#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_১১
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
(প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
বাস্তবে কন্ঠ কখনো আর তাকে জড়িয়ে ধরে এসব বলবে না। ফেরার কথাও না! ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ কখনো প্রতারকের নিকট ফেরে না।
দুপুরের তপ্ত রোদে কলেজ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ইফতি মল্লিক। সামনে একদল শিক্ষার্থীদের ঢল। সবাই ইফতিকে দেখে চুপচাপ অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। ইফতিও নিজের গন্তব্যে পৌঁছার জন্য এগোচ্ছে। এরমধ্যেই হুট করে একটা মেয়ে ইফতির সামনে এসে দাঁড়ালো।
” স্যার! স্যার! ”
মেয়েটা ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে আবারও বললো,
” স্যার সামনে তো আমাদের ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। আপনি কি একটুও সময় দিতে পারবেন না আমাদের? ”
” তুমি কি কলেজে নতুন এসেছো অথৈ? তুমি জানো না আমি ক্লাসের বাইরে এক্সট্রা কাউকে পড়াই না!”
ইফতি বিরক্ত হয়ে বললো। এককথা বারবার শুনতে কার ভালো লাগে? দূরে দৃষ্টিপাত করে দেখলো আরও কিছু ছাত্রছাত্রী দাঁড়িয়ে আছে। ওঁরা সবাই ইফতির সাথে কথা বলতে ভয় পায়। তাই প্রতিনিধি হিসেবে অথৈকে পাঠিয়েছে। অথৈ মেয়েটা বড্ড বাচাল। এজন্য ইফতির আরও অপছন্দের সে।
” স্যার প্লিজ! মাত্র এক সপ্তাহ পড়ান? আমরা প্রয়োজনে আপনার বাসায় গিয়ে পড়বো। প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!”
” আরে থামো তো। যেও কাল থেকে বিকেলে। তবে আসরের নামাজের পরে। ”
ইফতি আর কোনো বাক্যব্যয় না করে হনহনিয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে গেলো। এই নিয়ে অথৈ চারবার ইফতিকে একই কথা বলাতে ইফতি এক প্রকার বিরক্ত হয়ে তাদের পড়াতে রাজি হলো। এমনিতেও এক সপ্তাহ পরে হয়তো ইফতির বিয়ে। কন্ঠর সাথে মজিদ মল্লিক দুপুরে কথা বলবেন বলেই আস্বস্ত করেছিলেন গতকাল। ইফতি চলে যেতেই দূর থেকে সবাই অথৈর নিকট দৌড়ে আসে।
” আরে বস তুই তো কামাল করলি।”
জান্নাত হেসে হেসে অথৈ উদ্দেশ্যে বললো। সাথে সঙ্গ দিলো আদিত্য ও তুষার।
” আরে হ্যাঁ। যাক অবশেষে এক সপ্তাহে স্যারের কাছে পড়তে পারবো। ”
” হ্যাঁ আর আমি স্যারকে মনভরে দেখতে পারবো।”
অথৈ শেষ কথাটা বলেই দৌড়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে গেলো। জান্নাত,আদিত্য, তুষারও যে যার বাসার দিকে এগোলো। সামনে ওদের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা।
” কন্ঠ মা একটা জরুরি কথা বলার জন্য তোকে ডেকেছি। তোর কি মন মানসিকতা ঠিক আছে? কথাগুলো বলবো?”
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে মেয়ের ঘরে এসে বসেছেন মজিদ মল্লিক। বাবার কথায় কন্ঠর বড়ো মায়া লাগলো। এতটা পরিবর্তন হয়ে গেছে তার বাড়ির লোকজনও কথা বলতে গেলে জিজ্ঞেস করে নিতে হয়! এরকম বদলাতে তো চায়নি কন্ঠ। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কন্ঠ বলে,
” হ্যাঁ বাবা বলো।”
” পরীক্ষা তো শেষ তোর অনেক আগেই। এখন তো পড়ালেখার চাপ কম।”
” হুম। ”
” তুই যদি সম্মতি দিস তাহলে ইফতির সাথে এবার তোর বিয়েটা দিয়ে দিতাম। তুই তো এ বিষয় নিশ্চয়ই আগেও শুনেছিস।”
” হুম। ”
কন্ঠ ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দেয়। সত্যি বলতে কন্ঠ আন্দাজ করেছিল বাবা এসব কথাই বলবে। এসব নিয়ে কন্ঠও অনেক ভেবেছে এতদিন। নিজের কথা ভাবলে বাবা-মায়ের প্রতি যে অবিচার করা হবে। কন্ঠ যেভাবে নিজে নিজে কষ্ট পেয়ে এসেছে আর সেই সময় পরিবারের লোকজন যেমন সহায়তা করেছে তাতে পরিবারের বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো ইচ্ছে কন্ঠর নেই। আর তারচেয়ে বড়ো কথা ইফতি কন্ঠর জন্য নতুন কেউ না। কন্ঠর সকল দুঃখ- কষ্টর কথা ইফতির জানা। বাইরের কেউ হলে হয়তো কন্ঠ সময় নিতো। কিন্তু ইফতির বেলায় সময়ের দরকার নেই। ইফতি কন্ঠকে বোঝে।
” তাহলে কি মা আমরা বিয়েটা কথা এগোবো?”
” তোমাদের যা ভালো মনে হয় করো।”
মজিদ মল্লিকের বুকের উপর থেকে যেনো ভারী কোনো বোঝা নেমে গেলো। মনটা বেশ ভালো লাগছে এখন। মেয়ের মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি বললেন,
” অনেক সুখী হবি মা। বাবা-মায়ের দোয়া রইলো তোর জন্য। ”
মজিদ মল্লিক ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই কন্ঠ বালিশে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। কত-শত স্বপ্ন দেখেছিল বিয়ে নিয়ে। কীভাবে কীভাবে আদর করবে সেসব নিয়ে কথা বলেও কেটেছে কত রাত। অথচ সেই মানুষটা অন্য নারীকে হয়তো একইভাবে আদর করেছিল! ভাবতেই কান্নারা আরো দলা পাকিয়ে চোখের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে। মানুষকে ভোলা যেতো যদি তার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলোর স্মৃতি ভুলে যাওয়া যেতো। কিন্তু এই স্মৃতি কখনো ভোলা সম্ভব নয়।
ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে ইফতি,সমুদ্র ও বিনা। শায়লা পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। এমন সময় কলিংবেলের শব্দ ভেসে আসে তার কর্ণকুহরে। দ্রুত হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন তিনি। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে শায়লা জাহাঙ্গীর মল্লিককে বললেন,
” বেলা তিনটে বাজলো! এতো দেরি হলো আজ ফিরতে? ”
জাহাঙ্গীর মল্লিক সোফায় বসে ক্লান্ত বদনে বললেন,
” অফিসে কাজের চাপ ছিলো। এক গ্লাস পানি দাও তো।”
শায়লা মল্লিক বসার ঘর পেরিয়ে ডাইনিং রুম থেকে পানি নিয়ে ফের বসার ঘরে গিয়ে পানির গ্লাস দিলেন স্বামীর হাতে। জাহাঙ্গীর ডগডগ করে এক নিঃশ্বাসে সাবাড় করলেন পানিটুকু। টি-টেবিলের ওপর গ্লাস রেখে মুচকি হেসে তিনি বললেন,
” একটা ভালো খবর আছে শায়লা। ”
” কী খবর?”
” কন্ঠ রাজি হয়েছে বিয়েতে। সন্ধ্যায় ভাই আর ভাবি আসবেন কথাবার্তা বলতে।”
” যাক আলহামদুলিল্লাহ। অবশেষে ছেলেটার বিয়ে হবে। ”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন শায়লা। মায়ের কাছ থেকে বিয়ের কথা শুনে ইফতিও মনে মনে শান্তি পেলো। তবে কন্ঠর সাথে একবার কথা বলতে হবে তার। সন্ধ্যায় যখন সবাই এদিকে কথা বলায় ব্যস্ত থাকবে তখনই কন্ঠর কাছে যাবে বলে ঠিক করে ইফতি। সারা বিকেল অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে ইফতি। কখন সন্ধ্যা হবে!
মাগরিবের নামাজ বাদে মজিদ ও শারমিন এলেন ইফতিদের বাসায়। বিনা আর শায়লা টুকটাক নাস্তা তৈরি করে রেখেছিল আগেই। সবাই আসতে নাস্তাগুলো পরিবেশন করে বিনা। আর সেই ফাঁকে ইফতি বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।
কন্ঠ বসার ঘরেই ছিলো। টিভি অন করা ছিল বলে বন্ধ করে নিজের রুমের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কলিংবেল বেজে উঠলো। কন্ঠ একবার ভাবলো এমন সময় কে এসেছে? সমুদ্র আর বিনা হয়তো বাসায় ব্যস্ত আছে। তাহলে ইফতি ভাইয়া? হ্যাঁ উনি ছাড়া আর কে আসবে এই সময়! কিন্তু দরজা খুলতেই আঁতকে উঠলো কন্ঠ। প্রহর এসেছে। কন্ঠ দরজা আঁটকে ফেলবে এমন সময় জোর করেই ঘরে ঢুকলো প্রহর।
” বাসা থেকে বেরিয়ে যান বলছি। বাবা-মা এসে গেলে আপনাকে ছাড়বে না। ”
কন্ঠকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রহর জড়িয়ে ধরে বললো,
” কন্ঠ প্লিজ শান্ত হও। আমার কথা শোনো একবার। আমার ভুল হয়েছে। আমি ঐশীর সাথে থাকতে পারবোনা। ও আমাকে শেষ করে খেলবে। এখন জোরাজোরি করছে বিয়ে করার জন্য। প্লিজ চলো আমরা বিয়ে করে নেই! তাহলে আর ঐশী কিছু করতে পারবে না।”
কন্ঠ নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে প্রহরকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলে কন্ঠ। এই হাত দিয়েই ঐশীকে ছুঁয়েছিল সে।
” আর একটা বাক্য বললে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না প্রহর। বেরিয়ে যাও বলছি,বেরো!”
কন্ঠ রেগে চিৎকার করে বলে। কিন্তু প্রহর যেনো আজ কোনো কথা শুনবে না। সে আবারও কন্ঠকে জোর করে জড়িয়ে ধরে। কন্ঠ হাত দিয়ে মারতে থাকে তাকে। ঠিক সেই সময় ইফতি এসে দাঁড়ায় দরজার সামনে। দরজা খোলা ছিলো বলেই এসে এমন একটা দৃশ্য দেখতে পেলো। সহসাই বরফের ন্যায় জমে গেলো ইফতি। কন্ঠর চোখে চোখ পড়তেই কন্ঠর অসহায়ত্ব নজরে আসলো ইফতির। আর এক মুহুর্ত দেরি না করে প্রহরকে কন্ঠর থেকে আলাদা করে ফেললো ইফতি। প্রহর চমকালো। কন্ঠ ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে ফ্লোরে বসে পড়লো। মাথা কাজ করছে না তার। ইফতি প্রহরকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না। শরীরের আকৃতির দিক থেকে ইফতি এগিয়ে। তাই শক্তিতে প্রহর ইফতির সাথে পেরে উঠলো না। প্রহরকে কয়েকটা ঘুষি মারলো ইফতি। দরজার বাইরে বের করে দিয়ে বাসার ভেতরে দাঁড়ালো ইফতি।
” আর যদি কখনো কন্ঠর আশেপাশে আসার চেষ্টাপ করিস তাহলে প্রাণে মারা যাবি। কন্ঠ আমার হবু স্ত্রী। আশা করি কথাটা মনে থাকবে। গেট লস্ট! ”
প্রহরকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না ইফতি। মুখের উপর দরজা আঁটকে দিলো। কন্ঠ এখনো ফ্লোরে বসে আছে। থরথর করে কাঁপছে মেয়েটার। ইফতি পেছন ফিরে তাকিয়ে কন্ঠর এমন অবস্থা দেখে দৌড়ে গেলো ওর কাছে।
” কিচ্ছু হয়নি কন্ঠ। শান্ত হ। আমি আছি।”
কন্ঠ ইফতির দিকে তাকিয়ে হুট করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ইফতি মাথায় হাত ছোঁয়াতেই জোরে কান্না শুরু করলো কন্ঠ। ইফতিও ফ্লোরে বসে কন্ঠকে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগলো।
চলবে,
সময় সুযোগ হলে রাতে আরেক পর্ব দেওয়ার চেষ্টা করবো। আসলে এখন আর সময় নেই যে আরও বড়ো করে লিখবো। কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু!
আগের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=391442220203396&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz
পরের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=392568766757408&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz