#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_১০_বর্ধিত_অংশ
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
(প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
প্রহরের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার পরে আর সবার সাথে বসে কখনো কথা বলেনি মেয়েটা। সারাদিন পাগলামি করা মেয়েটা চুপ হয়ে গেলে মোটেও কারো ভালো লাগে না।
” কন্ঠ রুমে একা একা বসে কী করবি? তারচেয়ে চল বসার ঘরে সবাই একসাথে বসে পকোড়া খেতে খেতে আড্ডা দিবো।”
ইফতি কন্ঠর পেছনে দাঁড়িয়েই বললো কথাগুলো। কন্ঠ ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। ঘরের বাতি নেভানো। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় ইফতিকে অদ্ভুত লাগলো কন্ঠর কাছে। এতো অশান্তিতে ইফতির সাথে তার বিয়ের কথা বেমালুম ভুলে গেছিল কন্ঠ। এই মানুষটা তাকে কেনো বিয়ে করতে চায়? কখনো তো তেমন কোনো ইশারা পায়নি ইফতির থেকে সে। ভাবনাদের একপাশে সরিয়ে ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিলো কন্ঠ। ইফতি কন্ঠর দিকে দৃষ্টিপাত করলো এবার। সুন্দর মুখশ্রী কেমন মলিন থাকে সব সময়। হরিণীর মতো চোখগুলোর নিচে কালোদাগ হয়ে গেছে। চুলগুলোও আগের চেয়ে উষ্কখুষ্ক হয়ে গেছে। সবকিছুই যে নিজের প্রতি অযত্ন,অবহেলার ফল সেটা ইফতি জানে।
” তুমি যাও আমি যাবো না। বিছানা ঠিক করে ঘুমাবো।”
ইফতিকে তুমি এবং আপনি একসাথে দুটোই সম্মোধন করতো কন্ঠ। কিন্তু একদিন ইফতি ধমক দেওয়ার পর থেকে একেবারে তুমিতে এসে ঠেকেছে সেটা।
” আমি তোকে না নিয়ে গেলে ওদের সামনে আমার ইজ্জত থাকবে না কন্ঠ।”
ইফতি নরম সুরে বললো। কন্ঠ একবার তাকালো ইফতির চেহারার দিকে। কোথায় সেই গাম্ভীর্যের ছটা? কেমন বাচ্চাদের মতো বায়না করে আজকাল লোকটা। এই মানুষটার অসম্মান কোনো মতেই চায় না কন্ঠ। হোক সেটা ঘরে কিংবা বাইরে। কী করবে? কন্ঠ নিজেও চায় স্বাভাবিক হতে কিন্তু দিনশেষে কষ্টগুলো ফিরে আসে বারবার।
” ঠিক আছে। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ বসবো আর ওসব লুডু খেলতে পারবোনা। ”
” ঠিক আছে। ”
ইফতি সবগুলো দাঁত বের করে চমৎকার একটা হাসি দিলো। মনে হয় আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছে এমন কিছু।
কথামতো এক ঘন্টা বসার ঘরে ছিলো কন্ঠ। তবে কোনো প্রকার কথা বলেনি। শুধু মাথা নেড়ে হু হা করে গেছে কথার উত্তর দিতে। রাত দশটার দিকে সমুদ্ররা নিজেদের বাসায় ফিরে যায়। শুধু ইফতি থাকে। কন্ঠর বাবা ইফতির সাথে কথা বলবেন বলে রাতের খাওয়াদাওয়া করে যেতে বলেছেন একবারে। সমুদ্র আর বিনাকেও বলেছিলো খেয়ে যেতে কিন্তু ওদের না-কি পেটে আর জায়গা নেই। এদিক থেকে ইফতি ভোজনরসিক মানুষ বটে। কন্ঠ রাতে কিছু খায় না আজকাল। ইফতি জোরাজোরি করেও পারে না খাওয়াতে। ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছেন মজিদ মল্লিক ও ইফতি মল্লিক। শারমিন সুলতানা দু’জনকে খাবার পরিবেশন করে নিজেও খেতে বসেছেন।
” অনেক দিন তো হলো ইফতি,এখন কন্ঠ মোটামুটি ঠিক আছে। জাহাঙ্গীর আর শায়লা বলছিল তোদের বিয়েটা এখন দিয়ে দিতে। তোর কী মতামত? ”
খেতে খেতে কথা বলতে লাগলেন কন্ঠর বাবা। ইফতির খাওয়া শেষ এরমধ্যেই। কন্ঠ খায়নি ভেবে সব খাবার আর খাওয়া সম্ভব হলোনা তার পক্ষে।
” আমার কোনো আপত্তি নেই বড়ো আব্বু। তবে কন্ঠর মতের বিরুদ্ধে কিছু হবে না। ”
” কন্ঠকে জোর আমরাও করবো না। তবে বোঝাবো।”
” একমাত্র মেয়ে আমাদের। তুই তো নিজেদের লোক। সবকিছুই বুঝিস। তাছাড়া এই যে দিনদিন ওর খেয়াল রাখার জন্য ছোটাছুটি করে আসিস বিয়ে হয়ে গেলে তোরও সুবিধা। আর লোকজনের কানাঘুঁষাও কমবে।”
কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন কন্ঠর মা। লোকের আর কাজ কী? কোথায় কার কী হলো সেই নিয়ে তাদের মহা চিন্তা!
” তুমি এতকিছু ভেবো না বড়ো মা। বাইরের লোকজন দিয়ে আমাদের দরকার নেই। কন্ঠর সাথে কথা বলে দেখো। ”
” ঠিক আছে। আমি কালকে কথা বলবো ওর সাথে। ”
” আচ্ছা বড়ো আব্বু, এখন আসি তাহলে। ”
মজিদ মল্লিক ইফতিকে বিদায় দিলেন। কন্ঠর ঘরের দরজা খোলাই থাকে। ইফতি যাওয়ার আগে দরজা ফাঁক করে এক নজর দেখে নিলো কন্ঠকে। গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটা। মনে হয় কাঁদছে। ইফতির বুকের ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। দ্রুত দরজা চাপিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো ইফতি। কন্ঠকে ভালো রাখতে হলেও দ্রুত নিজের কাছে এনে রাখা দরকার তাকে। একা কাঁদার চেয়ে একটা বিশ্বস্ত বুকে মাথা রেখে কাঁদা নিশ্চয়ই স্বস্তির। তবে সমস্যা হলো আমরা যার জন্য কষ্ট পেয়ে কাঁদি তার বুকেই মাথা রেখে কষ্ট ভুলতে চাই। অথচ সে যদি বুক পেতে দিতো আমাদের আর কাঁদতে হতোই না!
” বিনা এদিকে এসো তো।”
বিছানার দুইপাশে দু’জন শুয়ে শুয়ে। তবুও বিনাকে কাছে ডাকায় বিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সমুদ্রর দিকে।
” কী হলো? ওভাবে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলে কেনো?”
” আমি তো আপনার পাশেই আছি শুয়ে! এরপর আর কত কাছে যাবো?”
” তুমি কি সত্যি বোঝো না কিছু? ”
” মিথ্যা মিথ্যা কি বোঝা যায়? ”
বিনার অদ্ভুত প্রশ্নে সমুদ্র হাসে। বিনার সাথে এখনো স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক এখনো তৈরি হয়নি সমুদ্রর। হবে কীভাবে? যখনই সমুদ্র কাছাকাছি আসতে চেয়েছে বিনা মোচড়ামুচড়ি করে পিছলে গেছে। মাঝে মধ্যে সমুদ্রর মনে হয় বিনা তাকে স্বামী হিসেবে পছন্দ করে না। কিন্তু বিনার আচরণে তো ভালোবাসা প্রকাশ পায়। এই যে রাত হলে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করা,ফিরতে দেরি হলে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করা এগুলো কি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ নয়?
” আজকে তোমাকে আদর করবো। এজন্য আরো কাছে ডাকলাম। ”
” আমার ওসব লাগবে না। আপনি ঘুমান।”
” কেনো? কেনো? আমাকে বুঝি তোমার ভালো লাগে না? ”
” ভালোলাগলেই ওসব অসভ্যতা করা লাগবে? ”
সমুদ্র আলতো করে শাড়ির উপর দিয়ে বিনার উদরে হাত রাখলো। বিনা তাতেও নড়েচড়ে উঠলো বেশ।
” এগুলো অসভ্যতা কে বললো?”
” নানি বলেছে। পুরুষ মানুষকে ছুঁতে দিতে নেই। তবে স্বামী হলে একটু-আধটু ছোঁয়া যায়। কিন্তু বেশি না। ”
” শেষের কথাটুকু তুমি বানিয়ে বললে। কারণ নানি কখনো বলবেন না,স্বামীকে বেশি ছুঁতে দিলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়।”
” আপনি দেখি ঝগড়াও করতে পারেন!”
” কেনো ঝগড়া করা কি মেয়েদের জাতীয় অধিকার? ”
” না না তা বলিনি। আপনার না কাল কলেজ আছে? তাড়াতাড়ি ঘুমান।”
সমুদ্র বিনার মাথা একহাতে তুলে অন্য হাত সোজা করে তার উপর বিনার মাথা রাখলো। নিজের হাতের উপর শুইয়ে দিয়ে এবার বিনার কোমরে হাত রাখলো।
” ঘুমাবো না।”
” তাহলে আমি ঘুমাই। আপনার হাতে শুয়ে ঘুম আসবে না আমার। আপনার গা ঘেঁষে থাকলে কেমন লাগে জানি। ”
” কেমন লাগে আবার? ”
” কেমন ঠোঁট শুকিয়ে যায়। হাসফাস লেখা মনে হয় কী জানি হচ্ছে হৃদয়ে। ”
” এজন্যই তো আদর দরকার বোকা মেয়ে। ”
বিনা সমুদ্রর হাত কোমর থেকে সরিয়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলে,
” ভারী বজ্জাত আপনি। সুযোগ বুঝে আদর করার ধান্দা। এই ঘুমালাম আমি। আর যদি গায়ে হাত দেন তাহলে খবর আছে এখন।”
কী হলো ব্যাপারটা? এমনিতে বিনা দূরে সরে গেলেও এরকম করে না কখনো। আজ কাছাকাছি আসতে চেয়েও মনে হলো এলোনা! আসলেই মেয়েদের মন বোঝা সহজ বিষয় নয়। অন্তত সমুদ্রর কাছে তো নয়-ই!
“প্রহর তুমি আমার সাথে কেনো এমন করলে বলো তো? আমার ভালোবাসায় কি কোনো খামতি ছিলো? ”
প্রহরকে জড়িয়ে ধরে বললো কন্ঠ। প্রহর কন্ঠর পিঠে শক্ত করে চেপে ধরেছে। কন্ঠর ব্যথা লাগছে তবুও কন্ঠ চুপ করে আছে।
” আমার ভুল হয়েছে কন্ঠ। আমি নিজেও জানি না হুট করে কেনো অন্য কারো প্রতি আসক্ত হয়ে গেছিলাম আমি। এখন ঐশী আমাকে ছাড়বে না। তুমি আমাকে বাঁচাও ওর হাত থেকে। ”
কন্ঠ হুট করে প্রহরকে দূরে সরিয়ে দিলো। চোখমুখ ওড়না দিয়ে মুছে ম্লান হেসে বললো,
” ওকে ধরেছিলে তো ভালোলাগার জন্য। এখন ছাড়ার জন্য এতো তাড়াহুড়ো কীসের প্রহর? ভালো হয়েছে এখুনি তোমার চরিত্রটা সামনে এসেছে। যদি বিয়ের পরে এমনকিছু ঘটতো তখন কী করতাম? ”
প্রহর কন্ঠর দু-হাত ধরে আকুতিভরা কন্ঠে বলে,
” প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না কন্ঠ। প্লিজ! কন্ঠ! ”
ঘুম ভাঙতেই শোয়া থেকে উঠে বসলো প্রহর। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ফেলছে সে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা জমেছে। আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো নিজের শোয়ার ঘরেই আছে সে। কিন্তু কোথাও কন্ঠ নেই! তাহলে স্বপ্নে এসেছিল কন্ঠ? হ্যাঁ স্বপ্নই ছিলো। বাস্তবে কন্ঠ কখনো আর তাকে জড়িয়ে ধরে এসব বলবে না।
চলবে,
হুট করে মনে হলো পাঠকদের জন্য আরেকটা পর্ব লেখি। কেমন হয়েছে জানাবেন। টাইপিং মিসটিক থাকলে দুঃখিত,রিচেক করা হয়নি। শুভ রাত্রি।
আগের পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=391342923546659&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz
পরের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=391958656818419&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz