#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_২২_দ্বিতীয়_অংশ
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
সাই-সাই করে গাড়ি ছুটে চলেছে হিজলতলী গ্রামের দিকে। মাসখানেক হলো ইফতি চার চাকার গাড়ি কিনেছে। সকাল হতেই ঝটপট নাস্তা সেড়ে সবাই বের হয়েছে। ড্রাইভারের সিটে সমুদ্র ,পাশের সিটে বিনা। আর পেছনে শায়লা, শারমিন ও কন্ঠ। ইফতি ও জাহাঙ্গীর মল্লিক সন্ধ্যায় আসবে। কন্ঠ জানালার পাশে বসেছে। বাইরের গাছপালা, লোকজন সবকিছু খুব মনোযোগ সহকারে অবলোকন করতে ব্যস্ত সে। দুপুরের আগেই ইয়ানাদের বাসায় পৌঁছে সবাই। লোকজনের ভীড় দেখে কন্ঠ রীতিমতো শকড। গ্রামের মান্যগণ্য ব্যক্তিদের বাড়ি বলে বলতে গেলে পুরো গ্রামের মানুষকেই দাওয়াত করা হয়েছে বিয়েতে। আফতাফ হাসান মেয়েদের ভীষণ ভালোবাসেন। মেয়ে হলো আল্লাহর রহমত। বাড়ির মধ্যে পৌঁছাতেই মারিয়া হাসান হাসিমুখে সবার দিকে এগিয়ে এলেন।
” আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন সবাই? আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?”
” আমরা আলহামদুলিল্লাহ। তোমার তো খাটতে খাটতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হচ্ছে। ”
মারিয়া হাসানের ঘর্মাক্ত মুখশ্রী দেখে শায়লা বললেন। তিনি মুচকি হেসে বাড়ির ভেতর অচেনা কাউকে নাম ধরে ডাক দিলেন। কিয়ৎক্ষণের মধ্যে সতেরো কি আঠারো বয়সী একটা ছেলে এসে দাঁড়ালো হাসিমুখে। শ্যামবর্ণ চেহারা তার,চুলগুলো পেছনের তুলনায় সামনের দিকের গুলো একটু বড়ো। পরনে লুঙ্গি আর খয়েরী টি-শার্ট।
” রশিদ ওদের ব্যাগগুলো ভেতরে নিয়ে যা। সমুদ্র সাথে যা।”
” ঠিক আছে খালা।”
রশিদ ব্যাগগুলো দু’হাতে নিলো সমুদ্রও নিলো একটা ব্যাগ। তারপর বাড়ির ভেতর ঢুকলো দুজন। রশিদ মারিয়ার খালাতো বোনের ছেলে। বিয়ে উপলক্ষে এসেছে।
” শায়লা আপু আপনি সবাইকে নিয়ে ভেতরে যান। ফ্রেশ হোন সবাই তারপর কথাবার্তা হবে। ইনায়া আছে ভেতরে ও সবকিছু দেখিয়ে দিবে।”
” তাই চলো সবাই। আচ্ছা ভাবি।”
বিকেলের দিকে বাইরে নামলো কন্ঠ ও বিনা সাথে ইয়ানাও আছে । বাড়ির পেছনের দিকে তাঁবু দিয়ে ঘিরে একটা সীমানা তৈরি করা। সেখানে রান্নাবান্নার কাজ করছে বাবুর্চিরা। রাত পোহালে বিয়ে। দুপুরে গায়েহলুদ সন্ধ্যায় বিয়ে করে বউ নিয়ে যাবে ছেলেপক্ষ। কন্ঠর মনটা কেমন অস্থির লাগছে সকাল থেকে। ইফতি আসার পর থেকে একবার কল পর্যন্ত করেনি। কন্ঠও ব্যস্ত আছে মনে করে ইফতিকে কল দেয়নি। বাড়ির অন্য দিকে পুকুর। ইনায়া কন্ঠ ও বিনাকে ঘাটে নিয়ে বসাবে বলে পুকুরের ঘাটে নিয়ে যায়। পরী আগে থেকেই ঘাটে বসে আছে। ইনায়া আস্তে আস্তে কন্ঠ ও বিনাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” ভাবিরা পরীর ভীষণ মন খারাপ। আমার বিয়ে হয়ে যাবে বলে মেয়েটা প্রায় এমন করে বসে থাকে। আবার নিজে থেকেই মজা করে। ”
” স্বাভাবিক। ঘরের মধ্যে দু’টো বোন সব সময় একসাথে থেকেছো। এখন একা হয়ে যাবে না এজন্যই।”
বিনাও নিচু স্বরে বললো। কিন্তু কন্ঠর কেনো জানি খটকা লাগলো বিষয়টাতে। মনে হচ্ছে এই বিষাদ ভিন্ন। এসে থেকেই পরীকে অন্য রকম লাগছে কন্ঠর। এখন এখানে এরকম করে বসতে থাকতে দেখে সন্দেহ আরও বাড়ল।
” আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা বাড়ি যাও আমি একটু একা পরীর সাথে কথা বলে দেখি। ”
” কথা বলবা? বেশ বলো। চলো বিনা ভাবি তোমাকে অন্য দিকে নিয়ে যাই। বাড়ির সামনের দিকে বাদে অন্য দিকে যাবো। কালকে বিয়ে তো এজন্য মা বারবার বাড়ির সামনের দিকে যেতে মানা করে। ”
” ঠিক আছে চলো।”
বিনাকে নিয়ে ইনায়া অন্যদিকে গেলো। কন্ঠ ধীর পায়ে গিয়ে ঘাটের অন্য দিকে বসলো। পরী বিষয়টা টের পেয়ে পানি থেকে পা তুলে কন্ঠর দিকে তাকালো।
” তোমার সমস্যা কী ঐশী? তুমি এসব কথা আমাকে কেনো বলছো! প্রহরের সাথে কন্ঠর সম্পর্ক ছিল। তারা দু’জন যদি ইন্টিমেট হয়েও থাকে সেটা কন্ঠর অতীত। আমি শুধু কন্ঠকে চাই ওর অতীত নয়। তুমি ভবিষ্যতে এরকম ফালতু কথাবার্তা নিয়ে আমার সামনে আসবা না।”
ক্রোধান্বিত হয়ে কথাগুলো একনিশ্বাসে বলে থামলো ইফতি। ঐশী ইফতির আচরণে মিইয়ে গেলো। নিজে প্রহরের সাথে সংসার করতে পারেনি বলে কন্ঠর শান্তিও সহ্য হচ্ছে না তার। এজন্য সরাসরি ফোনে কল দিয়ে এসব উদ্ভট কথা বলছে ইফতিকে। কিছু মানুষ আছে না কী করছে নিজেও জানে না? ঐশীও তেমন। জীবনে কখন কী করেছে এবং কীসের জন্য তার হিসাবে গড়মিল।
” ঠিক আছে। সময় হলে দেখবেন কন্ঠ আপনাকে ঠিক ছেড়ে দিবে। প্রহরের অস্তিত্ব পৃথিবীতে না থাকলেও কন্ঠর হৃদয়মাঝে আজীবন থাকবে। ভালো থাকুন। ”
ইফতি কালবিলম্ব না করে তড়িৎ গতিতে কল কেটে দিলো। চোখমুখ বন্ধ করে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেললো কতক্ষণ। যতই হোক কন্ঠ তার স্ত্রী, ভালোবাসার মানুষ। সে অন্য কোনো পুরুষের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছে, ভাবতেই কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছে ইফতির। সূর্য অস্ত যাবে প্রায়। জাহাঙ্গীর মল্লিক রেডি হয়ে এসে ইফতির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন,
” কী রে বের হবো কখন? মাগরিবের আজান দিবে তো!”
ইফতি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। বাবার কথায় পেছন ফিরল। পরনে তার সাদা শার্টের সাথে ফর্মাল প্যান্ট।
” আমি রেডি। চলো বের হই।”
জাহাঙ্গীর মল্লিক এগোলেন সামনে। ইফতিও সব চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে রওনা দিলো।
সাঁঝের অস্তমিত সূর্যের লাল আভায় ভরে আছে আকাশ। পরী কন্ঠকে জড়িয়ে ধরে আছে। কান্নার বেগ কিছুটা কমেছে এখন। কন্ঠ বাঁধা দেয়নি পরীকে। মাঝে মধ্যে কান্না করতে হয়। এতে বুকের কষ্ট একটু হলেও হালকা লাগে।
” পরী যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন কী করা যায় সেটা ভাবতে হবে। ”
পরী কন্ঠকে ছেড়ে ওড়না দিয়ে চোখমুখ মুছে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। কন্ঠর চিন্তিত মুখশ্রীর পানে আগ্রহসহকারে তাকাল পরী।
” কী করবো ভাবি? গ্রামাঞ্চল কোথাও গিয়ে যে সমস্যার সমাধান করবো তা-ও তো সবাই জেনে যাবে। ”
” আমি আসলে কী বলবো বুঝতে পারছি না। প্রেম ভালোবাসার মধ্যে দৈহিক সম্পর্কের কী দরকার! ছেলেরা চাইতেই পারে। ওটা ওদের স্বভাব। কিন্তু মেয়েরা? মেয়েরা বোঝে না ক্ষতি যা হওয়ার তার হয়? ”
পরী মাথা নিচু করে আছে। বিকেলে অনেক কষ্ট করে পরীর মনের কথা বের করে এনেছে কন্ঠ। এখানকার একটা ছেলের সাথে বছরখানেকের প্রেমের সম্পর্ক পরীর। ছেলে গ্রামের প্রধানের একমাত্র ছেলে। মাস্টার্স প্রথম বর্ষে আছে আপাতত। সেই সম্পর্কের ফল এখন পরীর গর্ভে! কন্ঠর অসহ্য লাগছে কিন্তু পরীর সাথে রাগারাগিও করা যাবে না। আজকাল কী হলো প্রেম, ভালোবাসার? শরীরের কারবার ছাড়া তো কিচ্ছু নাই এখানে। যেখানে মনের আগে শরীর বিলাতে হয় তেমন প্রেমের মুখে থুথু মারতে ইচ্ছে করে। শারীরিক সম্পর্ক শুধু মাত্র বিবাহের পরের জন্য। বিবাহবহির্ভূত কোনো সম্পর্কের জন্য নয়। পরীর নিস্তব্ধতা দেখে কন্ঠ নিজেকে শান্ত করে। সাবধানে সামলাতে হবে সবকিছু।
” আচ্ছা শোনো ওই ছেলের সাথে কথা হয়েছে তোমার? ”
” নাহ এখনো কিছু জানে না। পাঁচ দিন আগেই জানলাম আমি। শুভ্র বান্দরবান গেছে বন্ধুদের সাথে এক সপ্তাহ আগে। আর ওখানে তো নেটওয়ার্ক সমস্যা। ”
” তাহলে শুভ্র আগে আসুক। ওর সাথে কথা বলে একবার দেখো।”
” আমার মনে হয় ও সরাসরি বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে বলবে।”
কন্ঠ অবাক হয় পরীর কথায়। প্রেমিকের সম্পর্কে এমন ধারণা থাকার পরেও তার সাথে এতো ঘনিষ্ঠতা?
” তাহলে কী করবে? হয় তোমাকে বাচ্চা এবোরশন করাতে হবে নয়তো শুভ্রকে বিয়ে। এছাড়া আর কোনো পথ দেখি না আমি। ”
পরীর কপালে চিন্তা রেখার ছাপ স্পষ্ট। সম্পর্কের শুরু থেকেই শুভ্র কখনো পরীর প্রতি কেয়ারিং ছিল না। খোঁজ খবর পর্যন্ত সব সময় পরীই নিতো। সেখানে বলা মাত্র বিয়ে করে নিবে এমন আশা পরী করে না। বিষয়টা আজকাল এতো সহজলভ্য হয়ে গেছে দু’জনেই এনজয় করি। মাঝখান থেকে নিষ্পাপ একটা প্রাণের বিসর্জন ঘটে। মানুষ নামের মানুষগুলো আদতে আর মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি।
” ভাবি তুমি প্লিজ কাউকে বইলো না। ”
পরী হাতজোড় করে বললো। কন্ঠর ভেতর ভেতর ভীষণ রাগ হলেও কিছু বলতেও পারছে না।
” না বলবো না। তবে তোমার সমস্যার সমাধান করবো ঠিক। ”
পরী কিছুটা স্বস্তি পেলো। সব কথা বুকের ভেতর জমা হয়ে বড্ড ভারী ভারী লাগছিল সব।
রাত ন’টার দিকে ইফতি ও ইফতির বাবা ইনায়াদের বাড়ি পৌঁছে। ইফতিকে দেখে কন্ঠ দেহে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। কন্ঠ একটু আগেও কল দিয়েছিল কিন্তু কল রিসিভ করেনি ইফতি। গাড়িতে আছে ভেবে অপেক্ষা করে বসে ছিলো কন্ঠ।
চলবে,
রিচেক দেওয়া হয়নি। সবাই ভুলত্রুটি দেখিয়ে দিবেন। আপনাদের মন্তব্য আমার লেখার প্রাপ্তি।
পরের পর্ব https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=404733158874302&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz