#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৭||
৯১।
পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলেন রিজওয়ান কবির এবং মিসেস লাবণি। আহি বাইরে দাঁড়ানো ছিল। তাদের বের হতে দেখে সে সালমা ফাওজিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরলো। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের স্পর্শ পেয়ে তার দিকে ফিরে তাকালো। আহির চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আছে। বাইরে থেকে যে-কেউ দেখলে বুঝবে সে বেশ শক্ত মনের, কিন্তু আহির স্পর্শটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, সে ভেতর থেকে এখনো অনেকটাই দুর্বল। সে গতকাল সকালে এসেই বাবা, মিসেস লাবণি ও তাজওয়ারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। কিন্তু পুলিশ তাদের কাউকেই গ্রেফতার করে নি। উলটো তাদের বলে এসেছে, একবার নিজ থেকে থানায় এসে যাতে দেখা করে যায়৷ আর রিজওয়ান কবির এবং মিসেস লাবণি আজই এলেন থানায়। লাবণি থানায় আসার আগে আহিকে ফোন করে বলল, এসে তাদের মুক্তি দেখে যেতে। আহিও মাকে নিয়ে চলে এসেছে। ভেবেছে অন্তত কয়েকদিন তারা ছাড়া পাবে না। কিন্তু এক ঘন্টার জন্যও যে তাদের আবদ্ধ করা হবে না, এটাই বেশ কষ্ট দিয়েছে আহিকে। যারা বছরের পর বছর আহিকে ব্ল্যাকমেইল করে মানসিকভাবে বন্দি করে রেখেছিল, তাদের এক ঘন্টার শাস্তিও হলো না? অন্যদিকে তাজওয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তাকে ওসি সাহেব হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন ফলমূল। কাল সন্ধ্যায় তার সহচর সোহাগ এসে সেই হেলমেট পরা আগন্তুকের বিরুদ্ধে মামলা করে গেছে। সাথে প্রমাণস্বরূপ দিয়ে গেছে তাজওয়ারের বাংলো বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজের রেকর্ড। এদিকে আহি তাজওয়ারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে শুনে তাজওয়ার আহিকে ফোন করে আহত কণ্ঠে বলেছিল,
“সুইটহার্ট যদি এমন স্পাইসি কাজ করে জীবনটা একদম বেদনাদায়ক হয়ে যায়। আমার শরীরে এতো এতো আঘাত, শুধু মনটা অক্ষত ছিল। আর তুমি সেটাও ভেঙে দিলে। থাক, সমস্যা নেই। ভাঙা মনে কীভাবে মানুষকে রাখতে হয়, তা আমি জানি।”
আর আহি উত্তরে কিছু না বলেই কল কেটে দিয়েছিল।
(***)
রিজওয়ান কবির আহির সামনে এসে দাঁড়ালেন। আহি শক্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রিজওয়ান কবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সালমা ফাওজিয়ার দিকে একনজর তাকিয়ে আহিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“বাবার বিরুদ্ধে মামলা করেছো। বেশ বাড়াবাড়ি করছো মনে হচ্ছে।”
আহি বুকে হাত গুঁজে বলল,
“বাবা শব্দের অর্থ জেনে আসবেন, তারপর না হয় বাবা হওয়ার অধিকার দেখাবেন৷ আমি বাবার বিরুদ্ধে মামলা করি নি। আমি একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করেছি, যে তার ব্যবসার লাভের জন্য একটা মেয়ের সম্মানে আঘাত করেছে।”
মিসেস লাবণি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“যা করেছো, তার জন্য তোমাকে আর তোমার মাকে অনেক কিছু দেখতে হবে।”
আহি হালকা হেসে বলল,
“দেখে তো ফেলেছি। সব দেখে ফেলেছি। এবার দেখাতে হবে। তবে আপনাদের দেখাবো না। পুরো পৃথিবীকে দেখাবো। সবাইকে জানাবো, বাবা সবসময় রক্ষক হয় না। কিছু বাবা ভক্ষকও হয়। সব বাবা আগলে রাখতে জানে না, কিছু বাবা ধ্বংস করে দিতে জানে। সতর্ক করতে হবে সবাইকে। হিংস্র মানুষদের আসল চেহারা সবাইকে দেখাতে হবে।”
লাবণি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তা, কীভাবে দেখাবে শুনি? কী প্রমাণ আছে তোমার কাছে?”
আহি মাথা নিচু করে বলল, “প্রমাণ পেয়ে যাবো।”
লাবণি রিজওয়ান কবিরের হাত টেনে ধরে বলল,
“বাসায় চলো। তোমার মেয়েকে কিছুদিন মুক্তির স্বাদ পেতে দাও। বন্দি থাকতে থাকতে মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। না আছে কোনো প্রমাণ, আসছে আমাদের ধমকাতে।”
লাবণি রিজওয়ান কবিরকে নিয়ে সামনে পা বাড়াতে গিয়েই থেমে গেলো। সে পেছন ফিরে আহিকে বলল,
“আহি, ফিরে তো তোমাকে আসতেই হবে। আর এবার ফিরে এলে, পেছনে কাউকে জীবিত দেখবে না। তোমার তিন বান্ধবী, তোমার প্রাণের দুই বন্ধু, তাদের পুরো পরিবার আর তোমার মা ও তার পরিবার, না জানি কার কার কাফনের কাপড় কিনতে হয়৷ এক কাজ করো, আজ থেকেই কেনাকাটা শুরু করে দাও। আর কুলখানির আয়োজন তো হবেই। আমরা না হয় তোমার হয়ে দান করে দেবো।”
কথাটি বলেই তারা গাড়ি নিয়ে চলে গেলো। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের হাত ধরে বললেন,
“প্রমাণ কোথায় পাবি?”
আহি মায়ের হাতে আলতো হাত রেখে মুচকি হেসে বলল,
“প্রমাণ তো আমার কাছে আছেই। কিন্তু আমি এতো সহজে সেই প্রমাণ সবার সামনে আনবো না। অনেক বছর তারা আমাকে মানসিকভাবে কষ্ট দিয়েছে। আমি তাদের তিলে তিলে কষ্ট দেবো। রিজওয়ান কবিরের কাছে তার রেপুটেশন, বিজনেস, ইগো, আমার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি তার রেপুটেশন, বিজনেস ইগো, সবকিছুই ধ্বংস করে দেবো। মিসেস লাবণি সম্পর্কে আমি যা জেনেছি, একবার যদি সেটা সবার সামনে আনতে পারি, আমার কষ্টগুলো মুক্তি পাবে। আমি তো নিজেকে মুক্ত করে নেবোই। কিন্তু কয়েক বছর পর আমি আর শান্তি পাবো না। তাই আমার নিজের কষ্টগুলোকেও মুক্ত করতে হবে। তারপর আমি শান্তিতে বাঁচতে পারবো।”
(***)
তাজওয়ার কয়েক বার সিসিটিভি ফুটেজের রেকর্ড দেখে ফেলেছে। সে কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না তাকে মারার সাহস কারো থাকতে পারে। সোহাগ তাজওয়ারকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বলল,
“স্যার, আপনার কাকে সন্দেহ হচ্ছে?”
তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আহির সাথে জড়িত কেউ এই কাজ করেছে।”
“রাদ?”
তাজওয়ার কিছু একটা ভেবে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“হুমম, রাদ। আমার বাংলো বাড়ি সম্পর্কে আহি ছাড়া আর কেউই জানে না। আহি রাদকে এই ইনফরমেশন দিয়েছে, আর রাদই এই কাজ করেছে।”
“স্যার, আপনি অনুমতি দিলে তাকে এক্ষুনি ধরে নিয়ে আসছি।”
তাজওয়ার ফুটেজটা আবার দেখে বলল,
“না, না, না। রাদ হবে না। এই ছেলে রাদ নয়। রাদ অনেকবার আমার সামনে দাঁড়িয়েছে। হেলমেট পরা এই ছেলেটা আমার সমান৷ আর রাদের হাইট আমার চেয়ে বেশি। হাইট জুতো পরে বাড়ানো যায়, কিন্তু কমানো যায় না। এই ছেলে রাদ হবেই না।”
“তাহলে কে?”
“আহির বন্ধু, কি যেন নাম?”
“লাবীব?”
“হ্যাঁ, লাবীব। ছেলেটার বাইকও আছে। বেশ ভালোই বাইক চালায়।”
“স্যার, আফিফও তো হতে পারে!”
তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে সোহাগের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওর কথা আমার মাথায়ও আসে নি। ও এমন কাজ করতে পারবে? ওর কি সেই সাহস আছে?”
“আপনার বাংলো বাড়ি সম্পর্কে মিস আহির চেয়ে আফিফেরই ভালো জানার কথা। এখন তো সে আপনার এসিস্ট্যান্ট হিসেবেই কাজ করছে।”
তাজওয়ার চুপ করে রইলো। সোহাগ তাজওয়ারকে চুপচাপ দেখে বলল,
“কি ভাবছেন, স্যার?”
“আফিফকে আমি বোকা ভেবেছি। এখন ভাবছি, এই বোকাটা যদি সত্যিই চালাক হয়ে থাকে, তবে আমি ওকে আমার এসিস্ট্যান্ট বানিয়ে চরম ভুল করেছি। কারণ ওর কাছে আমার সেভেন্টি ফাইভ পারসেন্ট ইনফরমেশন থাকার কথা। ও আমাকে যে-কোনো মুহূর্তে ফাঁসাতে পারে।”
“স্যার, চিন্তা করবেন না। আফিফ এই কাজ নাও করতে পারে। আমি তো শুধু ওর নামটা জানালাম আপনাকে। আপনি এর আগে ওর আপার সাথে যা করেছেন, তারপর তো সে কিছুই করে নি।”
“করে নি কারণ রেনুকে নিয়াজীর সাথে বিয়ে দিয়ে আমি ওকে হাতে রেখেছিলাম।”
“তাহলে এখনো তো সে হাতেই আছে।”
তাজওয়ার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“নেই। মনে হচ্ছে নেই। আহি হুট করে নিয়াজীর বাড়িতে গিয়ে যেই কাজ করলো, এরপর নিয়াজী রেনুকে এখন আর কিছুই করবে না।”
“স্যার, আপনি ওকে মেরেছেন তাই কিছু করবে না। নিয়াজীকে বলে দিন, রেনুকে যাতে হাতছাড়া না করে। রেনু নিয়াজীর সাথে আটকে থাকলে আফিফ শান্ত থাকবে।”
“আর আফিফ দুর্বল থাকলে, আহি নেতিয়ে পড়বে।”
“হ্যাঁ, স্যার। মিস আহি অন্য কোনো ব্যাপারে ভয় পাক না পাক, আফিফের ব্যাপারে বেশ নরম।”
“ভালোবাসা। একেই তো বলে শুদ্ধ ভালোবাসা। এদের ভালোবাসা আমি কোনোভাবেই থামাতে পারি নি। আফিফকে আমি এতো কষ্ট দিয়েছি, কিন্তু সে আহিকে ঘৃণায় করতে পারলো না। আর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছি, আফিফ নিজেই পদ্মকে বিয়ে করে নিয়েছে।”
“মিস আহি এখনো সত্যটা জানে না।”
“আফিফ নিজেও এই সত্যটা জানে না। সবটাই তো আমার প্ল্যান ছিল।”
“কিন্তু আফিফ এখন পদ্মকে ভালোবাসে। সে কি আহির জন্য এমন কিছু করতে পারে, যা তার পরিবারের জন্য ক্ষতিকর?”
“আরেহ এটা মায়া। এটা সেই ভালোবাসা না, যেটা আফিফের মনে এখনো গেঁথে আছে। আফিফ পদ্মকে ভালোবাসে, তবে সেটা তার স্ত্রী হিসেবে। তার দায়িত্ব হিসেবে। প্রেমিকা আর স্ত্রীর মধ্যে এটাই তো পার্থক্য। আর আহির প্রতি আফিফের অনুভূতি যদি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, আমি কোনোভাবেই আহিকে নিজের করে নিতে পারবো না। আর আমার আহিকে চাই-ই চাই।”
“মিস আহির হয়তো আফিফের বোনের ব্যাপারে জানা উচিত। সত্যটা জানলে, সে আরো দুর্বল হয়ে পড়বে।”
তাজওয়ার ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, এই সত্য আহি জানলে পদ্মকে বিয়ে করার কারণটাও সে জেনে যাবে। আমার সুইটহার্ট অসম্ভব চালাক। দেখায় একদম শান্ত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বেশ ধূর্ত। ওতো আমাকে ফাঁসানোর সব প্ল্যান করে ফেলেছে। এখন শুধু সেই প্ল্যানগুলো আমার জানতে হবে।”
৯২।
আহির মুখের সামনে একটা চিপস ধরলো রাদ। আহি রাদের দিকে ফিরতেই রাদ আহির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আহিও হালকা হেসে আবার মুখটা গম্ভীর করে ফেললো। রাদ তা দেখে বলল,
“সবসময় মুখটা এমন পেঁচার মতো করে রাখিস কেন? এখন তো হাসতে পারিস। আন্টির সাথে আছিস, আমি আছি তোর পাশে। এখন কিসের কষ্ট?”
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এখনো অনেক কিছু করা বাকি। ভাবছি, শুরুটা কীভাবে করবো?”
“পরে ভাবিস। আগে খা।”
“তুই একটু বেশিই যত্ন নিচ্ছিস আমার!”
“আগে বন্ধু ছিলি, এখন প্রেমিকা। আর প্রেমিকাদের একটু বেশিই যত্ন নিতে হয়।”
আহি রাদের চোখের দিকে তাকালো। রাদের বাড়ন্ত অনুভূতিটা অনুভব করে খুশি হবে না-কি কষ্ট পাবে, সেটা বুঝতে পারছে না আহি। এভাবেই তো প্রিয় মানুষকে ভালোবাসতে হয়। আহি যেভাবে আফিফকে ভালোবেসেছিল, রাদ ঠিক সেভাবেই আহিকে ভালোবাসতে চায়ছে। আহি জানে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলা কতোটা কষ্টের৷ আহি রাদকে সেই কষ্ট দিতে পারবে না। অথচ তার মনে রাদের প্রতি ভালোবাসাটা শুধুই বন্ধুর মতো। আহির দম বন্ধ হয়ে আসছে। সারাজীবন বাস্তবতার সাথে কম্প্রোমাইজ করে গেছে সে৷ তাজওয়ারকে বিয়ে করার জন্য সম্মতি দেওয়া, মায়ের সাথে থাকতে চেয়েও থাকতে না পারা, আবার এখন রাদকে প্রেমিক হিসেবে মেনে নেওয়া। আর কতো কম্প্রোমাইজ করবে সে? রাদকে কষ্ট দিতে চায় না আহি। আর তাই রাদের অনুভূতিটা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না তার। এই মানুষটাই তো নিঃস্বার্থভাবে তাকে ভালোবেসেছে। তার জন্য কি আহি এতোটুকু করতে পারবে না? এসব ভাবতে ভাবতেই আহির চোখ ভিজে উঠলো। রাদ আহির চোখে পানি দেখে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“কাঁদছিস কেন তুই?”
আহি রাদকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার মনটা শান্ত হচ্ছে না, রাদ। আমি কোথায় একটু শান্তি পাবো, বলবি?”
রাদ আহিকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমি আছি, তাও ভালো লাগছে না?”
আহি এবার রাদকে ছেড়ে দিয়ে তার দিকে তাকালো। আহির গভীর চোখ দু’টি উপচে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। রাদ সেই চোখ দু’টি আলতোভাবে মুছে দিয়ে বলল,
“আমি তোর পাশে আছি। পাশে থাকবো।”
আহি মলিন হাসলো। রাদের হাত ধরে বলল,
“খুব ভালোবাসিস আমাকে?”
“হ্যাঁ, খুব।”
আবার আহির অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। রাদ আবারও সেই চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“কাঁদছিস কেন, বল? আমার ভালোবাসা কি তোকে কষ্ট দিচ্ছে, আহি?”
আহি ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“না না, কি বলছিস? আমার তো ভালো লাগছে। ভালো লাগলেও কিন্তু মানুষ কাঁদতে পারে।”
“হ্যাঁ, তুই পারিস হয়তো৷ তোর অশ্রু গ্রন্থিতে অশ্রু একটু বেশিই।”
আহি মনে মনে বলল,
“হ্যাঁ রাদ, আমার চোখে একটু বেশিই অশ্রু। হাসতে চাই, কিন্তু এই অশ্রুগুলো হাসতে দেয় না। আর এবার হয়তো তোকে ভালোবাসতে না পারাটাই আমার অশ্রু হয়ে বের হচ্ছে। তোকে তোর মতো করে ভালোবাসতে পারবো না আমি। তোর সাথে অন্যায় করে ফেলছি হয়তো। কিন্তু তোকে আমি সত্যটা জানালে তুই আরো কষ্ট পাবি। তার চেয়ে ভালো, আমিই কষ্ট পাই৷ কষ্ট সহ্য করার অনেক ক্ষমতা দিয়েই আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন। শুধু শুধু অন্যকে সেই কষ্টের ভাগ কেন দেবো আমি? তোর ভালোবাসা পাওয়া যে-কোনো মেয়ের জন্যই সৌভাগ্যের ব্যাপার। আর দেখ, আমি কতো সৌভাগ্যবতী। অথচ আমি সুখে নেই। আমি কোনো শান্তি খুঁজে পাচ্ছি না। নিজের মতো করে বাঁচতেও পারছি না।”
(***)
পদ্ম থমথমে মুখে বসে আছে। আফিফ দু’কাপ চা বানিয়ে ঘরে ঢুকে পদ্মকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বলল,
“কি হলো? মন খারাপ না-কি?”
পদ্ম আফিফের দিকে তাকালো। পদ্মের চোখ চিকচিক করছে। আফিফ তা দেখে চায়ের কাপ টেবিলের উপর রেখে পদ্মের পাশে বসে বলল,
“কাঁদছো কেন? মা কিছু বলেছে?”
পদ্ম মাথা নেড়ে বলল, “না।”
“তাহলে মন খারাপের কারণ!”
পদ্ম শান্ত দৃষ্টিতে আফিফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি, আফিফ।”
আফিফ পদ্মের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“জানি, তো। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো।”
“আমি আহিকেও খুব ভালোবাসি।”
“জানি আমি। তুমি সবাইকে খুব বেশিই ভালোবাসো। তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে। আমার পদ্মফুল তুমি।”
“মোটেও না। আমি ভালো না, আফিফ। আমি অনেক খারাপ। আমি অনেক খারাপ।”
“কি বলছো তুমি?”
“জানি না, কিচ্ছু জানি না আমি। আমার কষ্ট হচ্ছে খুব৷ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আহি সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে, এটা যতোবার মনে পড়ছে, আমারই মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”
“পদ্ম, এখন আহি ঠিক আছে।”
“আমিই হয়তো এসবের জন্য দায়ী।”
“কি যা তা বলছো? তুমি কেন দায়ী হবে?”
পদ্ম আফিফের চোখের দিকে তাকালো। নিজেকে শান্ত করে আফিফের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে বসলো। একনজর সামনের দেয়ালে থাকা ছবিটির দিকে তাকালো। বেশ কিছুক্ষণ সেই ছবিটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“আমি আহিকে বাসায় রেখে দিলে, ওর সাথে ওমন ঘটনা ঘটতো না।”
আফিফ পদ্মের গা ঘেঁষে বসে বলল,
“এখানে তোমার কোনো দোষ নেই। যার অপরাধ, সে শাস্তি পাবেই। এখন চা খাও। আমি তোমার জন্য নিজ হাতে চা বানিয়েছি।”
পদ্ম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আবার সেই ছবিটির দিকে তাকালো। এরপর আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার মতো মানুষকে নিজের করে পাওয়াটা আমার ভাগ্যে ছিল না। আমি হয়তো কারো ভাগ্য চুরি করেছি।”
আফিফ থমকে গেলো। চায়ের কাপ হাত থেকে রেখে পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার এমনটা কেন মনে হচ্ছে?”
“এমনিতেই।”
আফিফ চুপসে গেলো। পদ্ম কি কোনো ভাবে সত্যটা জেনে গেছে? এমন মুহূর্তে সত্যটা জানলে যে আহির জীবনে ঝামেলা সৃষ্টি হবে! আহি তার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছে। রাদ যেহেতু আহিকে ভালোবাসে, অন্তত তাদের এক হওয়ায় কোনো বাঁধা দিতে চায় না আফিফ। রাদের সাথে ভালো থাকুক আহি। এটাই চায় সে। কিন্তু পদ্ম যদি অতীতটা জেনে যায়, তাহলে আবার ঝামেলা হবে। আফিফকে এ ব্যাপারে আরো সতর্ক হতে হবে।
(***)
সোহাগ লাবীব আর আফিফের মোটরসাইকেলের সম্পূর্ণ তথ্য বের করে তাজওয়ারের সামনে রাখলো। তাজওয়ারকে যে মোটরসাইকেল আরোহী মারতে এসেছিল, তার মোটর সাইকেলের সাথে লাবীব আর আফিফের মোটর সাইকেলের কোনো মিল নেই। লাবীবের মোটর সাইকেল মোটামুটি দামী। আর আফিফেরটা অনেক পুরোনো মডেলের। আর যেই আগন্তুক তাকে মেরেছে, তার মোটরসাইকেলটা অনেক বেশি দামী। যেই মোটর সাইকেল কেনা আফিফের সামর্থের বাইরে। তবে লাবীব চাইলে কিনতে পারে। তাজওয়ার সব দেখে অনেক ভেবে বলল,
“আহির টিম আমাকে কনফিউজড করে দিচ্ছে। এখনো আফিফ আর লাবীবের মধ্যেই আটকে আছি আমি। আফিফের এই বাইক কেনার কোনো সামর্থ নেই। আর লাবীবের জন্য এই বাইক কেনা একটা স্বপ্ন পূরণ করা। আর এতো দামী বাইক নিয়ে লাবীব অন্তত আমাকে মারতে আসবে না। ও নিজের বাইককে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। মনে হচ্ছে, এই কাজ আফিফই করেছে। আর যদি এটা তার কাজ হয়, তাহলে নিশ্চিত সে এই বাইক কারো কাছ থেকে ধার নিয়েছে। আফিফের বন্ধুদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে, যার বাইকের শো’রুম আছে? বা এমন কোথাও কাজ করে?”
সোহাগ বলল,
“স্যার, দু’একদিন সময় দিতে হবে৷ আমি সব ইনফরমেশন বের করে আপনাকে জানাচ্ছি।”
তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“এই কাজ যদি আফিফের হয়, তাহলে মিস্টার আফিফ রাফাতের কপালে তো দুঃখ নেই৷ তবে অন্য কারো কপালে দুঃখ ঠিকই আছে৷ এবার উলটো পথ ধরবো। আহির জীবনের সুতোটা এমনভাবে ঘুরিয়ে দেবো। আহি সেই সুতোর জট খুলতে আমার কাছেই আসবে।”
(***)
উজ্জ্বলের সামনে এসে দাঁড়ালো কালো হেলমেট পরা এক পুরুষ। উজ্জ্বল তাকে দেখেই বলল,
“আপনি কে? আমাকে এখানে কেন আসতে বলেছেন?”
হেলমেট পরা যুবকটি কিছু ফাইল উজ্জ্বলের দিকে এগিয়ে দিয়ে কোনো উত্তর না দিয়েই মোটরসাইকেলে উঠে চলে গেলো। উজ্জ্বল অবাক হয়ে আগন্তুকটির যাওয়া দেখছে। সে এবার নিজের গাড়িতে উঠে ফাইলটা খুলে দেখলো সেখানে লেখা,
তাজওয়ারের অর্থপাচারের সব রেকর্ড এই ফাইলে আছে। আমি আহির শুভাকাঙ্ক্ষী। আপনি আহির পক্ষে কেইস নিয়েছেন, তাই আপনাকে এই তথ্যগুলো দেওয়া যুক্তিযুক্ত মনে হলো।
উজ্জ্বল ফাইলের ভেতরে থাকা সব তথ্য দেখে সাথে সাথেই আহিকে ফোন করলো। আহি কল রিসিভ করতেই উজ্জ্বল বলল,
“প্ল্যান ডি এক্সিকিউট করতে হবে।”
আহি সেই মুহূর্তে সালমা ফাওজিয়ার কোলে শুয়ে ছিল। সে উজ্জ্বলের কথা শুনে মাথা তুলে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“মানে? কিছু হয়েছে?”
“অনেক বড় কিছু হয়েছে। তুমি শুধু শুরু করো। আমি যা পেয়েছি, তা দিয়ে অন্তত চার বছর কাভার হবে। বেশি হলে দশ বছর। পুরো জীবন কাভার করার জন্য প্ল্যান ডি এর পাশাপাশি প্ল্যান সিতে মনোযোগ দিতে হবে। একসাথে দু’টো হলে, আমাদের বেশি সময় লাগবে না।”
চলবে-