#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_১৮
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
(প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
” গ্রাজুয়েশন শেষ হতে এখনো তো বাকি। এ বছরটা অন্তত লেখাপড়া কর একটু। সারাদিন ঘরে বসে না থেকে একটু লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ দিলে হয়।”
সন্ধ্যাবেলা। বসার ঘরে চেয়ারে বসে টিভি দেখতে ব্যস্ত সমুদ্র। শায়লা মল্লিক উল্টো দিকে সোফায় বসে উক্ত কথাটি বললেন। সমুদ্রর তাতে বিশেষ হেলদোল নেই।
” পড়ছি তো মা।”
” পড়লেই ভালো। ইফতিকে দেখে কিছু শেখ। ইফতিও কন্ঠকে ভীষণ ভালোবাসে কিন্তু কাজকর্ম রেখে না।”
বিনা বসার ঘরে ঢুকবার জন্য এগোতেই শ্বাশুড়ির কথাগুলো কানে এলো। এই মুহুর্তে সেখানে উপস্থিত হয়ে নিজের অস্বস্তি বাড়াতে চাইলো না মেয়েটা। কিন্তু সমুদ্র যে বিকেলে টিউশনি করায় সেটা কেনো বাসায় বলে না? বললে তো সবাই খুশি হয়!
” আমিও লেখাপড়া শেষ করে ভাইয়ার মতোই চাকরি করবো মা।”
” দেখা যাবে। ”
অবিশ্বাসের সুরে যেনো বললেন কথাটা। ছেলের বউয়ের সাথে ছেলের এতো ভালোবাসো ইদানীং সহ্য হচ্ছে না শায়লা মল্লিকের। ছেলেটাকে যেনো মেয়েটা একেবারে বশীকরণ করেছে। মনে মনে এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসা থেকে উঠলেন শায়লা। বিনা এখনও ভাবুক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। শ্বাশুড়িকে আসতে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে বসার ঘরে প্রবেশ করলো বিনা।
” ঘরে বসে থাকতে পারলে না আর?”
শ্বাশুড়ির কথার অর্থ বিনা বুঝতে পেরেছে। সমুদ্রর কাছে আসায় তার ভালোলাগেনি। সমুদ্র টিভির দিকে থেকে মনোযোগ সরিয়ে স্ত্রী ও মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলো।
” আসলে মা বিকেল থেকেই মাথা ব্যথা করছিল। আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আপনার ছেলে ঔষধটা কোথায় রেখেছে সেটা জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম। ”
” ঘরে ঔষধ না থাকলে আমার কাছে এসো।”
শায়লা মুখ গম্ভীর করে স্থান ত্যাগ করলেন। সমুদ্র আজকাল নিজের মা’কে ঠিক চিনতে পারে না। কন্ঠ মাঝে মধ্যে অবশ্য কিছু বলে। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তো নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখে সে। ইফতি ও জাহাঙ্গীর মল্লিক এখনো বাসায় ফেরেনি।
” মাথা ব্যথা করছিল সেটা আরও আগে বলোনি কেনো?”
সমুদ্র টিভি বন্ধ করে বসা থেকে উঠে বিনার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো। বিনার চোখমুখ বসে গেছে।
” অল্প ছিল তাই বলিনি। ”
” ঠিক আছে। ঘরে চলো। কিছু খেয়ে ঔষধ খাবে। ”
বিনা ঘাড় কাত করে সমুদ্রর পিছুপিছু ঘরে গেলো। কেনো জানি বিনার মনে হচ্ছে তার জীবনের সুখের দিনগুলো ফুরাতে চলেছে!
আসরের নামাজের পরে বাইরে বেরিয়েছিল ইফতি। রাস্তার পাশ ধরে হাঁটছে এখন। ঘড়িতে সময় রাত আটটার কাছাকাছি। এদিকটায় আজকে ফুলের দোকান নিয়ে বসেছে। ইফতি একটা দোকানীকে তিনটে গোলাপফুল দিতে বললো। দোকানী সেগুলো বাড়িয়ে বললো,
” এই নিন মামা একটা বেশি দিলাম। মামিরে যে আফনে কতো ভালা পান হেইডা আফনে ফুল চাওনের সময় বুঝবার পারছি।”
ইফতি হাসলো লোকটার কথায়। পৃথিবীর সবাই বুঝতে পারছে কন্ঠকে সে কতটা ভালোবাসে অথচ কন্ঠ নিজেই সে বিষয় উদাসীন।
” ধন্যবাদ মামা। এই নাও টাকা। ”
দোকানী হাসি মুখে টাকা নিলো। ইফতিও হাতে ফুল নিয়ে একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে বসলো। পকেট থেকে ফোন হাতড়ে বের করে কল দিল কন্ঠর নম্বরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কন্ঠ কল রিসিভ করলো।
” তোমার কিছু লাগবে কন্ঠ?”
প্রতিদিন বাইরে থেকে ফেরার আগে ইফতি এভাবেই শুধায় কন্ঠকে। কিন্তু কন্ঠ বরাবর নেতিবাচক উত্তর দেয়।
” হ্যাঁ লাগবে। ”
ইফতি চমকাল,থমকাল। আজ প্রথম কন্ঠ তার কিছু লাগবে বললো। ইফতি আগ্রহসহকারে জিজ্ঞেস করে,
” বলো কী লাগবে?”
” আমার একটু মানসিক শান্তি লাগবে। তুমি পারবে আমাকে একটু শান্তি দিতে? ”
কন্ঠর গলা ভারী হয়ে এসেছে। ইফতির মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মেয়েটা নিশ্চয়ই একা ঘরে কাঁদছে।
” লক্ষ্মীটি দশ মিনিটের মধ্যে ফিরছি আমি। প্লিজ চোখের পানি ফেলো না। আমি আসছি।”
কল কেটে রিকশাওয়ালা মামাকে একটু জোরে চালাতে বললো ইফতি। কন্ঠর কান্না কখনোই সহ্য করতে পারে না সে। এক মায়াবতীর চোখের অশ্রু গম্ভীর শক্তপোক্ত পুরুষের হৃদয় পোড়ায়।
বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে কন্ঠ। ইদানীং মাঝে মধ্যে ফ্যান চালাতে হয়। দুপুরের পরে গরম অনুভব হয়। কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে আজ। এভাবে জীবন চলে? আজকে ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় যে বাসে উঠছিল কন্ঠ,সেই বাসেই প্রহরও ছিল। চোখাচোখি হলেও প্রথমে কথা বলেনি কন্ঠ। কিন্তু কন্ঠর পাশের সিট খালি থাকায় প্রহর এসে বসেছিল পাশে। নির্লজ্জের মতো হেসে বলেছিল সে,
” কেমন আছো কন্ঠ?”
” ভালো। ”
কন্ঠ এক বাক্যে উত্তর দেয়। পাল্টা প্রশ্নে সে কেমন আছে জানতে পর্যন্ত চায় না। প্রহর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। পাবলিক প্লেস পাশে বসার জন্য বলে কন্ঠ তেমন কিছু বলে না প্রহরকে। তার ঠকে যাওয়ার কথা পৃথিবীর আর কাউকে জানাতে চায় না কন্ঠ।
” কন্ঠ বদলে গেছো তুমি। চোখে নেই মুগ্ধতা, নেই কোনো ব্যাকুলতা! ”
” আকুলতা, ব্যাকুলতা, মুগ্ধতা সবকিছুই আছে শুধু বদলেছে প্রকাশ করার ধরণ। কিঞ্চিৎ পরিমাণ লজ্জা থাকলে তুমি এই প্রশ্ন করতে না। তোমার জন্য এখনো আমার চোখে মুগ্ধতা দেখতে চাইছো!”
কন্ঠ কিছুটা উত্তেজিত হয়ে যায়। আশেপাশের লোকজন এরমধ্যে তাকিয়েছে ওদের দিকে। প্রহর চুপ করে যায়। আসলেই তো! এতো বড়ো অন্যায় করে এরকম অযৌক্তিক কথা কীভাবে শুধায় সে কন্ঠর কাছে? কন্ঠ চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বারকয়েক । নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে সে। চোখ মেলে তাকিয়ে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বাসের কন্ডাক্টরকে বলে বাস থামাতে। আর সাত কিংবা আট মিনিট পরেই কন্ঠর গন্তব্য। তাই এখুনি বাস থেকে নেমে যায় কন্ঠ। প্রহর শুধু কন্ঠর যাওয়ার পথের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিন্ধান্ত নেয় প্রহর। কন্ঠকে দেখেও নিজের বলে বুকে জড়াতে পারছে না। পারছে না ঐশীর সাথে মানিয়ে আর সংসার করতে। এরচেয়ে জীবনের যবনিকা পতন ঘটানোও ভালো মনে হলো প্রহরের।
ঘরের বাতি জ্বেলে দিতেই ভাবনার ছেদ ঘটে কন্ঠর। ঘর অন্ধকার করেই শুয়েছিল এতক্ষণ। হৃদয়ে যে অদৃশ্য ঝড় চলছে তার বহিঃপ্রকাশ পাচ্ছে কন্ঠর বিধস্ত মুখশ্রীতে। সিলিং থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখে ইফতি এসেছে। হাতে টকটকে লাল রঙের চারটে গোলাপ। ইফতি সেগুলো টেবিলের উপর রেখে কন্ঠর পাশে বসলো। চোখগুলো ফুলে গেছে কন্ঠর। ইফতির বুকের ভেতর হুহু করে উঠলো। যার জন্য এতো কষ্ট হচ্ছে কন্ঠর সেই মানুষটা কতটা দূর্ভাগা সেটা ভেবে আরও খারাপ লাগছে। ইফতি কন্ঠকে ধরে বসালো। এলোমেলো চুলে আর ফোলা ফোলা লাল চোখে কেমন ভয়ংকর লাগছে কন্ঠকে।
” কন্ঠ শোন…..”
ইফতিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কন্ঠ তাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করলো। ইফতির বুকে যেনো ছোটোখাটো একটা ঝড় বইতে শুরু করেছে। জীবনে প্রথম তার নিজস্ব মায়াবতী তার বক্ষে! অথচ সে কষ্টে মূর্ছা যাচ্ছে। তা-ও তার প্রাক্তনের জন্য। ইফতি কিয়ৎক্ষণ বিলম্ব না করে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো কন্ঠকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো ইফতি আজকেই যেনো প্রহরের জন্য কন্ঠর শেষ কান্না হয়। এরপর থেকে কখনোই নিজের স্ত্রীকে অন্যের জন্য অশ্রুপাত করতে দিবে না সে। কন্ঠ কাঁদল। কতক্ষণ সেটা হিসাব নেই কারোরই। কান্নার বেগ কমে গেছে এখন। কন্ঠ শুধু ফোপাঁতে ফোপাঁতে ইফতির বুকে নাক ঘসছে এখন। ইফতির লোমশ বক্ষ শার্ট অতিক্রম করে নোনাজলে ভিজে গেছে। কন্ঠ শান্ত হয়েছে বুঝতেই ইফতি দুঃসাহসিক হলো কিছুটা। আলতো করে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো মাথার তালুতে। কন্ঠ কেঁপে উঠল। কিন্তু ছাড়লো না ইফতিকে। বিষয়টা খুব ভালো লাগে ইফতির।
” এই যে মহারাণী! পাঁচ মিনিটের জন্য ছাড়া যায়? শার্ট তো নাকের জলে,চোখের জলে ভিজে গেছে তো।”
কন্ঠ কিছুটা লজ্জা পেয়ে তড়িৎ গতিতে সোজা হয়ে বসলো। ইফতি হাসতে হাসতে আলমারি থেকে টি-শার্ট আর লুঙ্গি বের করে বাথরুমে গেলো ফ্রেশ হতে। কন্ঠ চোখমুখ ওড়না দিয়ে মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইলো। কিন্তু ফ্রেশ না হলে ভালো লাগবে না মনে হচ্ছে। ইফতি বাথরুম থেকে বেরোলে না হয় ফ্রেশ হবে। টেবিলের উপর রাখা ফুলগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলো কন্ঠ। একবার ভাবলো নিজে গিয়ে ধরবে কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো যে এনেছে সে নিজেই দিবে। একটু অপেক্ষা করলেই ভালো হয়। কন্ঠ তাই করলো। আবারও বিছানায় বসলো। বাথরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ থেমে গেছে। তারমানে এখুনি বের হবে ইফতি। মিনিট তিনেক পরে দরজা খুলে বের হলো সে। চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে কন্ঠর সামনে এসে দাঁড়ালো। ফোঁটা ফোঁটা পানি লেগে আছে নাকের আশেপাশে। ভেজা চুলগুলো ললাটের মাঝখানে কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। ইফতির সামনের চুলগুলো তুলনামূলক একটু লম্বা। লোকটাকে যেনো আজ প্রথম এতো ভালো করে দেখছে কন্ঠ। ইফতি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
” এভাবে দেখিস না। মেয়েদের রোগে পেয়েছে আমাকে। কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। ”
কন্ঠ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো কিছুটা। কিন্তু থমলো না। মনে মনে সে ঠিক করে নিয়েছে প্রহরের জন্য আর নিজের জীবনটাকে মরুভূমি করে রাখবে না। যে মানুষটা তাকে ভালোবাসে সে-ও সেই মানুষটার সঙ্গ দিবে।
” আমি মোটেও তোমাকে দেখছি না।”
” তাই? তা বেশ বুঝলাম। ঘরে আরও কেউ আছে নয়তো তোর চোখ গেছে। আচ্ছা শোন,ফ্রেশ হয়ে আয়। চোখমুখ কেমন লাগছে।”
কন্ঠ বিছানা থেকে উঠে বাথরুমের দিকে এগোতে এগোতে বলে,
” হুম যাচ্ছি। ”
ইফতি মুচকি হেসে আবারও তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে ব্যস্ত হয়ে উঠে।
বিনার শরীর আরও খারাপ হয়েছে। জ্বরও এসেছে কিছুটা। ঔষধ খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুমানোর পর আবারও জেগে উঠে মেয়েটা। সমুদ্রর কেমন দিশেহারা লাগছে। চঞ্চল মেয়েটাকে এভাবে চুপচাপ থাকতে দেখতে মোটেও ভালো লাগছে না তার।
চলবে,
পেইজের রিচ কমে গেছে একেবারে। পরীক্ষা, অসুস্থতা নিয়েও আপনাদের জন্যই তো লেখি! সবাই একটু রেসপন্স করুন। রিচেক দেওয়া হয়নি। টাইপিং মিসটিক থাকতে পারে।
আগের পর্বের লিংক https://www.facebook.com/100080128645410/posts/400902762590675/
পরের পর্বের লিংক https://www.facebook.com/100080128645410/posts/401923235821961/