#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_২৪
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
শুভ্র যান্ত্রিক যন্ত্রটি বালিশের পাশে রেখে লম্বা ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিলো। ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে এতদিন তেমন ঘুম হয়নি তার। ঘুমিয়ে উঠে বিকেলে গোসল সেড়ে খেয়েদেয়ে একেবারে বাসা থেকে বের হবে বলে ঠিক করে শুভ্র।
সূর্য মাথার উপরে। আজান দিলো কিছুক্ষণ আগে। উঠোনের এককোনায় মধ্যবয়স্ক মহিলা শিলনোড়ায় হলুদ,মেহেদী পাতা পিষছেন। পরনে উনার সাদা কালো মিশ্রিত ছাপার শাড়ি। গোলগাল চেহারায় থুতনিতে তিলটা এই বয়সেও দারুণ লাগছে। ভদ্রমহিলা কাজ করতে করতে আঞ্চলিক ভাষায় কিছু গানও গাইছেন। উনার পাশে গোল হয়ে বসেছে কিছু উঠতি বয়সের মেয়ে। শিলনোড়ার সামনে কুলোয় রাখা আছে বড়ো বড়ো ঘাস,ধান,কাঁচা হলুদ ও সরিষার তেলের বোতল।
” মা তোমার হলো? বেলা তো গড়িয়ে যাচ্ছে। জোয়ারের পানি আনতে আনতে দেরি হলো যে!”
মারিয়া হাসান ব্যস্ত ভঙ্গিতে নিজের মা আসিয়া বেগমকে বললেন। আসিয়া বেগম মুচকি হেসে বললেন,
” হ রে হইয়া গেছে সব কাম। হলুদ, মেহেন্দী সব রেডি। চল ইনায়াকে গোসলের জইন্য নিয়া আসি।”
” তাহলে তোমরা যাও আমি তো আর যাবো না।”
আসিয়া বেগম বসা থেকে উঠে কুলো হাতে নিয়ে ঘরের দিকে এগোলেন। ইনায়া গায়ে হলুদের জন্য হলুদ রঙের শাড়ি পরে আছে। বিনা,কন্ঠ, পরীসহ আরও অনেকেই হলুদ রঙের শাড়ি পরেছে। কে জানি এসে বললো মেয়েকে গোসলের জন্য নামাতে হবে। ব্যস আত্মীয় স্বজনরা ইনায়াকে ঘরের দরজা পর্যন্ত নিয়ে এলো। তারপর কুলো দিয়ে বরণ টাইপের কিছু একটা করে ইমায়াকে গায়ে হলুদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়া হলো। কন্ঠ ও বিনাও হলুদে অংশ নিলো। পরী একটু দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছে। মনটা অস্থির লাগছে তার। শুভ্র আসার কথা সন্ধ্যায়। খবরটা শোনার পরে শুভ্র কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেই নিয়ে হাজার চিন্তা পরীর। ইফতি যে সর্বক্ষণ পরীর উপর নজর রাখছে তাতে শুভ্র এলে নিশ্চিত সে জানবে। শুভ্র যদি সরাসরি বিয়ের জন্য “না” করে দেয় তখন যদি ইফতি ঝামেলা করে? বিয়ে বাড়ির মধ্যে তো কেলেংকারী হয়ে যাবে তাহলে। কিন্তু সবার মানসম্মানের কথা ভেবে নিশ্চয়ই ইফতি ভাইয়া এমন করবে না? মনে মনে নানান প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলছে পরী।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। ইনায়াকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে কন্ঠ। লাল বেনারসি আর হালকা সোনার গয়নায় অপরুপ সুন্দর লাগছে তাকে। ঘরে শুধু মেয়েরা আছে বলে অনেকক্ষণ ধরে সমুদ্র দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উসখুস করছে। বিয়ে বাড়িতে আসা সবে বউকে এক মুহুর্তের জন্যও কাছে পায়নি বেচারা।
” এই বিনা শোনো।”
” হ্যাঁ বলো কন্ঠ আপা।”
” তুমি একটু বাইরে গিয়ে দেখে এসো তো আমার দেবর বজ্জাতটার কী লাগবে।”
বিনা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো বিনা। বিনাকে দেখা মাত্রই হাত ধরে টেনে সিঁড়ির দিকে গিয়ে দাঁড়াল সমুদ্র।
” কতক্ষণ ধরে ইশারা দিচ্ছিলাম! তাকালেই না। শেষমেশ কন্ঠ দেখলো।”
” হ্যাঁ তারপর আমাকে বললো। এভাবে লজ্জায় কেনো ফেলো তুমি? ”
সমুদ্র বিনাকে হেঁচকা টানে বুকের সাথে মিশিয়ে ফেললো। বিনা চোখ বন্ধ করে বুকে মাথা ঠেকিয়ে আছে।
” চুপ করে থাকো। ”
তারপর দুই মিনিট নীরবতা। হঠাৎ শ্বাশুড়ির ডাকে হকচকিয়ে উঠলো বিনা। চট করে সমুদ্রকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো।
” আম্মা ডাকছেন। আমি আসি।”
বিনা তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো। সমুদ্র একবুক তৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে রইলো বিনার গমনপথের দিকে।
মাগরিবের আজান হয়েছে অনেকক্ষণ। অন্ধকারে ছেয়ে গেছে পৃথিবী। কৃত্রিম আলো ছাড়া কোনো আলোর অস্তিত্ব নেই কোথাও। পুকুরপাড়ে অধৈর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্র। প্রায় আধঘন্টা যাবত এখানেই অপেক্ষারত সে। পরীর আসতে কেনো এতো সময় লাগছে বুঝতে পারছে না। ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখলো শুভ্র। সাতটা বেজেছে। বরযাত্রী তো আরও বিশ-একুশ মিনিট আগেই এসেছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই তাদের বসানো হয়েছে? তাহলে কী করছে মেয়েটা! শুভ্র যখন আনমনে চিন্তায় মশগুল তখনই পেছন থেকে অস্ফুটে আওয়াজ শুনতে পেলো সে।
” শুভ্র! ”
ফোনের বাতি জ্বেলে পেছন ফিরে তাকালো শুভ্র। পরী এসেছে এতক্ষণে। শ্যামাঙ্গিনীর পরনে শুভ্র সাদা রঙের লেহেঙ্গা। খোলা চুলে বেলী ফুলের মালা জড়ানো। পরী নামটা যেনো সার্থক হয়েছে তার সাজসজ্জায়। পরী ও শুভ্র দু’জনেই দুজনার দিকে এগোলো। মুখোমুখি দাঁড়াতেই শুভ্র পরীকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গভীরতম ছোঁয়ায় বুকে টেনে নিলো। কাল বিলম্ব না করে অধরে অধর ছুঁইয়ে ডুবে গেলো উষ্ণতম আবেশে। কিছুক্ষণ পরে যখন নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো তখন দু’জন দু’জনাকে ছেড়ে শান্ত হলো কিছুটা। শুভ্র নিজের ঠোঁট রুমাল দিয়ে মুছে ঠোঁট টিপে হেসে বললো,
” আরেকটু লিপস্টিক দিতে? আমি তো আছিই বান্দা তোমার লিপস্টিক খাওয়ার জন্য। ”
” মজা করা রাখো। আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে শুভ্র। ”
পরীর চোখমুখ দেখে শুভ্র ভাবুক হয়ে গেলো। মেয়েটাকে ভীষণ সিরিয়াস দেখাচ্ছে।
” কী হয়েছে পরী? ”
” আমি প্রেগন্যান্ট শুভ্র। ”
পরী কোনো প্রকার ভনিতা না করে সোজাসাপটা বলে দিলো। শুভ্র ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একইভাবে। মিনিট পাঁচেক একইভাবে পরীর দিকে তাকিয়ে রইলো শুভ্র। পরীর নেত্র দ্বয় ছলছল করছে। শুভ্রর প্রত্যাখ্যান কীভাবে সহ্য করবে সেই ভেবেই।
” তোমাকে গতবার ঔষধ খেতে বলেছিলাম তুমি খাওনি?”
মুখ খুললো শুভ্র। পরী ভয়ে চুপসে যাচ্ছে। ঔষধ ঠিকই খেয়েছিল। কিন্তু খাওয়ার পরে কোনো কারণে বমি হয়েছিল। হয়তো ঔষধের মেয়াদ ছিল না কিংবা অন্য কিছু।
” খেয়েছিলাম। আমি ভাবিকে বলেছি এবোরশনের ব্যবস্থা করবে। তবুও তোমাকে….. ”
” তোমার মাথা ঠিক আছে? এবোরশনের সিন্ধান্ত নিয়েছো তা-ও আমাকে না জানিয়ে? ”
পরীর কথার ইতি টানার আগেই শুভ্র ক্রোধান্বিত হয়ে বললো। পরী নিশ্চুপ। ঠিক বুঝতে পারছে না কী বলা উচিত। চিন্তায় এতটা ঘাবড়ে গেছে যে কথার পিঠে কী কথা বলবে তাও ঘেটে ‘ঘ’ হয়ে যাচ্ছে। পরীর নীরবতাকে উপেক্ষা করে শুভ্র আবারও বলতে শুরু করলো।
” মানলাম বিয়ের আগে ওসব করা ঠিক হয়নি কিন্তু আমি কোনো মেরুদন্ডহীন পুরুষ নই যে নিজের অনাগত সন্তানকে পরিচয় দিতে অনিহা প্রকাশ করবো। আমি তোমাকে ভালোবাসি পরী। আমাদের দু’জনের সেই ভালোবাসার চিহ্নকে তুমি মুছে ফেলতে চাও?”
পরী শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কান্না করতে শুরু করেছে। শুভ্র পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে পরী বললো,
” আমি ভাবিনি তুমি বিষয়টা মেনে নিবে। ভেবেছিলাম ক্যারিয়ারের কথা ভেবে এবোরশন করতে বলবে।”
” ধুর পাগলি। আমার বাবার কি কম টাকা আছে? আমার সন্তান মানে তাদের নাতি-নাতনি। আমি যতদিন না ইনকাম করছি তাদের টাকা খাবে তোমরা। তাছাড়া আমি ভাবছি লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগেই একটা ব্যবস্থা করবো। ব্যবসা করবো একটা। ”
” ঠিক আছে। ”
” নিজের আর আমাদের অনাগত সন্তানের খেয়াল রাখো। ইনায়ার বিয়েটা চুকে যাক আর তোমার পরীক্ষাও সামনে, ততদিন একটু থাকো বাবার বাড়ি। আমি আজকেই বাড়ি গিয়ে তোমার কথা জানাবো। তুমি হয়তো পারবেনা বাসায় বলতে, তাই না?”
” হুম পারবো না।”
” সমস্যা নেই। আমি সব ব্যবস্থা করবো। তুমি শুধু আমার সাথে থেকো। আর হ্যাঁ এখন যাও। কে জানি আসছে এদিকে। কেউ দেখে ফেললে লোকজন জড়ো করে ফেলবে আবার। ”
পরীকে ছেড়ে তাড়াহুড়ো করে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অফ করলো শুভ্র।
” আচ্ছা ঠিক আছে। এসো তাহলে। ফোনে কথা হবে ইনশাআল্লাহ। ”
” ইনশাআল্লাহ। গেলাম আমি পরী।”
” যাও।”
উপস্থিস সবাই মেয়ের সম্মতির জন্য অপেক্ষা করছে। কবুল শব্দটা তিন শব্দের হলেও আজ সেটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভিন্ন একটা শব্দ মনে হচ্ছে ইনায়ার। এই শব্দটা আওড়ানোর পরেই অন্য পুরুষটা নিজস্ব পুরুষ হয়ে যাবে! ইনায়ার কান্না পাচ্ছে কিন্তু নিজেকে সামলে নিতে পেরেছে সে। ইনায়ার পাশেই আছে কন্ঠ। পরীও এসে বসলো মাত্র। একটা সময় শান্ত ভঙ্গিতে গলা খাদে নামিয়ে ইনায়া বলে, “ আলহামদুলিল্লাহ কবুল”। উপস্থিত সবাইও আলহামদুলিল্লাহ বলে শুকরিয়া আদায় করে সৃষ্টিকর্তার নিকট। তারপর শুরু হয় দোয়াদরুদ পড়ানো। বিয়ে শেষ হলে রাত দশটার মধ্যেই সবাই খাওয়াদাওয়া সেড়ে ফেলে। তার আগে অবশ্য গ্রামের অতিথিরা খেয়ে নিয়েছে। ইফতি আজকে শুধু ছটফট করে যাচ্ছে। লাল রঙের শাড়িতে কন্ঠকে এতো সুন্দর লাগবে স্বপ্নেও ভাবেনি লোকটা। নিজের স্ত্রী যে এতটা সুন্দরী সেটা যেনো আজকে নতুন করে আবিষ্কার করলো ইফতি।
চলবে,
আপনাদের মতামত আশা করছি। রাতে আরেক পর্ব দেওয়ার চেষ্টা করবো। আমার গল্পের যেকোনো বিষয় সম্পর্কে মতামত জানাতে প্রিয়ার গল্পকথন ( Tasmia Tasnin Priya) গ্রুপে এড হতে পারেন।
আগের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=404733158874302&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz
পরের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=405587995455485&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz