#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_১৫
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
(মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে মেয়েটা। ইফতি গিয়ে কন্ঠর পাশে বসেছে। বিনা ও সমুদ্র শারমিনকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কন্ঠ ঠোঁট কামড়ে বসে আছে। চোখ দিয়ে পড়ছে টুপটাপ অশ্রুর ফোঁটা। এই মুহুর্তে কী বলা উচিত বুঝতে পারছে না ইফতি। ইফতিকে পাশে দেখে কন্ঠ বিনাবাক্যে জড়িয়ে ধরে।
মানুষ কতকিছুই আশা করে অথচ সেই আশা পূর্ণ হবে কি-না জানে না। মজিদ মল্লিকও মেয়ের জীবনের একটু সুখ দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম! সবকিছু মানুষের হাতে থাকে না। মজিদ মল্লিকের মৃত্যুতে মল্লিক বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে আজ তিন দিন হলো। বিয়ে বাড়ির সাজসজ্জা নিমিষেই উবে গিয়ে বেদনার নীলচে রঙে ছেয়ে গেছে। কন্ঠকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে গতকাল। মানসিক ও শারিরীক দুই অশান্তি থেকে প্যানিক অ্যাটাক হয়েছিল। শারমিন সুলতানা স্বামীর শোকে যেনো পাথর হয়ে গেছে। তার উপর মেয়ের এই পরিণতিতে বাকশক্তি যেনো খুইয়ে ফেলেছেন। ইফতিদের বাসার সকলেই এই ক’দিন ধরে কন্ঠদের বাসায় আছে। আর ইফতি গতকাল থেকে হসপিটালে কন্ঠর কাছে আছে। মেন্টাল ট্রমা থেকে কন্ঠকে বের করে না আনতে পারলে বড়সড় মানসিক ক্ষতি হতে পারে বলে জানিয়েছেন ডাক্তার ।
” কন্ঠ! এই কন্ঠ কী বলছিস?”
কন্ঠর ঠোঁট নাড়ানো দেখে ইফতি ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সকাল থেকে বসে ছিল পাশের চেয়ারে।
” আব্বু! আমার বাবা….”
” কন্ঠ মাথা ঠান্ডা কর। তুই তো ভীষণ শক্ত মেয়ে। এভাবে ভেঙে পড়লে চলে? বড়ো মায়ের কথা একবার ভাববি না? বড়ো মা ভীষণ অসুস্থ। এমন সময় যদি তুই এভাবে অসুস্থ হয়ে থাকিস!”
কন্ঠ চোখ মেলে তাকিয়ে ঠিক কিন্তু কিছু বুঝতে পারছে না। ইফতির হাত কন্ঠর হাতের উপর রাখা ছিল। কন্ঠ আলতো করে চেপে ধরে হাতটা। হাত ধরার মধ্যে অন্য রকম একটা অনুভূতি থাকে।প্রিয় মানুষের হাত ধরা মানে ভরসার জায়গা খুঁজে পাওয়া।
” কন্ঠ লক্ষ্মীটি এরকম ভেঙে পড়ে না। মানুষ মরণশীল। তোকে,আমাকে সবাইকেই একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। ”
” আমি খুব অলক্ষুণে। আমার কপালে ভালোবাসা সহ্য হয় না। বাবাও আমাকে ছেড়ে চলে গেলো! ”
কন্ঠ কাঁদতে লাগলো। ইফতির বুকটা খাঁ খাঁ করছে। কী করলে এই কষ্ট কমবে কন্ঠর! পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়ে বাবাকে হারানোর দুঃখ, বেদনা দূর করা সম্ভব না।
” তুমি কোথাও যাবে না প্রহর। তারপরও যদি যাও তাহলে আমি তোমার নামে স্ত্রী নির্যাতন কেস করবো।”
রুদ্ধশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো ঐশী। কন্ঠর বাবা মারা গেছেন খবরটা শোনা মাত্রই প্রহর কন্ঠদের বাসায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। সেই নিয়ে প্রহর ও ঐশীর মধ্যে ঝামেলা।
” ঐশী! জীবনটা নরক করে দিচ্ছ তুমি। আমাকে একটু রেহাই দাও প্লিজ। ”
” তুমি কী ধরনের ছেলে? মেয়েটার বাবা মারা গেছে, এরমধ্যে যদি তুমি গিয়ে উপস্থিত হও ওর মনের অবস্থা কেমন হবে ভাবতে পারতেছ? ”
” অদ্ভুত! আমি তো বিপদের সময় পাশে দাঁড়াতে চাচ্ছি জাস্ট। ”
প্রহর কিছু বোঝার আগেই ঐশী ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো গালে।
” তুই একটা অমানুষ। তোকে দেখে মেয়েটা আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে সেটা কি বুঝতে পারছিস না? আর তারচে বড়ো কথা আমি চাই না কন্ঠর আশেপাশে তুমি যাও। এখনো সময় আছে নিজেকে শুধরে নাও। নয়তো জেলের ঘানি টানতে টানতে জীবন শেষ হয়ে যাবে। ”
প্রহর কিছু বলার আগেই ঐশী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। প্রহর কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
হসপিটাল থেকে কন্ঠকে বাড়ি নিয়ে এসেছে ইফতি। শারমিন সুলতানার অসুস্থতার কথা বলাতে কন্ঠ যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়েছে। বাবাকে হারিয়ে ফেলেছে, মা’কেও হারাতে চায় না কন্ঠ। তবে আপাতত ইফতিদের বাসায় আছে কন্ঠ ও কন্ঠর মা। শায়লা মল্লিকই বলেছিলেন আপাতত কিছু দিন তাদের বাসায় থাকতে।
” কন্ঠ আপা একটু কিছু খেয়ে নাও। এরকম না খেয়ে থাকলে তো আরও অসুস্থ হবা।”
বসার ঘরে বসে ছিল কন্ঠ। আজকাল ভীষণ ভাবুক হয়ে গেছে মেয়েটা। একা একা বসে থাকে প্রায় সময়। খাওয়াদাওয়া তো প্রায় বন্ধ! চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে।
” ক্ষিদে লাগলে খাবো। তুমি যাও বিনা।”
বিনা জানে কন্ঠ খাবে না তারপরও এসেছিল সাধতে। খাবারগুলো নিয়ে ফ্রিজে তুলে রেখে শোয়ার ঘরে গেলো বিনা।
” কী হলো?”
ঘরে ঢুকতেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলো সমুদ্র। বিনা মুখে কিছু না বলে ছুটে গিয়ে সমুদ্রর বুকে মাথা রেখে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। সমুদ্র চমকায়।
” এই বিনা! বিনা তুমি ঠিক আছো? কী হয়েছে? ”
মাথায় হাত বুলিয়ে শুধালো সমুদ্র। বিনা নাক-মুখ টি-শার্টে মুছে ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলে,
” কন্ঠ আপার এতো কষ্ট আমার আর সহ্য হয় না। বড়ো আম্মা কারো সাথে কথা বলে না। মাঝে মধ্যে কাঁদতে থাকে। কন্ঠ আপা একেবারে চুপচাপ থাকে। খাওয়াদাওয়ার তো বালাই নেই। আমার ভালো লাগে না। খুব কষ্ট হয়।”
” কিছু করার নেই। পরিস্থিতি এখন এমন যে চাইলেও আমরা কিছু ঠিক করতে পারবো না। ধৈর্য ধরতে হবে। লক্ষ্মী বউ আমার এভাবে কেঁদো না।”
বিনা আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে সমুদ্রকে। স্বামীর বক্ষে যেনো স্ত্রীর সর্বোচ্চ মানসিক শান্তি।
” হুম। ”
” এখন ছাড়ো। দুপুরবেলা কেউ হুট করে এসে পড়লে সমস্যা। ”
বিনা চট করে ছেড়ে দেয় সমুদ্রকে।
” ঠিক আছে। এতো সমস্যার কথা যেনো সব সময় মনে থাকে। ”
” আগের চেয়ে দুষ্ট হয়ে গেছো তুমি। ”
” আপনার সাথে থেকে থেকেই হয়েছি।”
” তাই নাকি?”
সমুদ্র বিনার দিকে মুচকি হেসে এগোতে চাইলে বিনা দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
” কী যে করি শায়লা বুঝতে পারছি না। ভাবির মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আমার বুকটা কেমন হুহু করে উঠে। আমার ভাইটা এভাবে চলে গেলো!”
খাবার টেবিলে বসে ভাতের প্লেটে আঙুল ডুবিয়ে বসে আছে জাহাঙ্গীর মল্লিক। বিনা আর শায়লা দাঁড়িয়ে আছে। সমুদ্র গোসল সেড়ে আসলে একসাথে খাবে দু’জন।
” কন্ঠর দিকে কি তাকানো যায়? কথা ছিল এতদিনে বউ হয়ে আমার সংসারে আসবে। আর কী হলো! লোকজন কতো আজেবাজে কথা বলে আজকাল। ওসব শোনা যায় না। ”
” মানুষের কথায় কী এসে যায়? লোকে বলতে পারে কিন্তু কিচ্ছু করতে পারে না। তোমার পরনে ছেড়া পোশাক দেখলে এঁরা শুধু আফসোস করবে কিন্তু কেউ কিনে দিবে না। বরং কীভাবে ছিড়লো সেটার নেগেটিভ দিক বের করে মিথ্যা অপবাদ দিবে।”
শায়লা মল্লিক চুপ হয়ে যান। ইফতিকে আসতে দেখে। ইফতি মাত্র বাসায় ফিরেছে। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসেছে। চেহারায় এখনো পানির ফোটা।
” বড়ো মা আর কন্ঠ খেয়েছে? ”
” না ভাইয়া। আমি কন্ঠ আপারে বললাম কিন্তু খেলো না আর না তো বড়ো আম্মা।”
” আচ্ছা। আমি রুমে গিয়ে একবার ঘুরে আসি।”
ইফতি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বিনা বাঁধা দিয়ে বলে,
” আপা ছাদে গেলো। বড়ো মা ঘরে। ”
” ঠিক আছে। ”
ইফতি প্রথমেই শারমিন সুলতানার কাছে যান। কিন্তু অনেক বার বুঝিয়ে বলা সত্বেও কিছু খাবেন না বলেন তিনি। ইফতির খুব জোড়াজুড়িতে রাতে খাবে বলে জানায় কন্ঠর মা।
” ঠিক আছে বড়ো মা। আমি তাহলে কন্ঠর কাছে গেলাম। ”
” দেখ বাবা মেয়েটাকে খাওয়াতে পারিস কি-না। ”
ইফতি ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মেঘলা দিনে উত্তরের শীতল হাওয়া বইছে। ছাদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কন্ঠ। আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। খোলাচুল উড়ছে বাতাসে। ইফতি পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো নিশ্চুপে।
” আমি খাবো না ইফতি ভাইয়া। তুমি চলে যাও।”
” তুই বুঝলি কীভাবে খেতে যাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছি! ”
“এছাড়া দুপুরবেলা অন্য কোনো কারণে তোমার এখানে আসার কথা নয়।”
কন্ঠ ইফতির দিকে না তাকিয়েই বললো। ইফতি বুঝতে পারছে না কীভাবে মানাবে মেয়েটাকে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা বুদ্ধি এলো মাথায়। কিন্তু তাতে মিথ্যা বলতে হবে। কিন্তু আপাতত এই মিথ্যাটা ভালো কাজের জন্য বলা।
” তুই খেলে বড়ো মা-ও খাবে বলেছেন। এখন ভেবে দেখ তো তুই কি বড়ো মাকেও না খাইয়ে রাখবি?”
মায়ের কথা শুনে নরম হলো কন্ঠ।
” সত্যি মা খাবে? ”
” হ্যাঁ। তুই আমার সাথে ডাইনিং টেবিলে চল আমি বড়ো মাকেও নিয়ে আসবো।”
” আচ্ছা।”
কন্ঠ পেছন ফিরে ছাদ থেকে প্রস্থান করতে যাবে এমন সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলে ইফতি তৎক্ষনাৎ ধরে ফেলে কন্ঠকে।
” এই কন্ঠ! ঠিক আছিস তুই? ”
” হ্যাঁ। মাথাটা কেমন ঘুরে গেলো। তুমি একটু ধরে নিয়ে চলো আমাকে। ”
” আজীবন এই হাত ধরে থাকবো কথা দিলাম। চল এবার। ”
চলবে,
রিচেক দেওয়া হয়নি। আগামীকাল গল্প দিতে পারবো না। কাল সারাদিন বাসে থাকবো। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হবে। সবাই দোয়া করবেন। 🙏
আগের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=395053143175637&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz
পরের পর্বের লিংক https://www.facebook.com/100080128645410/posts/398047302876221/