#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৬||
৯০।
সালমা ফাওজিয়ার হাত ধরে আহি ধীর পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতেই তাজওয়ারের মুখোমুখি হলো। তাজওয়ার ফুলের তোড়া আহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“কেমন আছো, সুইটহার্ট?”
আহির শরীর এখনো দুর্বল। কিন্তু তাজওয়ারকে দেখেই তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। আহির রাগান্বিত চোখ দু’টি দেখে তাজওয়ার হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আই প্রমিজ, আমি খুব ভালো হয়ে যাবো। ভবিষ্যতে এমন কিছুই করবো না, যেটা তোমাকে কষ্ট দেবে। তোমাকে ছুঁয়েও দেখবো না।”
রাদ আহির পাশে দাঁড়িয়ে তার এক হাত আলতো ভাবে স্পর্শ করলো। আহি রাদের স্পর্শ পেয়ে তার দিকে তাকালো। এবার তাজওয়ারের দৃষ্টি আটকালো আহি আর রাদের আবদ্ধ হাতের দিকে। তাজওয়ার রাদের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“তুমি এতো সহজে আমার ভালোবাসাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারবে না। তুমি হয়তো জানো না, আহিকে ভালোবাসা তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।”
তাজওয়ার এবার আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আর আমার কাছে না আসা, তোমার জীবনের শেষ ভুল।”
লিনাশা, পদ্ম আর পুষ্প আহিকে আড়াল করে তাজওয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালো। লিনাশা বলল,
“এখন এখানে দাঁড়িয়ে লম্বা-চাওড়া ভাষণ না দিয়ে, ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে নাও। তোমার ঠিকানা হয়তো এখন আর খান বাড়ির গ্যারেজেও হবে না।”
তাজওয়ার বাঁকা হাসলো। তাজওয়ারের হাসি দেখে পুষ্প বলল,
“এতো মুখ বাঁকিয়ে লাভ নেই। পুলিশের ঠেঙ্গানি খেলে মুখটা আর সোজা হবে না।”
তাজওয়ার এবার রাগী দৃষ্টিতে পুষ্পের দিকে তাকালো। এবার পদ্ম বলল,
“দেখুন, এখানে তামাশা করে লাভ নেই। আমরা যদি আট-দশ জন লোক জড়ো করি, আপনাকে খুঁজেও পাওয়া যাবে না।”
পদ্মের কথা শুনে লাবীব বলল,
“আট-দশ জন কেন? এই এক পিসের জন্য আমরাই যথেষ্ট।”
লাবীব কথাটি বলেই হাসলো। রাদ লাবীবের পিঠে চাপড় মেরে সামনে এগিয়ে তাজওয়ারকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“রাস্তা মাপো। আহির আশেপাশেও তুমি আর ঘেঁষতে পারবে না।”
তাজওয়ার মৃদু হাসলো। সে পিছু যেতে যেতে বলল,
“আজ না হয় পুরো ফোর্স নামিয়ে দিয়েছো, কাল কিন্তু কেউ থাকবে না। আমার মুখোমুখি তুমিই থাকবে, আহি। মনে ভীষণ ক্ষোভ জন্মেছে আমার। এই পৃথিবীতে আমি ছাড়া তোমার দ্বিতীয় কোনো প্রেমিক থাকুক, এটা তো মানা যায় না। আহি শুধু একজনের।”
(***)
সালমা ফাওজিয়া আহিকে বাসায় নিয়ে এসেছেন। রোকেয়া ফাওজিয়া আহির পাশে বসে আছেন। লিনাশা, পদ্ম আর পুষ্প ছাড়া বাকিরা চলে গেছে। তিন বান্ধবী ব্যস্ত আহিকে হাসাতে। অনেক বছর পর আয়েশ করে আড্ডা দিলো তারা। সালমা ফাওজিয়ার ঘরে উষ্ণ আমেজ ছড়িয়ে পড়লো। দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন তিনি। আহির ঠোঁটের ফাঁকে মিষ্টি হাসি দেখে তার চোখ ভিজে গেলো। এভাবেই যদি মেয়েকে আগলে রাখা যেতো!
এদিকে পদ্ম একটু পর পর আফিফের নম্বরে কল করছে। কিন্তু কল যাচ্ছে না। ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে পদ্মকে। লিনাশা পদ্মের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি রে, কি হয়েছে?”
পদ্ম বলল, “উনি যে কোথায় গেলেন!”
“আরেহ, ভাবিস না। হয়তো অফিসে গেছে।”
“আমার না ভয় করছে। উনি ওই তাজওয়ার খানের কোম্পানিতে কাজ করছেন। উনার যদি কিছু হয়ে যায়?”
“কাজ ছেড়ে দিতে বল?”
“তাজওয়ার খান নিজ থেকে উনাকে বের না করলে, আফিফকে অনেক টাকা দিতে হবে। পাঁচ বছরের চুক্তিতে ঢুকেছেন।”
“এটা তো সমস্যা? কতো টাকা লাগবে?”
“কয়েক লাখ।”
“নায়ীব থেকে ধার নিতে পারে।”
“কি যে বলিস!”
“বিপদে তো বন্ধুই বন্ধুকে সাহায্য করে। পদ্ম, আমার মনে হয় ভাইয়ার ওখানে কাজ করা উচিত হবে না।”
(***)
নিজস্ব বাংলো বাড়ির সামনে বাগানে বসে টি-টেবিলের ওপর পা তুলে চেয়ারে আয়েশ করে বসে সিগারেট ফুঁকছে তাজওয়ার। ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। এই মুহূর্তে বাংলো বাড়িতে সম্পূর্ণ একা থাকে সে। বাড়ির বাইরে প্রহরীরা ছাড়া ভেতরে তাজওয়ার একাই। সোহাগকে জরুরি কাজে পাঠিয়ে সে। আজ তার ছিমছাম গড়নের সুন্দরী রমনীর প্রেমে ডুবে যেতে হবে৷ রাগে তার মাথাটা ভো ভো করছে। আর তাজওয়ারের মাথা ঠাণ্ডা করার জন্যই রমনীর সন্ধানে বের হয়েছে সোহাগ। হঠাৎ ধোঁয়া উঠিয়ে দ্রুতগতিতে একটা মোটর সাইকেল বাংলো বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকে তাজওয়ারের বাগানে এসে তার টি-টেবিলে ধাক্কা দিলো। মোটর সাইকেলের ধাক্কা খেয়ে টেবিলটি ভেঙে কয়েক হাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়লো। আকস্মিক ঘটনায় তাজওয়ার চেয়ার থেকে মাটিতে উলটো হয়ে পড়লো। আর তার হাতটি তারই আধ-খাওয়া জ্বলন্ত সিগারেটের উপর পড়লো। হালকা আঁচ লাগায় তাজওয়ার চোখ-মুখ কুঁচকে অশ্রাব্য গালি দিয়ে পেছন ফিরে দেখলো মাথায় কালো হেলমেট, হাতে কালো গ্লাভস, পরনে কালো জ্যাকেট আর ট্রাউজার, পায়ে কালো বুটস পরে তার সামনে এক আগন্তুক দাঁড়িয়ে আছে। হেলমেট আর মোটা জ্যাকেটের কারণে মানুষটির চেহারা আর শারীরিক কাঠামো আন্দাজ করা যাচ্ছে না। তাই তাজওয়ার বুঝে উঠতে পারছে না, কে এই আগন্তুক? তাজওয়ার মাটি থেকে উঠে এদিক-ওদিক তাকাতেই খেয়াল করলো আগন্তুকটির হাতে একটা স্প্রে। তাজওয়ার তা দেখে দ্রুত পায়ে হেঁটে গেটের দিকে এগুতেই দেখলো তার প্রহরীরা সব মাটিতে পড়ে আছে। তাজওয়ার তা দেখে আগন্তুকটির দিকে তাকাতেই আগন্তুকটি তার হাতে থাকা স্প্রেটি মাটিতে ফেলে দিলো। এরপর মোটর সাইকেলের চাবি হাতে নিয়ে এক হাতে শূন্যে উঠিয়ে অন্য হাত দিয়ে তা ধরে তাজওয়ারের দিকে এগুতে লাগলো। তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কে তুমি? কি চাও?”
আগন্তুকটি তাজওয়ারের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“ডাকাতি করতে এসেছিস?”
আগন্তুকটি সাথে সাথেই তার মুষ্টিবদ্ধ হাত তাজওয়ারের নাক বরাবর বসিয়ে দিলো। তাজওয়ার নাক ধরে কয়েক পা পিছিয়ে আবার অশ্রাব্য গালি দিয়ে বলল,
“কে তুই? তোর সাহস হলো কি করে আমার গায়ে হাত তোলার? তুই জানিস আমি কে?”
আগন্তুকটি তাজওয়ারের কলার ধরে তাকে নিজের দিকে টেনে আনলো। আর ইচ্ছেমতো বুকে-পেটে ঘুষি মারতে লাগলো। তাজওয়ার ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে পড়ে যেতেই আগন্তুকটি মাটিতে পড়ে থাকা চেয়ার তুলে তাজওয়ারের গায়ে ইচ্ছেমতো আঘাত করতে লাগলো। এবারও সে ক্ষান্ত হলো না৷ তার মোটরসাইকেলটির সাথে লাগানো একটা লোহার রড হাতে নিয়ে তাজওয়ারের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। তাজওয়ার হাতজোড় করে বলল,
“তোর কি ক্ষতি করেছি আমি? যা, ঘরে যা আছে, নিয়ে যা। তোকে আমি এক্ষুনি কয়েক লাখ টাকার চেক লিখে দিচ্ছি। তুই বল কতো টাকা লাগবে?”
আগন্তুকটি নিঃশব্দে হাসলো। তাজওয়ার তার হাসির শব্দ শুনলো না। অথচ তার শরীর হেলানো দেখেই বুঝলো হেলমেট পরা আগন্তুকটি দিব্যি তার উপর হাসছে। তাজওয়ারের রাগ উঠলো ভীষণ। তবুও সে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে রইলো। সে কি করবে বুঝে উঠার আগেই লোহার রোডটি দিয়ে অনবরত তার গায়ে আঘাত করতে লাগলো আগন্তুকটি। প্রায় কয়েক মিনিট আঘাত করার পর লোহার রডটি মাটিতে ফেলে দিলো সেই আগন্তুক। এদিকে তাজওয়ার নিভু নিভু দৃষ্টিতে এখনো সেই হেলমেট পরা আগন্তুকটির দিকে তাকিয়ে আছে। আগন্তুকটি তার মোটরসাইকেলের কাছে গিয়ে চাবিটা ঘুরিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে তাজওয়ারের চারপাশে তিন-চার বার ঘুরে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলো। মোটরসাইকেলটা বের হতে দেখেই তাজওয়ার মাটিতে মাথা ফেলে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো।
(***)
মোটর সাইকেলটা শূণ্য রাস্তায় এসে থামলো। সেকেন্ড খানিক পর মোটর সাইকেল থেকে নামলো সেই আগন্তুক যে ঘন্টাখানেক আগে তাজওয়ার খানকে বেধড়ক পিটিয়েছিলো। সে একপাশে এসে একটা বোতল বের করে তার গ্লাভসের উপর ঢাললো। রক্ত বেয়ে পড়ছে সেই গ্লাভস বেয়ে। রড দিয়ে মেরে তাজওয়ারের শরীর রক্তাক্ত করে এসেছে সে। শান্তি লাগছে তার। বোতলটা দূরে ছুঁড়ে দিয়ে পরনের জ্যাকেটটা খুললো। জ্যাকেট খুলতেই ঘামে গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা সাদা শার্টটি দৃশ্যমান হলো। এবার সে মোটর সাইকেলে উঠে বসলো। জ্যাকেটটি পেছনে আটকে হেলমেটের উপরের অংশটা খুলে দিলো। এবার তার চোখ দু’টি দৃশ্যমান হলো। সেই গভীর আর শান্ত চোখ। একটু আগে তার এমন ভয়ংকর আক্রমণ দেখে বোঝার উপায় ছিল না, তাজওয়ারের উপর হামলে পড়া মানুষটি আফিফ রাফাত।
আফিফ মোটর সাইকেলে চাবি ঘুরিয়ে সামনে আগালো। গতি যতো বাড়ছে, আফিফের দৃষ্টি ততো সরু হচ্ছে। অঅনেকক্ষণ পর গাড়ি এসে থামলো একটা গ্যারেজের সামনে। তার বন্ধুর মোটর সাইকেলের শো’রুম। আফিফ বন্ধুর হাতে চাবি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“যতোদিন আমার কাজ শেষ হবে না, এই বাইকটা বের করিস না।”
“কি করবি তুই?”
“কাজ আছে।”
“পুলিশ কেস হবে না তো!”
“হতেও পারে।”
“কি বলিস এসব?”
“এবারের ন্যায়টা আমার পক্ষেই আসবে। তুই শুধু এইটুকু সাহায্য কর।”
আফিফ শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে বলল,
“আপা, এবার তোমার মৃত্যুর শোধ আমি তুলবোই। আমি তোমাকে হারিয়েছি, দ্বিতীয় বার আর কাউকে হারাতে চাই না। আহির কিছু হয়ে গেলে, আমি শান্তি পেতাম না। জানি না কেন? হয়তো কোনো এক ঋতুতে সে আমার খেয়াল হয়ে ছিল তাই। বর্তমানে আমার জীবনে তার অস্তিত্ব থাকুক না থাকুক। অন্তত যেখানেই থাকুক, যার সাথেই থাকুক, ভালো থাকুক সে। আমি তাজওয়ারের ছায়াও তার আশেপাশে আসতে দেবো না।”
চলবে-