#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_৩৩+৩৪
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
মানুষটা কতদিন না জানি অনাহারে আছে! ভাবতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো বিনার। এতে ভালোবাসার সংসারে কে ঘটালো এই অঘটন? সুস্থ মানুষটা কীভাবে মানসিক ভারসাম্য হারালো? সব প্রশ্নের উত্তর ঠিক জানবে বিনা। শুধু সময়ের অপেক্ষা এখন।
সমুদ্রর কথা শুনতেই সবাই তড়িৎ গতিতে পৌঁছে বাজারে। পূর্নতার বুকের ভেতর যে কী অস্থিরতা কাজ করছে কাউকে বোঝাতে পারবে না। বিনা শুধু ইফতিকে কল দিয়ে বলেছিল সমুদ্রকে পেয়েছে। আরকিছুই বলতে পারেনি। কান্নায় গলা ধরে এসেছিল বিনার।
খাওয়াদাওয়া শেষ হয়েছে আরো কিছুক্ষণ আগেই। সমুদ্র বসে আছে বিনার মুখোমুখি। চেহারায় বড়ো বড়ো গোঁফ, দাঁড়ি। চুলগুলো পাকিয়ে একাকার অবস্থা। বিনার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে মানুষটা। অবচেতন মন ঠিকই বিনাকে জানে,চেনে। কিন্তু আদতে সমুদ্র বিনাকে চেনে না। বিষয়টা হচ্ছে ঘুমের ঘোরে চেনে অথচ জেগে থাকতে চেনে না এমনকিছু। এখন কোনো প্রশ্ন করা অনর্থক বলে বিনা কোনো প্রকার প্রশ্ন করছে না। বিশেষ করে কিছু বললে যদি উত্তেজিত হয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যায় তবে ইফতিরা এসে পাবে না সমুদ্রকে। সেজন্য একেবারে নীরবতা পালন করছে বিনা। মিনিট পাঁচেক পরে সবাই উপস্থিত হলো রেস্টুরেন্টে। সমুদ্রর মুখোমুখি ইফতি,কন্ঠ,পূর্ণতা ও শাওন। পূর্ণতা কিচ্ছু বলতে পারছে না। দু-চোখ গড়িয়ে শুধু জল ঝরছে তার। ইফতির মতো শক্তপোক্ত পুরুষের আঁখি যুগলও ছলছল আজ। কন্ঠর অবসও সেইম। ইফতি ভাইকে বুকে জড়ালো। কপালে চুমু খেলো। আদরের ছোটো ভাইয়ের এই পরিণতিতে ইফতিও ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। কী এমন হয়েছিল আঠারো বছর আগে? যার জন্য আজ পাহল হয়ে রাস্তায় আছে তার ভাই? এসব প্রশ্নের উত্তর শুধু সমুদ্রর নিকটই আছে। যতদিন সমুদ্র সুস্থ না হবে ততদিন কিছু জানা যাবে না। মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে পূর্ণতা। চোখের সামনে বাবার এমন দশা ক’জন মেয়ে সইতে পারে?
সমুদ্রকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিজেদের সাথে নিয়ে এসেছে ইফতি। মানুষটার মানসিক ভারসাম্য হারালেও শান্ত প্রকৃতির আছে। এখন পর্যন্ত উত্তেজিত হয়ে যায়নি। রিসোর্টে এসে নৈশকে বলে সমুদ্রর গেটআপের ব্যবস্থা করে ইফতি। চুল,দাঁড়ি, গোঁফ সবকিছুই নিয়মমাফিক কেটে ফেলা হলো। বিনা নিজ হাতে গোসল করিয়ে দিলো পরম যত্নে। হাতে পায়ে যে কতগুলো ছোটো ছোটো ক্ষত ছিল তার হিসাব নেই। প্রিয়তম স্বামীর এমন অবস্থা অবলোকন করে বারবার কষ্টে মূর্ছা যাচ্ছে সে। ইফতি এখনও বাসায় কিছু জানায়নি। একেবারে ভাইকে সাথে নিয়ে সারপ্রাইজ দিবে বলে ভেবেছে। আগামীকাল সকালেই ঢাকা ফিরে যাবে সবাই।
ঘড়ির কাঁটায় সময় রাত আটটা। রিসোর্টের সামনের বাগানে একা দাঁড়িয়ে আছে পূর্ণতা। মনটা আজ ভীষণ ভালো তার। বাবা তাকে চিনতে না পারলেও পেয়েছে এটাই অনেক। এতো বছর পরে যে এভাবে বাবাকে দেখতে পাবে সেটাও তো কল্পনাতীত ছিল।
” এই যে দস্যি মেয়ে! ”
পুরুষালি আওয়াজে পেছন ফিরে তাকায় পূর্ণতা। নৈশ দাঁড়িয়ে আছে, হাতে কিছু বুনো ফুল। হঠাৎ পূর্ণতার মনে পড়লো এই ফুলগুলো গতকাল আসার সময় নিয়ে আসতে চেয়েছিল সে। কিন্তু পারেনি।
” বলুন চৌধুরী সাহেব কী হাল?”
” খুব ভালো। নিশ্চয়ই তুমিও ভীষণ ভালো? ”
” অবশ্যই! তা হাতে ওসব কী?”
” দেখতেই পাচ্ছ বুনো ফুল!”
পূর্ণতা মুচকি হাসলো। নৈশ মাথা চুলকে ফের পূর্ণতার দিকে দৃষ্টিপাত করলো।
” তা এনেছেন যখন দিন। হাতে নিয়ে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন? ”
নৈশ ফুলগুলো পূর্ণতার হাতে দিলো। এরমধ্যেই নৈশের ফোনটা খামখেয়ালি ভাবে বেজে উঠলো। নৈশ কল কাটলো একবার, দুইবার। পূর্ণতা ফের বললো,
” সমস্যা এড়িয়ে গেলে সমাধান হয় না। পরে হলেও তার মুখোমুখি হতেই হবে। তাই কথা বলে নিন।”
নৈশ চমকাল পূর্ণতার কথায়। মেয়েটা কী ভেবে বললো কথাগুলো সে বুঝতে পারছে না। তবে কথা ঠিক। কতদিন এভাবে এড়িয়ে যাবে মিমিকে? সিমও পরিবর্তন সম্ভব হচ্ছে না। প্রায় দশ বছর ধরে এই সিম ব্যবহার করে নৈশ। সব দরকারি জায়গায় এই নম্বর! মিমির কতগুলো নম্বর যে ব্লক লিস্টে রেখেছে তার হিসাব নেই।
” ঠিকই বলেছো তুমি। তুমি দাঁড়াও একটু আমি কথা বলছি।”
পূর্ণতার থেকে একটু দূরে গিয়ে ফের কল রিসিভ করলো নৈশ। কল রিসিভ করতেই মিমির ব্যাকুল কন্ঠ ভেসে এলো ওপাশ থেকে।
” নৈশ প্লিজ কেটে দিও না।”
” হ্যাঁ বলো কী বলবে।”
বিরক্তি নিয়ে বললো নৈশ।
” প্লিজ নৈশ আমাকে আরেকটা বার সুযোগ দাও! একটু মনে করে দেখো আমাদের ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের কথা?”
” অসভ্য মেয়ে কোথাকার। সেসব আমাদের অতীত। এখন তোর স্বামী আছে। তাকে নিয়ে থাক। আমাকে আর যদি বিরক্ত করিস এবার তাহলে আমি তোর স্বামীকে বলতে বাধ্য হবো।”
” নৈশ! তুমি থেকে তুই তুই করে বলছো?”
” হ্যাঁ বলছি। তুই, তুই এরও যোগ্য না। ”
” প্লিজ নৈশ একবার দেখা করো।”
” কেনো? স্বামী বুঝি তোর শরীরের জ্বালা মেটাতে পারে না? না-কি মনের জটিলতার ঠাঁই পায় না? ”
নৈশ অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছে। এদিকে পূর্ণতাকে ডাকছে কন্ঠ। তাই পূর্ণতা নৈশের কিছুটা কাছাকাছি গিয়ে ডেকে বলে,” চৌধুরী সাহেব! আমি রুমে গেলাম।”
এটুকু বলেই রিসোর্টের ভেতরে গেলো সে। মিমি পূর্ণতার আওয়াজ শুনে বলে,
” ওহ নতুন সঙ্গী পেয়ে গেছো?”
নৈশের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। এই মুহুর্তে মিমিকে হার্ড করাই তার প্রধান কাজ।
” হ্যাঁ পেয়ে গেছি। এখন রাখ। রুমে যাবো।”
” খুব আদর করো তাকেও? এখন রুমে গিয়ে করবে?”
” হ্যাঁ। খাট ভাঙি প্রতিবারই। এখনও যাচ্ছি ভাঙতে। নির্লজ্জ মেয়ে মানুষ। রেহাই দে আমাকে এবার। স্বামী নিয়ে সুখে সংসার কর।”
মিমিকে আরকিছুই বলার সুযোগ দিলো না নৈশ। কল কেটে ফোন পকেটে রেখে চোখ বন্ধ করে প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো। মেয়েটা কত বছর হলো ঠকিয়েছে নৈশকে কিন্তু আজও তার উপস্থিতি এলোমেলো করে দেয় নৈশকে। মাথা ঠান্ডা করে শাওনদের কাছে যাবে বলে ঠিক করলো নৈশ। নৈশকে দেখতে যতটা ভদ্র মনে হয় আদতে তেমনটা নয়। মাথা গরম হলে মুখের লাগাম থাকে না তার। পূর্ণতাকে নিয়ে যেসব মিমির সাথে বললো সেসব যদি কোনোভাবে মেয়েটা শুনতো কী হতো ভাবতেই আনমনে হেসে উঠলো নৈশ!
বিছানায় গুটিশুটি হয়ে বসে আছে সমুদ্র। সারাক্ষণই বিরবির করে কিছু বলে যাচ্ছে। বিনা বোঝার চেষ্টা করলেও ঠিক বুঝতে পারছে না। মানুষটা সুস্থ থাকলে সেই কখন বুকে জড়াতো তাকে সেসব ভাবছে বিনা।
” তুমি জানো আমার কলিজা কই? জানো? ওহ জানো না?”
হঠাৎ সমুদ্রের প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো বিনা। কী বলছে মানুষটা?
” তোমার কলিজা তো তোমার সাথে আছে। ”
” তাহলে বুকটা এমন খালি খালি লাগে কেনো তুমি জানো?”
” আমাকে বুকে জড়িয়ে নাও। তাহলে আর খালি খালি লাগবে না। ”
বিনার কথা শেষ হওয়ার আগেই রেগে গেলো সমুদ্র। তীব্র ক্ষোভে বললো,
” খবরদার! এখানে বিনা থাকে বিনা। তোর সাহস হয় কীভাবে বুকে জড়িয়ে নিতে বলিস? আমি থাকবো না তোদের সাথে। থাকবো না। থাকবো না। ”
বিনার অনুভূতি শূন্য লাগছে। মানুষটা তার জন্য বুকে জায়গা পুষে রেখেছে অথচ তাকেই চিনতে পারে না। বিনা পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলো এবার।
” আমার ভুল হয়েছে। তোমার বিনা ঢাকা আছে। আমাদের সাথে শহরে গেলেই তুমি বিনাকে পেয়ে যাবে।”
” সত্যি পাবো?”
খুশিতে গদগদ হয়ে বললো সমুদ্র। কে বলবে তাকে দেখে একটু আগেই রেগেমেগে আগুন হয়ে গেছিল সে!
” হ্যাঁ সত্যি। বিনাকে পেতে হলে আমাদের সাথে ভদ্রভাবে যেতে হবে। যাবে না?”
” হ্যাঁ যাবো। জানো আমার বিনার কতো কষ্ট! ওর বাবা-মা নেই। ”
” তাই? ”
” হ্যাঁ। ”
” আচ্ছা সব গল্প শুনবো। কিন্তু তার আগে তো রাতের খাওয়াদাওয়া করতে হবে তাই না?”
” হু।”
” চলো খেয়ে আসি।”
” ঠিক আছে। ”
বিনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সমুদ্রকে নিয়ে খাবার খেতে গেলো। কন্ঠ শাওন আর পূর্ণতাকে আগেই খাইয়ে দিয়েছে। তাই কন্ঠ,ইফতি আর সমুদ্র, বিনা একসাথে খেলো।
ঘরের বাইরের বারান্দায় কারো হাঁটাহাঁটি শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো কন্ঠ। আজকে কন্ঠ একা একটা ঘরে শুয়েছে। সমুদ্র আসাতে বিনার ঘরে জায়গা হয়নি তার। তাই ঘুম না আসাতে সহজেই ঘর থেকে বেরোতে পারলো। নৈশ পায়চারি করছে। হাতে সিগারেট। পূর্ণতা নৈশের হাতে সিগারেট দেখে চমকাল। দিনে তো কখনো সিগারেট খেতে দেখেনি তাকে। কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেলো নৈশের দিকে। কিন্তু নৈশকে কিছু বলার আগেই পূর্ণতাকে দেখে নৈশ বললো,
” এতরাতে জেগে কেনো? সকালে তো বেরোতে হবে।”
” আপনি সিগারেট খান?”
নৈশের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পূর্ণতা পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো। নৈশ সময় নিয়ে উত্তর দিলো
” এমনিতে খাই না। তবে যখন মন ও মস্তিষ্ক অতিরিক্ত অস্থির লাগে তখন খাই। এই ধরো সপ্তাহে তিনটা!”
” হুম বুঝলাম। ”
” গুড গার্ল। যাও এখন ঘুমাও।”
নৈশ চাইছে না পূর্ণতা বেশিক্ষণ তার সামনে থাকুক। যে ছেলে বিচ্ছেদের এতগুলো বছর পরেও বিয়ে করেনি সেই ছেলের যে এই অষ্টাদশী মেয়ের প্রতি মারাত্মক ভালোলাগা সৃষ্টি হয়েছে সেটা প্রকাশ করতে চায় না নৈশ। পূর্ণতা হাসলো নীরবে। নৈশ আড়চোখে সেই হাসি দেখে ঢোক গিললো। নারীর হাসিতে পুরুষ খু*ন হয় বারবার । তবে এই খুন শরীরের না মনের।
পরের দিন সকালেই বান্দরবন থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো সমুদ্র, বিবা,কন্ঠ, ইফতিসহ সকলেই। শুধু নৈশ গেলোনা। আসার আগে নৈশের ফেইসবুক অ্যাকাউন্টের সাথে এড হয়ে নিয়েছে শাওন ও পূর্ণতা। মাত্র দু’দিনের মধ্যে নৈশের সাথে সকলের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ছেলেটা ভীষণ মিশুক প্রকৃতির। বিকেলের দিকে ঢাকায় পৌঁছল সবাই। বাসায় যেতে যেতে মাগরিবের আজান দিচ্ছে। সমুদ্রকে দেখে মায়ের রিয়াকশন কেমন হবে সেটা ভেবেই সবাই ভীষণ আনন্দিত। ইশ! এত বছর পরে মল্লিক বাড়িতে আবারও আনন্দের মুহুর্ত উপস্থিত হলো।
#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_৩৪
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
মাগরিবের নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে তসবিহ হাতে জিকির করেছেন শায়লা মল্লিক। মনটা আজ ভীষণ অস্থির লাগছে কেনো জানি। আর হৃদয়ে অস্থিরতা বিরাজ করলে বেশি বেশি জিকির করেন তিনি। জিকির করলে অন্তর শান্ত হয়। হঠাৎ এ সময় কলিংবেলের আওয়াজে মনোযোগ ক্ষুণ্ণ হলো উনার। কিন্তু এমন সময় তো কারো আসার কথা না। ইফতিরা ফিরবে আরও তিন/ চার দিন পর। তাহলে?
বসার ঘরেই বসে ছিলেন শারমিন সুলতানা। একটা বই পড়ছিলেন। অবসরে বই পড়ার স্বভাব তার। কলিংবেলের শব্দে তিনিই গেলেন দরজা খুলে দিতে।
” তোরা! আজকেই ফিরলি! সবাই ঠিক আছিস তো?”
ইফতিদের দেখে অবাক হয়ে বললেন শারমিন। কন্ঠসহ সকলেই মুচকি হাসছে। শারমিন সুলতানা চমকালেন, থমকালেন। বিনার সাথে দাঁড়িয়ে আছে চিরচেনা সেই ছেলেটা! কিন্তু! কিন্তু কীভাবে সম্ভব এটা? মাথা কাজ করছে না উনার। কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারলেন না। দরজার বাইরে গিয়ে সমুদ্রর হাত ধরলেন তিনি। সত্যি না-কি স্বপ্ন সেটাই হয়তো পরখ করে দেখলেন।
” বড়ো মা নিজেকে শান্ত করো। সমুদ্র তোমাকে চিনতে পারবে না। ভেতরে চলো। সব কথা বলবো।”
” কিন্তু ইফতি! আমার মাথা কাজ করছে না। সত্যি সমুদ্র এসেছে তো?”
শারমিনের চোখগুলো বিস্ময়ে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। ইফতির কথায় যেনো আরও বিস্মিত হলো। সমুদ্র কেনো চিনতে পারছে না?
” হ্যাঁ মা এসেছে। চলো ভেতরে চলো। মা’কে ডাকো।”
কন্ঠর কথায় সবাই বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো। ততক্ষণে শায়লা মল্লিকও বসার ঘরে উপস্থিত হয়েছেন। এই মুহুর্তটা লিখে প্রকাশ করতে পারছি না আমি। মা তার সন্তানকে আঠারো বছর পরে চোখের সামনে জীবিত দেখছে। হৃদয় থমকে গেছে শায়লার। চোখে জল টলমল করছে। সবার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে বিষয়টা সত্যি নাকি তার অবচেতন মনের মিছে ভাবনা। কিন্তু শায়লার সংশয় দূর করতে শারমিন বলে,
” সমুদ্র ফিরে এসেছে! এসব সত্যি, স্বপ্ন না।”
শায়লা মল্লিক চোখের পলকে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগলেন। সমুদ্র নির্বিকার অবশ্য। সে ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র দেখতে ভীষণ ব্যস্ত।
” বাবা এত বছর কোথায় ছিলি তুই? এই সমুদ্র মায়ের সাথে কথা বলবি না? সমুদ্র! ”
” মা ওর মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। সোজা কথায় কিছু মনে নেই। পাগলের মতো আচরণ করে মাঝে মধ্যে। ”
ইফতির কথায় বুকে ধাক্কা লাগলো শায়লা মল্লিকের। তার আদরের ছোটো ছেলের কী অবস্থা হলো! কান্নার বেগ আরো বাড়লো উনার। সমুদ্র ততক্ষণে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে। কেউ এভাবে ধরলে সমুদ্রর মোটেও ভালো লাগে না।
” এসব কীভাবে হলো ইফতি? ভালো ছেলেটা বাড়ি থেকে বেরোলো আর আজ এতো বছর পরে ফিরলো মাথা খারাপ হয়ে! ”
ইফতি মায়ের কাঁধে হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
” আমরা ভালো ডাক্তার দেখাবো সমুদ্রকে। ইনশাআল্লাহ ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যাবে আমার ভাই। ”
” হ্যাঁ দাদি। আমরা সবাই মিলে বাবাকে সুস্থ করে তুলবো।”
এতক্ষণে মুখ খুললো পূর্নতা। শায়লা পূর্ণতাকে জড়িয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন আরও।
পরের দিন শহরের নামকরা মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে সমুদ্রকে নিয়ে গেলো ইফতি। দিনের পর দিন মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের ফলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে সমুদ্র। ডাক্তার এসব বললেন। তবে আসলে কী হয়েছিল সেটা সমুদ্র সুস্থ না হলে বলা দায়। ঠিকমতো চিকিৎসা হলে অনেক আগেই মানুষটা সুস্থ হয়ে যেতো বলে জানান ডাক্তার ফারুক হাসান।
” আপাতত এই ঔষধ গুলো নিয়মিত খাবেন উনি। আর হ্যাঁ কোনো মানসিক অশান্তি যেন আর না ছুঁতে পারে উনানে।”
প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে ইফতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন ডাক্তার। সমুদ্র ইফতির পাশের চেয়ারে বসে এদিক-সেদিক তাকাতে ব্যস্ত। এমনিতে সমুদ্র ভীষণ শান্ত থাকে। তখন মাঝে মধ্যে রেগে যায়। তাই ডাক্তার বলেছে শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবে আশা করেন।
” ঠিক আছে ডক্টর। আমরা খুব সাবধানে রাখবো ওকে।”
বিনা, পূর্ণতা চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করছে। ডাক্তারের চেম্বারে এতগুলো মানুষ ঢোকা শোভনীয় নয় বলেই। চেম্বার থেকে বেরোতেই ইফতির কাছে সবকিছু শুনলো মা-মেয়ে। ডাক্তার যে সুস্থ হওয়ার আশ্বাস দিয়েছে এটুকুই অনেক।
” যাক সমুদ্র ফিরেছে। এবার সুস্থ হয়ে যাক,সংসারটা আগের মতো হাসিখুশি হয়ে যাবে। ”
জানালা বন্ধ করতে করতে বললো বিনা। জানালা বন্ধ করে রুমের লাইট নিভিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। ইফতি শুয়ে ফোন টিপছে। কন্ঠর উপস্থিতি টের পেয়ে ফোন পাশে রাখলো।
” ইনশা আল্লাহ! সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ”
কন্ঠ বালিশে মাথা রাখতেই ইফতি বালিশটা সরিয়ে নিজের হাতটা দিলো মাথার নিচে। কন্ঠ আড়চোখে তাকাল ইফতির দিকে।
” এই বয়সেও তোমার পাগলামি গেলো না গো।”
আফসোসের সুরে বললো কন্ঠ। ইফতি অন্য হাত ততক্ষণে কন্ঠর কোমরে রেখেছে। বুকের সাথে প্রিয়তমা স্ত্রীকে মিশিয়ে ফেললো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে।
” ভালোবাসার কোনো বয়স হয় না মিসেস ইফতি।”
” তা তো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।”
ইফতি মুচকি হেসে কন্ঠর খোলাচুলে নাক ডুবিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করলো কন্ঠর হৃদয় ও কায়ায়।
ফোন হাতে নিয়ে মেসেঞ্জারে একজন নির্দিষ্ট মানুষের ইনবক্সে ঢুকে বসে আছে নৈশ। ঠিক কী লিখে কনভারসেশন শুরু করবে কনফিউশানে আছে। একবার ‘হাই’ লিখলো পরক্ষণেই আবার ব্যাকস্পেস দিয়ে কেটে ‘ আসসালামু আলাইকুম ‘ লিখল। পরে কী মনে করে আবার সেটাও মুছে ফেলে শুধু ‘ পিচ্চি ‘ লিখে বসে রইলো। পূর্ণতা কি পিচ্চি ডাক শুনে রাগ করবে? যদি করে! তাহলে? এই সম্মোধনও চলবে না। সবকিছু বাদ দিয়ে এবার শুধু ‘পূর্ণ ‘ লিখেই মেসেজ লিখে পাঠাল নৈশ। পূর্ণতা জেগে ছিল। কিন্তু ফোনে হালকা সাউন্ড দিয়ে গান বাজিয়ে বালিশের পাশে রাখা ছিল। মেসেঞ্জারের টুংটাং মেসেজের আওয়াজে টনক নড়ল তার। ওদিকে নৈশ অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে। এই বুঝি রিপ্লাই আসে! হলো ঠিক তাই। এক মিনিটের মাথায় মেসেজের রিপ্লাই দিলো পূর্ণতা।
” হাই নেশা ভাই থুক্কু নৈশ ভাই। ”
পূর্ণতার দুষ্টমির কথা ভেবে অধর কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে নৈশের। সেই হাসিটুকু বজায় রেখেই পাল্টা মেসেজ করলো সে-ও।
” নেশা সহ্য করতে পারো? কখনো করেছো এসব?”
পূর্ণতা কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো নৈশের এরকম রিপ্লাই পেয়ে। কিন্তু দমবার পাত্রী সে নয়। সে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে লিখলো,
” কখনো করিনি। কিন্তু সব কাজই তো প্রথম শুরু করতেই হয়। তাই না? ”
” বেশ তাহলে চলো একদিন নেশা করি।”
পূর্ণতা থমকাল। ছেলেটাকে ভালো মনে করেছিল সে। শেষমেশ এটাও গাঁজা কিংবা মদখোর মাতাল?
” কীসের নেশা?”
” আপাতত খেজুরের রসের নেশা ধরাতে পারবো। তাছাড়া অন্য নেশার সামগ্রী আমার কাছে নেই। ”
পূর্ণতা মেসেজটার উপর ক্লিক করে হাহা রিয়াকশন দিলো। ( গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেখালাম কিন্তু, কীভাবে মেসেজে রিয়াক্ট দিতে হয়!) নৈশের ঠোঁটের কোণেও হাসি।
” আচ্ছা বুঝলাম। কেমন আছেন? এখনো বান্দরবান আছেন? ”
” আলহামদুলিল্লাহ। তুমি? হ্যাঁ আছি। কাল রাতে বাসে উঠবো।”
” হুম ভালো। ইশ সময়ের অভাবে কিছু কেনা হলো না বাজার থেকে। ব্যাপার না। পরে গেলে হবে। আর আবারও গেলে আপনাদের রিসোর্টেই যাবো।”
” অবশ্যই। রাত হয়েছে মেয়ে। এবার ঘুমাও। সামনে পরীক্ষা। ফোন কম ব্যবহার করো,তাতে তোমারই মঙ্গল। ”
নিজের দিকে একবার তাকাল পূর্ণতা। কই তাকে দেখতে তো একেবারে পিচ্চি লাগে না! তাহলে ছেলেটা সরি লোকটা হবে, লোকটা তাকে শিশুর মতো ট্রিট করে কেন? এই প্রশ্ন তো নৈশকে করাও যায় না। অগত্যা আলাপচারিতায় সমাপ্তি ঘোষণা কার জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও লিখলো,
” ঠিক আছে। শুভ রাত্রি। ”
” গুড নাইট।”
মেসেঞ্জার থেকে বেরিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে ইভাকে নক করলো ইফতি। ইভা পূর্ণতার বান্ধবী।
” কী রে ফকিন্নি ঘুমাস না কেন?”
” তুমি তো মুসাফির তাই নিজে না ঘুমিয়ে আবার আমার কাছে আসছো জিজ্ঞেস করতে। ”
কথার সাথে ক্লোজআপ হাসি মার্কা ইমোজিটা পাঠালো ইভা। পূর্ণতা হাসলো।
” কালকে ক্লাসে একটি তাড়াতাড়ি আসিস তো। কিছু নোটস বাকি ছিল না? সেগুলো নিবো”
” ওকে ভাই রাখ।”
পূর্ণতা ঠোঁট কামড়ে হাসে। তারপর আবারও মেসেজ টাইপ করলো,
” বইন আমি টেক্সটে কথা বলতেছি রাখবো কীভাবে? কলে তো না।”
অতঃপর অপরদিক থেকে কয়েকটা সেন্টি মার্কা ইমোজি দিয়ে অফলাইনে চলে গেলো ইভা। পূর্ণতাও হারালো ঘুমের দেশে সংগোপনে।
চলবে,