রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৬৭| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
596

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৬৭|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

বৈঠকখানায় উপস্থিত মাধুরী ফিরোজা সাবিনা অবাক ও বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন ভূমির দিকে। আজ ছ-দিন পর ভূমিকে পাওয়া গিয়েছে। সাবিনা আর ফিরোজা খুশি হতে পারলেও মাধুরীর মুখটা আগের মতই। তিনি খুশি হয়েছেন কিনা মুখ দেখে বলা যাচ্ছে না! গম্ভীর মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অর্পণ তা দেখেও না দেখার ভান করে সাবিনাকে বলল‚

“সাবিনা যা তো ভূমির জন্য একগ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়।”

চট করেই সাবিনা জবাব দিল‚ “আইচ্ছা ছোটো ভাইজান।”

সাবিনা রান্নাঘরে চলে যেতেই ফিরোজা জিজ্ঞেস করলেন‚ “তুই ভূমিকে কোথায় পেলি বাবা?” এরপর ভূমির দিকে তাকিয়ে বললেন‚ তুমি বোরকা‚ হিজাব আর নেকাবটা খুলে বসো ভূমি৷”

ভূমি কিছুই বলল না৷ সে তো পুরো বাড়িটা দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে৷ যেন যুগ পর দেখছে। ছ-দিনকেও ছ-বছরের সমতূল্য মনে হচ্ছে তার৷ সবটাই ঘোরের মাঝে কাটিয়ে গেল। ভূমির মৌনতা কাটছে না আজ৷ তবে ফিরোজার কথানুযায়ী বোরকা‚ হিজাব আর নেকাব খুলে নিয়েছে ইতিমধ্যেই। পড়নে তার একটা ঢিলাঢালা গোল জামা৷ এই বোরকা‚ হিজাব আর নেকাব কোনোটাই তার না৷ বরঞ্চ জামাটা পর্যন্ত রুমার৷ মাথায় ওড়না পেচিয়ে নিল ভূমি। অর্পণ তার মায়ের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে বলল‚

“ভূমিকে আমি গলির মোড়ে পেয়েছি। প্রথমেই চিনতে পারিনি এরপর নিজে থেকেই পরিচয় দিয়েছে। তাই দুজনে একসঙ্গে বাড়ি ফিরেছি।”

ফিরোজা এগিয়ে এসে ভূমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল‚ “এতদিন কোথায় ছিলেন মা? তুমি ঠিক আছ? শরীর ভালো আছে তোমার?”

ভূমিকে কিছু বলতে না দিয়ে মাধুরী এবার বললেন‚ “নির্বোধ তুমি? সভ্য বাড়ির বউ কখনো এমন কাজ করে? কোথায় পালিয়ে গিয়েছিলে তুমি? আমার ছেলেটার দিকে তাকানো যায় না। ছেলেটা আমার গুমরে গুমরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।”

ভূমিকে নিজের কথা বলার সময় বা সুযোগটুকু দিচ্ছেন না মাধুরী। অর্পণ আর ফিরোজা সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অর্পণ সাবিনাকে পাঠিয়েছে রান্নাঘর থেকে যেন ভূমির জন্য পানি নিয়ে আসে। এদিকে মাধুরীর এমন ব্যবহারে বিরক্ত হচ্ছে সে। তারই সামনে তার বোনকে অহেতুক কথা শোনাচ্ছেন তিনি। এদিকে বাবার উপর ভীষণ রেগে আছে সে। পথে আসতে আসতেই ভূমি তাকে সব সত্যি জানিয়েছে। অর্পণ ভেবে পায় না— একটা মানুষ কী করে এতটা জঘন্য হতে পারে! শুধুমাত্র ভূমির কাছে করা ওয়াদার কারণে সে কিছুই বলতে পারছে না। আর না প্রলয়কে এসব কিছু জানাতে পারছে। এইজন্য ভেতরে ভেতরে ভূমি ওপর রেগে রয়েছে। কেন যে তাকে দিয়ে ওয়াদা করাল! সাবিনা পানি নিয়ে আসতেই অর্পণ তাকে পানি পান করতে দিল। অনেকক্ষণ যাবৎ তেষ্টা পেয়েছিল বিধায় ঢকঢক করে একগ্লাস পানি পান করল ভূমি। মাধুরী দুহাত আড়াআড়ি ভাজ করে ফিরোজার সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অনেকক্ষণ আগেই ভূমিকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন কিন্তু তার উত্তর এখনো পাননি তিনি। সে নিয়ে মূলত কিছুটা ক্ষেপে আছেন ভূমির উপর। মাধুরী আবারও বললেন‚

“তোমাকে আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম!”

ভূমিকে কিছু বলতে না দিয়ে ফিরোজা বললেন‚ “মেয়েটাকে এখন একটু বিশ্রাম করার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। দেখে মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত। তোমার প্রশ্নের উত্তর তো পরেও দেওয়া যাবে ভাবি।”

অর্পণ তার মায়ের কথাতে সায় জানাল। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল ভূমিকে তার ঘরে চলে যেতে। কিছু সময় বিশ্রাম নিক তারপর নাহয় সবার সামনে সব কথা বলবে। কিন্তু অর্পণের কথায় ভূমি রাজি হলো না। সে এখনই মাধুরীর সকল প্রশ্নের উত্তর দেবে৷ তাই সে সব কথা খুলে বলল। ফিরোজা আফসোস করতে শুরু করলেন কারণ এ কদিন ভূমি মানসিকভাবে ভীষণই কষ্টে ছিল। যার একাংশ ধারণাও এখানে উপস্থিত কারোর নেই। একে তো সদ্য তার আম্মাকে হারিয়েছে তারউপর আবার একটা খারাপ জায়গায় আটকা পড়েছিল। ভাগ্যিস কোনো বিপদ হয়নি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন ফিরোজা। মাধুরী বললেন‚

“তা ওমন একটা জায়গায় তুমি পৌঁছালে কী করে?”

ক্ষীণ স্বরে ভূমি জবাব দিল‚ “আমি নিজেও জানিনা মা— আমি কী করে ওমম একটা জায়গায় পৌঁছালাম!”

মেহরাব শিকদারের কথাটা পুরোপুরিভাবে এড়িয়ে গেল ভূমি৷ সে এখন চাইছে না মেহরাব শিকদারের কথাটা অর্পণ ব্যাতিত অন্য কেউ জানুক! ওই লোককে তো সে নিজের হাতে শাস্তি দেবে। এমন মৃ’ত্যু দেবে যেন‚ ওই লোক নিজেই নিজের মৃ’ত্যু কামনা করেন। যতটা কষ্ট আর যন্ত্রণা তার আম্মাকে পেতে হয়েছে ততটাই সে সুদে আসলে ফেরত দেবে৷ মনে মনে সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। অর্পণ জানিয়েছে ভূমির প্রত্যেকটা পদক্ষেপে সে তাকে সাহায্য করবে৷ এবার ভূমি কিছুটা মনোবল পেয়েছে৷ এরই মাঝে পূর্ণতা পুষ্পিতা কলেজ থেকে এসেছে। বৈঠকখানায় ভূমিকে দেখে ওরা দু-বোন খুবই খুশি হয়েছে। আনন্দে আটখানা পুষ্পিতা দৌঁড়ে এসে ভূমিকে জড়িয়ে ধরল৷ এ কদিন ওরাও তাদের ভাবিমণিকে ভীষণ মিস করেছে। ভূমিকে ফিরে পেয়ে খুবই ভালো লাগছে তাদের। ভূমির হাত ধরে পুষ্পিতা বলল‚

“তুমি এতদিন কোথায় ছিলে ভাবিমণি? তুমি জানো আমরা তোমাকে কত মিস করেছি?”

আদরের রায়বাঘিনী ননদিনীদের ভালোবাসায় সিক্ত ভূমি৷ ক্ষীণ হেসে ভূমি কিছু বলতেই নেবে তার আগেই অর্পণ বলে উঠল‚ “অনেক কথা হয়েছে। ভূমি এখন বিশ্রাম নেবে৷ তোরা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নে। পরে যত পারিস ভাবিমণির সঙ্গে কথা বলে নিস।”

অর্পণের কথাই ওরা মেনে নিল। নিজেদের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নিজেদের ঘরে চলে গেল৷ এদিকে অর্পণ তার মাকে ইশারা করতেই ভূমিকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলেন ফিরোজা৷ এখানে থাকলে আরও বহু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে ভূমিকে। যেটা অর্পণ এই মুহূর্তে কিছুতেই চাইছে না। এদিকে ওদের এমন ব্যবহারে বেজায় বিরক্ত মাধুরী। বড়ো বড়ো পা ফেলে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন তিনি। আনমনেই তাচ্ছিল্য করে হাসল অর্পণ। মাধুরী যে শুধুমাত্র প্রলয়ের জন্যই সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে নিচ্ছেন তা সে বেশ ভালই বুঝতে পারছে। সত্যিটা তো একদিন সবার সামনে আসবেই সেদিন হয়তো ভূমি সকল অবহেলা থেকে মুক্তি পাবে। মাধুরীও হয়তো তাকে কাছে টেনে নেবে৷ অর্পণ খুব করে চায় তার বোন মাধুরীর থেকে মায়ের মতো ভালোবাসা পাক। আদতে কী সেই দিনটা কোনোদিন আসবে?

রাতে…

প্রলয় সেই যে দুপুরের বেরিয়েছিল তারপর রাত করে বাড়ি ফিরেছে সে৷ আজ ব্যস্ত থাকায় কারো ফোন তোলেনি সে৷ বিকেলে অবশ্য অর্পণ আর মাধুরী কয়েকবার কল করেছিল। প্রলয় খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি কারণ এমন কল তোর প্রতিদিনই আসে। এখন সময় রাত সাড়ে নয়টায়। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরেছে প্রলয়। আজকাল বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না তার৷ শূন্য ঘরটায় শুধুই হাহাকার। কোথাও শান্তি মেলে না। প্রলয় নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত তার ফলাফল শূন্য। নিজের ঘরে যাওয়ার পূর্বে প্রলয় একটিবার পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরের দিকে গেল৷ ওদের দুজনের জন্য চকলেট কিনে এনেছিল৷ চকলেট দিয়েই প্রলয় নিজের ঘরে চলে এলো। তখন খেয়াল করল পূর্ণতা পুষ্পিতা মুচকি মুচকি হাসছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পারল না প্রলয়। তারউপর আরেক আজব ঘটনা ঘটল তা হচ্ছে‚ তার ঘর আঁধারিয়ায় আচ্ছন্ন। বারান্দা থেকে আবছা আলো ঘরে প্রবেশ করছে ঠিকই। বাহিরের ল্যাম্পপোস্ট থেকেই মূলত হরিদ্রাভ আলোর দেখা মিলছে। প্রলয় অনুভব করল‚ সে ছাড়াও ঘরের ভেতর কারো অস্তিত্ব রয়েছে। চট করে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিল। অকস্মাৎ ভূমিকে দেখে অবাকের শীর্ষে পৌঁছাল প্রলয়। একই স্থানে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল সে। চোখ থেকে চশমা একবার খুলে‚ পরিষ্কার করে আবারও চোখে পড়ে নিল। সে ভাবছে হয়তো সবটাই তার চোখের ভুল। কারণ এ কদিনে ভূমিকে বহুবার সে কল্পনা করেছে। তবে বারবারই সে মিথ্যে ছিল৷ আজ কী সত্যিই তার ভূমি কন্যা ফিরে এসেছে? প্রলয় ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ভূমির দিকে৷ একটিবার ছুঁয়ে দেখল ভূমিকে৷ না! আজ সে ভুল না। সত্যি সত্যিই তার ভূমি কন্যা ফিরে এসেছে৷ ভূমির সারা মুখে আদুরে ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিল প্রলয়৷ অতি খুশিতে কান্না পাচ্ছে তার। ভূমির হাতের পিঠে বার কয়েক চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করল‚

“কোথায় ছিলে তুমি? তোমাকে ছাড়া আমি একটুও ভালো ছিলাম না ভূমি কন্যা।”

সহজ কথা বলতে গিয়েও পুরুষালি গম্ভীর কণ্ঠনালি কাঁপছে৷ প্রলয়ের অবস্থা কিছুটা হলেও বুঝতে পারল ভূমি। নিজে থেকেই প্রলয়কে জড়িয়ে ধরল। মনে হচ্ছে যেন একযুগ পর নিরুপদ্রব বুকটায় মাথা রেখেছে সে৷ আবেশে চোখ দুটো বন্ধ করে নিয়েছে ভূমি৷ সেই চিরচেনা সুবাসে মুগ্ধকারিণী আরও লেপ্টে রইল তার অর্ধাঙ্গের বক্ষঃস্থলে। ভূমির মাথায় হাত বুলিয়ে প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚

“কোথায় ছিলে তুমি? তুমি জানো তোমাকে আমি কত খুঁজেছি! তবুও শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়িনি৷”

এবার ভূমি বিগত ছয় দিনের ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই বলতে শুরু করল ভূমি। তার পাশে বসে নীরবে সব কথা শুনতে লাগল প্রলয়। ভূমি বলল‚

“সেদিন যখন আমার জ্ঞান ফেরে তখন আমি নিজেকে একটা সংকীর্ণ জানালা বিহীন কামরায় আবিষ্কার করি৷ আমার সামনে দুটো মেয়ে বসে ছিল৷ তাদের ভাষ্যমতে তারা নাকি আমাকে রাস্তা অচৈতন্য অবস্থায় পেয়েছিল। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে‚ আমি আম্মার কবরটা দূর থেকেই দেখতে গিয়েছিলাম। আপনি তখন বাড়ি ছিলেন না তাই আপনাকে জানানো হয়নি। তো হঠাৎ করেই তখন আমার শরীর খারাপ লাগতে শুরু করে। উপলব্ধি করছিলাম শরীর প্রচণ্ড ঘামছে। হাত পা দুটো নিঃসাড় হয়ে পড়ছিল৷ দুচোখ মেলে তাকিয়ে থাকার শক্তিটুকু ছিল না৷ এরপর কখন যে জ্ঞান হারাই আমার মনে নেই৷ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আমি গ্রাম ছেড়ে কী করে অন্য একটা জায়গা পৌঁছে গেলাম আমার জানা নেই। মনে হচ্ছিল ঘটনাগুলো সব আকস্মিকভাবেই ঘটছে৷ হুট করে একটা নিষিদ্ধ জায়গায় কী করে পৌঁছে গেলাম জানা নেই আমার! বারবার শুধু মনে হয়েছে কী করে এখান থেকে পালিয়ে আসা যায়! প্রতি মুহূর্ত আমি দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়ছিলাম। একমাত্র তিথি আপু আমার খেয়াল রেখেছেন। ওখান থেকে পালাতে উনিই আমাকে সাহায্য করেছেন। আজ ওখানকার সর্দারনি আমাকে নিয়ে বের হয়েছিল। বের হবার কথাটা আগে থেকেই জানা ছিল তাই তিথি আপু উনার পানির সঙ্গে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছিল৷ ওই পানি পান করার সঙ্গে সঙ্গেই পিংকি ঘুমিয়ে পড়েন আর আমি সুযোগ বুঝে পালিয়ে আসি।”

এতগুলো কথা বলে একটু থামল ভূমি৷ পরবর্তী আরও কথা বলতে নেবে তার আগেই প্রলয় তাকে থামিয়ে দিল৷ তার আর কিছুই শোনার নেই৷ তার ভূমি কন্যাকে ফিরে ফেয়েছে সেটাই অনেক৷ আর কিছুই চাই না তার।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here