উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৪৯ (১ম ভাগ)||

0
501

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৯ (১ম ভাগ)||

৯৯।
শেষমেশ রিজওয়ান কবিরের স্বপ্ন পূরণ হলো। গতকাল মন্ত্রীর পদে শপথ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। আর আজ চট্টগ্রাম ফিরে একটা সভার আয়োজন করবেন। এই সুযোগ ব্যবহার করে তিনি সহজে আহিকে নিজের সাথে ঢাকায় নিয়ে যেতে পারবেন। লাবণি বিকেলে বারান্দায় বসে আয়েশ করে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। তখনই তার ফোনের স্ক্রিনে ভেসে এলো একটি নাম। চুনি সেই মুহূর্তে এসে নামটি আর সেই নামের পেছনের ছবিটি দেখে ফেললো। লাবণি ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে তড়িৎ গতিতে পাশ ফিরলেন। চুনি চোখ সরিয়ে নিলো আরো সেকেন্ড খানিক আগেই। সে নিজের কাজে মনোযোগ দেওয়ার ভান ধরেছে। লাবণি কফির কাপটা রেখে ফোন হাতে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। লাবণি চলে যেতেই চুনি দুই গালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে বলল,
“তওবা, তওবা, এই কথা তো ছোট আফারে কইতেই অইবো। এতো মজার নিউজ পাইলেই আফা আমারে অস্কার দিবো।”

দুই দিন পর সভা অনুষ্ঠিত হলো। রিজওয়ান কবিরকে নতুন মন্ত্রী হওয়ার শুভকামনা দিচ্ছে সবাই। রিজওয়ান কবির সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে দেশের উন্নতির জন্য কি করবেন, সেই বিষয়ে কিছু নীতিমালা পড়ে শোনালেন। হঠাৎ রিজওয়ান কবিরের মাইক্রোফোন কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তিনি কিছুক্ষণ পর পর মাইক্রোফোনটির উপর ঠোকা দিচ্ছেন। কিন্তু তার কথা উপস্থিত কেউই শুনতে পারছে না। রিজওয়ান কবির বিরক্ত হলেন। ব্যবস্থাপকদের মনে মনে ইচ্ছেমতো বকে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু ঠোঁটে তার সরল হাসি। তবে তার হাসিটা স্থায়ী হলো না। তাকে ভীষণভাবে ধাক্কা দিলো হুট করে মাইকে ছড়িয়ে পড়া বাক্যগুলো। রিজওয়ান কবির থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। লাবণি বসার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সভায় উপস্থিত মানুষজন একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। মাইকে ছড়িয়ে পড়ছে আহি আর রিজওয়ান কবিরের কথোপকথন। যেখানে রিজওয়ান কবির বলেছিলেন,
“তুমি যদি ইলেকশনের পর পর আমার কাছে ফিরে না আসো, তাহলে তোমার মাকে আর জীবিত দেখবে না।”

“আপনি যদি মন্ত্রী হয়েও যান, তবুও আপনাকে ভয় পাই না। আমার বিশ্বাস, আল্লাহ অসৎ মানুষদের জয়ী হতে দেয় না।”

“এতো বছর তো আমিই জয়ী হয়েছি। তোমার নানাকে সিরাজ খানের সাহায্যে গুম করিয়ে ফেলেছিলাম। জানতে চাও না, কোথায় তিনি? তোমার মাকে বলো, তার বাবার লাশটা যাতে তার বিয়ের কমিউনিটি সেন্টারের পেছনে থাকা জঙ্গল থেকে তুলে আনে। এতোদিনে হয়তো কঙ্কালটা পাওয়া যাবে।”

রিজওয়ান কবির চমকে উঠলেন। চেঁচিয়ে বললেন,
“বন্ধ করো। মাইকটা বন্ধ করো।”

লাবণি ভীত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। না জানি তিনিও কখন ফেঁসে যান। রেকর্ডিংটা আরো কিছুক্ষণ চলার আগেই মাইক বন্ধ করে দেওয়া হলো। ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে যে ছিল সে মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। রাদ আর লাবীব মিলেই তাকে বেধড়ক পিটিয়ে মাটিতে ফেলে রেখেছে। রিজওয়ান কবিরের সহচররা গিয়ে তাকে উঠালো। আর তারাই মাইকটা বন্ধ করলো।

রিজওয়ান কবির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সভার দুই পাশে চেয়ার রাখা। মাঝখানে লাল কার্পেটের রাস্তা। কার্পেটে ফুলের পাপড়ি ছিটানো। আহি দৃঢ় পা ফেলে কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে রিজওয়ান কবিরের সামনে এসে দাঁড়ালো। তার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। পেছনে সালমা ফাওজিয়া দাঁড়ানো। আহি সভার মঞ্চে উঠে উপস্থিত জনসাধারণের দিকে তাকালো। রাদ একটা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে আহিকে দিলো, আর তার হাতে একটা ছোট মাইক। অন্তত সভায় উপস্থিত মানুষদের কানে যাতে আহির বলা শব্দগুলো পৌঁছায়। আহি বলল,
“এই হলো, আপনাদের পছন্দে নির্বাচিত হওয়া দেশের রক্ষক। আদৌ কি এই লোকটা দেশের রক্ষক হতে পারে?”

রিজওয়ান কবির আহির বাহু চেপে ধরে বললেন,
“তোমাকে আজকের কাজটার জন্য অনেক কিছু দেখতে হবে।”

আহি মাইক্রোফোন রাদের হাতে দিয়ে বলল,
“আপনার মতো বোকা, আমি এই জীবনে দ্বিতীয়টা দেখি নি। আপনি অতীতে যা করেছেন, আমার সাথে, মায়ের সাথে, সব আপনার ইগো হার্ট হয়েছে বলে করেছেন। দাদার সাথে রাগ করে আপনি এতোগুলো জীবন নষ্ট করেছেন। একটা মানুষ ভালোবাসা ছাড়া থাকতে পারে না। আপনি কাউকে ভালোবাসেন না, এমন তো নয়।”

আহি লাবণির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসেন। কিন্তু যেদিন বুঝবেন, আপনার ভালোবাসা আপনাকে কতোটা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে, কতোটা হিংস্র বানিয়েছে, সেদিন নিজের ভালোবাসায় ঘৃণা জন্মাবে। আপনি আমার মাকে ঠকিয়েছেন। ঠকিয়ে অন্তত একজনকে সত্যিকার অর্থে ভালোবেসেছেন। কিন্তু যারা ঠকায়, তাদের শাস্তি ঠকেই হয়। আপনাকে আইন শাস্তি দেবে না। আপনি নিজেই নিজেকে সেই শাস্তি দেবেন।”

রিজওয়ান কবির রাদের কাছ থেকে মাইক্রোফোন ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
“এই কণ্ঠ আমার এর প্রমাণ কি? আজকাল প্রযুক্তি এতো উন্নত হয়েছে, এসব মিথ্যে ভয়েস রেকর্ডে কোনো কাজ হবে না।”

আহি মাইক্রোফোনটা বন্ধ করে দিয়ে বলল,
“যদি আমি সবাইকে সেই ভয়েসের আড়ালে থাকা ভিডিওটা দেখাই?”

রিজওয়ান কাঁপা কন্ঠে বললেন,
“তুমি ভিডিও বানিয়েছো!”

“আমাকে কি এখনো সেই ভীত-সন্ত্রস্ত আহি ভেবেই বসে আছেন? আমি আপনার কাছ থেকে এতো বড় ধাক্কা খেয়ে উঠেছি, মৃত্যুর মতো ভয়ংকর মুহূর্তকে এতোটা কাছ থেকে দেখেছি, আপনি তো তার সামনে কিছুই না। আপনার মতো শ’খানেক রিজওয়ান কবির আসুক, এখন আমাকে কেউ হারাতে পারবে না।”

রিজওয়ান কবির হনহনিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে সালমা ফাওজিয়ার মুখোমুখি হলেন। সালমা ফাওজিয়া রাগী স্বরে বললেন,
“আমার বাবার হত্যাকারীকে আমি ছাড়বো না।”

রিজওয়ান কবির তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
“একটা রেকর্ডিং, আর একটা ভিডিও আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমি এখন মন্ত্রী।”

কথাটি বলেই তিনি চলে গেলেন। এদিকে রাদ আহির পাশে এসে বলল,
“আন্টি তো কেইস করবেই।”

“হুম, কিন্তু কিছু হবে না। বাবার দুর্বলতা লাবণি মেহেরা। আগে ওটাকে শিক্ষা দিবো, তারপর বাবা আপনা-আপনি নিজের ভুল বুঝতে পারবে।”

“বাবা বলছিস?”

আহি রাদের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“এই মানুষটাই আমার কাছে একটা সময় হিরো ছিলো। খুব কম সময়ই তো হলো তার রূপ পরিবর্তন হয়েছে। আমার জীবনের আঠারো বছরে একবারো মনে হয় নি, আমার বাবা আমাকে নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছে। শেষ কয়েকটা বছর কি আঠারো বছরের ভালোবাসার কাছে হেরে যাবে? আমি সত্যিই তাকে ভালোবাসি। বাবার সাথে আমি যুদ্ধ করছি না। উনার ভেতরের নিকৃষ্ট আত্মাটার সাথে আমার যুদ্ধ। একবার সেই আত্মা মুক্তি নিক। ভালো আত্মাটা জেগে উঠুক। আমি আমার পরিবার ফিরে পাবো। বাবা, আমি আর মা।”

“আংকেল-আন্টির ডিভোর্স হয়ে গেছে, আহি।”

“আমার বাবা-মা হয়ে থাকার পরিচয়টা তো হারিয়ে যায় নি।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here