#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৬৮|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
এশার নামাযের পরপরই গণিকালয়ে ফিরে এসেছেন পিংকি। অনেক খুঁজেও আশেপাশে কোথাও ভূমিকে পাননি তিনি। গণিকালয়ে ফিরে এসেই চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছেন। সমস্ত রাগ ঝাড়ছেন তিথির উপর। ভূমির পালিয়ে যাওয়া নিয়ে মনে মনে খুশি হলেও প্রকাশ্যে সকলের সামনে নিজের ক্ষিপ্ততা প্রকাশ করলেন পিংকি৷ চামেলি অনেকক্ষণ ধরেই তিথির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে যাচ্ছে৷ তার ভাষ্যমতে তিথি কোনো কলকাঠি নেড়েছে ভূমিকে পালাতে সাহায্য করবে বলে। একমাত্র সেই তো সারাক্ষণ আঠার মতো লেগে লেগেই ছিল৷ তিথির বাহু ধরে ঝাকিয়ে চামেলি জিজ্ঞেস করল‚
“ভূমিকে কোথায় পাঠিয়েছিস? তাড়াতাড়ি বল! নয়তো তুই বুঝতেই পারছিস ম্যাডাম তোর সঙ্গে ঠিক কী কী করবে! তাই বলছি ভালোই ভালোই সত্যিটা বলে দে।”
“আমি ওকে কোথাও পাঠাইনি। ওই মেয়ে যে পালাতে পারে সেটাই তো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না৷ আমাকে বিশ্বাস কর! আমি কিছুই জানি না।”
কিছুটা তাচ্ছিল্য করে চামেলি বলল‚ “তুই বললি আর তোকে আমরা বিশ্বাস করে নেব?”
“সত্যি আমি কিছুই করিনি।”
“তুই চুপ থাক। যা বিচার করার ম্যাডামই করবেন।”
এবার পিংকি চেঁচিয়ে বললেন‚ “থামবি তোরা? এই নিয়ে এখন আমি কোনো কথা শুনতে চাইছি না৷ ওই মেয়েকে খুঁজে আনা আমার বাঁ হাতের খেলা৷ এখন আমি একটু একা থাকতে চাই। বাকিরা যে যার কাজে যা।”
পিংকির কাছ থেকে ধমক খেয়ে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল চামেলি৷ বাকিরা যে যার কাজে আগেই লেগে পড়েছে৷ গণিকামহলের সকলেই পিংকি এবং তার রাগকে ভীষণই ভয় পায়৷ রাগ মাথায় চড়লে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন পিংকি৷ সেই রাগ গিয়ে ঝড়ে পড়ে গণিকামহলে থাকা সকল মেয়েদের উপর৷ চামেলি রান্নাঘরে চলে গেল। পিংকিকে এক কাপ কড়া করে দুধ চা বানিয়ে খাওয়াবে। আপাতত বৈঠকখানায় পিংকি আর তিথি ছাড়া আর কেউই নেই৷ সুযোগ বুঝে পিংকি জিজ্ঞেস করলেন‚
“পানিতে তুই-ই ঘুমের ঔষধ মিশিয়েছিলি?”
ঘাবড়ে গেল তিথি৷ কী উত্তর দেবে ভেব পেল না৷ না জানি পিংকি এখন কী করবে! ভয়ে আঁটসাঁট অবস্থা তার৷ আমতা আমতা করতে শুরু করল। তার অবস্থা বুঝতে পেরে পিংকি বললেন‚
“আমার জন্য একগ্লাস পানি দে৷ দেখিস এখন আবার ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিস না৷ সারা বিকেল ধরে ঘুমিয়েই ছিলাম৷”
পিংকির কাছ থেকে এমন নমনীয় ব্যবহার কস্মিনকালেও আশা করেনি তিথি৷ কিছুটা ভড়কে গেল বৈকি৷ পিংকি সত্যিটা জেনেও কিছুই বললেন না দেখে ভীষণই অবাক হয়েছে সে৷ তিথি তাড়াহুড়ো করে জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে পিংকিকে দিয়ে দিল৷ ভূমি ঠিকঠাক ভাবে তার ঠিকানায় পৌঁছেছে কি-না জানা নেই তার! আর না কখনো জানতে পারবে৷ তবে ভূমির যে এই নরক থেকে মুক্তি মিলেছে এটাই বা কম কীসের? এতেই সে খুখি। তিথিকে এভাবে মৌনতা পালন করতে দেখে পিংকি বলে উঠলেন‚
“যাকে নিয়ে এত চিন্তা করছিস— সে তার নিজের ঠিকানায় পৌঁছে গেছে।”
চকিত দৃষ্টিতে তাকাল তিথি৷ তার বিশ্বাস হচ্ছে না এ কথা পিংকি তাকে বলছে। আজ পিংকিকে একদম অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে অনেকটা বদলে গিয়েছেন তিনি৷ তারমানে পিংকি সবটাই জানত৷ তবুও কিচ্ছুটি বললেন না৷ অবিশ্বাস্য কম্পিত কণ্ঠে তিথি বলল‚
“ম্যাডাম আ..আপনি?”
নিজ ঠোঁটে তর্জনী ছুঁয়ে পিংকি বললেন‚ “হুস! এই কথাটা শুধুমাত্র আমাদের দুজনের মাঝেই থাকবে৷”
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা আঁখিপল্লব দ্রুত ঝাপটাল তিথি৷ যার অর্থ এই কথা তৃতীয় কোনো ব্যক্তি কখনো জানবে না৷ পানি গ্লাসটা নিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন পিংকি৷ আর এদিকে আড়াল থেকে ওদের সব কথাই শুনেছে চামেলি৷ শুনেও খুব একটা লাভ হবে না তার৷ এখানে সর্দারনি হচ্ছে পিংকি৷ তিনি যা ভালো মনে করেন সেটাই হয়৷ তার উপর দিয়ে কেউ আদতে যেতে পারবে বলে মনে হয় না। আর বাকি রইল তিথি! তাকে তো সে একাই সামলে নিতে পারবে৷ বাঁকা হেসে রান্নাঘরে চলল তদারকি করতে৷
রাত সাড়ে সাড়ে দশটা…
খাবার টেবিলে সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছেন৷ ফিরোজা আর মাধুরী এখনো খেতে বসেননি। উনারা পরে খেতে বসবেন। সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন উনারা। আজ রান্নার কাজ শেষ হয়েছে রাত সাড়ে আটটার দিকে৷ দুটো খাবার ভূমির খুবই পছন্দের। সেগুলোই আজ ফিরোজা নিজের হাতে রান্না করেছেন। এক হলো শিং মাছ‚ টমেটো আলু দিয়ে ঝোল আর একটা খাবার হলো ঝাল ঝাল করে দেশি মুরগীর মাংস ভুনা৷ ভূমির থেকেই শুনেছিলেন‚ এই খাবার গুলো নাকি মহুয়া খুবই যত্নসহকারে রান্না করতেন মেয়ের জন্য৷ ভূমির মায়ের মতো রান্না করতে পেরেছেন কি-না জানা নেই তবে তিনি চেষ্টা করেছেন ভূমির পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়ার। ওর মায়ের মতো করে ওর খেয়াল রাখার৷ খাবার টেবিলে ভূমিকে দেখে তখন চক্ষু চড়কগাছ। তিনি আশা করতে পারেননি যে‚ ভূমি এভাবে পালিয়ে এসে খুঁজে খুঁজে ঠিক বাড়িতেই চলে আসবে৷ এমনটা উনার কল্পনাতীত ছিল৷ গ্রামের এই সহজ সরল মেয়েটাকে তিনি একটু বেশিই সহজ সরল মনে করেছিলেন। তাই এখন উনাকে পস্তাতে হচ্ছে। খাবার খাওয়ার এক পর্যায়ে অর্পণকে মেহরাব শিকদার জিজ্ঞেস করলেন‚
“ভূমিকে তুমি কোথায় পেলে?”
“এক কথা বারবার বলতে আমি সাচ্ছন্দ্যবোধ করছি না।”
অর্পণের কথা শুনে সকলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে৷ যে ছেলে কি-না সবসময় সকলের বাধ্যগত হয়ে থাকত সেই ছেলেই কি-না তার বাবার। মুখে মুখে কথা বলছে! ছেলের কথার প্রত্যুত্তরে ফিরোজা বললেন‚ “বাবার সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে? কী হয়েছে তোর?”
“কিছু হয়নি। আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে৷ আমি ঘরে যাচ্ছি৷”
বাকিরা কেউই অর্পণকে জোর করল না৷ হাত ধুয়ে নিজের ঘরে চলে গেল অর্পণ। বাবার সঙ্গে কখনোই সে এমন ব্যবহার করে না তবে আজ তার কী হলো? সবাই মনে করছে হয়তো কোনো বিষয় নিয়ে মন খারাপ আর নয়তো কিছু নিয়ে চিন্তা করছে৷ তাই তারা বিষয়টিকে নিয়ে খুব একটা ঘাটলেন না৷ অর্পণের মুড এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে৷ উপস্থিত কেউ অর্পণের মনের অবস্থা বুঝতে না পারলেও ভূমি ঠিকই বুঝল। এমন ব্যবহারের মানেটা বুঝতে তার এক সেকেন্ডও সময় লাগেনি তার। মেহরাব শিকদার আড়চোখে বার কয়েক তাকালেন ভূমির দিকে৷ প্রলয় নিজের হাতে ভূমিকে খাইয়ে দিচ্ছে৷ আজ লাজলজ্জার মাথা খেয়েছে যেন৷ ভূমিও কিছু বলছে না৷ অপলক দৃষ্টে প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে খাবার খাচ্ছে৷ বাচ্চা আসার কথাটা এখনো প্রলয়কে জানাতে পারেনি সে৷ তখন বলতেই নিচ্ছিল কিন্তু প্রলয় তাকে কিছু বলতেই দিল না৷ সে চায় তার অনাগত সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে যেন প্রলয়ের মতই হয়। পানি পান করে আলতো স্নেহময় হাতটা নিজের পেটের উপর রাখল ভূমি৷ মা হবার অনুভূতি সত্যিই খুবই অসাধারণ। কথাটা জানলে হয়তো প্রলয় খুবই খুশি হবে৷ তাকে আরও বেশি বেশি ভালোবাসবে৷ ভালো তো বাসতেই হবে৷ এ সময় মায়েরা তার আর সন্তানের জন্য দ্বিগুণ ভালোবাসা পায়৷ তার ক্ষেত্রেও অবশ্যই সেটা হবে৷ আজ অনেকটা তৃপ্তি নিয়ে খাবার খেয়েছে ভূমি। বাড়িতে ফেরার পর একবারের জন্যও গা গোলায়নি তার৷ বরঞ্চ শরীরটা বেশ ভালো লাগছে৷ ওখানকার নোংরা আর অপবিত্র পরিবেশে থাকতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল তার৷ যদিও তাকে একটা জানালা বিহীন ঘরের ভেতরে একপ্রকার আটকে রাখা হয়েছিল৷ বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে আকাশে উড়তে ইচ্ছে হচ্ছে ভূমির৷ খাওয়া হয়ে গেলে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল৷ তাকে খাইয়ে দেওয়ার চক্করে প্রলয় এখনো কিচ্ছুটি খায়নি৷ আসার পর থেকে লোকটা তার যত্ন নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ছেলের এমন ব্যবহার করার কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না মেহরাব শিকদার। অর্পণ কেন উনাকে না দেখার ভান করছে— কেন উনার সঙ্গে এমন অদ্ভুত আচরণ করছে তার কোনো উত্তরই উনার কাছে আপাতত নেই।
রআত দেড়টা…
রাত গভীর হচ্ছে। শুধুমাত্র ঘুম নেই ভূমির দুচোখে। গম্ভীর হয়ে কিছু একটা ভেবে যাচ্ছে সে। মেহরাব শিকদারকে হালকা ভাবে নেওয়া তার একদমই উচিত হচ্ছে না। যে নিজের অপকর্ম ঢাকতে মানুষ খু’ন করাতে পারে সে যাচ্ছেতাই করতে পারে। তার এখন একটাই ভাবনা কী করে মেহরাব শিকদারের সমস্ত অন্যায় কাজের প্রমাণ বের করবে৷ এই জঘন্য লোককে দুনিয়ায় মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেওয়া যাবে না৷ মেহরাব শিকদারের করা প্রতিটা পাপের শাস্তি সে নিজের হাতে দেবে৷ একমাত্র এই লোকের জন্য তার জীবনটা আজ এলোমেলো। তার আম্মাকে ম’রতে হয়েছে শুধুমাত্র এই লোকের জন্য৷ মাথার উপর থেকে আম্মা নামক বটবৃক্ষটা আর নেই৷ কয়েক ফোঁটা অশ্রুবর্ষণ হলো। আঁধারিয়া কামরা বিছানা হাতড়ে প্রলয়কে খোঁজার চেষ্টা করল সে। প্রলয় হয়তো ওপাশ ফিরে শুয়েছে৷ ভূমি আজ নিজ থেকেই এগিয়ে গেল। পেছন থেকে প্রলয়কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল৷ আম্মাকে হারিয়ে দ্বিতীয়বার সে প্রলয়কে হারাতে চায় না৷ সবে ঘুমোনোর চেষ্টা করছিল প্রলয়৷ সে মনে করেছিল ভূমি হয়তো ঘুমিয়ে পোরেছে। কিন্তু তার ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল। তার ভূমি কন্যা তো দিব্যি জেগে রয়েছে৷ ঘুমু ঘুমু ভারী কণ্ঠে প্রলয় বলল‚
“হঠাৎ করে বরকে এত ভালোবাসা হচ্ছে— কী ব্যাপার?”
প্রলয়ের কণ্ঠ শুনে অবাক হলো সে৷ লোকটা এখনো জেগে রয়েছেন৷ সে তো ভাবছিল প্রলয় হয়তো এতক্ষণে গভীর ঘুম তাইতো জড়িয়ে ধরল৷ ভূমি মুখে বলল‚ “তারমানে আপনি ঘুমাননি?”
“ঘুমিয়েছিলাম তো কিন্তু তুমি কোথায় আমাকে ঘুমতে দিলে ভূমি কন্যা?”
এই বলে পাশ ফিরে ভূমির উপর চড়ে কপালে আদুয়ে স্পর্শ ছুঁয়ে দিল৷ প্রলয় নিজের মাঝে নেই৷ সে মত্ত হতে চায় তার ভূমি কন্যার মাঝে৷ আর বিলম্ব না করে ভূমিকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে শুরু করল প্রলয়৷ যুগ্ম দেহাবয় নিজেদের অধরামৃ’তের স্বাদ গ্রহণ করতে শুরু করল। চেয়েও প্রলয়কে থামানো যাচ্ছে না৷ লোকটা যেন মুহূর্তেই উন্মাদ হয়ে গিয়েছে৷ ভূমিকে আগলে নিয়েছে নিজের মাঝে৷ বেশ অনেকটা সময় অতিবাহিত হবার পর ভূমির মুখের দিকে তাকাল প্রলয়৷ ঘরে ঘুমবাতি জ্বালিয়ে রাখা। এই আবছা আলোতে ভূমিকে দেখে ক্ষীণ হাসল সে। মেয়েটা চোখ বন্ধ করে ক্রমশ হাঁপাচ্ছে৷ ভূমির বুকের উপর মাথা রাখল প্রলয়৷ শরীরের মৃদু কম্পন খুব করে অনুভব করল সে। এবার চোখ মেলে তাকাল ভূমি। শরীরের উপর প্রলয়ের ভার সহ্য করতে না পেরে বলল‚
“একটু সরুন এমপি মশাই— আমার শরীরে চাপ লাগছে।”
প্রলয় শুনল না। সেভাবেই শুয়ে রইল৷ অনেকদিন পর তার ভূমি কন্যাকে সে কাছে পেয়েছে৷ আজ আর কোনো বাঁধা সে শুনবে না৷ না ভূমিকে কোনো বাঁধা দিতে দেবে৷ ভূমির গ্রীবাদেশে আদুরে ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিল। সেই সঙ্গে গ্রীবাদেশে কিছু চিনচিনে ব্যথাও অনুভূত হলো ভূমির৷ তবে সে তা সহ্য করে নিল। প্রলয় সেভাবেই শুয়ে থেকে ভূমিকে বলল‚
“আজকের রাতটা শুধুই তোমার আর আমার৷ তোমার মন থেকে সকল বিষণ্ণতা আর গ্লানি আমি নিংড়ে নিতে চাই ভূমি কন্যা৷ আজ আর বাঁধা দিয়ো না৷ ব্যাকুল হৃদয়ে একপশলা মেঘের আবির্ভাব ঘটুক৷ প্লিজ!”
চলবে?…..