় না করেনি বলেছিল, অন্য একদিন ইনশাআল্লাহ। আর আজ তো! এই তিন চারদিন অতঃপর সে এমনিই আসবে। জামাই হয়ে!”
~~~~~•••••••
ধীরে ধীরে কেটে গেল এই অল্প দুই তিনটা দিন। কেনাকাটা করা হয়েছে। একটা সেন্টার দেখা হয়েছে। সেখানেই বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। আজ বৃহস্পতিবার। রাত পোহালেই শুক্রবার অতঃপর শুভক্ষণ। ছোটখাটো ভাবে একটা হলুদ সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছে আজ। রণয়ীর পরিচিত জন! কলিগ! ফ্রেন্ড। রাজশাহী থেকে দুইজন বান্ধবী এসেছে। মামাতো বোন নিজেও হাজব্যান্ড নিয়ে এসেছে। রিদিমার বান্ধবী নিরা নিজেও এসেছে। যখন শুনেছে সে দুর্জয়ের সাথে বিয়ে! চোখ তো তাঁর কপালে। জানা আছে দুর্জয় সম্পর্কে। তবু সেও খুশি। যাক এতো দিনে মেয়েটা তবে সঠিক মানুষ পেতে যাচ্ছে। হলুদের পর্ব শেষে এলো মেহেদী। চৈতি পারে মেহেদী পড়াতে। অনুরিমার বিয়েতেও তাকে সেইই পড়িয়ে দিয়েছিল। তাই সে দুহাত ভরে মনের মতো করে মেহেদী পড়িয়ে দিল। কাঁচা হলুদ রঙা শাড়িতে, এবং ফুলের গয়নায় বেশ লাগছে রণয়ী কে। রণয়ী যে মুখ বেজার করে বসে আছে তা নয়। বরং তাঁর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলে রয়েছে। একেকজনের একেক রকম কথায় তাঁর প্রতিক্রিয়া ও দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ অচেনা কেউ দেখলে তাকে বলতে বাধ্য বিয়েটা তাঁর পুরো সম্মতিতেই হচ্ছে। এমন কী এটা তাঁর নতুন এবং প্রথম বিয়ে। মনমার, চেহারা মলিন নেই। মেজাজটাও ফুরফুরে মনে হচ্ছে। হাসছে, খাচ্ছে, কথাবার্তার জবাব ও দিচ্ছে। তাঁর এমন পরিবর্তন কিংবা আচরণ দেখে খুশি কাছের সবাই। বাকিটা জীবন এমন হাসিখুশি থাকলেই যেন হয়। রাবিয়া খানম মেয়ের আশেপাশে ঘুরে তাকে পরখ করলেন। না অভিনয় নয় এটা! বকের ভেতর শান্তি অনুভব করলেন তিনি। আল্লাহ তায়ালার দরবারে অশেষ শুকরিয়া।”
রণয়ী কে ঘিরে একপাশে বসেছে অবশ্য বাচ্চারা। তাদের মনোযোগ তাঁর হাতের মেহেদীতে। রাইজু কিছুক্ষণ পরপর গিয়ে জিজ্ঞেস করছে রিদিমা কে, ‘ফুপিমনি কী কাল চলে যাবে আম্মু! সত্যি চলে যাবে? আমাদের সাথে আর থাকবে না?”
প্রথমবার হ্যাঁ বলে দিলেও পরেরবার গুলোতে বলতে কষ্ট হলো রিদিমার। মেয়ের মুখ কালো হয়ে গিয়েছে এমনিতেই। বাচ্চারা সবাই যেখানে তাঁর হাতের মেহেদী দেখছে। সেখানে সে তাঁর ফুপিকেই দেখছে। অন্যসময় হলে ভাইয়ের সাথে চিপস নিয়ে একবার না একবার ছোটখাটো জগড়া একটি বাধিয়ে দিত। কিন্তু আজ সে ওসবে নেই। কী বুঝলো ছোট্ট মেয়েটা কে জানে। রিদিমা ডেকে আনলো মেয়েকে। সারাদিনে একবারো খায়নি। রাবিয়া খানম বারবার তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। এই মানুষটা নাতি নাতনি কে একটু বেশিই ভালোবাসেন। এই যে রামিনের ছেলে কে কোল থেকে রাখতেই চাচ্ছেন না। মেয়ে কে কোলে বসিয়ে খাইয়ে দিল রিদিমা বুঝিয়ে বুঝিয়ে। ‘বড় হলে সবাইকেই এভাবে যেতে হয়। আম্মু এসেছি না তোমার নানাবাড়ি থেকে? তোমার ছোটমা এসেছে না? তোমার ফুঁপিমনিও এভাবে যাচ্ছে। বড় হলে তুমিও যাবে। ওই যে তোমার নিরা আন্টির মেয়ে সুহিনীও যাবে। ওই যে পুতুল জুনায়না সেও যাবে।”
রাইজু জড়িয়ে ধরে বললো, ‘না আমি যাবো না। আম্মু, আব্বু, ভাই, দাদু, ফুপিমনি, ছোট আব্বু, ছোট আম্মু, ছোট ভাই কে রেখে আমি যাবো না। এখন ফুপি কেও যেতে দেবো না।”
‘আচ্ছা আমার আম্মা কে দেবো না। কিন্তু ফুপি কে তো এসে জুনায়না নিয়ে যাবে মামানি বলে। দেখো না সে ওইদিন ডাকলো মামানি বলে।”
‘না না পুতুল মেয়ে আমার ফুপিমনি কে মামানি ডেকে নিয়ে যাবে না। আমাদের বাসায় আসবে তারপর আমাদের সাথে থাকবে। তখন ফুপিমনি কে মামানি ডাকলে সমস্যা নেই।”
রিদিমা মেয়ের কথায় হেসে চোখের কোণা মুছলো। আহারে! এতোটা সহজ যদি হতো। রাইজু বাবাকেও বললো। রনক নিজেও বুঝালো। এভাবেই সে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।”
অতঃপর ভোর। ফজরের আজানের ধ্বনি কর্ণপাত হতেই রণয়ী নামাজে দাঁড়ায়। জেগে সে অনেক আগে থেকেই। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেছে। নিজের সাথে বোঝাপড়া সেরেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এই কটা দিনে তাঁর রক্তিমের কথা মনে আসেনি। ভাবনায় ও আসেনি। মাথায় ছিল শুধু কীভাবে প্রস্তুত করবে নিজেকে। আদৌ সবাই যেমন ভাবছে! তেমন পথচলা কী হবে।”
মোনাজাত শেষে রণয়ী দুহাতের মেহেদী দেখলো। গাঢ় রঙ হয়েছে। প্রথম বিয়েতে শুধু একহাতই রাঙিয়ে ছিল মেহেদী রঙে। জায়নামাজ গুছিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো। খানিকটা আবছায়া বাহিরে এখনো। শীতল সকাল। মোবাইল হাতে নিয়ে সে পা বাড়ায় ছাদের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে ফোনে দুর্জয়ের একটি ছবিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। এই ছবিটা রণয়ী কে রোজা দিয়েছিল। বিয়ের কথা যখন জানে তখন খানিকটা অভিমান করেছিল। কেন আগে বলেনি তাকে? রণয়ী বুঝিয়ে বলে। যদি শেষ অব্দি এসে না করে দিত তবে বলে শুধু শুধু কথা উড়িয়ে লাভ আছে? রোজা কিছু আর বলে না। বরং রাতে দুর্জয়ের দুই তিনটা ছবি দেয় তাকে। কেন দিয়েছে কে জানে। আর নিজেই বা পেল কোথায়? অনুরিমার বিয়েতে তোলা। হয়তো আবু সাঈদ দিয়েছে। এই দুজনের মধ্যে আগের থেকে এখন বেশ মিল মিশেলের সম্পর্ক দেখা যায়। ওই সেদিনের শপিং মল থেকে যাওয়ার পর হতে। অফিস থেকেও দুইতিন দিন একসাথে ফিরতে দেখা গিয়েছে।”
রণয়ী কেন যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো দুর্জয়ের ছবি। মনে ধরার মতো। কালো পাঞ্জাবি! সাদা প্যান্ট। হাতে দামি রিস্ট ওয়াচ। চোখে কালো সানগ্লাস। হঠাৎ লজ্জা লাগলো রণয়ীর। মোবাইল রেখে দিল পাশে। আকাশ পানে চাইলো। ঠোঁটের কোণে ফুটলো এক টুকরো হাসি। জীনের দ্বিতীয় এই পবিত্র বন্ধনের সফর দীর্ঘ হোক, সুন্দর হোক, খোদা তায়ালার রহমত থাকুক।”
রণয়ী যদি জানতো এপাশে কেউ তাঁর ছবিও দেখছে, তবে হয়তো আরো একটু বেশিই লাজে লাল হতো তাঁর শুভ্র কোমল কপোলদ্ধয়।”
ধীরে ধীরে সময় গড়ালো। পার্লারে আর যেতে হলো না। দুইজন বিউটিশিয়ান এসে সাজিয়ে দিয়ে গেল। শুভ্র রঙা শাড়ি। কনুই অব্দি শুভ্র ব্লাউজ। পাথরের কাজ সম্পূর্ণ শাড়িতে। মাথায় হিজাব। উপড়ে দুপাট্টা সেই শুভ্র রঙা। উভয়ের পছন্দের রঙ। হাত ভর্তি চুড়ি। সুন্দর সাদা পাথরের নথ! ঠোঁটে পিংক লিপস্টিক! চোখে আইলাইনার! আর্ট করা। উঁচু হিল। সেটাও সাদায় পাথর বসানো। অর্কিড দিয়ে তৈরি ফুলের তোড়া। সাদা একটি হ্যান্ডব্যাগ। অতঃপর তৈরি রণয়ী। গাড়িতে বসানো হলো তাকে। গন্তব্য সেন্টার! অতঃপর সেখান থেকে ইমাম মঞ্জিল।”
অপরদিকে দুর্জয়ের ও একই রঙের শেরওয়ানি। হাতে ব্র্যান্ডের ওয়াচ। চিকচিক করছে তা। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু, ভাই সবাই তৈরি। আগে তারা জুম্মার নামাজ আদায় করবে। অতঃপর সেন্টারে।”
দুই তলার একটি সেন্টার বুকিং করেছে রনক, রামিন। উপরের তলায় নারী এবং নিচ তলায় পুরুষ। আলাদা খাবারের ব্যবস্থা ও।”
জুম্মার নামাজ আদায় করে সেন্টারে আগমন ঘটলো বরের। প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় কাটলো। কাজী সাহেব বিয়ের কার্যক্রম শুরু করলেন। তিন লাখ টাকা দেনমোহর ধার্য করা হলো। রণয়ী কে কবুল বলতে বলা হলে, সে খানিকটা সময় নিল। এরপর বড় একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে, অতীতের সব মায়া, পিছুটান, ভুল, সব ত্যাগ করে কবুল বললো। অতঃপর দুজনের কবুল বলা এবং মোনাজাতের মধ্য দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হলো। বর কনে কে একসাথে করে ফটোশুট করা হলো। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শুরু হলো। খাবার টেবিলে পাশাপাশি নব বিবাহিতদের বসানো হলো। দুর্জয়ের মনে হলো ভেতর তাঁর মৃদু কাঁপছে। শুন্য হৃদয় আজ পূর্ণ হয়েছে সেই খুশিতে কী তবে! এক চামচ বিরিয়ানি খেতেই কাশি উঠে গেল রণয়ীর। দুর্জয় পানি এবং টিস্যু এগিয়ে দিল দ্রুত। পাশে বসা সবাই মিটমিট করে হাসলো একঝলক। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ। সময় কাটলো ঘন্টার পর ঘন্টা। পরপর তিন ঘন্টা। সন্ধ্যায় মাগরিবের আজানের পরপরই বিদায়ের পালা।”
শেষ মুহূর্তে এসে রণয়ী ভাইঝি কে ধরে কেঁদে দিল। সারাটা দিন সে নতুন পোশাক পড়ে ঘুরঘুর করেছে উপর নিচে। মায়ের ফোন, দাদুর ফোনে নিজের ফটো ফুপির ফটো তুলে তুলে হাজার খানেক হবে। নতুন সাজে ফুপি কে কত সুন্দর লাগছিল। অতঃপর বিদায়ের সময় আসতেই সবকিছু ছেড়ে সে রণয়ী কে জাপটে ধরে রইলো। কোনোভাবেই যেতে দিবে না ফুপিমনি কে। রোজা মিথ্যার আশ্রয় নিল। বললো, ‘ফুপিমনি তাদের বাসাতেই যাবে। পিছনের গাড়িতে ওরাও যাবে।’ সে শুনলো না। ফুপি সাজানো গাড়িতে যাচ্ছে সেও যাবে। রনক বুঝিয়ে কোলে তুলে নিতে গেলে দুর্জয় তাকে তাদের গাড়িতে তুলে দিল। মা কে জড়িয়ে ধরে বোনের পাগলামি দেখে বেচারা রাজন ও কেঁদে কেটে পাঞ্জাবি ভিজিয়ে দিয়েছে। তবে সে আর বোনের মতো যাওয়ার বায়না ধরলো না। জুমায়রা আস্বস্ত করলো রিদিমা কে সে তাঁর কাছে থাকবে। না হলে মায়ের কাছেও থাকতে পারবে। রিদিমা বাঁধা দিল না আর। এগিয়ে গেল তাদের গাড়ি। একে একে বর যাত্রীদের বাকি সব গাড়িও বেরিয়ে গেল। কনে পক্ষের গাড়িও। রনক বাসায় গিয়ে মা কে রেখে আসলো প্রথমে। তিনি প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বিশ্রামের প্রয়োজন।”
সেন্টার থেকে ইমাম মঞ্জিলে আসতে খুব বেশি সময় গেল না। আধা ঘন্টার পরিবর্তে কেবল পনেরো বিশ মিনিট বেশি লাগলো। রাইজু জড়িয়ে ধরিয়ে আছে রণয়ী কে। তবে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে সে দুর্জয় কে। ফুপিমনির সুন্দর স্বামী! তাঁর আঙ্কেল। খুব ভালো।”
ইমাম মঞ্জিলের গেট পেরিয়ে গাড়ি প্রবেশ করলো ভেতরে। চারদিকে লাল নীল মরিচবাতি। সুসজ্জিত বিশাল বাড়িটি। আলোয় আলোয় জ্বলমল করছে। গাড়ির দরজা খুলে দিলেন এমদাদ সাহেব। দুর্জয় নেমে রাইজুর দিকে হাত বাড়ালে সে নিঃশব্দে নেমে আসে। তাকে নামিয়ে দিয়ে রণয়ীর দিকে হাত বাড়ায় দুর্জয়।
রণয়ী একপলক দেখে নিচু মস্তকে আকড়ে ধরে বাড়িয়ে দেওয়া হাত। এই হাত বিশ্বস্ত! এই হাত এখন পবিত্র! এই হাত ভরসার! সুন্দর মনের মানুষটির ঘরণী অবশেষে সে হয়েই গেল। পারবে তাঁর মনের মতো হতো! যতটা ত্যাগ সে করলো তাঁর জন্য। জেনেশুনে তাকে যে সম্মান দিয়ে ঘরে তুলে আনলো। সে পারবে কী তাদের মন রাখতে। পাশাপাশি নব দম্পতি! সামনে রাইজু! তাঁর কোলে তাঁর পুতুল অর্থাৎ জুনায়না। দুজনের এমন মিল হয়েছে। রাইজু কে দেখতেই তাঁর কোলে চলে এসেছে সে।”
ইমাম পরিবারের একমাত্র পুত্রবধূ কে ঘরে তুললেন সৈয়দা জোহরা ইয়াসমিন। উপস্থিত দুর্জয়ের ফুপি জয়নব ইমাম ও। ভাইপোর বিয়ে শুনে চারদিন আগেই দেশে এসেছেন ইতালি থেকে। তিনির সাথে অবশ্য সৈয়দা জোহরা ইয়াসমিন শলাপরামর্শ করেছিলেন। তিনির স্পষ্ট জবাব। যে ঘর করবে তাঁর যদি সমস্যা না থাকে। আমাদের বলে কী হবে! কিছুই বলার নেই। আমাদের মেনে নেওয়া তাঁর মেনে নেওয়া না হলেও, তাঁর মেনে নেওয়া আমাদের মেনে নেওয়া। ঘর করবে সে! এখানে তাঁর পছন্দের থেকে আমাদের মতামত মূখ্য নয়।”
অতঃপর যখন রণয়ী কে দেখলেন মনে হলো না মেয়ের আরো একখানা বিয়ে হয়েছে ইতোমধ্যে। ভাইপোর ভাবীর পছন্দের তারিফ করতে হয় বটে।”
সময় কাটলো। সময় এখন রাত নয়টা বেজে আটাশ মিনিট। দুর্জয় ঘরে এলো। রণয়ী মোবাইলে তাদের বিয়ের ফটো দেখছিল। তাদের কম! দুর্জয়ের বেশি। সব রোজা অনুরিমা চৈতির কারসাজি। সঙ্গে সোবা, সায়রা ও যোগ দিয়েছে। এই মেয়ে গুলো ও না। কী পরিমাণ জ্বালাতে পারে এরা। ফোন রেখে দিল সে। রণয়ী সালাম করলো দুর্জয় কে। দুজনে নামাজ আদায় করে নিল। জায়নামাজে বসে রইলো দু’জন। দুর্জয় পিছিয়ে এসে বসলো রণয়ীর মুখোমুখি। দেখলো দু’চোখ ভরে। আজ দেখতে তো আর কোনো বাঁধা নেই। রণয়ী সরলো না। নত মস্তকে লাজুক হাসি নিয়ে লাল বর্ণ ধারণ করা গাল নিয়ে বসে রইলো জায়গায়। পুরো হক আছে এখন এই মানুষটার তাকে দেখার।”
দুর্জয় উঠে গিয়ে আলমিরা খুলে টাকা নিয়ে এলো। দেনমোহরের পুরো টাকা রণয়ীর হাতের মুঠোয় দিলে সে তাকায় তাঁর দিকে। দুর্জয় মুচকি হেসে বললো, ‘এটা আপনার হক!”
সেই টাকা ভর্তি হাত উঁচিয়ে অষ্ট ছুঁইয়ে দিল। আকড়ে ধরলো টাকা রণয়ী খানিকটা জোরে। স্বাভাবিক ভাবে নেওয়া চেষ্টা করলো সে। দুর্জয় তাঁর দুপাট্টা ঠিক করে দিতে দিতে বললো,
‘আলহামদুলিল্লাহ! দশ বছর আগে শুনেছিলাম বউ হবেন। অতঃপর দশ বছর পর পেলাম। অপেক্ষাটা আপনার জন্য ছিল নাকি এমনিই ছিল জানিনা। তবে পেয়েছি। এই দশ বছরে কী হলো না হলো তা আর দেখতে চাই না। আপনি মনে করুন তাও চাই না। আমার সাথে পথ চলবেন! দুই জীবনেই। সময় নিন! আপনি নিজেকে মানিয়ে নিন। ভরসা করতে পারেন। বিশ্বাস ও করতে পারেন। আপনার বিশ্বাস ভরসা ভাঙ্গবো না ইনশাআল্লাহ। পাশাপাশি থাকতে থাকতে! একসাথে পথ চলতে চলতে! দুঃখ সুখের শত গল্প করতে করতে মায়া জন্মে যাবে। আর মায়া চলে আসলো ভালোবাসা এমনিই চলে আসবে। আর যে ভালোবাসায় মায়া! বিশ্বাস! ভরসা! যত্ন আছে সেই ভালোবাসার দৃঢ়তা নিশ্চয় একটুখানি নয়। আমার মতে সীমাহীন। অনেক দৃঢ় বন্ধন! যতটা দৃঢ় হলে ছেড়ে যাওয়া যাবে না। আপনার আমার সংসার জীবন রহমতে ভরপুর হোক। আপনার জন্য দোয়া রইলো। শুরু করুন! পাশে আছি। বিয়েটা পুরো মায়ের পছন্দে করেছি এমনটা নয়। বরং আমি আপনাকে পছন্দ করেই বিয়ে করেছি। আমি জানি আপনি আমায় মাঝপথে ফেলে যাবেন না। ইনশাআল্লাহ যাবে না।”
‘যাবো না ইনশাআল্লাহ!”
মুগ্ধ করা কথা গুলোর বিপরীতে এই কথা গুলো তো বলাই যায়।”
চলবে!